হাস্য-কৌতুক (১৯১৪)/অভ্যর্থনা

অভ্যর্থনা

প্রথম দৃশ্য

গ্রামের পথ

 (চতুর্ভুজ বাবু এম্‌-এ পাস করিয়া গ্রামে আসিয়াছেন। মনে করিয়াছেন গ্রামে হুলস্থূল পড়িবে। সঙ্গে একটি মােটাসােটা কাবুলি বিড়াল আছে।)

নীলরতনের প্রবেশ

 নীল।  এই যে চতু বাবু, কবে আসা হল?

 চতু।  কালেজে এম্‌-এ একজামিন্ দিয়েই—

 নীল।  বা বা, এ বেড়ালটিত বড় সরেশ।

 চতু।  এবারকার এক্‌জামিনেশন ভারি—

 নীল।  মশায়, বেড়ালটি কোথায় পেলেন?

 চতু।  কিনেছি। এবারে যে সব্‌জেক্ট্‌ নিয়েছিলুম—

 নীল।  কত দাম লেগেছে মশায়?

 চতু।  মনে নেই। নীলরতন বাবু আমাদের গ্রামের থেকে কেউ কি পাশ হয়েছে?

 নীল।  বিস্তর। কিন্তু এমন বেড়াল এ মুল্লুকে নেই।

 চতু।  (স্বগত) আ মােলাে, এ যে কেবল বেড়ালের কথাই বলে—আমি যে পাস ক’রে এলুম সে কথা যে আর তােলে না।

জমিদার বাবুর প্রবেশ

 জমি।  এই যে, চতুভুর্জ এতকাল কলকাতায় বসে কি করলে বাপু?

 চতু।  আজ্ঞে এনে দিয়ে আস্‌চি।

 জমি।  কি বল্লে? মেয়ে দিয়ে এসেছ? কাকে দিয়ে এসেছ?

 চতু।  তা নয়—বি-এ দিয়ে—

 জমি।  মেয়ের বিয়ে দিয়েছ? তা আমরা কিছুই জানতে পারলেম না?

 চতু।  বিয়ে নয়—বি-এ—

 জমি।  তবেই হল। তােমরা সহরে বল বি-এ, আমরা পাড়াগাঁয়ে বলি বিয়ে। সে কথা যাক্। এ বেড়ালটি তােফা দেখ্‌তে।

 চতু।  আপনার ভ্রম হয়েছে; আমার—

 জমি।  ভ্রম কিসের—এমন বেড়াল তুমি এ জেলার মধ্যে খুঁজে বের কর দেখি!

 চতু।  আজ্ঞে না, বেড়ালের কথা হচ্ছে না—

 জমি।  বেড়ালের কথাইত হচ্ছে—আমি বল্‌চি এমন বেড়াল মেলে না।

 চতু।  (স্বগত) আ খেলে যা!

 জমি।  বিকেলের দিকে বেড়ালটি সঙ্গে ক’রে আমাদের ওদিকে একবার যেও। ছেলেরা দেখে ভারি খুসি হবে।

 চতু।  তা হবে বৈ কি—ছেলেরা অনেক দিন আমাকে দেখে নি।

 জমি।  হাঁ—তা ত বটেই—কিন্তু আমি বল্‌চি, তুমি যদি যেতে না পার ত বেড়ালটি বেণীর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিও—ছেলেদের দেখাব।

(প্রস্থান)

সাতুখুড়াের প্রবেশ

 সাতু।  এই যে, অনেক দিনের পর দেখা।

 চতু।  তা আর হবে না। কতগুলাে এক্‌জামিন—

 সাতু।  এই বেড়ালটি—

 চতু! (সরােষে) আমি বাড়ি চল্লেম। (প্রস্থানােদ্যম)

 সাতু।  আরে শুনে যাও না—এ বেড়ালটি—

 চতু।  না মশায়, বাড়িতে কাজ আছে।

 সাতু।  আরে একটা কথার উত্তরই দাও না—এ বেড়ালটি-

 [কোন উত্তর না দিয়া হন্‌হন্‌ বেগে চতুর্ভুজের প্রস্থান]

 সাতুখুড়ো।  আ মােল! ছেলেপুলেগুলাে লেখাপড়া শিখে ধনুর্দ্ধর হয়ে উঠেন! গুণ ত যথেষ্ট—অহঙ্কার চারপােয়া।

(প্রস্থান)

দ্বিতীয় দৃশ্য

চতুর্ভুজের বাটির অন্তঃপুর

 দাসী।  মাঠাকরুণ, দাদাবাবু একেবারে আগুন হয়ে এসেছেন।

 মা।  কেন রে?

 দাসী।  কি জানি বাপু।

চতুর্ভুজের প্রবেশ

 ছােটছেলে।  দাদা বাবু, এ বেড়ালটি আমাকে—

 চতুর্ভুজ।  (তাহাকে এক চপেটাঘাত) দিন রাত্রি কেবল বেড়াল, বেড়াল বেড়াল!

 মা।  বাছা সাধে রাগ করে! এত দিন পরে বাড়ি এল, ছেলেগুলাে বিরক্ত করে খেলে। যা, তােরা সব যা! (চতুর্ভুজের প্রতি) আমাকে দাও বাছা—দুধভাত রেখে দিয়েছি, আমি তােমার বেড়ালকে খাইয়ে আনচি।

 চতু।  (সরােষে) এই নাও মা, তােমরা বেড়ালকেই খাওয়াও আমি খাবনা, আমি চল্লেম।

 মা।  (সকাতরে) ও কি কথা! তােমার খাবার ত তৈরি আছে বাপ, এখন নেয়ে এলেই হয়।

 চতু।  আমি চল্লেম—তােমাদের দেশে বেড়ালেরই আদর—এখানে গুণবানের আদর নেই! (বেড়ালের প্রতি লাথি বর্ষণ)

 মাসি মা।  আহা ওকে মেরাে না—ও ত কোনাে দোষ করেনি!

 চতু।  বেড়ালের প্রতিই যত তােমাদের মায়া মমতা—আর মানুষের প্রতি এক্‌টু দয়া নেই!

(প্রস্থান)

 ছােট মেয়ে।  (নেপথ্যের দিকে নির্দেশ করিয়া) হরি খুড়াে দেখে যাও ওর লেজ কত মােটা!

 হরি।  কার?

 মেয়ে।  ঐ যে ওর!

 হরি।  চতুর্ভুজের?

 মেয়ে।  না, ঐ বেড়ালের।


তৃতীয় দৃশ্য

পথ

(ব্যাগ হস্তে চতুর্ভুজ। সঙ্গে বিড়াল নাই।)

 সাধুচরণ।  মশায়, আপনার সে বেড়ালটি গেল কোথায়?

 চতুর্ভুজ।  সে মরেছে।

 সাধু।  আহা, কেমন করে মােলা?

 চতু।  (বিরক্ত হইয়া) জানিনে মশায়!

পরাণ বাবুর প্রবেশ

 পরাণ।  মশায়—আপনার বেড়াল কি হল?

 চতু।  সে মরেচে।

 পরাণ।  বটে! মােলাে কি করে?

 চতু।  এই তােমরা যেমন করে মরবে। গলায় দড়ি দিয়ে!

 পরাণ।  ও বাবা, এযে একেবারে আগুন!

 (চতুর্ভুজের পশ্চাতে ছেলের পাল লাগিল। হাততালি দিয়া “কাবুলি বিড়াল” “কাবুলি বিড়াল” বলিয়া খেপাইতে লাগিল।)