১৯০৫ সালে বাংলা/সভাভঙ্গ
সভা-ভঙ্গ।
পুলিশ সাহেব যখন বলেন যে, হয় আপনারা সভা হইতে স্বেচ্ছায় বাহির যান, না হয় আমি পুলিশ দিয়া এখনই সকলকে বাহির করিয়া দিব, তখন সেই নির্ম্মম বাণী শুনিয়া সেই মণ্ডপস্থিত জন-সমুদ্র অবিরাম কলরোলে মুখরিত হইয়া উঠিল। মাতৃপূজার মন্ত্র “বন্দে মাতরম্” তখন মূহূর্মূহু মণ্ডপ-গৃহচূড়া ভেদ করিয়া দিঙ্মণ্ডল নিনাদিত করিতে লাগিল। উত্তাল-সমুদ্র-তরঙ্গ পাষাণ গাত্রে প্রবল আঘাত প্রাপ্ত হইলে যেমন ক্ষুব্ধ হইয়া উঠে, তেমনি এই অগণিত মনুষ্যমণ্ডলী ক্রোধে ক্ষোভে উন্মত্ত হইল। কিন্তু নেতার আদেশ অনতিক্রমণীয়। সুতরাং সকলেই ধীরে, ধীরে মণ্ডপ গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইতে লাগিলেন। মাননীয় মিঃ জে, চৌধুরী বলিলেন, যাও সকলে বাড়ী যাও, কনফারেন্স এ জায়গায় ভাঙ্গিল বটে, কিন্তু গৃহে গৃহে কনফারেন্স হউক—গ্রামে গ্রামে আন্দোলন হউক। বিদেশী জিনিষ একেবারে নির্ব্বাসিত হউক। স্বদেশী দ্রব্য নির্ম্মিত হউক। যাও, বাড়ী যাও। আজি আমাদের শোকের দিন নহে, আনন্দের দিন। যে দিন এই লাঠি বিলাতে ইহাদিগের পৃষ্ঠে পড়িবে, সেই দিন আমাদিগের প্রতিশোধের দিন আসিয়াছে বুঝিব।
ক্রমে সভাগৃহ জন-শূন্য হইল। উৎসবান্তে নাট্যমঞ্চ যেমন বিষাদ-মণ্ডিত হয়, এখানেও সেইরূপ বা ততোধিক বিষাদের কালিমা দৃষ্ট হইল। ইংরাজ রাজ্যে নবশাসন-প্রণালীর সুস্পষ্ট প্রতিকৃতি সর্ব্বজন সমক্ষে প্রকটিত হইল!
পরামর্শ সভার বাদানুবাদ।
প্রাদেশিক সমিতি ভঙ্গ হইবার পরেই স্থানীয় মিউনিসিপালিটির চেয়ারম্যান বাবু রজনীকান্ত দাস মহাশয়ের বাটীতে একটি পরামর্শ সভার অধিবেশন হয়। পরামর্শকালে কথা-প্রসঙ্গে কাব্যবিশারদ মহাশয়ের সহিত বাবু বিপিনচন্দ্র পালের কিঞ্চিৎ বাগ্বিতণ্ডা হয়। পুলিশের ভয়ে সমিতির মণ্ডপ পরিত্যাগ উপলক্ষে মতভেদই এই বিষয়ের সূত্রপাত হয়। কাব্যবিশারদ মহাশয় পুলিশের ভয়ে সভা ভাঙ্গিয়া সরিয়া যাইবার পক্ষপাতী ছিলেন না। বাবু বিপিনচন্দ্র পাল কাব্যবিশারদ মহাশয়ের অনুযোগের উত্তরে বলেন, আমি লাঠি মানি, গবর্ণমেণ্ট মানি না। তাই লাঠি দেখিয়াই সরিয়া গিয়াছিলাম। কাব্যবিশারদ বলিলেন, আমি গবর্ণমেণ্ট মানি, লাঠি মানি না। এই কথা সভাপতি মিঃ রসুল, শ্রীযুক্ত হালিম গজনবি, মাননীয় ভূপেন্দ্রনাথ বসু, যোগেশচন্দ্র চৌধুরী, শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ, শ্রীযুক্ত গীষ্পতি রায় চৌধুরী, মৌলবী আবুল হোসেন, বাবু মতিলাল ঘোষ এবং ময়মনসিংহ, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশাল প্রভৃতি স্থানের বহু প্রধান ব্যক্তির সমক্ষে হইয়াছিল।