আমার খাতা/গৃহিনীপনা
গৃহিনীপনা।
আমাকে বাল্যকালে গৃহিনীপনা শিখাইবার মা ব্যতিত আর কেহ ছিল না। আমি দেখিলাম সংসার করিতে হইলে প্রথমে ধৈর্য্য পরে শৃঙ্খলা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব আয়ত্ব করা চাই। শিশুপালন বিদ্যা ও প্রধান। তাহার আনুষঙ্গিক মুষ্টিযোগ ও জানা চাই।
সুশৃঙ্খলা অর্থে সাংসারিক দ্রব্যাদি যথাস্থানে সুবিন্যস্ত ভাবে রাখা ও সমস্ত কাজকর্ম্মে নিজের জীবনকে নিয়মিত ভাবে পরিচালনা করা অর্থাৎ রন্ধনগৃহে পাঠ্যপুস্তক, ভাণ্ডারগৃহে কেশবিন্যাসের দড়ি বা শয়নগৃহে চালের হাঁড়ি এইরূপ উল্টাপাল্টা না হয়। সুব্যবস্থার উদাহরণ স্বরূপ দেখ যে যদি ভাণ্ডার-গৃহে যে সমস্ত দ্রব্যাদি রক্ষিত প্রত্যেকের নাম ছোট কাগজে লিখিয়া পাত্রের গাত্রে আঁটিয়া রাখিলে এই সুবিধা যে, যে প্রত্যহ ভাণ্ডার হইতে দ্রব্যাদি বাহির করিয়া দেয় সে যদি কোন কারণে একদিন না পারে তাহা হইলে অপর কেহ ভাঁড়ার দিতে গিয়া কিসে কি আছে বলিয়া হাঁতড়াইতে হয় না।
আজকাল হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার যে রকম চলন তাহাতে প্রায়ই সকল গৃহস্থের গৃহে অন্ততঃ দু-চারটি শিশি ঔষধ আছেই। কাহারও জ্বর হইলে প্রথমে একোনাইট ৬ ক্রম পরিষ্কার জলে এক ফোঁটা খাওয়াইয়া দিলে অনেক সময়ে জ্বর আর বাঁকা দিকে যাইতে পারে না। আর তাহা যদি ঘরে না থাকে তাহা হইলে আদা চাকা চাকা করিয়া কাটিয়া একটি কাঠিতে তাহা গাঁথিয়া প্রদীপের শিখায় দগ্ধ করিয়া লইয়া মিছরিসহযোগে খাইতে দিলে একোনাইটেরই কার্য্য করিবে, অর্থাৎ জ্বরকে বাঁকা দিকে যাইতে দিবে না। ছোট ছেলের জ্বর ও কাশি থাকিলে সিকি তোলা কালতুলসিপাতার রস কিঞ্চিৎ মধু ও পাঁচ সাত ফোঁটা পানের রস পিত্তলপাত্রে গরম করিয়া তাহা সামান্য গরম থাকিতে থাকিতে তাহা ঐ পরিমাণে সকাল সন্ধ্যা দুইবার খাওয়াইয়া দিবে।
খাঁটি সরিষার তৈলে একটি প্রদীপ প্রজ্বলিত করিয়া এমন ভাবে সলিতা দিবে যাহাতে প্রদীপ জ্বলিবার কালে সলিতা বহিয়া ফোঁটা ফোঁটা জ্বলন্ত তৈল নিম্নে পড়ে; সেই তৈলের ফোঁটা একটা পাত্রে ধরিবে। এইরূপে ধরা তৈলকে দীপ-তেল বলে। এই তেল ছেলেদের ঘুংরি বালসা কাশিতে মালিশ করিলে এমন কি ঘায়ে লাগাইলে বিশেষ উপকার হয়। জ্বরের সঙ্গে যদি ছোট ছেলেদের হাঁপানী কাশি থাকে তবে একটি লৌহের পলায় খাঁটি সরিষার তৈল রাখিয়া প্রদীপের উপরে ধরিয়া গরম করিবে; তৈল গরম হইলে তাহাতে কিঞ্চি সৈন্ধবলবণের গুঁড়া নিক্ষেপ করিবে; যখন ফেণা উঠিবে তখন সেই তেল বুকে হাতের পায়ের তেলোয় মাথায় ব্রহ্মরন্ধ্রে দিলে হাঁপানি সারে।
রক্ত আমাশায় জানি হরিতকী পাঁচ সাতটি নূতন সরায় গব্যঘৃতে ভাজিয়া চূর্ণ করিয়া সূক্ষ্ম বস্ত্রে ছাঁকিয়া লইয়া দুই তিন বার খাইতে দিলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আরোগ্য হইতে দেখা গিয়াছে।
কাশির পাঁচন—জ্যেষ্ঠমধু গোলমরিচ লবঙ্গ কাল তুলসীমঞ্জরী শুঁট ও মিছরি প্রত্যেক দ্রব্য আধ তোলা হিসাবে মিশ্রিত করিয়া আর যদি দাস্ত পরিষ্কার না থাকে তাহা হইলে জানি হরিতকী ও কিসমিস দুইটিই অর্দ্ধতোলা হিসাবে সংযোগ করিয়া একটি হাঁড়িতে অর্দ্ধসের জলে সিদ্ধ করিয়া অর্দ্ধ পোয়া থাকিতে নামাইবে; এই পাঁচন দুই তিন বার খাইতে দিলে আশাতীত ফল পাওয়া যাইবে।
ক্ষত ফোড়া পাকাইবার ও শুকাইবার ঘি—অর্দ্ধসের মহিষের ঘৃতে গ্যাঁদা পাতা ১ তোলা, রশুন ১ তোলা, নিমপাতা ১ তোলা, এই কয়টি দ্রব্য ভাজিয়া ছাঁকিয়া ফেলিয়া দিবে সেই অবশিষ্ট ঘৃত ক্ষত স্থানে ও ফোড়ায় লাগাইলে আবোগ্য হয়।
রন্ধনবিদ্যায় পারদর্শী হওয়া গৃহিনীপনার আর একটি লক্ষণ কিন্তু সে বিষয়ে বিপ্রদাস বাবু ও প্রজ্ঞাসুন্দরীর পুস্তকের কাছে আমার রন্ধন বিষয়ে উপদেশ দিতে যাওয়া বাতুলতা মাত্র। তবে যা দু-একটি দিলাম তাহা আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতার ফল।
চাট্নি—বাঁধা কপি সরু সরু করিয়া কাটিয়া জলে সিদ্ধ করিয়া পাত্রে রাখ,পরে কড়ায় তেল চড়াইয়া ঐ সিদ্ধ কপিকে ভাজিয়া পৃথক রাখ, পরে একটি পাত্রে পরিমাণ মত তেঁতুল চিনি কিম্বা গুড় গুলিয়া রাখিয়া তাহাতে সামান্য হলুদবাটা দেও, পরে আবার কড়ায় তেল চড়াইয়া তেল পাকা হইলে মেতি ও সরিষা ফোড়ন দেও, তেঁতুলগোলাটি ঢালিয়া ভাজা কপিগুলি তাহাতে ছাড়িয়া দিয়া সামান্য দুটি ময়দা দিয়া ঘন ঘন হইলে নামাইয়া লও। ভাত লুচি উভয়ের সঙ্গে ইহা চলিবে।
নারিকেলের মালপোয়া—একসের ময়দা নারিকেল জলে কিম্বা দুধে গুলিয়া তাহাতে আধপোয়া চিনি মিশ্রিত করিয়া কিঞ্চিৎ ঝুনা নারিকেল কোরা দিয়া কিঞ্চিৎ ছোট এলাচের গুঁড়া তাহার সহিত মিশ্রিত করিবে; একসের চিনির রস করিয়া একটি পৃথক পাত্রে রাখিবে; কড়ায় অর্দ্ধসের ঘৃত চড়াইয়া ঐ ময়দা গোলা গোল গোল করিয়া ভাজিয়া পূর্ব্বপাত্রস্থিত রসে নিক্ষেপ করিবে; অর্দ্ধ ঘণ্টা পরে তাহা আহারের উপহোগী হইবে।
আমি এইখানে আমার গৃহিনীপনা মধুরেণ সমাপন করিলাম।