হাস্য-কৌতুক (১৯১৪)/পেটে ও পিঠে

পেটে ও পিঠে
প্রথম দৃশ্য

 বাড়ীর সম্মুখে পথে বসিয়া পা ছড়াইয়া বনমালী পরমানন্দে সন্দেশ আহার করিতেছেন। বয়স ৭।

তিনকড়ির প্রবেশ। বয়স ১৫

 তিনকড়ি।  (সন্দেশের প্রতি সলোভ দৃষ্টিপাত করিয়া) কি দে বটকৃষ্ণ বাবু, কি করচ?

(বনমালীর নিরুত্তরে অবাক্ হইয়া থাকন্)

 তিনকড়ি।  উত্তর দিচ্চনা যে। তোমার নাম বটকৃষ্ণ নয়?

 বনমালী।  (সংক্ষেপে) না।

 তিনকড়ি।  অবিশ্যি বটকৃষ্ণ। যদি হয়! আচ্ছা, তোমার নাম কি বল।

 বনমালী।  আমার নাম বনমালী!

 তিনকড়ি।  (হাসিয়া উঠিয়া) ছেলেমানুষ, কিচ্ছু জান না। বনমালীও যা বটকৃষ্ণও তাই, একই! বনমালীর মানে জান?

 বনমালী।  না।

 তিনকড়ি।  বনমালীর মানে বটকৃষ্ণ। বটকৃষ্ণের মানে জান?

 বনমালী।  না।

 তিনকড়ি।  বটকৃষ্ণের মানে বনমালী। আচ্ছা, বাবা তোমাকে কখন আদর করেও ডাকে না বটকৃষ্ণ!

 বনমালী।  না।

 তিনকড়ি।  ছী ছি। আমার বাবা আমাকে বলে বটকৃষ্ণ, মোধোর বাবা মোধোকে বলে বটকৃষ্ণ,—তোমার বাবা তোমাকে কিচ্ছু বলে না। ছী ছি। (পার্শ্বে উপবেশন)

 বনমালী।  (সগর্ব্বে) বাবা আমাকে বলে ভুতু।

 তিনকড়ি।  আচ্ছা ভুতুবাবু তোমার ডান হাত কোন্‌টা বল দেখি!

 বনমালী।  (ডান হাত তুলিয়া) এইটে ডান হাত!তিনকড়ি।{

 তিনকড়ি।  আচ্ছা তোমার বাঁ হাত কোন্‌টা বল দেখি!

 বনমালী।  (বাম হাত তুলিয়া) এইটে!

 তিনকড়ি।  (খপ্ করিয়া পাত হইতে একটা সন্দেশ তুলিয়া নিজের মুখের কাছে ধরিয়া) আচ্ছা ভুতুবাবু এইটে কি বল দেখি!

(বনমালীর শশব্যস্ত হইয়া কাড়িয়া লইবার চেষ্টা)

 তিনকড়ি।  (সরোষে পৃষ্ঠে চপেটাঘাত করিয়া) এতবড় ধেড়ে ছেলে হলি, এইটে কি জানিস্‌নে! এটা সন্দেশ। এটা খেতে হয়। (তিনকড়ির মুখের মধ্যে সন্দেশের দ্রুত অন্তর্ধান)

 বনমালী।  (পৃষ্ঠে হাত দিয়া) ভ্যাঁ—

 তিনকড়ি।  ছি ছি ভুতুবাবু, তোমার জ্ঞান হবে কবে বল দেখি? এইটে জাননা যে, পেটে খেলে পিঠে সয়?

(আরেকটা সন্দেশ মুখের ভিতর পূরণ)

 বনমালী।  (দ্বিগুণ বেগে) ভ্যাঁ—

 তিনকড়ি।  তবে, তুমি কি বল পেটে খেলে পিঠে সয় না? এই দেখনা কেন, পেটে খেলে (আরেকটা সন্দেশ খাইয়া) পিঠে সয়। (বনমালীর পৃষ্ঠে চপেটাঘাত) সয় না?

 বনমালী।  (সরোদনে চীৎকার পূর্ব্বক) না ন্না ন্না।

 তিনকড়ি।  (শেষ সন্দেশটি নিঃশেষ করিয়া) তা হবে! তোমার তা হলে সয় না দেখ্‌চি! যার যেমন ধাত! তবে থাক্, তবে আর কাজ নেই। তবে এই স্থির হল কারো বা পেটে সমস্তই সয়, কারো বা পিঠে কিছুই সয় না! যেমন আমি আর তুমি।

সহসা বনমালীর পিতার প্রবেশ

 পিতা।  কিরে ভুতু কাঁদ্‌চিস্ কেন?

(পিতাকে দেখিয়া বনমালীর দ্বিগুণ ক্রন্দন )

 তিনকড়ি।  (বনমালীর পৃষ্ঠে হাত বুলাইয়া অতি কোমল স্বরে) বাবা জিগ্‌গেস‌্ কর্‌চেন, কথার উত্তর দাও!

 বনমালী।  (সরোদনে) আমাকে মেরেচে!

 তিনকড়ি।  আজ্ঞে, পাড়ার একটা ডানপিটে ছেলে খামকা মেরে গেল, বেচারার কোন দোষ নেই— সন্দেশগুলি খেয়ে ভুতুবাবু ঠোঙাটি নিয়ে খেলা কর্‌ছিল—

 পিতা।  (সরোষে) ভুতু কে মেরেচেরে?

 বনমালী।  (তিনকড়িকে দেখাইয়া) ও মেরেচে!

 তিনকড়ি।  আজ্ঞে হাঁ, আমি তাকে খুব মেরেচি বটে! কার না রাগ হয় বলুন দেখি! ছেলেমানুষ খেলা কর্‌চে—খামকা ওকে মেরে ওর ঠোঙাটা কেড়ে নেও কেন বাপু? আপনি থাক্‌লে আপনিও তাকে মার্‌তেন।

 পিতা।  আমি থাক্‌লে তার দুখানা হাড় একত্তর রাখ্‌তেম না। যত সব ডানপিটে ছেলে এ পাড়ায় জুটেছে!

 বনমালী।  বাবা ও আমার সন্দেশ—

 তিনকড়ি।  (নিবৃত্ত করিয়া) আরে, আরে, ও কথা আর বল্‌তে হবে না।

 পিতা।  কি কথা!

 তিনকড়ি।  আজ্ঞে কিছুই নয়। আমি ভুতুবাবুকে আনা দুয়েকের সন্দেশ কিনে খাইয়েছি। সামান্য কথা! সে কি আর বলবার বিষয়!

 পিতা।  (পরম সন্তোষে) তোমার নাম কি বাপু?

 তিনকড়ি।  (সবিনয়ে) আজ্ঞে, আমার নাম তিনকড়ি মুখোপাধ্যায়।

 পিতা।  ঠাকুরের নাম?

 তিনকড়ি।  খুদিরাম মুখোপাধ্যায়।

 পিতা।  তুমি আমার পরমাত্মীয়। খুদিরাম যে আমার পিস্‌তুতো ভাই হয়।

(তিনকড়ির ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম)

 পিতা।  চল বাবা, বাড়িভিতর চল। জলখাবার খাবে। আজ পৌষপার্ব্বণ, পিটে না খাইয়ে ছাড়্‌ব না।

 তিনকড়ি।  যে আজ্ঞে!

 পিতা।  আজ রাত্রে এখানে থাকবে। কাল মধ্যাহ্ন ভোজন করে বাড়ি যেয়ো।

 তিনকড়ি।  যে আজ্ঞে।


দ্বিতীয় দৃশ্য
অন্তঃপুরে তিনকড়ি পিষ্টক আহারে প্রবৃত্ত

 তিনকড়ি।  (স্বগত) ডানহাতের ব্যাপারটা আজ বেশ চল্‌চে ভাল।

 ভুতুর মা।  (পাতে চারটে পিটে দিয়া) বাবা চুপ করে বসে থাক্‌লে হবে না, এ চার খানাও খেতে হবে!

 তিনকড়ি।  যে আজ্ঞে। (আহার)

ভুতুর বাপের প্রবেশ

 পিতা।  ওকি ও, পাত খালি যে! ওরে, খান আষ্টেক পিটে দিয়ে যা। (পিটে দেওন) বাবা, খেতে হবে। এরি মধ্যে হাত গুটোলে চলবে না!

 তিনকড়ি।  যে আজ্ঞে। (আহার)

পিসিমার প্রবেশ

 পিসি। (ভুতুর মার প্রতি) ও বউ, তিনকড়ির পাত খালি যে। হাঁ করে দাড়িয়ে দেখ্‌ চ কি? ওকে খানদশেক পিটে দাও। লজ্জা কোরাে না বাবা, ভাল করে খাও।

 তিনকড়ি।  যে আজ্ঞে।

পিসে মহাশয়ের প্রবেশ

 পিসে।  বাপু তােমার কিছু খাওয়া হলনা দেখ্ চি। দিয়ে যা দিয়ে যা, এদিকে দিয়ে যা। পাতে খান পনর পিটে দে। তােমাদের বয়েসে আমরা খেতুম হাঁসের মত। সবগুলি খেতে হবে তা বল্‌চি।

 তিনকড়ি।  যে আজ্ঞে।

দিদিমার প্রবেশ

 দিদিমা।  (ভুতুর মার প্রতি অন্তরালে) ও বউ পিটেত সব ফুরিয়ে গেছে আর একখানাও বাকি নেই।

 ভুতুবাবুর মা। কি হবে!

 দিদিমা।  কি আর হবে। (তিনকড়ির পাশে গিয়া পরিহাস করিয়া পিঠে এক কিল মারিয়া) পিটে আর খাবে।

 তিনকড়ি।  আজ্ঞে না।

 দিদিমা।  সেকি কথা। আর দুটো খাও। (আর দুটো কিল)

 তিনকড়ি।  (গাত্রোত্থান করিয়া) আজ্ঞে না আর আবশ্যক নেই।

তৃতীয় দৃশ্য

পরদিন তিনকড়ি শয্যাগত। পাশে বনমালী

 তিনকড়ি।  (ক্ষীণকণ্ঠে) ভুতুবাবু, তােমার বাবা কোথায় হে।

 বনমালী।  বদ্যি ডাকতে গেছে।

 তিনকড়ি।  (কাতরস্বরে) আর বদ্যি ডেকে কি হবে। ওষুধ খাব যে তার জায়গা কোথায়?

 বনমালী।  তােমার পেটে কি হয়েছে তিনকড়ি দা?

 তিনকড়ি।  যাই হােক্‌ গে। কাল তােমাকে যা শিখিয়েছিলুম, মনে আছে কি?

 বনমালী।  আছে।

 তিনকড়ি।  কি বল দেখি?

 বনমালী।  পেটে খেলে পিঠে সয়।

 তিনকড়ি।  আজ আরেকটা শেখাব। কথাটা মনে রেখাে- “পিটে খেলে পেটে সয়না।”

[১২৯২]