১৯০৫ সালে বাংলা/পুলিশের প্রবেশ
পুলিশের প্রবেশ।
কাব্যবিশারদ মহাশয় বক্তৃতা করিতেছিলেন, এমন সময়ে পুলিশ সাহেব মিঃ কেম্প সশস্ত্র পুলিশ ফৌজ লইয়া মণ্ডপের দ্বারদেশে উপস্থিত হইলেন। কিন্তু দ্বারস্থিত একজন ভলণ্টিয়ার তাঁহাকে সভাস্থলে প্রবেশ করিতে দিল না। তিনি ভিতরে প্রবেশ করিবার চেষ্টা করিলে ভলণ্টিয়ার (মুকুন্দলাল) তাঁহাকে বাধা দিয়া বলিল, “কাপ্তেনের অনুমতি ভিন্ন আমি কাহাকেও বিনা টিকিটে ভিতরে প্রবেশ করিতে দিব না।” তখন মণ্ডপের বাহিরে বহুসংস্যক বন্দুক ও লগুড়ধারী পুলিশ দণ্ডায়মান ছিল, দ্বারস্থিত ভলণ্টিয়ার তথাপি ভীত হয় নাই। মিঃ কেম্প মণ্ডপে প্রবেশ করিতে অসমর্থ হইয়া বাবু অশ্বিনীকুমার দত্ত ও সমিতির সম্পাদক বাবু রজনীকান্ত দাস মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ করিবার, ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। তদনুসারে তাঁহারা বাহির হইবামাত্র, মিঃ কেম্প তাঁহাদিগের হস্তে নিম্নলিখিত পরোয়ানা প্রদান করিলেন।
কনফারেন্স সভার সভ্য সেক্রেটারী দর্শক ও শ্রোতাগণ প্রতি।
যেহেতু আমার নিকট প্রকাশ করা হইয়াছে যে, আপনারা অত্র বরিশাল সহরে ব্রজমোহন কলেজের উত্তর পার্শ্বে এক সভা করিয়া বিনা কারণযুক্ত কার্য্য গোলমালজনক কার্য্য করিতেছেন। অতএব আমি এতদ্দ্বারা আপনাদিগকে আদেশ করিতেছি যে, আপনারা অথবা সর্ব্বসাধারণ কেহই ঐ সভায় যোগদান করিতে পারিবেন না অথবা করিবেন না। প্রকাশ থাকে যে, অত্র সহরে রাজা বাহাদুরের হাউলীতে [বা অন্যত্র] ঐরূপ কোন কাজ করিবেন না।
T. Emerson, Magistrate.
15. 4. 09.
As it appears from Police report that the breaking up of the meeting of the Conference which is being held at a Pandal in the town opposite the B. M. College is likely to be followed by unruly proceedings in the streets and noisy prrocession which have been forbidden by proper authority, I hereby order that the public or any persous are not to meet in the Pandal or elsewhere for the said purpose and the public are not to form crowds in the streets. As it also appears likely that the crowds may meet in Rajabahadur’s Habeli and from unlawful assembly.
It is hereby ordered that this is also forbidden.
15. 4. 06.
অশ্বিনী বাবু ও রজনী বাবু এই বিচিত্র ইংরাজী ও অশ্রুতপূর্ব্ব বাঙ্গালা ভাষায় লিখিত পরোয়ানা লইয়া সভাপতির নিকট উপস্থিত হইলেন। তখন উহা লইয়া নেতৃবৃন্দের মধ্যে আলোচনা আরম্ভ হইল। বাবু বিপিনচন্দ্র পাল বলেন, পুলিশ যখন আপত্তি করিতেছে, তখন আমাদের সভাভঙ্গ করাই উচিত। কৃষ্ণবাবু এই কথায় প্রতিবাদ করিয়া বলেন,—আমরা কিছুতেই সভাগৃহ ত্যাগ করিব না। পুলিশ গুলি চালাক্ তথাপি আমরা নড়িবনা। এই বলিয়া তিনি বিপিন বাবুকে ভীরুতার জন্য তিরস্কার করেন। আলোচনার স্থির হইল যে, এই অবৈধ আদেশ কেহ পালন করিবে না, যদি মিঃ কেম্প ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে বলপূর্ব্বক সভা ভঙ্গ করিতে পারেন। এই সময়ে মিঃ কেম্প সভাপতির অনুমতি গ্রহণ করিয়া মঞ্চোপরি আরোহণ করিলেন। তখন চারিদিকে ভৈরব রবে “বন্দেমাতরম্” ধ্বনি উত্থিত হইতেছিল। উপস্থিত জনগণের চিত্তে বিষম উত্তেজনার সঞ্চার হইয়াছিল। সেই ভীষণ উত্তেজনা দর্শনে কম্পিত কলেবর কেম্প সুরেন্দ্র বাবুর সম্মুখবর্ত্তী হইয়া বলিলেন “I hope now I am safe.” অর্থাৎ ভরসা করি আপনার নিকট দাঁড়াইয়া আমি এখন নিরাপদ হইয়াছি। প্রতিনিধিগণ তখন মিঃ কেম্পকে বলিলেন, ‘বল বন্দেমাতরম্’,—চারিদিক হইতে বিশেষ উত্তেজনার সহিত ঐ কথা ধ্বনিত হইতে লাগিল। তখন মিঃ কেম্পও বন্দে মাতরম্ বলিলেন।
মিঃ কেম্পের মুখে বন্দে মাতরম্ ধ্বনি শ্রবণ করিয়া উত্তেজিত জনসাধারণ শান্ত হইলে মিঃ কেম্প বলিলেন, সভা ভাঙ্গিয়া ফিরিয়া যাইবার সময় কেহ রাস্তায় “বন্দেমাতরম্” বলিবে না। আপনারা যদি এ বিষয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করিতে পারেন, তাহা হইলে আপনাদিকে সভার কার্য্য নির্ব্বাহ করিবার অনুমতি প্রদত্ত হইবে। বলা বাহুল্য, প্রতিনিধিগণ এ প্রস্তাবে সম্মত হইলেন না। তখন কেম্প বলিলেন, দায়িত্ব গ্রহণ না করেন, শুদ্ধ নেতৃবৃন্দ প্রতিনিধিদিগকে সভার বাহিরে “বন্দেমাতরর্” ধ্বনি করিতে নিষেধ করুন। তাহাতেও কেহ সম্মত হইলেন না। তখন কেম্প বলিলেন, অগত্যা আমাদিগের বল প্রকাশ করিতে হইবে।
অতঃপর নেতৃবৃন্দের মধ্যে পরামর্শ আরম্ভ হইল। তাঁহারা বুঝিলেন যে, পুলিশ সাহেবের আদেশে সভাগৃহ ত্যাগ না করিলে বালকদিগকে অকারণে লগুড়াঘাত সহ্য করিতে হইবে। সুতরাং পুলিশকে অত্যাচার করিবার অবসর না দিয়া নীরবে সভাগৃহ ত্যাগ করাই কর্ত্তব্য বলিয়া সকলে স্থির করিলেন। বাবু কৃষ্ণকুমার মিত্র কিছুতেই সে প্রস্তাবে সম্মত হইতে চাহেন নাই। পরিশেষে অনেক বুঝাইয়া তাঁহাকে সভা ত্যাগ করিতে সম্মত করা হয়।