হাস্য-কৌতুক (১৯১৪)/চিন্তাশীল
চিন্তাশীল
(হেঁয়ালি নাট্য)
প্রথম দৃশ্য
(চিন্তাশীল নরহরি চিন্তায় নিমগ্ন। ভাত শুকাইতেছে। মা মাছি তাড়াইতেছেন।)
মা। অত ভেবােনা মাথার ব্যাম হবে বাছা!
নর। আচ্ছা, মা, “বাছা”শব্দের ধাতু কি বল দেখি!
মা। কি জানি বাপু!
নর। “বৎস।” আজ তুমি বল্চ “বাছা”—দুহাজার বৎসর আগে বল্ত বৎস—এই কথাটা বড় সামান্য নয়। একথা যতই ভাব্বে ততই ভাবনার শেষ হবে না।
(পুনরায় চিন্তায় মগ্ন)
মা। যে ভাবনা শেষ হয় না এমন ভাবনার দরকার কি বাপ! ভাবনা ত তাের চিরকাল থাকে্বে, ভাত যে শুকোয়। লক্ষ্মী আমার একবার ওঠ।
নর। (চমকিয়া) কি বল্লে মা? লক্ষ্মী? কি আশ্চর্য! এককালে। লক্ষ্মী বল্তে দেবী-বিশেষকে বােঝাত। পরে লক্ষ্মীর গুণ অনুসারে সুশীলা স্ত্রীলােককেও লক্ষ্মী বল্ত, কালক্রমে দেখ পুরুষের প্রতিও লক্ষ্মী শব্দের প্রয়ােগ হচ্ছে। একবার ভেবে দেখ মা, আস্তে আস্তে ভাষার কেমন পরিবর্তন হয়! ভাবলে আশ্চর্য হতে হবে।
(ভাবনায় দ্বিতীয় ডুব)
নর। এ কথাটা বড় গুরুতর মা! আমি হঠাৎ এর উত্তর দিতে পারব না। এটা কিছুদিন ভাবতে হবে—ভেবে পরে বল্ব।
মা। আমি যে কথাই বলি তাের ভাবনা তা'তে কেবল বেড়েই ওঠে কিছুতেই আর কমে না। কাজ নেই বাপু, আমি আর কাউকে পাঠিয়ে দিই।
মাসি
মাসি। ছি নরু, তুই কি পাগল হলি? ছেঁড়া চাদর, একমুখ দাড়ি—সমুখে ভাত নিয়ে ভাবনা! সুবলের মা তােকে দেখে হেসেই কুরুক্ষেত্র!
নর। কুরুক্ষেত্র! আমাদের আর্যগৌরবের শ্মশানক্ষেত্র! মনে পড়্লে কি শরীর লােমাঞ্চিত হয় না! অন্তঃকরণ অধীর হয়ে ওঠে না! আহা কতকথা মনে পড়ে! কত ভাবনাই জেগে ওঠে! বল কি মাসি! হেসেই কুরুক্ষেত্র! তার চেয়ে বল না কেন কেঁদেই কুরুক্ষেত্র।
দিদিমা
দিদিমা। ও নরু, সূর্য্য যে অস্ত যায়!
নর। ছি দিদিমা সূর্য্য ত অস্ত যায় না। পৃথিবীই উল্টে যায়। রােস আমি তােমাকে বুঝিয়ে দিচ্চি। (চারিদিকে চাহিয়া) একটা গােল জিনিষ কোথাও নেই?
দিদিমা। এই তোমার মাথা আছে—মুণ্ডু আছে।
নর। কিন্ত মাথা যে বদ্ধ, মাথা যে ঘোরে না।
দিদিমা। তোমারই ঘোরে না, তোমার রকম দেখে পাড়াসুদ্ধ লোকের মাথা ঘুর্চে! নাও, আর তোমায় বোঝাতে হবে না, এ দিকে, ভাত জুড়িয়ে গেল; মাছি ভন্ ভন্ করচে।
নর। ছি দিদিমা, এটা যে তুমি উল্টো কথা বল্লে; মাছি ত ভন্ ভন্ করে না! মাছির ডানা থেকেই এই রকম শব্দ হয়। রোস, আমি তোমাকে প্রমাণ করে দিচ্চি―
দিদিমা। কাজ নেই তোমার প্রমাণ করে।
দ্বিতীয় দৃশ্য
(নরহরি চিন্তামগ্ন। ভাবনা ভাঙাইবার উদ্দেশে নরহরির শিশু ভাগিনেয়কে কোলে করিয়া মাতার প্রবেশ)
মা। (শিশুর প্রতি) যাদু, তোমার মামাকে দণ্ডবৎ কর।
নরহরি। ছি মা, ওকে ভুল শিখিও না। একটু ভেবে দেখ্ লেই বুঝতে পারবে, ব্যাকরণ অনুসারে দণ্ডবৎ করা হতেই পারে না―দণ্ডবৎ হওয়া বলে! কেন বুঝ্তে পেরেচ মা? কেন না দণ্ডবৎ মানে―
মা। না বাবা, আমাকে পরে বুঝিয়ে দিলেই হবে। তোমার ভাগ্নেকে এখন একটু আদর কর।
নর। আদর কর্ব? আচ্ছা এস আদর করি। (শিশুকে কোলে লইয়া) কি ক’রে আদর আরম্ভ করি? রোস এক্টু ভাবি।
মা। আদর কর্বি, তাতেও ভাব্তে হবে নরু?
নর। ভাব্তে হবে না মা? বল কি? ছেলেবেলাকার আদরের উপরে ছেলের সমস্ত ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তা কি জান? ছেলেবেলাকার এক একটা সামান্য ঘটনার ছায়া বৃহৎ আকার ধরে আমাদের সমস্ত যৌবনকালকে আমাদের সমস্ত জীবনকে আচ্ছন্ন করে রাখে এটা যখন ভেবে দেখা যায়—তখন কি ছেলেকে আদর করা একটা সামান্য কাজ বলে মনে করা যায়! এইটে একবার ভেবে দেখ দেখি মা।
মা। থাক্ বাবা, সে কথা আরেক্টু পরে ভাব্ব, এখন তোমার ভাইটির সঙ্গে দুটো কথা কও দেখি!
নর। ওদের সঙ্গে এমন কথা কওয়া উচিত যাতে ওদের আমোদ এবং শিক্ষা দুই হয়। আচ্ছা, হরিদাস, তোমার নামের সমাস কি বল দেখি!
হরি। আমি চমা কাব৷
মা। দেখ দেখি বাছা, ওকে এসব কথা জিগেস কর কেন? ও কি জানে!
নর। না, ওকে এইবেলা থেকে এই রকম করে অল্পে অল্পে মুখস্থ করিয়ে দেব।
মা। (ছেলে তুলিয়া লইয়া) না বাবা, কাজ নেই তোমার আদর করে।
মা। (কাতর হইয়া) বাবা, আমাকে কাশী পাঠিয়ে দে, আমি কাশীবাসী হব।
নর। তা যাও না মা, তোমার ইচ্ছে হয়েছে, আমি বাধা দেব না!
মা। (স্বগত) নরু আমার সকল কথাতেই ভেবে অস্থির হয়ে পড়ে এটাতে বড় বেশী ভাব্তে হল না! (প্রকাশ্যে) তাহলে ত আমাকে মাসে মাসে কিছু টাকার বন্দোবস্ত করে দিতে হবে।
নর। সত্যি না কি, তা হলে আমাকে আর কিছু দিন ধরে ভাব্তে হবে। একথা নিতান্ত সহজ নয়। আমি এক হপ্তা ভেবে পরে বল্ব।
মা। (ব্যস্ত হইয়া) না বাবা, তোমার আর ভাব্তে হবে না― আমার কাশী গিয়ে কাজ নেই!