১৯০৫ সালে বাংলা/বরিশাল প্রাদেশিক সমিতি



বরিশালে প্রাদেশিক সমিতি।



বিস্তারিত বিবরণ।



ষ্টিমার পথে।

 বঙ্গদেশে কেন, সমগ্র বৃটিশ ভারতে এ পর্য্যন্ত যাহা কখনও ঘটে নাই যাহা ঘটিতে পারে বলিয়া কেহ কখনও কল্পনা করিতে পারে নাই, গত ১৩১৩ সালের ১লা ও ২রা বৈশাখ বরিশালে ফুলার লাটের অনুগ্রহে তাহাই ঘটিয়াছে। এই ঘটনায় একদিকে যেমন ইংরাজ শাসনের ন্যায়পরতা সম্বন্ধে জন-সাধারণের চিত্তে ঘোর অবিশ্বাসের সঞ্চার হইয়াছে, অন্যদিকে সেইরূপ বাঙ্গালীর জীবনে নূতন উদ্দীপনার সমাগম হইয়াছে, এক দিকে সভ্যতাভিমানী ইংরাজ শাসনকর্ত্তাদিগের বিচার দেখিয়া যেমন বাঙ্গালীর মোহ ভঙ্গ হইয়াছে, অন্যদিকে সেইরূপ আত্মনির্ভরশীলতার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিয়া বাঙ্গালী জাতীয় জীবনে নূতন শক্তি সঞ্চয়ে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছে। বাঙ্গালীর সাহস ও একতার পরিচয়ও এই ঘটনায় যথেষ্ট পাওয়া গিয়াছে।

 কলিকাতা হইতে প্রস্থানের পর বাবু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মাননীয় যোগেশচন্দ্র চৌধুরী, শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ প্রভৃতি প্রতিনিধিগণ ও স্বদেশ-সেবক সম্প্রদায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে বিরাট স্বদেশী সভার অধিবেশন করিয়া ষ্টিমার যোগে বরিশালে গমন করিতেছিলেন। বরিশালের স্বেচ্ছা সেবকেরা কলিকাতার প্রতিনিধিদিগের প্রত্যুদ্গমনের জন্য খুলনা পর্য্যন্ত আগমন করিয়াছিলেন। তথা হইতে ষ্টিমারের প্রত্যেক ঘাটেই স্থানীয় অধিবাসিগণের অভ্যর্থনার জন্য বিবিধ বর্ণের পতাকা হস্তে সমবেত হইয়া “বন্দে মাতরম্” ধ্বনি সহকারে চতুর্দ্দিক কম্পিত করিয়াছিলেন। খুলনার ষ্টীমার ঘাটে সভাপতি মহাশয়ের যথোচিত সম্বৰ্দ্ধনা হইয়াছিল।

 পূর্ব্ববঙ্গের ষ্টীমারষ্টেসনে বহু প্রহরী বড় বড় লাঠী হস্তে লইয়া “বন্দেমাতরম্” ধ্বনি নিবারণের জন্য উপস্থিত ছিল। ষ্টীমার হইতে প্রতিনিধিগণ তীরস্থ ব্যক্তিদিগকে “বন্দেমাতরম্” বলিয়া অভিবাদন করিলেন। কিন্তু পুলিশের ভয়ে তীরস্থ লোকেরা প্রথমে “বন্দে মাতরম্‌” বলিয়া তাঁহাদিগের প্রত্যভিবাদন করিতে পারেন নাই। কিন্তু তাহার পর যখন এণ্টিসার্কুলার সোসাইটির যুবকদিগের মধ্যে দুই একজন অগ্রসর হইয়া বলিলেন, “বল ভাই বন্দেমাতরম্‌। যদি বাঙ্গালী হও, তবে আজ প্রাণ খুলিয়া বল, বন্দে মাতরম্‌, জীবন ধন্য হউক।” এই কথায় বালির বাঁধ ভাঙ্গিয়া গেল, লগুড়ধারী পুলিশ প্রহরীর ভয় ঘুচিল। তীর হইতে সহস্ৰ সহস্র কণ্ঠে চতুর্দ্দিক মুখরিত করিয়া ধ্বনি উঠিল “বন্দেমাতরম্‌”। অনেক স্থানেই এইরূপ হইয়াছিল, পুলিশ প্রহরীরাও ভয়ে উচ্চবাচ্য করে নাই। মাঠের কৃষকেরা পর্য্যন্ত লাঙ্গল ছাড়িয়া নদীতীরে সমবেত হইয়া সেই বন্দেমাতরম্ উচ্চারণে যোগদান করিয়াছিল।

সভাপতি মিঃ এ রসুল মহোদয়ের অভ্যর্থনার জন্য প্রত্যেক ষ্টীমার ষ্টেশনই স্থানীয় অধিবাসীগণের দ্বারা পত্রপুষ্প কদলীবৃক্ষে ও আম্র পল্লবে সজ্জিত হইয়াছিল।

স্বতন্ত্র পথে।

 খুলনার পথে এই। নারায়ণগঞ্জের পথে সুরেন্দ্রনাথের ষ্টীমারে আরও উৎসাহপূর্ণ দৃশ্য পরিলক্ষিত হইয়াছিল। ফরিদপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ প্রভৃতি স্থানের প্রতিনিধিবর্গ এই জাহাজেই কোন প্রকারে স্থান করিয়া লইয়াছিলেন। “বন্দেমাতরম্” ধ্বনির সহিত “সুরেন্দ্রনাথের জয়” “সুরেন্দ্রনাথের জয়” ইত্যাদি ধ্বনি সর্ব্বত্র পরিশ্রুত হইয়াছিল। কুমারীগণ মঙ্গল শঙ্খ নিনাদিত করিয়া তাঁহার অভ্যর্থনা করিয়াছিলেন। মুসলমানেরাও দলবদ্ধ হইয়া প্রায় প্রত্যেক ষ্টীমার ষ্টেশনেই সুরেন্দ্রবাবুর প্রতিনিধিবর্গের অভ্যর্থনার জন্য সাগ্রহে সমবেত হইয়াছিলেন। সুরেন্দ্রনাথকে দেখিবার জন্য সকলেরই বিশেষ ব্যগ্রতা প্রকাশ পাইয়াছিল। ইদিলপুর ষ্টেশনের দৃশ্যই অধিকতর চিত্তাকর্ষক হইয়াছিল। সেখানকার লোকেরা ৫ খানি নৌকা “বন্দে মাতরম্”, Long live our Banerjee, আমাদের বাড়ুয্যে দীর্ঘজীবী হউন ইত্যাদি শব্দাঙ্কিত পতাকা নিচয়ে সজ্জিত করিয়া ষ্টীমারের নিকট উপস্থিত হইয়াছিলেন এবং পুষ্পমাল্যে সুরেন্দ্রনাথ ও তাঁহার সহগামী প্রতিনিধিদিগকে ভূষিত করিয়াছিলেন। নৌকাগুলি স্থানীয় ভদ্র মহোদয়গণে এরূপ পরিপূর্ণ হইয়াছিল যে, নৌকায় তিল ধারণের স্থান ছিল না। নৌকাস্থিত মহোদয়েরা ষ্টীমারে উঠিয়া “বন্দে মাতরম্” প্রভৃতি শব্দাঙ্কিত পতাকা দিয়া ষ্টিমারটিকে সজ্জিত করিয়াছিলেন। সুরেন্দ্রনাথের অনেক সহযাত্রী তাঁহার সম্মানের অংশ পাইয়াছিলেন।

“রাজেন্দ্র সঙ্গমে
দীন যথা যায় দূর তীর্থ দরশনে।”

 তাঁহার সঙ্গে অনেকে সেইরূপ সুখে বরিশালে গমন করিয়াছিলেন। কতদূর হইতে কত প্রবীণ অশীতিপর বৃদ্ধ সুরেন্দ্র বাবুকে দেখিতে আসিয়াছিলেন ভাবিলে হৃদয় আনন্দে আপ্লুত হয়। কৃষক বালিকা হইতে অধ্যাপক ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা পর্য্যন্ত নদীর তীরে সারি দিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। তাঁহাদিগের সকলের নিকটেই সুরেন্দ্র বাবুর এক নিবেদন—“আপনারা স্বদেশী বস্তুর প্রচার ও ব্যবহার করুন, বিদেশী দ্রব্যের পরিবর্জ্জন করুন।”

বরিশালে পদার্পণ।

 শুক্রবার রাত্রি আটটার সময় কলিকাতা, যশোহর, খুলনা, ঢাকা, রংপুর, বগুড়া, প্রভৃতি স্থানের প্রতিনিধিগণকে লইয়া ষ্টিমার বরিশালে উপস্থিত হইল। ষ্টীমার ঘাটে লাগিবামাত্র সমাগত প্রতিনিধিগণ উচ্চ কণ্ঠে “বন্দে মাতরম্” ধ্বনি করিলেন। তীরে বরিশালের মান্যগণ্য লোকেরা তাঁহাদিগের অভার্থনার জন্য

১। শ্রীমান্ চিত্তরঞ্জন গুহ ২। শ্রীমান্ বজেন্দ্রকিশোর গাঙ্গুলী।
৩। শ্রীযুক্ত মনোরঞ্জন গুহ ঠাকুরতা।  ৪। জনৈক স্বেচ্ছাসেবক।
উপস্থিত হইয়াছিলেন। কিন্তু কেহই প্রতিনিধিগণের জয়ধ্বনির উত্তরে “বন্দে মাতরম্” বলিয়া প্রতিধ্বনি করিলেন না। তখন প্রতিনিধিগণের মধ্যেই যাঁহারা প্রধান, তাঁহারা পরামর্শ করিয়া স্থির করিলেন যে, “বন্দে মাতরম্” ধ্বনিতে বরিশালের রাজপথ প্রতিধ্বনিত করিতে হইবে। বরিশালের নেতৃবর্গ ষ্টীমারে উঠিয়া সুরেন্দ্র বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া বলিলেন,—ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব রাজপথে “বন্দে মাতরম্” বলিতে নিষেধ করিয়াছেন এবং দলবদ্ধভাবে রাজপথ দিয়া সভাপতি রসুল সাহেবকে লইয়া যাইতেও নিষেধ করিয়াছেন। অতএব সকলে নীরবে ষ্টীমার হইতে অবতরণ করিয়া ভূকৈলাসের রাজবাটীতে চলুন। সেখানে “বন্দে মাতরম্” ধ্বনি প্রাণ ভরিয়া করা যাইবে, প্রতিনিধিগণের যথোচিত অভ্যর্থনাও সেইখানেই হইবে। অনুরোধ পালনে প্রতিনিধিবর্গের মধ্যে অনেকেই সম্মত হইলেন। কিন্তু এণ্টিসারকুলার সোসাইটীর প্রতিনিধিগণ বলিলেন “ম্যাজিষ্ট্রেটের আইন বিরুদ্ধ আদেশ আমরা মানিতে পারিব না। যদি “বন্দে মাতরম্” বলিতে দেওয়া না হয়, তবে আমরা কনফারেন্সে যোগদান করিব না।” অনেকে এণ্টীসারকুলার সোসাইটীর প্রতিনিধিগণের মতের সমর্থন করিলেন।

দ্বিতীয় জাহাজের আগমন।

 এই সকল প্রতিনিধি ঘাটে প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন এমন সময়ে নারায়ণগঞ্জের জাহাজে সুরেন্দ্র বাবু প্রভৃতি বরিশালে আসিলেন। জাহাজ হইতে বন্দে মাতরম্ শব্দ উঠিল, তীর হইতেও পূর্ব্ব জাহাজে সমাগত প্রতিনিধিমণ্ডলী সেই পবিত্র শব্দের প্রতিধ্বনিতে তীরভূমি কাঁপাইয়া তুলিলেন। তখন ভূপেন্দ্রনাথ প্রভৃতি প্রথম জাহাজের যাত্রীরা ইঙ্গিতে তাঁহাদিগকে থামাইয়া দ্বিতীয় জাহাজে সুরেন্দ্র বাবু প্রভৃতির সহিত পরামর্শ করিতে আসিলেন। বরিশালের নেতারা বলিলেন এখন পথিমধ্যে পুলিশের সঙ্গে বিবাদ করিলে আমরা অভ্যর্থনার যে উদ্যোগ করিয়াছি সে সকলই পণ্ড হইবে। তর্ক বিতর্কের পর স্থির হইল যে, অন্ততঃ সেদিনকার মত কোন বিবাদ করা হইবে না। প্রতিনিধিরা তখন রাজা বাহাদুরের হাবেলীতে চন্দ্রাতপ তলে গমন করিলেন। রীতিমত অভ্যর্থনা হইলে যে যার নির্দ্দিষ্ট স্থানে গমন করিলেন।

স্বেচ্ছাসেবক

 বা ভলাণ্টিয়ারদিগের সম্বন্ধে দুই একটি কথা না বলিলে আমাদিগের বিবৃতি সম্পূর্ণ হইতে পারে না। সম্ভ্রান্ত বংশ সম্ভূত উচ্চপদস্থ ভদ্র সন্তানগণ সামান্য ভৃত্যের ন্যায় অভ্যাগতদিগের পরিচর্য্যায় কিরূপ আগ্রহ সহকারে রত হইয়াছিলেন, তাহা বলিয়া বুঝান দুঃসাধ্য। পুলিশ কুলিদিগকে উত্তেজিত করিয়া ভারবহনে অপ্রবৃত্ত করিলে এই মহোদয়গণের গুণে সেজন্য কাহারও কোন কষ্ট হয় নাই। দলে দলে ভদ্র সন্তানেরা মাথায় মোট লইয়া প্রতিনিধিদিগের জন্য নির্দ্দিষ্ট বাসায় উপনীত হন। এ দৃশ্য যিনি দেখিয়াছেন তিনি কখনই ভুলিতে পারিবেন না। ইঁহাদিগের শ্রমশীলতা, কষ্টসহিষ্ণুতা, আজ্ঞানুবর্ত্তিতা প্রভৃতি সদ্গুণ সকলেরই অনুকরণীয়।