একাধিক লেখক
মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন সম্পাদিত
(পৃ. ১০১-১০৩)

মুর্শিদাবাদ জিলার মেয়েলী গান

 মেয়েলী গানগুলির মধ্যে একটা সরস ও কোমল প্রাণের অভিব্যক্তি পাওয়া যায়। এই গানগুলি অত্যন্ত অনাড়ম্বর ও ইহার সহজ সুরে আমাদের হৃদয় অধিকার করিয়া ফেলে। সত্যই এই গানগুলির মধ্যে বাংলার মেয়েদের প্রাণের সুন্দর পরিচয় পাওয়া যায়। কে এই গানগুলি রচনা করিয়াছেন তাহা এক্ষণে জ্ঞাত হওয়া সম্ভবপর নহে, তবুও এই গানগুলি কবিত্ব রস-ধারায় অভিষিক্ত।

 এই সঙ্গে তিনটী গান প্রকাশিত হইল। এই গানগুলি মুরশিদাবাদ জিলার মেয়েরা গাহিয়া থাকেন। শুনিয়াছি কাজে মশগুল রহিয়াছেন, আর গুণ গুণ করিয়া ইহার দুই চারি ছত্র গান করিতেছেন।

 এই গানগুলির বিষয় অতি সাধারণ, ইহাতে কোন বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য নাই। প্রথম গানটী বেহুলাকে লইয়া রচিতঃ বেহুলা কে তাহা আমাদের জানিবার প্রয়োজন করে না। বড় ভাই ছোট বোন বেহুলাকে খেলাইতে যাইতে নিষেধ করিতেছেন, কিন্তু তৎসত্ত্বেও বেহুলা খেলাইবার সাজসরঞ্জাম লইয়া বাহির হইল, মাটির ঘল তৈয়ারী করিল। এমন সময় নাপিত (= লাপিত) আসিয়া অনর্থক তাহার ধুলার ঘর ভাঙ্গিয়া দিল এবং তাহাকে কোলে তুলিয়া লইল। সে আশ্বাস দিয়া বলিল,

“কাদার চুকার বদলে বেহুলা সোণার চুকা দিল হে,
ধুলার ঘরের বদলে বেহুলা দালান কোঠা দিব হে।”

বোধ হয় সুন্দরী বেহুলার ঘটকের কাজ করিয়া লোভী ঘটক কিছু লাভ করিবার আশায় এই আত্মীয়তা দেখাইতেছে।

 দ্বিতীয় গানটীর মর্ম্ম অতি চমৎকার। ভাই ডোলা (=পাল্কী) সাজাইতেছে, কিন্তু কোন কিছুতেই যাইতে রাজী নহে। আমগাছ কাটিয়া ডোলা সাজাইল, জাম গাছ কাটিয়া ডোলা সাজাইল, তবু সে যাইবে না। ভাই নিরুপায় হইয়া তাহাকে নানাবিধ অলঙ্কারের প্রলোভন দেখাইল, কিন্তু তাহাতেও তাহার মন টলিল না। সে সমস্ত অলঙ্কারগুলি তাহার ভাবীসাহেবাকে দিতে বলিল। গানটীর মধ্যে অতি কচি মনের একটা বিফল প্রয়াসের করুণ ছবি পাওয়া যায়। ইহার ধুয়া, “ভায়া না যাব ডোলাতে” অতি নিবিড় ভাবে আমাদিগকে বেদনাহত করে। রবীন্দ্রনাথের “যেতে নাহি দিব” কবিতাটীর মধ্যে যে করুণ চিত্র উজ্জ্বলভাবে ধরা পড়িয়াছে, ইহার মধ্যে তেমনি একটা সজল আঁখিপল্লবের চিত্র রহিয়াছে। কিন্তু সে যাবনা বলা সত্ত্বেও যে তাহাকে যাহতে হইয়াছিল তাহা ধ্রুব সত্য।

 তৃতীয় গানটীতে একটু রসিকতা করিবার ইচ্ছা নিশ্চয়ই রচয়িতার মনে ছিল। নতুবা তিনি দুর্ল্লভের দামাদকে রাজপথ দিয়া লইয়া আসিয়া নানাবিধ সুপেয় খাদ্য সামগ্রীর ব্যবস্থা করিলেন, অথচ দামাদের পিতার আগমনের পথ যেমন অপথ, তাঁহার বসিবার আসন যেমন অযোগ্য, তেমনি তাঁহার খাদ্য সামগ্রী অনাহার্য্য। গ্রামে যে এখন বৈবাহিককে লইয়া ঈদৃশ্য রসিকতার অভাব নাই তাহা বলা বাহুল্য।

 এই গানগুলি সম্বন্ধে অধিক বলা নিম্প্রয়োজন। পাঠক নিজেই ইহার রস-ভোক্তা হউন।