হিন্দু মহিলাগণের হীনাবস্থা/ভাশুর পত্নী ও দেবর পত্নীগণের পরস্পর ব্যবহার
আহা! কি পরিতাপের বিষয় যে আমাদিগের এই বঙ্গদেশস্থ প্রায় সমস্ত গৃহেই ভ্রাতৃ বিচ্ছেদ রূপ বিষম বিষ প্রবেশ করিয়া সেই গৃহ একেবারে দগ্ধ করিতেছে, কিন্তু এই ভয়ঙ্কর বিচ্ছেদানলে সকলে নিরন্তর সন্তাপিত হইয়াও তাহা নিবারণ করিতে কেহই যত্নবান হয়েন না, এবং এই বাড়বানল সদৃশ বিচ্ছেদানল যে কোথা হইতে কি প্রকারে উৎপন্ন হয় ও কোন উপায় অবলম্বনে তাহা একেবারে নির্ব্বাপিত হয় তাহার যথার্থ অনুসন্ধানে কেহই মনোনিবেশ করেন না, কিন্তু কোন কোন মহাশয় অনুভব করিয়া থাকেন যে পৈতৃক ধন সম্পত্তিই ইহার মুলীভূত কারণ, কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত কি প্রকারে যুক্তি মূলক হইতে পারে। যদ্যপি পৈতৃক ধন সম্পত্তি ইহার কারণ হইত তবে এই অনল কখনই সর্ব্বত্র ব্যাপী হইত না, কেবল ধনাঢ্য গৃহেই প্রবেশ করিত। সেই হেতু এক্ষণে বিশেষ রূপে প্রতীয়মান হইতেছে যে শুদ্ধ দেবর পত্নী ও ভার পত্নীগণের পরস্পর ব্যবহার দোষেই এই বিষম অনল উদ্ভূত হইয়া থাকে। অতএব হে মহোদয়গণ! তোমরা সেই অগ্ন্যুৎপাদক প্রস্তর সদৃশ ব্যবহার সমুহকে একেবারে সমুলে নির্ম্মূল করিয়া সর্ব্ব সাধারণকে সুখী কর।
পূর্ব্বেই লিখিত হইয়াছে যে ভাশুর-পত্নী ও দেবর-পত্নীগণের ব্যবহার-দোষেই ভ্রাতৃ বিচ্ছেদ উপস্থিত হইয়া থাকে, সেই নিমিত্ত তাহাদিগের ব্যবহার গুলি এই স্থলে প্রকাশ করিতে বাধ্য হইলাম। ইহারা স্বভাবতই অতি বিদ্বেষ-পরায়ণা হইয়া পরস্পরের প্রতি কুব্যবহার করিয়া থাকে, এবং একের অভ্যুদয়ে অন্য অতিশয় অনুতাপিত হয়, ও উভয়ে স্ব স্ব প্রাধান্য সাধনের নিমিত্ত বিধিমতে চেষ্টা পায়, কিন্তু সেই প্রধানতা যে কি প্রকারে প্রাপ্ত হইবে তাহার কোন সদুপায় চিন্তা করে না, এই নিমিত্ত তাহাদিগের কিছু মাত্র ঐক্য হয় না। এই দুর্জ্জয় বৈরভাব যে কি প্রকারে উৎপন্ন হয় তাহার যথার্থ তত্ত্ব কেহই প্রাপ্ত না হইয়া কেবল অনুভব দ্বারা অনুমান করে যে, শ্বশুর শ্বশ্রূগণ উহাদিগের মধ্যে একের প্রতি অনুরাগ অন্যের প্রতি বিরাগ প্রকাশ করেন, এই জন্য তাহাদিগের হৃদয়ে এই বিদ্বেষ ভাবের আবির্ভাব হয়। এরূপ হওয়া সম্ভবও বটে; অনেকে শ্বশ্রূ ও শ্বশুরগণ বর্ত্তমানে বাহ্যিক ঐক্য প্রকাশ করিয়া একত্রে বাস করে, কিন্তু তাঁহারা গত হইলেই স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন করিয়া থাকে, অতএব ইহাদিগের মনান্তর হইবার আর অন্য কোন কারণ নাই, কেবল ইহাদিগের মনই এক প্রধান কারণ। হে বিদ্যোৎসাহী বন্ধুগণ! তােমরা যত্নবান হইয়া এই দীনভাবাপন্ন মহিলাগণের কঙ্করাবৃত ক্ষেত্র সদৃশ যে বন্ধুর অন্তঃকরণ তাহা বিদ্যারূপ ঘর্ষণী দ্বারা সরল করিতে চেষ্টা কর। আমি এই স্থলে স্বীয় ভগিনীগণের প্রতি কিঞ্চিৎ উপদেশ বাক্য প্রয়োগ করিতে বাধ্য হইলাম। হে ভগিনীগণ! তোমরা কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্য্যের আশা করিও না, কিঞ্চিৎ আন্তরিক সৌন্দর্য্যের উপায় চেষ্টা কর, তোমরা বিবিধ অলঙ্কারে ভূষিতা হইয়া কত দূর সৌন্দর্য্য ধারণ করিবে, ও নয়ন তৃপ্তিকর অতি বিচিত্র বসন পরিধানেই বা কত প্রভা বৃদ্ধি করিবে,এবং নানাবিধ সুগন্ধ দ্রব্যাদি অঙ্গে লেপন দ্বারাই বা কত শোভান্বিত হইতে পারিবে, এই সমস্ত অস্থায়ি শোভায় কখনই চিরস্থায়ি সুখ প্রদান করিতে সমর্থ হইবে না, সেই নিমিত্ত তোমরা চির সুখদায়িনী যে মনোহারিণী শোভা সেই শোভা ধারণ করিতে যত্নবতী হও, তোমরা বিদ্যারূপ ভুষণে ভুষিতা হইয়া জ্ঞান-বস্ত্র পরিধান কর, এবং সৎকার্য্যরূপ সুগন্ধ দ্রব্য ব্যবহার দ্বারা যশোরূপ মনোহর সৌরভে দিঙ্মণ্ডল আমোদিত করিতে চেষ্টা কর, এবং যাঁহার সহিত যাদৃশ সম্বন্ধ তাঁহার সহিত তাদৃশ ব্যবহার করিতে প্রবৃত্ত হও। দেবরপত্নী ভাশুরপত্নী এবং ননন্দাগণের ভগিনী সম্বন্ধ, অতএব তাহাদের সহিত ভগিনীর ন্যায় ব্যবহার করিবে, শ্বশ্রুকে মাতার ন্যায় ভক্তি করিবে, শ্বশুর ভাশুরগণকে পরম গুরুর ন্যায় মান্য করিবে, দেবর ও তৎপুত্র এবং ভাশুর-পুত্র ও ভাগিনেয় প্রভৃতিকে পুত্রবৎ স্নেহ করিবে, দাসবর্গকে স্বীয়-চ্ছায়া স্বরূপ দেখিবে, এবং সকলকেই প্রিয় বাক্য কহিবে, আর ক্ষুধার্ত্তকে ভোজ্য দানে ও তৃষ্ণার্ত্তকে পানীয় দানে পরিতৃপ্ত করিবে।