১৯০৫ সালে বাংলা/প্রথম দিবসের ঘটনা

প্রথম দিবসের ঘটনা।

 বেলা দুই ঘটিকার কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে এণ্টিসারকুলার সোসাইটির প্রতিনিধিগণ দলবদ্ধ হইয়া রাজবাটী অভিমুখে গমন করিতেছিলেন। তাঁহাদের সঙ্গে ব্রজমোহন কলেজের অধ্যক্ষ বাবু রজনীকান্ত গুহ, হাওড়া-হিতৈষী সম্পাদক বাবু গীষ্পতি রায় চৌধুরী ও সঞ্জীবনী সম্পাদক বাবু কৃষ্ণকুমার মিত্র ছিলেন। ইঁহারা রাজবাটীর তোরণের নিকট উপস্থিত হইবামাত্র পুলিশ সুপারিটেণ্ডেণ্ট মিঃ কেম্প সহসা এণ্টিসার্কুলার সোসাইটীর সভ্যদের গতিরোধপূর্ব্বক তাঁহাদিগের সম্মুখে দণ্ডায়মান হইলেন এবং এক লাঠি দ্বারা বাবু ফণিভূণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিবুকে আঘাত করিলেন; চিবুক কাটিয়া শোণিতপাত হইতে লাগিল। বাবু কৃষ্ণকুমার মিত্র পশ্চাৎদিক্ হইতে দৌড়িয়া আসিলেন এবং কেম্প সাহেবকে বলিলেন, “আপনি অকারণে ফণিভূষণকে প্রহার করিলেন কেন?” মিঃ কেস্প বলিলেন “আমি ইঁহাদিগকে দলবদ্ধ হইয়া যাইতে দিব না।” কৃষ্ণবাবু বলিলেন “পাছে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া না গেলে আপনারা বলেন যে রাস্তা বন্ধ করিয়া যাইতেছে, তাই ইহাঁরা সুশৃঙ্খল ভাবে গমন করিতেছিলেন কেন ইঁহাদিগের গতিরোধ করিলেন? কেনই বা একজনকে প্রহার করিলেন?” মিঃ কেম্প এ প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়া বলিলেন “ইহাঁরা প্রতিনিধি নহেন, ইঁহাদিগকে যাইতে দিব না।” কৃষ্ণবাবু বলিলেন “ইহাঁরা প্রতিনিধি, অবশ্য যাইতে দিতে হইবে।” তখন কেম্প বলিলেন “ইহাঁরা যাইতে পারেন।” অতঃপর ইহাঁদের সম্মুখ হইতে লালপাগড়ীর দল সরিয়া গেল, ইঁহারা শ্রেণীবদ্ধ হইয়া রাজবাটীতে প্রবেশ করিলেন। নেতৃবর্গের আদেশ ছিল, সে দিন পুলিশের সহিত বিবাদ করিবে না, কাজেই এণ্টিসার্কুলার সোসাইটীর প্রতিনিধিরা রক্তপাত দেখিয়াও নীরবে নিগ্রহ সহ্য করিলেন।

 অতঃপর এণ্টিসার্‌কুলার সোসাইটীর সভ্যগণ বাটীর প্রাঙ্গণে প্রথমে “বন্দেমাতরং” এবং “যায় যাবে জীবন চলে’ সঙ্গীত গাইয়া সমবেত জনমণ্ডলীর হৃদয়ে অপূর্ব্ব উদ্দীপনার সঞ্চার করিতে লাগিলেন।

 বেলা আড়াইটার সময় মিঃ রসূল সহধর্ম্মিণীসহ প্রাঙ্গণে উপনীত হইলেন এবং শকটারোহণে মণ্ডপের অভিমূখে যাত্রা করিলেন।

প্রহরী দল।

 পুলিশ সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট মিঃ কেম্প সাহেব বহুসংখ্যক কৃষ্ণপরিচ্ছদ সাধারণ পুলিশ ও খাকি কোর্ত্তাধারী রিজার্ভ পুলিশ লইয়া বেলা একটার সময় রাজবাটীর দ্বারদেশে বার দিয়াছিলেন। আসিষ্টাণ্ট সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট একটী বালক ফিরিঙ্গী মাত্র। তিনিও অশ্বপৃষ্ঠে তথায় অবস্থিতি করিতেছিলেন। বহুসংখ্যক বাঙ্গালী ইনস্পেক্টার রাস্তায় ও হাবেলীর প্রাঙ্গণে যাতায়াত করিতেছিলেন। তাহারা এণ্টিসারকুলার সোসাইটীর প্রতিনিধিদের উপর রক্তলোলুপ ব্যাঘ্রের ন্যায় সতৃষ্ণ দৃষ্টিপাত করিতেছিল। হাবেলীর নিকটে রাস্তার অপর পার্শ্বে ঢাকার নবাব সলিমোল্লার কাছারী। সেই বাটী পুলিশের কেল্লায় পরিণত হইয়াছিল। সেই বাটীতে বহুসংখ্যক পুলিশ বন্দুক লইয়া সমবেত হইয়াছিল।

 প্রতিনিধিগণ দেখিলেন, সাধারণ পুলিশ ও রিজার্ভ পুলিশ বড় লাঠি লইয়া রাজপথে অবস্থিতি করিতেছে, নবাবের কাছারীতে বন্দুকধারী পুলিশ সজ্জিত হইয়া রহিয়াছে রিজার্ভ পুলিশের সুবাদারের হাতে লাঠি ও কটিদেশে তরবারি শোভা পাইতেছে। তথাপি বরিশালের রাজপথে “বন্দে মাতরম্” বলিবার জন্য তাঁহারা যে দৃঢ় সঙ্কল্প করিয়াছিলেন, তাহা কিছুতেই বিচলিত হইল না। তাঁহারা ফুলারের বেআইনী সার্কুলার অগ্রাহ্য করিয়া রাজপথে “বন্দে মাতরং” বলিবার জন্য বহির্গত হইলেন; বাবু সুরেন্দ্রনাথ প্রভৃতি নেতৃবৃন্দও রাজপথে বহির্গত হইলেন। তাঁহাদের কিছু পশ্চাতেই এণ্টীসোসাইটীর প্রতিনিধি ছিলেন ইহাঁরা ফটক পার হইয়া রাজপথে বহির্গত হইবামাত্র একদল তাঁহাদের পশ্চাতে আসিয়া দাঁড়াইল। নিমেষ মধ্যে পূর্ব্বগামী ও অনুসরণকারী প্রতিনিধিদিগের শ্রেণী হইতে তাঁহাদিগকে পৃথক করিয়া বহু “কৃষ্ণবর্ণ কোর্ত্তা ও খাকি কোর্ত্তাধারী” পুলিশ তাঁহাদিগকে বেষ্টন করিল। মিঃ কেম্প তাঁহাদের নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “তোমাদের উত্তরীয় (Badge) পরিত্যাগ কর;” তাঁহারা “বন্দেমাতরং” অঙ্কিত উত্তরীয় পরিত্যাগ করিতে অস্বীকার করিলেন। তখন কেম্প বলপূর্ব্বক উত্তরীয় কাড়িয়া লইবার উদ্যোগ করিলেন। তাঁহারা হস্ত দ্বারা বক্ষোপরিস্থ উত্তরীয় চাপিয়া ধরিলেন। তখন কেম্প স্বয়ং ও তাহার অনুচর পুলিশ তাঁহাদিগকে প্রহার করিতে লাগিল। তখন তাঁহারা “বন্দেমাতরম্” ধ্বনি করিয়া অটল অচলের ন্যায় রাজপথে দণ্ডায়মান হইলেন। কেম্প ও পুলিশ বলপূর্ব্বক তাঁহাদের উত্তরীয় অপহরণ করিতে লাগিল। ইহাদের উপর অবিশ্রান্ত লাঠি বৃষ্টি হইতে লাগিল, তথাপি ইহারা ছত্রভঙ্গ হইলেন না, বন্দেমাতরম্ ধ্বনিতে চতুর্দ্দিক প্রতিধ্বনিত করিতে লাগিলেন। পুলিশের লাঠিতে শচীন্দ্র প্রসাদের বদনমণ্ডল ফাটিয়া রক্তপাত হইল। ফণীন্দ্রনাথের সর্ব্বাঙ্গ লাঠিতে ক্ষত বিক্ষত হইল, বীরেন্দ্র, সুরেন্দ্র, হেম আহত হইল, তথাপি কেহ বন্দেমাতরম্ বলিতে ক্ষ্যান্ত হইল না। এণ্টিসার্কুলার সোসাইটীর প্রত্যেক প্রতিনিধি আহত হইল, তথাপি কেউ ভীত হইল না। শ্রেণী ভাঙ্গিয়া পলায়ন করিল না।

বাবু বিপিনচন্দ্র পাল

 গোলযোগের প্রারম্ভকালে লোন আফিসের অলিন্দোপরি দ্রুত-পদবিক্ষেপে গমন করিলেন, আর
শ্রীযুক্ত ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়

 ‘আত্মশক্তির” উপর নির্ভর করিয়া “সমাজের অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশের” আশায় শনৈঃ শনৈঃ প্রাচীর উল্লঙ্ঘন পূর্ব্বক সেই স্থান ত্যাগ করিলেন।