১৯০৫ সালে বাংলা/সুরেন্দ্রবাবুর অবরোধ
সুরেন্দ্র বাবুর অবরোধ।
বাবু ললিতমোহন ঘোষালের গগনভেদী স্বরে অগ্রগামী নেতারা যখন জানিতে পারিলেন যে পশ্চাদ্ ভাগের শ্রেণীতে যুবকদিগের উপর লাঠি চালাইতেছে, তখন তাঁহারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইলেন। সুরেন্দ্র বাবুকে দেখিয়া সকলের উৎসাহ বৃদ্ধি পাইল। পুলিশদলেও একটা হৈ চৈ পড়িয়া গেল। কনষ্টেবলগণ লাঠি স্কন্ধে করিয়া রুদ্ধশ্বাসে সেই দিকে দৌড়িয়া গেল। কেম্পও সেই দিকে ধাবিত হইলেন। কিঞ্চিৎকাল পরে কেম্প সুরেন্দ্র বাবুকে বন্দী করিয়া ফটকের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। পশ্চাতে লাঠির আঘাতে প্রতিনিধিদিগের দেহ ক্ষত বিক্ষত করিতেছে, ইহা শুনিতে পাইয়া বাবু সুরেন্দ্রনাথ, মতিলাল, ভূপেন্দ্রনাথ প্রভৃতি ফিরিয়া আসিতেছিলেন। সম্মুখে কেম্পকে দেখিতে পাইয়া সুরেন্দ্র বাবু বলিলেন, “এসব কি হইতেছে? যদি কোন বে-আইনী কাজ করিয়া থাকি, তবে আমাদিকে অবরুদ্ধ করিতে পার, কিন্তু কাহাকেও প্রহার করার অধিকার তোমাদিগের নাই। যদি ইচ্ছা হয়, আমাকে বন্দী করিতে পার। কেম্প বলিলেন “আপনাকে গ্রেপ্তার করিলাম।” সুরেন্দ্র বাবু তখন বলিলেন, “বেশ গ্রেপ্তার কর ক্ষতি নাই, আমার ঘাড়ে সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ করিতেছি। কাহাকেও প্রহার করিও না।” তখন মতি বাবু, ভূপেন্দ্র বাবু প্রভৃতি পশ্চাদ্ধিকে আসিয়া বলিলেন, “আমাদিগকেও গ্রেপ্তার কর।‘’ চারিদিক হইতে বহু লোক বলিলেন, “আমাদিগকেও গ্রেপ্তার কর।” কেম্প বলিলেন আপনাদিগকে গ্রেপ্তার করিবার হুকুম নাই। কেম্প সুরেন্দ্র বাবুকে লইয়া ম্যাজিষ্ট্রেটের বাড়ী গেলেন। লাকুটিয়ার মনস্বী জমীদার বাবু বিহারীলাল রায়, শ্রীযুক্ত অশ্বিনীকুমার দত্ত ও শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ তাঁহার সঙ্গে গমন করিলেন। গমনকালে সুরেন্দ্র বাবু অপর সকলকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “আপনারা মণ্ডপে গমন করিয়া কার্য্য নির্ব্বাহ করুন।”
শ্রীযুক্ত যোগেশচন্দ্র চৌধুরী।
সুরেন্দ্রনাথের এই অবরোধের অব্যবহিত পূর্ব্বে শ্রীযুক্ত অনারেবল মিঃ জে, চৌধুরী ফটকের সম্মুখে আসিয়া কেম্পকে বলিলেন, “তুমি পুলিশকে শাসনে রাখিতে পারিতেছ না।” কেম্প বলিলেন, “আমার কর্ত্তব্য কর্ম্ম আমি বেশ জানি।” একজন কনেষ্টবল আসিয়া মিঃ চৌধুরীর মাথায় লাঠি মারিয়াছিল। তাঁহার মাথায় টুপী না থাকিলে বোধ হয় তাঁহার মাথা ফাটিয়া যাইত। সে যাহা হউক, এমন সময়ে হঠাৎ সম্মুখে গভীর “বন্দে মাতরম্” ধ্বনি হইল। কেম্প তখন সুরেন্দ্র বাবুকে বন্দী করিয়া ম্যাজিষ্ট্রেটের বাটীতে গিয়াছিলেন। সুতরাং আসিষ্টাণ্ট সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট অশ্বে কশাঘাত করিয়া দ্রুতবেগে সেই দিকে ছুটিলেন। প্রকাণ্ড লাঠি উত্তোলন করিয়া পুলিশদল সেই দিকে দৌড়িল। তখন পশ্চাদ্দিক হইতে বন্দেমাতরর্ ধ্বনি হইল। ছোট প্রভু ও পুলিশ আবার পশ্চাদ্ধিকে দৌড়িয়া আসিলেন। তখন সম্মুখে বন্দেমাতরম্ ধ্বনি শুনিয়া আবার পুলিশ সেই দিকে ধাবিত হইল। পুলিশ এইরূপ একবার সম্মুখে, একবার পশ্চাদ্দিকে, ফুটবলের ন্যায় দৌড়াদৌড়ি করিতে লাগিল। সমস্ত প্রতিনিধি রাস্তায় বহির্গত হইয়া বন্দেমাতরম্ রবে নগর প্রতিধ্বনিত করিতে করিতে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। ভাণ্ডার পত্রের অধ্যক্ষ বাবু কেদারনাথ দাস গুপ্ত রাস্তা দিয়া যাইতেছিলেন। ছোট সাহেব ঘোড়ার উপর হইতে তাঁহার পেটে পদাঘাত করিলেন। কেদার বাবু তাঁহরে ঘোড়া ধরিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু ছোট বীর দ্রুতবেগে ঘোড়া ছুটাইয়া চলিয়া গেলেন। সকলের পশ্চাতে বাবু আনন্দচন্দ্র রায়, বাবু অনাথবন্ধু গুহ ও মিঃ জে, চৌধুরীর নির্দ্দিষ্ট স্থানে ছিল। তাঁহারা সমস্ত প্রতিনিধিদিগকে লইয়া অগ্রসর হইতে লাগিলেন। পথে একজন যুবক সভাপতির মুদ্রিত বক্তৃতা লইয়া মণ্ডপের দিকে যাইতেছিলেন। ছোটহুজুর মনে করিলেন ঐ বুঝি রাজদ্রোহসূচক পুস্তিকা লইয়া যাইতেছে। তাই সে কয়েকখানি কাগজ কাড়িয়া লইয়া তিনি প্রস্থান করিলেন।