ময়মনসিংহ।

 রাজপথের ধারে মারওয়াড়ী ব্যাপারীরা বিলাতী কাপড় বিক্রয় করে দেখিয়া কতিপয় ছাত্র ও যুবক অগ্রহায়ণ মাসের শেষভাগে দেশীয় কাপড় বিক্রয় করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। তাহাতে বিলাতী পণ্যের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া পুলিশের সহায়তা প্রার্থনা করে। ম্যাজিষ্ট্রেট পথের ধারে ছাত্রদিগের পণ্য বিক্রয় করা রহিত করিয়া দিবার জন্য মিউনিসিপাল চেয়ারম্যান্ বাবু শ্যামাচরণ রায়কে লিখিয়া পাঠান। শ্যামাচরণ বাবু কি বিলাতী কি স্বদেশী কোন প্রকার পণ্য পথের ধারে বিক্রয় করিতে দেওয়া হইবে না এই আদেশ প্রচার করেন। ম্যাজিষ্ট্রেট পুঙ্গব ইহাতে ক্রুদ্ধ হইয়া শ্যামাচরণ বাবু কেন বিলাতী বিক্রয়ে বাধা দিতেছেন জানিতে চাহেন। শ্যামাচরণ বাবু মারওয়াড়ীদিগের ও ছাত্রদিগের বস্ত্রবিক্রয় ব্যাপারে নিয়মের কোন তারতম্য করিতে স্বীকার না করায় ম্যাজিষ্ট্রেট বাহাদুর তাঁহাকে নিজ প্রকৃতি সুলভ ভাষায় ভয় প্রদর্শন করেন এবং পদচ্যুত করিতে চাহেন। শ্যামাচরণ বাবুও ছাড়িবার পাত্র নহেন, নিজ পদমর্য্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখিয়া ম্যাজিষ্ট্রেটকে উপযুক্ত উত্তর দান করেন এবং পদচ্যুত করিবার অধিকার ম্যাজিষ্ট্রেটের নাই ইহা ক্রুদ্ধ হুজুরকে বুঝাইয়া দেন।

 এ দিকে মারওয়াড়িরা বিলাতী কাপড় বেচিতেছে কি না দেখিবার জন্য যুবকেরা পথের ধারে যায়। পুলিশ এই উপলক্ষে তাহাদিগের সহিত বিবাদ বাধাইয়া দাঙ্গা করে। তজ্জন্য শ্রীযুক্ত খগেন্দ্রজীবন রায়, মেঘনাথ দাস, হরকিশোর ধর, ধীরেন্দ্রচন্দ্র রায়, সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ এবং একজন মুসলমান ধৃত হন। মুসলমান যুবককে নাম জিজ্ঞাসা করিয়াই ছাড়িয়া দেওয়া হয়। অবশিষ্ট যুবকদিগের নামে দণ্ডবিধির ১৪৪, ১৪৫, ১৪৮, ১৪৯, ৩২৫, ৩২৬, ৩৫৩ ধারা অনুসারে অভিযোগ হয়, এবং বহু কষ্টে পাঁচশত টাকা করিয়া জামীন লইয়া তাঁহাদিগকে থানা হইতে ছাড়িয়া দেওয়া হয়।

 এই ঘটনা ২১শে অগ্রহায়ণ বৃহস্পতিবার ঘটে। আরও কয়েক জন ভদ্রলোক ধৃত হন। বাবু সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ নামক যে ভদ্রলোক ধৃত ও একরাত্রি হাজতে আবদ্ধ হন তিনি পাটের আফিসে কার্য্য করিতেন, ছাত্র নহেন। এতদ্ভিন্ন জজকোর্টের উকীল বাবু দ্বারিকানাথ বসু, ও বাবু ললিতচন্দ্র দে এবং দেবেন্দ্র চন্দ্র আইচ লাঞ্ছনার জন্য পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করিয়াছিলেন। বাবু সুরেন্দ্রনাথ চৌধুরী নামক আর একজন ভদ্রলোক অকারণে ধৃত ও লাঞ্ছিত হন।

 সে যাহা হউক, গত ২২শে ফেব্রুয়ারি বিচারের রায় বাহির হয়। খগেন্দ্র, মেঘনাদ, ধীরেন্দ্র ও সুরেন্দ্র চৌধুরী, প্রত্যেকে পঞ্চদশ দিবসের জন্য সপরিশ্রম কারাবাসের এবং একশত টাকা করিয়া অর্থদণ্ডের আদেশ প্রাপ্ত হন। ললিত ও সুরেন্দ্রমোহন প্রত্যেকের একশত টাকা করিয়া জরিমানা হয়।

 ময়মনসিংহ এডওয়ার্ড স্কুলের হেড্‌ মাষ্টার বাবু বিপিনচন্দ্র দাস গুপ্ত কিরূপে স্থানীয় কর্ত্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হন তাহা অনেকেরই স্মরণ আছে। কিরূপে বিপিন বাবুকে বিরক্ত করা হইয়াছিল, তাঁহার নামে অভিযোগ, স্কুল ইন্স্পেক্টরের পীড়াপীড়ি, বিপিন বাবুকে পদত্যাগ করাইবার প্রয়াস, প্রভৃতি ধারাবাহিকরূপে বিবৃত করিলে একটী সুদীর্ঘ প্রবন্ধ হইয়া পড়ে। সুতরাং আমরা সে বিষয়ে কোন কথা না বলিয়া বিপিন বাবুর নিজের একটী উক্তি অবিকল উদ্ধৃত করিলাম তাহাতেই প্রত্যেক বিষয়ের এবং বিপিন বাবুর স্বদেশানুরাগের ও সৎসাহসের যথেষ্ট আভাষ পাওয়া যাইবে।

 With reference to your memo No. 5442, dated Dacca, the 22nd December 1905, and to your office No. 402, dated the 1st February 1905, I have the honour to state that the District Magistrate of Mymensingh on the strength of D. S. P’s report, called upon me for an explanation of my conduct on the 1st December 1905. The Magistrate after receiving my explanation reported against my school to the Commissioner of the Dacca Division, laying a fresh charge upon the school, namely “the conduct of my boys in the Barabazar.” As a copy of my explanation No. 17, dated the 2nd December 1905 has been forwarded to you by the Magistrate, it is needless to repeat my arguments again. With regard to the latter charge, I humbly beg to submit that the statement that the Edward School boys were conspicuous in the Barabazar riot and in the previous picketing is without any basis. It is a patent fact that my boys were not implicated in the riot; only one boy of my school was arrested by the Police on the day of occurrence, not because he took part in the riot but because he simply happened to be there. He had a stall in the bazar and he used to sell country made guernsey frocks in the evening. Eye witnesses say that he was dragged by the Police from the Verandah of a building where he was standing. Whatever that may be, it can hardly be expected that a Head master should keep every boy of his school under control beyond school hours.

 বিপিন বাবুর নামে যে মোকদ্দমা হইয়াছিল তাহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এইস্থলে সংবাদপত্র হইতে সঙ্কলিত করা গেল। সে বিবরণ এই—

 “এডওয়ার্ড স্কুলের হেড্মাষ্টার বাবু বিপিনচন্দ্র দাস গুপ্ত বি-এ পুলিশ ইন্স্পেক্টর বাবু গোপালচন্দ্র মুখার্জ্জির আদেশ অনুসারে স্কুলের ছাত্রগণের উপস্থিতি বহি পুলিশ সাহেবের নিকট নির্দ্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত করেন নাই এই অবজ্ঞা প্রকাশ অপরাধে ময়মনসিংহের জয়েণ্ট ম্যাজিষ্ট্রেট্ মেঃ গারলিক বিপিনবাবুর প্রতি পাঁচ দিবসের জন্য কারাবাস ও ৬০৲ টাকা অর্থদণ্ডের আদেশ করেন। গত ১২ই চৈত্র সেসন জজের সমীপে বিপিন বাবুর আপীলের শুনানী হইয়াছিল। মিঃ বসু বিপিন বাবুর পক্ষ সমর্থন করেন ও পাবলিক প্রসিকিউটার বাবু শশাঙ্কমোহন ঘোষ গবর্ণমেণ্ট পক্ষে উপস্থিত হন। উভয় পক্ষের বক্তৃতা শুনার পর জজ সাহেব রায় প্রকাশ করেন। বিপিনবাবু আপীলে মুক্তিলাভ করেন।”

 স্বদেশী আন্দোলনের নিমিত্ত সাহসপূর্ণ প্রত্যুত্তর দানের জন্য বাবু তারানাথ বলকে অবৈতনিক ম্যাজিষ্ট্রেট ও মিউনিসিপাল কমিশনর কার্য্য হইতে অপসারিত করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। আসাম বঙ্গ লাটের আদেশ এই;—



NOTIFICATION.

The 9th Feb. 1906.

 No. 820 J. C. Babu Taranath Bal, Magistrate of the 2nd class in the District of Mymensing, is now removed from his office under sec. 26 of the Code of Criminal Procedure, Act V of 1898.

P. C. LYON. 
Chief Secretary.

Memo No. 821

Dated the 9th Feb. 1906.

 Copy forwarded to the Commissioner Dacca for information and favour of communication to the Honorary Magistrate who should be informed that it was passed after consideration of his letter to the District Magistrate dated the 9th December 1906.

By order &c. 
P. C. Lyon.
Chief Secretary.

 বাবু তারানাথ বলকে রৌপ্য দোলক ও বাবু শ্যামাচরণ রায় এবং বাবু বিপিন চন্দ্র দাশগুপ্ত, এই দুইজন মহাত্মাকে “বন্দেমাতরম্” চিহ্নাঙ্কিত রজতবন্ধনী বা ব্রুচ দেওয়া হইয়াছিল। বাবু খগেন্দ্র জীবন রায়কে রৌপ্য পদক ও অন্যান্য যুবকদিগকে “বন্দে মাতরম্” লকেট বা রৌপ্য পরিদোলক প্রেরণ করা হইয়াছিল।

 ময়মনসিংহের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যদি বঙ্গের অন্যান্য স্থানে অনুকৃত হয় তাহা হইলে ইহাদিগের লাঞ্ছনাভোগ সার্থক হইয়াছে একথা সকলেই বুঝিবেন। ময়মনসিংহের অন্যতম নেতা পুণ্যশ্লোক বাবু অনাথবন্ধু গুহের উপর বিতরণের ভার অর্পিত হইয়াছিল।

বল্লা—ময়মনসিংহ।

 আবদুল রসীদ নামক একব্যক্তি দ্বারা রাজেন্দ্রলাল সাহা নামক একটী সপ্তদশ বৎসর বয়স্ক বালকের বিরুদ্ধে দাঙ্গা প্রভৃতির দাবীতে দণ্ডবিধির ১৪৭ ও ৩৭৯ ধারায় অভিযোগ উপস্থাপিত করা হয়। বিচারালয়ে বালক রাজেন্দ্র বিদেশী কলমে নাম স্বাক্ষর করিতে চাহে নাই। তাহার দুই সপ্তাহ কঠোর কারাবাস ও ৬০৲ টাকা জরিমানা হইয়াছিল! সম্মান প্রদর্শনের দিবসে মোকর্দ্দমা বিচারাধীন ছিল, তথাপি সর্ব্বসম্মতিক্রমে “বন্দেমাতরম্” শব্দাঙ্কিত রজত বন্ধনী বা ব্রুচ তাঁহাকে প্রদত্ত হয়।

ময়মনসিংহ—টাঙ্গাইল।

 ডাক্তার শশিধর নিয়োগী পুলিশ দ্বারা গুরুতর ভাবে প্রহৃত হন। তাঁহাকে রজত পরিদোলক প্রদানে অনুরাগ প্রকাশ করা হইয়াছিল।

বরিশাল—মাধবপাশা।

 শ্রীযুক্ত বিলাসচন্দ্র কুঞ্জবিল্ব সেটেলমেণ্ট অফিসারকে “বন্দেমাতরং” শব্দে অভিনন্দন করিয়া দণ্ড বিধির ১৫৭ ও ১০৬ ধারা মতে অভিযুক্ত হন। বিচারে তাঁহার দুই মাসের জন্য কঠোর কারাবাস এবং দেড়শত টাকার মুচলেখা লওয়া হইয়াছিল।

 বরিশাল বিভাগের যে সকল মহাত্মা কলিকাতার সভায় উপস্থিত থাকিতে পারেন নাই তাঁহাদিগের প্রতি প্রদর্শিত সম্মানের নিদর্শন আমাদিগের অন্যতম নেতা অশ্বিনীবাবুর নিকট প্রেরিত হইয়াছিল।

হ্যারিসন রোড।

 কলিকাতা হ্যারিসন রোডে বিদেশীদ্রব্যবর্জ্জন প্রস্তাবের পোষকতা করিবার উদ্যমে পুলিশের সহিত একদল যুবকের দাঙ্গা হয়। বলা বাহুল্য এ প্রসঙ্গে পুলিশ অকারণে অনেক পথিককেও আসামী করিয়াছিল। বাবু যতীন্দ্রনাথ সিংহ নামক একজন কলিকাতা কলেজের ছাত্র এই ব্যাপারে ধৃত ও চারিজন ইংরাজ ও হিন্দূস্থানী কনষ্টেবল দ্বারা থানায় নীত হন। তাঁহাকে পুলিশ যখন নিজের স্থানে পাইয়া জিজ্ঞাসা করিল—এখন তোমার “বন্দে মাতরম্” কোথায়? যুবা অম্লান বদনে বলিলেন এই বুকের ভিতর “বন্দে মাতরম্” রহিয়াছে।

 বাবু জ্ঞানেন্দ্র নাথ সিংহ, বীরেন্দ্র নাথ মৈত্র প্রভৃতি এই মোকদ্দমায় আসামী ছিলেন। এ অভিযোগের মীমাংসা অনেকের চেষ্টায় “আপোস” হয়। যতীন্দ্রবাবুর বিরুদ্ধে মেডিকেল কলেজের অনেকেই খড়্গহস্ত হওয়াতে তিনি চিকিৎসা শিক্ষা পরিত্যাগ পূর্ব্বক আইন শিক্ষার্থ বিলাত যাত্রা করেন। যাইবার পূর্ব্বে তিনি সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলেন, তখনও তাঁহার স্বদেশানুরাগ ও উৎসাহের নিদর্শন যেন বদনমণ্ডলে পরিস্ফুট হইয়া উঠিতেছিল। ইহাঁদিগকে রজত দোলকাদি নিদর্শনে সম্মানিত করা হইয়াছিল।

 সর্ব্বশুদ্ধ মেডাল ২১টা’ লকেট ৫০টা ও ব্রূচ ১০টা প্রস্তুত হইয়াছিল।