হাস্য-কৌতুক (১৯১৪)/রোগের চিকিৎসা
রােগের চিকিৎসা
প্রথম দৃশ্য
হাঁপাইতে হাঁপাইতে খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে
হারাধনের প্রবেশ
হারা। বাবা! ডাক্তার সাহেবের আস্তাবল থেকে হাঁসের ডিম চুরি কর্ত্তে গিয়ে আজ আচ্ছা নাকাল হয়েছি! সাহেব যে রকম তাড়া করে এসেছিল, মরেছিলেম আর কি! ভয়ে পালাতে গিয়ে খানার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেম। পা ভেঙে গেছে, তাতে দুঃখ নেই প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছি এই ঢের। রােগীগুলােকে হাতে পেলে ডাক্তার সাহেব পট্পট্ করে মেরে ফেলে, আমার কোন ব্যামস্যাম নেই আমাকেই ত সেরে ফেলবার যাে করেছিল। এবারে রােজ রােজ আর হাঁসের ডিম চুরি করব না, একেবারে আস্ত হাঁস চুরি করব আমাদের বাড়িতে ডিম পাড়বে!
নেপথ্য হইতে।—হারু!
হারা। (সভয়ে) ঐরে বাবা এসেছে। আমার একটা পা খোঁড়া দেখ্ লে মারের চোটে বাবা আরেকটা পা খোড়া করে দেবে।
নেপথ্যে পুনশ্চ।—হারু। (নিরুত্তর)। হারা। (নিরুত্তর)। হেরাে।
পিতার প্রবেশ
হারা। (অগ্রসর হইয়া) আজ্ঞে!
পিতা। তুই খােঁড়াচ্ছিস যে!
(হারাধনের মাথা চুল্কন)
পিতা। (সরােষে) পা ভাঙলি কিরে!
হারা। (সভয়ে) আজ্ঞে, আমি ইচ্ছে করে ভাঙিনি!
পিতা। তা ত জানি! কি ক’রে ভাঙল সেইটে বল্না।
হারা। জানিনে বাবা!
পিতা। তাের পা ভাঙল তুই জানিস্নে ত কি ও পাড়ার গােব্রা তেলি জানে!
হারা। কখন ভাঙল টের পাইনি বাবা!
পিতা। বটে! এই লাঠির বাড়ি তাের মাথাটা ভাঙলে তবে টের পাবি বুঝি!
হারা। (তাড়াতাড়ি হাত দিয়া মাথা আড়াল করিয়া) না বাবা! ঐ মাথাটা বাঁচাতে গিয়েই পা-টা ভেঙেছি।
পিতা। বুঝেছি। তবে বুঝি সেদিনকার মত ডাক্তার সাহেবের বাড়িতে হাঁসের ডিম চুরি করতে, গিয়েছিলি তাই তারা মেরে তাের পা ভেঙে দিয়েছে!
হারা। (চোখ রগ্ড়াতে রগ্ড়াইতে) হাঁ বাবা! আমার কোন দোষ নেই। পা আমি নিজে ভাঙিনি, পা তারাই ভেঙে দিয়েছে।
পিতা। লক্ষ্মীছাড়া তাের কি কিছুতেই চৈতন্য হবে না।
হারা। চৈতন্য কাকে বলে বাবা?
পিতা। চৈতন্য কাকে বলে দেখ্বি? (পিঠে কিল মারিয়া) চৈতন্য একে বলে।
হারা। এ ত আমার রােজই হয়।
পিতা। আমি দেখছি তুমি জেলে গিয়েই মরবে!
হারা। না বাবা রােজ চৈতন্য পেলে ঘরে মরব।
পিতা। নাঃ, তােকে আর পেরে উঠলেম না!
হারা। (চুপ্ড়ির দিকে চাহিয়া) বাবা, তাল এনেছ কার জন্যে? আমি খাব।
পিতা। (পৃষ্ঠে কিল মারিয়া) এই খাও!
হারা। (পিঠে হাত বুলাইয়া) এ ত ভাল লাগ্ল না!
নেপথ্যে।হারা। হারু।
হারা। কি মা!
নেপথ্যে।হারা। তাের জন্যে তালের বড় করে রেখেছি—খাবি আয়!
দ্বিতীয় দৃশ্য
(ডাক্তার সাহেবের আস্তাবলে হারাধন হাঁস চুরি করণে প্রবৃত্ত)
পিতা। (দূর হইতে) হারু!
হারা। ঐ রে, বাবা আস্চে, কি করি!
(হারাধনের গলা হইতে পেট পর্যন্ত থলি ঝুলিতেছিল তাড়াতাড়ি। থলির মধ্যে হাঁস পূরিয়া ফেলিল।)
পিতা। হারু! (নিরুত্তর)। হারা! (নিরুত্তর)। হেরাে!
হারা। আজ্ঞে!
পিতা। তাের পেট হঠাৎ অমন ফুলে উঠ্ল কি করে?
হারা। বাবা, কাল সেই তালের বড়া খেয়ে।
পিতা। অমন ক্যাঁক্ ক্যাঁক্ শব্দ হচ্ছে কেন?
হারা। পেটের ভিতর নাড়িগুলাে ডাক্চে।
পিতা। দেখি, পেটে হাত দিয়ে দেখি!
হারা। (শশব্যস্তে) ছুঁয়াে না, ছুঁয়ােনা, বড্ড ব্যথা হয়েছে। (পেটের মধ্যে ক্যাঁক্ ক্যাঁক্।)
পিতা। (স্বগত) সব বােঝা গেছে। হতভাগাকে জব্দ করতে হবে! (প্রকাশ্যে) তােমার রােগ সহজ নয়। এস বাপু তােমাকে হাঁসপাতালে নিয়ে যাই!
হারা। না বাবা, এমন আমার মাঝে মাঝে হয় আপনিই সেরে যায়! (ক্যাঁক্ ক্যাঁক্ ক্যাঁক্।)
পিতা। কৈরে, এত ক্রমেই বাড়ছে! চল্ আর দেরি নয়!
তৃতীয় দৃশ্য
হারাধন। পিতা ও মাতা।
মা। (কঁদিতে কাঁদিতে) বাছার আমার কি হল গা!
পিতা। হাঁগাে, তুমি বেশী গােল কর না। হাঁসপাতালে নিয়ে গেলেই এ ব্যাম সেরে যাবে।
মা। আমি বেশী গােল করচি—না তােমার ছেলের পেট বেশী গােল করচে! (সভয়ে) এযে হাঁসের মত ক্যাঁক্ ক্যাঁক্ করে! বাবা, হারু, তােকে আর আমি হাঁসের ডিম খেতে দেব না—তাের পেটের মধ্যে হাঁস ডাক্চে কি হবে! (ক্রন্দন)
হারু। (তাড়াতাড়ি) না মা, ও হাঁস নয়, ও তালের বড়া! হাঁস তােমাকে কে বলে! কখ্ খন হাঁস নয়। হাঁস হতেই পারে না। আচ্ছা, বাজি রাখ’ যদি তালের বড়া হয়।
মা। তালের বড়া কি অমন করে ডাকে বাছা!
হারা। তুমি এক্টু চুপ কর না। তােমাদের গােলমাল শুনে পেটের ভিতর আরাে বেশী করে ডাক্চে!
পিতা! বােসেদের বাড়ি আমার একটু কাজ আছে, আমি কাজ সেরেই হারুকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্চি।
((ক্যাঁক্ ক্যাঁক্ ক্যাঁক্ ক্যাঁক্)
মা। ওগাে, এযে ক্রমেই বাড়তে চল্ল! ওগাে ও মুখুয্যে মশাই!
মুখুয্যে মশায়ের প্রবেশ
মুখু। কি গাে বাছা!
মা। বাছার আমার ক্রমেই বাড়তে লাগ্ল। একে শীগগির—ঐ যে কি বলে ঐ—তােমাদের হাঁচ্পাতলে নিয়ে চল।
মুখু। আমি ত তাই প্রথম থেকেই বল্চি, হারুর বাবাই ত এতক্ষণ দেরী করিয়ে রাখ্লে। (হারার প্রতি) তবে চল্, ওঠ্!
হারা! না দাদা মশায়, আমি হাঁসপাতাতে যাব না, আমার কিছু হয়নি!
মুখু। কিছু হয় নি বটে! তাের পেটের ডাকের চোটে পাড়াসুদ্ধ অস্থির হয়ে উঠল! পেটের মধ্যে বাতশ্লেষ্মা পিত্ত তিনটিতে মিলে যেন দাঙ্গাহাঙ্গামা বাধিয়ে দিয়েছে!
চতুর্থ দৃশ্য
হাঁসপাতালে ডাক্তার সাহেব ও হারাধন।
ডাক্তার। টোমার পেটে কি হইয়াছে!
হারা। কিছু হয় নি সাহেব। এবার আমাকে মাপ কর সাহেব, আমার কিছু হয় নি!
ডাক্তার। কিছু হয় নি ট এ কি! (পেটে খোঁচা দেওন ও দ্বিগুণ ক্যাঁক্ ক্যাঁক শব্দ) (হাসিয়া) টোমার ব্যাম আমি সমষ্ট বুঝিয়াছি।
হারা। তােমার গা ছুঁয়ে বল্চি সাহেব আমার কোন ব্যাম হয় নি। এমন কাজ আর কখন করব না!
ডা। টোমার ভয়ানক ব্যাম হইয়াছে।
হারা। সাহেব, আমার ব্যাম আমি জানিনে তুমি জান! (ক্যাঁক্ ক্যাঁক্) (সরােষে থলিতে চাপড় মারিয়া) আমােলাে যা, এর যে ডাক কিছুতেই থামে না!
ডাক্তার। (বৃহৎ ছুরি লইয়া) টোমার ব্যাম হইয়াছে, ছুরি না ডিলে সারিবে না! (পেট চিরিতে উদ্যত)।
হারা। (কাঁদিয়া হাঁস বাহির করিয়া) সাহেব, এই নাও তােমার হাঁস। তােমার এ হাঁস কোন মতেই আমার পেটে সইল না। এর চেয়ে ডিমগুলাে ছিল ভাল!
(হারাকে ধরিয়া সাহেবের প্রহার)
হারা। সায়েব, আর আবশ্যক নেই, আমার ব্যাম একেবারেই সেরে গেছে।