হাস্য-কৌতুক (১৯১৪)/ছাত্রের পরীক্ষা
হাস্য-কৌতুক
ছাত্রের পরীক্ষা
ছাত্র শ্রীমধুসূদন। শ্রীযুক্ত কালাচাঁদ মাষ্টার পড়াইতেছেন।
অভিভাবকের প্রবেশ
অভিভাবক। মধুসূদন পড়াশুনা কেমন করচে কালাচাঁদ বাবু?
কালা। আজ্ঞে, মধুসূদন অত্যন্ত দুষ্ট বটে কিন্তু পড়াশুনোয় খুব মজ্বুৎ। কখনো একবার বৈ দুবার বলে দিতে হয় না। যেটি আমি একবার পড়িয়ে দিয়েছি সেটি কখন ভোলে না।
অভি। বটে? তা, আমি আজ একবার পরীক্ষা করে দেখ্ব।
কালা। তা দেখুন না।
মধুসূদন। (স্বগত) কাল মাষ্টার মশায় এমন মার মেরেছেন যে আজও পিট চচ্চড় কর্চে। আজ এর শোধ তুল্ব। ওঁকে আমি তাড়াব।
অভি। কেমনরে মোধো, পুরোনো পড়া সব মনে আছে ত?
মধু। মাষ্টার মশায় যা বলে দিয়েছেন তা সব মনে আছে।
অভি। আচ্ছা, উদ্ভিদ কা’কে বলে বল্ দেখি?
মধু। যা’ মাটি ফুঁড়ে ওঠে।
অভি। একটা উদাহরণ দে।
মধু। কেঁচো।
কালা। (চোক রাঙাইয়া) অ্যাঁ! কি বল্লি!
অভি। রসুন মশায়, এখন কিছু বলবেন না। (মধুসুদনের প্রতি) তুমি ত পদ্যপাঠ পড়েছ, আচ্ছা, কাননে কি ফোটে বল দেখি?
মধু। কাঁটা। (কালাচাঁদের বেত্র আস্ফালন) কি মশায়, মারেন কেন? আমি কি মিথ্যে কথা বল্চি?
অভি। আচ্ছা, সিরাজউদ্দৌলাকে কে কেটেছে? ইতিহাসে কি বলে?
মধুসূদন। পোকায়। (বেত্রঘাত) আজ্ঞে মিছিমিছি মার খেয়ে মরচি―শুধু সিরাজউদ্দৌলা কেন সমস্ত ইতিহাস খানাই পোকায় কেটেচে! এই দেখুন (প্রদর্শন) (কালাচাঁদ মাষ্টারের মাথা চুল্কায়ন)
অভি। ব্যাকরণ মনে আছে?
মধু। আছে।
অভি। কর্তা কি তার একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দাও দেখি?
মধু। আজ্ঞে কর্তা ওপাড়ার জয়মুন্সি।
অভি। কেন বল দেখি
মধু। তিনি ক্রিয়া কর্ম নিয়ে থাকেন।
কালা। (সরোষে) তোমার মাথা। (পৃষ্ঠে বেত্র)
মধু। (চমকিয়া) আজ্ঞে, মাথা নয় ওটা পিট।
অভি। ষষ্ঠী তৎপুরুষ কা’কে বলে?
মধু। জানিনে।
কালাচাঁদ বাবুর বেত্র দর্শায়ন
মধুসূদন। ওটা বিলক্ষণ জানি—ওটা ষষ্ঠী-তৎপুরুষ।
অভিভাবকের হাস্য এবং কালাচাঁদ বাবুর তদ্বিপরীত ভাব
অভি। অঙ্ক শিক্ষা হয়েছে?
মধু। হয়েছে।
অভি। আচ্ছা তোমাকে সাড়ে ছ’টা সন্দেশ দিয়ে বলে দেওয়া হয়েছে যে, পাচ মিনিট সন্দেশ বাকী থাকে তোমার ছোট ভাইকে দিতে হবে। একটা সন্দেশ খেতে তোমার দুমিনিট লাগে, কটা সন্দেশ তুমি তোমার ভাইকে দিবে?
মধু। একটাও নয়।
কালা। কেমন করে!
মধু। সবগুলো খেয়ে ফেল্ব। দিতে পারব না।
অভি। আচ্ছা, একটা বটগাছ যদি প্রত্যহ সিকি ইঞ্চি করে উঁচু হয় তবে যে বট এ বৈশাখ মাসের পয়লা দশ ইঞ্চি ছিল ফিরে বৈশাখ মাসের পয়লা সে কতটা উঁচু হবে।
মধু। যদি সে গাছ বেঁকে যায় তাহলে ঠিক বল্তে পারিনে, যদি বরাবর সিধে ওঠে তা হলে মেপে দেখ্লেই ঠাহর হবে, আর যদি ইতিমধ্যে শুকিয়ে না যায় তা হলেত কথাই নেই।
কালা। মার না খেলে তোমার বুদ্ধি খোলে না! লক্ষীছাড়া, মেরে তোমার পিট লাল কর্ব তবে তুমি সিধে হবে!
মধু। আজ্ঞে, মারের চোটে খুব সিধে জিনিষও বেঁকে যায়।
অভি। কালাচাঁদ বাবু, ওটা আপনার ভ্রম। মারপিট করে খুব অল্প কাজই হয়। কথায় আছে গাধা পিট্লে ঘোড়া হয় না, কিন্তু অনেক সময়ে ঘোড়াকে পিট্লে গাধা হয়ে যায়। অধিকাংশ ছেলে শিখ্তে পারে কিন্তু অধিকাংশ মাষ্টার শেখাতে পারে না। কিন্তু মার খেয়ে মরে ছেলেটাই। আপনি আপনার বেত নিয়ে প্রস্থান করুন, দিনকতক মধুসূদনের পিট জুড়োক্ তার পরে আমিই ওকে পড়াব।
মধু। (স্বগত) আঃ বাঁচা গেল।
কালা। বাঁচা গেল মশায়। এ ছেলেকে পড়ানো মজুরের কর্ম্ম, কেবল মাত্র manual labour ত্রিশ দিন একটা ছেলেকে কুপিয়ে আমি পাঁচটি মাত্র টাকা পাই, সেই মেহনতে মাটি কোপাতে পারলে নিদেন দশটা টাকাও হয়।