আমার খাতা/ভ্রমণকাহিনী
ভ্রমণ-কাহিনী।
৬ই মাঘ রাত্রি ৭ঘটিকার সময় রেল পথে বালিগঞ্জ স্টেশন হইতে আশা ও ভরসাশূন্য হৃদয় লইয়া শিশুপুত্র কন্যাদের রাখিয়া রজনীর অন্ধকারে ভ্রমণে বাহির হইলাম। কোথায় যাইব, কি করিব, কিছুই স্থির করিয়া বাড়ীর বাহির হই নাই। তবে ২০ দিনের মধ্যে বাড়ী ফিরিব একথা বাড়ীতে বলিয়া ও যৎসামান্য কাপড় ও দুইখানি পুস্তক লইয়া বালীগঞ্জে রেলে উঠিয়া সেখান হইতে বেলেঘাটা হইয়া গাড়ী করিয়া হাবড়ার স্টেশনে পৌঁছিলাম। আমার প্রধান তীর্থ মধুপুরে সর্ব্বপ্রথম যাইব এই মনস্থ করিয়া রেলে উঠিলাম। সঙ্গে আমার খুল্লতাত-পুত্র ছিলেন। আমি মেয়েদের গাড়ীতে, আমার ভাই অন্য গাড়ীতে উঠিয়া বসিয়াছি, কিছুক্ষণ পরে দেখি একটি মেয়ে উঠিল। ভাবিলাম নিঃসঙ্গ যাওয়া অপেক্ষা একটি সঙ্গী জুটিল ভালই হইল। তাহার পরিচয় জানিলাম, তাহার স্বামী ধানবাদে কাজ করে, সেও সেইখানে যাইতেছে, রাজ-দরশনে আসিয়াছিল। তাহার ঘরের কথা ও সুখ দুঃখের কথা শুনিতে শুনিতে ১১টা বাজিয়া গেল। আসিবার সময় আমার কন্যা অনেক করিয়া বলিয়া দিয়াছিল তাই একখানি লেপও সঙ্গে লইয়াছিলাম। ১১টা বাজিবার পর শুইবার জন্য রেলের জানলার সার্সিগুলি বন্ধ করিতে গেলাম; তাহার একখানি বন্ধ হইল না, হু হু করিয়া হাওয়া আসিতে লাগিল। সে মেয়েটির স্বামী আসিয়াও অনেক চেষ্টা করিয়া উঠাইতে পারিলেন না, কাজেই আমরা তদবস্থায় শুইয়া পড়িলাম। দেখিলাম সে মেয়েটি শীতে কাঁপিতেছে; আমার লেপখানি তাহাকে দিয়া আমার দেহস্থিত বালাপোষে গা ঢাকিয়া শুইয়া পড়িলাম। আশা ও ভরসাশূন্য হৃদয়ে আর কিছু থাক আর না থাক্ স্বস্তি টুকু ছিল তাই শুইবামাত্র ঘুমাইয়া পড়িলাম। যখন আমার নিদ্রাভঙ্গ হইল তখন গাড়ী একটা ষ্টেশনে আসিয়াছে।
উঠিয়া বসিয়া দেখিলাম সেটা আসানসোল ষ্টেশন, তখন ভোর হয় হয়, শুখতারা উঠিয়াছে। আসানসোল স্টেশনটি আমার কাছে ভাল লাগিবার কারণ আমি তথায় ৩৷৪ বৎসর ছিলাম। সেখানকার পুরাতন স্মৃতি হৃদয়ে জাগিয়াছিল সে স্মৃতি আমার হৃদয়ে বেশীক্ষণ রহিল না কারণ আমার আসা ভরসাশূন্য হৃদয় সুখ দুঃখের অতীত পথ খুঁজিতেছিল্; সেই যে উঠিলাম আর শুইলাম না, মুড়ি শুড়ি দিয়া বসিয়া দেখিতে দেখিতে চলিলাম, রজনীর ঘোর অন্ধকার ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইয়া উষার অঞ্চলে মুখ লুকাইল,হাসিতে হাসিতে উষারাণী পূর্ব্বাকাশে দেখা দিলেন। শীতকালের ঠাণ্ডা হাওয়া ততটা প্রীতিকর বোধ হইতেছিল না তথাপি আমি সেই ভাবেই বসিয়া রহিলাম। কোনো একটা স্টেশনে সঙ্গীটি নামিয়া গেল। আমি একাকী মধুপুরের অপেক্ষায় বসিয়া রহিলাম, তার পরে গাড়ী মধুপুরে আসিয়া থামিল। এই মধুপুরে আমার স্বামী দেহত্যাগ করিয়া স্বর্গে গিয়াছেন, এই মধুপুরে কার্ত্তিক মাসের ১৬ই আসিয়াছিলাম। সেই এক আসা আর এই এক আসা। তখনকার আসা ছিল স্বামীর আরোগ্য কামনায়, আর এখন আসা তীর্থদর্শন, ষ্টেশনে একটি গাড়ী করিয়া Tagore cut-এ আমার মাতুল মহাশয় থাকেন, সর্ব্বাগ্রে সেইখানে যাইলাম সেইখানে যাইয়া সেখান হইতে কিছু পুষ্প চয়ন করিয়া লইয়া Tagore Cut এর ম্যানেজার জানকী বাবুর বাড়ীতে গিয়া সেইখানে মুখ হাত ধুইয়া আমরা যে বাঙ্গালায় পূর্ব্বে ছিলাম সেইখানে গেলাম। সে বাংলাটি তখন বন্ধ ছিল আমি তাহার সম্মুখস্থ বারান্দায় বসিলাম; আমার ভাই তাহার চাবি আনিতে গেল—মনে হইল শনিবারে এই বাংলায় উনি দেহত্যাগ করেন আর আজও শনিবার। ইতিমধ্যে চাবি আসিল, ঘরের মধ্যে যাইয়া দেখিলাম যেখানে যেমনটি ছিল সেই রূপই রহিয়াছে। ঘরের মধ্যে যাইয়া আমার অতীত কালের ঘটনা সকল কে যেন আমার চক্ষের সম্মুখে ধরিল, আমি সেইখানে বসিয়া আমার দৈনন্দিন উপাসনা ও পূজা শেষ করিলাম। আমার মাতুল মহাশয় আমাদের জন্য চা পাঠাইয়াছিলেন তাহা পান করিয়া আমার স্বামীর এক শ্রদ্ধেয় বন্ধুর পুত্র—এক সময় তিনি আমাদের অনেক উপকার করায় তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞতার ঋণী ছিলাম—তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে মধুপুর হইতে কিছু দূরে অবস্থিত তাঁহার বাড়ীর দিকে গাড়ী করিয়া রওনা হইলাম। তাঁহার সঙ্গে দেখা করিয়া পুনরায় Tagore Cot এ আসিয়া আমরা গাড়ী ছাড়িয়া দিলাম। রেলে বসিয়া সংকল্প করিয়াছিলাম বৈদ্যনাথ হইয়া অন্যত্র যাইব। তার পরে আমরা Cot-এর সুযোগ্য ম্যানেজার জানকী বাবুর বাড়ীতে গেলাম। সেখানে যাইয়া আমার দুই আত্মীয়ার সহিত বহুদিন অসাক্ষাতের পর সাক্ষাৎ হইল— তাহাদেরও জীবনে আমার মত দুঃখের ঝড় অনেক বহিয়া গিয়াছে তাঁহাদের সহিত কথোপকথনে অনেকটা আনন্দ বোধ করিলাম। তার পর বেলা তিনটার সময় আত্মীয়া দুইটি ও আমরা সকলে মধুপুর হইতে রওনা হইলাম। তাঁহারা শিমুলতলা হইতে আসিয়াছিলেন সেইখানে যাইবেন, আর আমি বৈদ্যনাথে যাইব। অল্পক্ষণ পরে আমাদের গাড়ী বৈদ্যনাথ স্টেশনে দাঁড়াইল, আমরা নামিয়া ট্রামের মত একটি ছোট রেলগাড়ীতে উঠিলাম। দেওঘর ষ্টেশনে নামিয়া পথপ্রদর্শকরূপে একজন বৈদ্যনাথের পাণ্ডা একখানি ঘোড়ার গাড়ী আনিয়া তাহাতে আমাদের চড়াইয়া তাহার বাড়ীতে লইয়া গেল। যাইয়া বলিল মা আপনারা কি আজ রাত্রে থাকিবেন? শয়নের ব্যবস্থা করিয়া দিব? আমরা বলিলাম, না আমরা ঠাকুর দেখিয়া আজই রওনা হইব। পাণ্ডা বলিল, আচ্ছা মা আপনার যা অভিরুচি হয় সেইরূপই ব্যবস্থা করিয়া দিব। এই কথা বলিয়া বসিবার জন্য একখানি সতরঞ্চি পাতিয়া দিয়া তাহার চাকরকে মুখ হাত ধুইবার জল আনিতে বলিল—আমি সমস্ত দিন অনাহারে শ্রান্ত হইয়াছিলাম, পাণ্ডা নিজে যাইয়া আমার জন্য কিছু রাবড়ী ও মালাই ও আমার ভ্রাতার জন্য লুচি ইত্যাদি সংগ্রহ করিয়া আনিল। তার পর আমরা জলযোগ করিয়া ঠাকুর দর্শন করিতে গেলাম। পাণ্ডার বাড়ীর অনতিদূরেই মন্দির, পাণ্ডা আমাদের সঙ্গে চলিল, আমরা পদব্রজেই চলিলাম। সন্ধ্যার অন্ধকার, পথে তেমন আলোর বন্দোবস্ত নাই, আর পথের দুই ধার হইতে কেবল শিবারা সন্ধ্যা ঘোষণা করিতেছে। আমি পাণ্ডাকে বলিলাম যে বৈদ্যনাথে বড় বেশি শেয়াল আছে দেখছি, তাহাতে পাও বলিল, যে সারাদিন উহারা থাকে না, সন্ধ্যা হইলে দল বাঁধিয়া বন হইতে আসে আবার প্রভাত হইলেই চলিয়া যায়।
ইতিমধ্যে ঠাকুরবাড়ীর প্রশস্ত প্রাঙ্গনে যাইয়া উপস্থিত হইলাম। তাহার চারিদিকেই মন্দির, সম্মুখে হর পার্ব্বতীর মন্দীর, ঊর্দ্ধ দিকে চাহিয়া দেখিলাম লালবস্ত্র খণ্ডের দ্বারা মহাদেবের মন্দির হইতে পার্বতীর মন্দিরে গ্রন্থি বন্ধন করা আছে। আমি তাহা দেখিয়া পাণ্ডাকে জিজ্ঞাসা করিলাম—ইহার উদ্দেশ্য কি? পাণ্ডা বলিল যে, যাত্রীগণ শুভফলাকাঙ্খায় টাকা খরচ করিয়া এই গ্রন্থি বাঁধিয়া যায়। সেই গ্রন্থি বন্ধন দেখিয়া আমার মনে হইল যে আমার স্বামীর হৃদয়ে ও আমার হৃদয়ে যে গ্রন্থি বন্ধন হইয়াছিল তাহা ইহলোক পরলোকের ব্যবধান অতিক্রম করিয়া অনুস্যূত হইয়া রহিয়াছে। প্রেমের পরাকাষ্ঠা হর পার্ব্বতীর যুগল মূর্ত্তী ভাবিতে ভাবিতে প্রেমের মহাসত্ত্বায় মগ্ন হইয়া গেলাম। আমায় তদবস্থায় দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া পশ্চাৎ হইতে পাণ্ডা ডাকিল—মা, ঠাকুর দর্শনে চলুন— তখন আমার চমক ভাঙ্গিল। অগ্রসর হইয়া দেখিলাম দুই তিন জন সন্ন্যাসী মন্দিরের প্রশস্ত বারান্দায় বসিয়া দর্শকের কোলাহলশূন্য নিস্তব্ধ রাত্রে মৃদুস্বরে ভজন গান করিতেছে, সেখানে শান্তি যেন মূর্ত্তিমতী হইয়া বিরাজ করিতেছে। মন্দিরের ভিতর যাইয়া দেখি তখন আরতির আয়োজন হইতেছে, মহাদেবের মাথায় চন্দন দিয়া একরাশ ফুল চাপান হইয়াছে, মহাদেবের সেই এক বেশ। মহাদেবের ও পার্ব্বতীর মন্দির দেখিয়া মন্দির প্রদক্ষিণ করিয়া আবার সেই পাণ্ডার বাড়ীতে ফিরিয়া আসিলাম।
পাণ্ডা বলিল—আপনাদের যাইবার গাড়ী রাত্র ১টায়, এখান হইতে রাত্র ১২টায় যাইলেই হইবে। আপনারা নিশ্চিন্ত হইয়া বিশ্রাম করুন আমরা ঠিক সময়ে গাড়ী আনিয়া আপনাদের লইয়া যাইব।—এই কথা বলিয়া তাহারা সকলে বহির্বাটিতে চলিয়া গেল। একটি কেরোসিন তৈলের ল্যাম্প মিট্ মিট্ করিয়া জ্বলিতেছিল। আমি আমার ভ্রাতাকে বলিলাম যে, দুই জনে ঘুমাইলে চলিবে না সঙ্গে টাকা কড়ি আছে, রাত্রকাল অপরিচিত স্থান, একজনকে শুইতে হইবে একজনকে জাগিতে হইবে। আমার ভাই বলিল— আমি জাগিয়া আছি তুমি শোও। আমি বিনা উপাধানে আমার পাত্র বস্ত্রই গায়ে দিয়া শুইয়া পড়িলাম। কিছুক্ষণ পরে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়া যাওয়ায় ভাইকে বলিলাম—এইবার গাড়ী আনিবার ব্যবস্থা দেখ, শুধু পরের কথায় নির্ভর করিয়া থাকিলে চলিবে না। এই বলিতে বলিতে পাণ্ডা আসিয়া বলিল—মা গাড়ী এসেছে।
আমরা গাড়ীতে উঠিয়া কাশি রওনা হইলাম এবং পর দিন বেলা এগারটার সময় কাশিতে পৌঁছিলাম। পৌঁছিয়াই গঙ্গাস্নান করিয়া বিশ্বেশ্বর দর্শনের পর বাসায় ফিরিয়া আসিলাম, এবং সেই দিনই বৈকালে সেখান হইতে আমার কন্যাকে দেখিবার জন্য লক্ষ্ণৌ রওনা হইয়া ভোর ৫ টার সময় লক্ষ্ণৌয়ে পৌঁছিলাম। আমরা স্টেসন হইতে গাড়ী করিয়া তখনই বাহির হইলাম এবং বাড়ীতে উঠিয়া দেখি সকলেই নিদ্রিত। অনেক ডাকাডাকি করায় সকলে উঠিয়া আসিল এবং অসময়ে আমায় উপস্থিত দেখিয়া আমার কন্যা বিস্মিত হইল। কন্যার বিশেষ অনুরোধে সেদিন সেখানে থাকিয়া পরদিন ৩টার গাড়ীতে উঠিয়া ডেরাদুন রওনা হইলাম। আমি মেয়েদের একটি খালি গাড়ীতে উঠিলাম, আমার ভাই অন্য গাড়িতে উঠিল। গাড়ী চলিতে লাগিল, আমি একাকী প্রকৃতির দৃশ্য দেখিতে দেখিতে চলিলাম। ক্রমে সন্ধ্যা হইবার পর অন্ধকারে আর কিছু দেখা না যাওয়ায় আমি বেঞ্চেতে শুইয়া পড়িলাম। রাত্রি ১টার সময় গাড়ীর দরজা খোলার শব্দে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল চাহিয়া দেখি দুইটা কুলি কতকগুলি জিনিষপত্র লইয়া গাড়ীতে ঢুকিল। কুলিরা জিনিষপত্রগুলি রাখিয়া নামিয়া যাবার পর একটি বর্ষিয়সী ইংরাজ-রমণী গাড়ীতে আসিলেন। কুলি একটা টুকরি বেঞ্চিতে রাখিয়াছিল, অন্যান্য জিনিষপত্র এবার ওধার সাজান ছিল, সেই ইংরাজ-রমণী আমাকে জিজ্ঞাসা করিল—এই টুকরি তোমার? আমি বলিলাম—না। অল্পক্ষণ পরেই আর একটি যুবতী ও সুন্দরী ইংরাজমহিলা একটি বন্দুক লইয়া গাড়ীতে উঠিল এবং হস্তস্থিত বন্দুক রাখিয়া বেঞ্চে বসিল। পরে তাহাদের সহিত পরিচয়ে জানিলাম তাহারা সৈনিকরমণী, শিকার করিতে গিয়াছিল, এক্ষণে বাড়ী ফিরিতেছে। আমার সহিত রমণীদ্বয়ের খুব ভাব হইয়া গেল, তাহারা তাহাদের দেরাদুনের বাংলায় আমাকে যাইবার জন্য বিশেষ অনুরোধ করিল ও তাহাদের নাম ধাম আমার পকেট-বহিতে লিখিয়া দিল এবং বলিল তুমি যখন মসূরি বেড়াতে যাবে তখন আমি একখানা চিঠি দেব সেখানে আমার চৌকিদার আছে সে তোমাদের আবশ্যকমত সাহায্য করিতে পারিবে। এই দুইজন সঙ্গী পাইয়া পরস্পর গল্প করিতে করিতে রাত্রি প্রভাত হয় হয় এমন সময় দেরাদুন ষ্টেসন উপস্থিত হওয়ায় আমরা সকলেই গাড়ী হইতে নামিলাম। ইংরাজরমণীদ্বয় আপন গৃহাভিমুখে চলিল, আমি ও আমার ভ্রাতা ৺কালীকৃষ্ণ ঠাকুরের বাংলা অভিমুখে রওনা হইলাম। আমরা বাংলার দ্বারে অনেক ডাকাডাকি করিলাম কেহই উঠিল না, সকলেই তখনও নিদ্রিত, তাই বৃথা সেখানে সময় নষ্ট না করিয়া আমরা গাড়োয়ানকে টপকেশ্বর যাইতে বলিলাম। আমাদের গাড়ী টপকেশ্বরের পথে চলিল। দুই ধারে জঙ্গল, রাস্তাটা পাহাড়ে।
বিলক্ষণ শীত। দেখা গেল কোচম্যান টপকেশ্বরের ঠিক পথ জানে না গাড়ী জঙ্গলের মধ্য দিয়া ঘুরাইয়া ফিরাইয়া এমন এক স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল যে, আর সেখানে গাড়ী চলে না। তখন কোচম্যান তাহার সঙ্গের একটা ছোঁড়াকে নামাইয়া দিল, সে ছেলেটা ঘোড়ার মুখ ধরিয়া টানাটানি করিতে নিজেই মাটিতে পড়িয়া গেল। তখন আমি ভাইকে বলিলাম—তুমি গাড়ী থেকে নাম, দেখিতেছ না কোচম্যান পথ জানে না, এখানকার অন্য কোন লোককে পথ জিজ্ঞাসা কর। আমার ভাই নামিয়া সম্মুখে একজন হিন্দুস্থানী পথিককে দেখিয়া তাহাকে পথ জিজ্ঞাসা করায় সে বলিল যে আমরা পথ ছাড়িয়া বিপরীত দিকে আসিয়াছি। তাহাকে পথ দেখাইয়া দিতে বলায় সে আমাদের সঙ্গে যাইতে প্রস্তুত হইল। তখন কোচম্যান নিজে অনেক কষ্টে টানাটানি করিয়া গাড়ীখানি বাহির করিল ও পথপ্রদর্শক পথিকের পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল। কিয়দ্দূর যাইয়া এক জায়গায় গাড়ী দাঁড় করাইয়া বলিল যে আপনারা এইখানে নামুন আর আগে গাড়ী যাবে না। কাজেই আমরা নামিয়া টপকেশ্বর দেখিতে পদব্রজেই চলিলাম। কিয়দ্দুর যাইয়া দেখি যে পর্ব্বতের একটি গুহায় টপকেশ্বর নামে এক মহাদেব প্রতিষ্ঠিত, উর্দ্ধদিক হইতে পাহাড়ের জল টপ্টপ্ করিয়া শিবের মাথায় পড়িতেছে, সম্ভবতঃ এই জন্যই টপকেশ্বর নাম হইয়াছে। প্রবাদ আছে পূর্ব্বে জলের পরিবর্ত্তে দুগ্ধ ক্ষরিত হইত, পরে কোন রাখাল বালক তাহা উচ্ছিষ্ট করায় দুগ্ধের বদলে জল পড়িতেছে। এই গুহার সম্মুখে একটি বৃক্ষের গোড়া ৺কালীকৃষ্ণ ঠাকুর বাঁধাইয়া দিয়াছেন সেখানে একজন সন্ন্যাসী বাস করিতেছেন। আমরা টপকেশ্বর দেখিয়া কালীকৃষ্ণ বাবুর বাড়ীতে ফিরিয়া আসিলাম এবং সেখানে কিয়ৎক্ষণ বিশ্রাম করিয়া টোঙ্গায় করিয়া রাজপুর রওন হইলাম। রাজপুরে পৌঁছিয়া একটি ডাণ্ডি ভাড়া করিয়া মসূরী রওনা হইলাম কিন্তু আমার ভাই ডাণ্ডি বা ঘোড়ায় চড়িতে সম্মত না হইয়া বলিল—না, আমি পদব্রজে তোমার সঙ্গে যাইব। আমরা পাহাড়ের যতই উর্দ্ধে উঠিতে লাগিলাম প্রকৃতির সৌন্দর্য্যে ততই মুগ্ধ হইলাম। ইংরাজরা সুন্দর রাস্তা ও বাড়ী ঘর করায় পাহাড় এখন নগরীর রূপ ধারণ করিয়াছে। ছোট খাট অনেক বাজার আছে, তন্মধ্যে ল্যাণ্ডোর বাজারই দর্শন যোগ্য—ডাণ্ডিওয়ালা আমাকে লইয়া ক্রমশঃ উর্দ্ধে উঠিতে থাকিল কিন্তু আমার ভাই পদব্রজে পাহাড়ে উঠায় অনভ্যস্ত তাই অনেক পিছাইয়া পড়িল, কাজেই আমি একাকী পাহাড়ের সৌন্দর্য্য দেখিতে দেখিতে চলিলাম। দেখিলাম—পর্ব্বতবাসীরা পৃষ্ঠদেশে নানাবিধ মোট, আলু চাল ডাল ইত্যাদি, এমন কি বড় বড় আলমারি পর্য্যন্ত, লইয়া অনায়াসে চলিয়াছে এবং মহাজনেরা ঘোড়ার পিঠে দিয়া নানাবিধ পণ্য দ্রব্য ল্যাণ্ডোর বাজারে লইয়া যাইতেছে। কিয়ৎক্ষণ পরে বালুর বাজারে ডাণ্ডিওলারা ডাণ্ডি নামাইয়া আমার নিকটে জলখাবার পয়সা চাহিল এবং জলপান করিয়া সুস্থ হইল।
তাহারা আবার ডাণ্ডি তুলিবার উপক্রম করিতেছে এমন সময় আমার ভাই আসিয়া উপস্থিত হইল। পূর্ব্বোল্লিখিত মেম আমাকে একখানি পত্র দিয়াছিল এবং বলিয়াছিল যে এই বালুর বাজারে তাহার একখানি বাংলা আছে। আমার ভাইকে শ্রান্ত দেখিয়া তথায় বিশ্রাম করিতে বলিয়া আমি ল্যাণ্ডোর বাজার দেখিয়া আসিয়া এক ঘোড়া করিয়া আমার ভাইকে সঙ্গে লইয়া যখন রাজপুরে ফিরিয়া আসিলাম তখন সন্ধ্যা হইয়াছে। শুনিলাম রাজপুরে সন্ সন ধারা নামে একটি পাহাড় আছে, নামটি বোধ হইল যেন সহস্র ধারার অপভ্রংশ। তাহা দেখিব বলিয়া সেরাত্র রাজপুরের বাসায় রহিলাম এবং পরদিন প্রাতে ৯ টার সময় ডাণ্ডি ভাড়া করিয়া রওনা হইলাম। কিয়ৎ দূর যাইয়া ঝরণার ঝর্ ঝর্ ধ্বনি শ্রুতিগোচর হইল, আমি ভাবিলাম এই বুঝি সহস্র ধারার শব্দ।
কিন্তু ডাণ্ডিওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করায় সে বলিল এ অন্য একটা ঝরণার শব্দ। পথ এত দুর্গম যে প্রতি পদেই পদস্খলনের সম্ভাবনা, সেখানে ডাণ্ডি ভিন্ন ঘোড়ায় যাওয়া যায় না, পণ্য দ্রব্য ও অন্যান্য মাল একপ্রকার শ্বেত ছাগল ও মেষের পৃষ্ঠে দিয়া লইয়া যায়। এইরূপ একদল গলায় ঘণ্টা বাঁধা ছাগল পিঠে বাজারের পণ্য দ্রব্য ও পশ্চাতে পাহাড়ী চালক লইয়া আসিতেছে তাহা দেখিতে দেখিতে আমরা গন্তব্য স্থানে পৌঁছিলাম। সেখানে পৌঁছিয়া দেখি কোথাও ঝর্ ঝর্ কোথাও বা ঝুর ঝুর করিয়া নিশিদিন জল ঝরিতেছে। অনতিদূরে এক সমতল ভূমিতে দেখিলাম গন্ধকের প্রস্রবণ অনবরত গন্ধক মিশ্রিত ঈষৎ উষ্ণ জল উদগীরণ করিতেছে, সেই জলে রজতখণ্ড ফেলিয়া দিলেই তাহা তৎক্ষণাৎ কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে। এই জল বড় হজমি ও চুলকণাদি নাশক, আমরা শুনিয়াছিলাম ১ টাকা মূল্যে ১ বোতল জল গভর্ণমেণ্টের লোক বিক্রয় করে কিন্তু আমরা যখন সকালবেলা গিয়াছিলাম তখন কোন প্রহরী ছিল না কাজেই আমরা তাহা বিনা মূল্যেই সংগ্রহ করিয়া আনিলাম।
আমরা রাজপুরে ফিরিয়া আসিয়া হরিদ্বারে রওনা হইলাম সেই দিনই বেলা ৪টার সময় হরিদ্বারে পৌঁছিলাম। সেখানে একটি ধর্ম্মশালায় উঠিয়া গাড়ী করিয়া কঙ্খল দেখিতে রওনা হইলাম। কিছুদিন পূর্ব্বে একবার হরিদ্বারে আসিয়াছিলাম বলিয়া সেখানকার কিছু পুনরায় দেখিয়া বরাবর কঙ্খলেই যাইলাম। কঙ্খলে যখন পৌঁছিলাম তখন অস্তগমনোম্মুখ সূর্য্যের লোহিত কিরণ গঙ্গার স্বচ্ছ সলিলে পড়িয়া বড়ই রমণীয় হইয়াছিল। এইখান হইতে তরঙ্গিণী পর্ব্বতেমালার মেখলা পরিয়া আঁকিয়া বাঁকিয়া সাগর অভিমুখে যাত্রা আরম্ভ করিয়াছে। এইখানে দক্ষযজ্ঞে সতী দেহত্যাগ করিয়াছিলেন। মহাদেবের প্রস্তর মূর্ত্তি ও দক্ষযজ্ঞনাশের সমস্ত দৃশ্য রহিয়াছে অর্থাৎ বীরভদ্র প্রভৃতির প্রস্তর দেহ রহিয়াছে। ঐখানে রাত্রে থাকিয়া পরদিন গাড়ী করিয়া হৃষীকেশে রওনা হইলাম। সকাল বেলায় হৃষীকেশে যাইয়া সেখানকার একটি ধর্ম্মশালায় উঠিলাম। এখানকার ধর্ম্মশালার সুন্দর বন্দোবস্ত, একটি বৃহৎ দ্বিতল অট্টালিকা চারিদিকের চক্মিলান দালান এবং যাত্রীদের পরিচর্যার জন্য ৪ জন চাকর যাত্রীদের খাইবার শুইবার আবশ্যকীয় সমস্ত দ্রব্য গুদামে রহিয়াছে। চাকরেরা আমাদের স্নানের জল ও অন্যান্য সমস্ত দ্রব্য সরররাহ করিল, এমন কি আমরা আসিবার সময় কিছু পুরস্কার দিতে চাহিয়াছিলাম তাহারা বিনীত ভাবে তাহা লইতে অস্বীকার করিল। আমরা সেখান হইতে ডাণ্ডি করিয়া লছ্মনঝোলা দেখিতে রওনা হইলাম। আমরা এক ছোট পাহাড়ের ভিতর দিয়া বদ্রিনারায়ণ যাইবার পথে চলিলাম।
লছমনঝোলায় যাইয়া একটি কাঠের সেতু এবং রাম ও লক্ষণ প্রভৃতির কতিপয় মন্দির দেখিয়া হৃষীকেশের ধর্ম্মশালায় আসিয়া তথা হইতে গাড়ী করিয়া ৮টার সময় ষ্টেসনে পৌঁছিলাম। ট্রেণ রাত্রি ১টায় ছাড়িবে কাজেই আমাদের সেখানে অপেক্ষা করিতে হইল। ট্রেণ আসিলে আমরা রওনা হইলাম এবং প্রাতঃকালে দিল্লীতে পৌঁছিলাম। সেখানে একটি লোক আসিয়া আমাদের বলিল—এখানে ব্রাহ্মণের ভাল হোটেল আছে চলুন সেইখানে বাসা করিবেন—এই বলিয়া আমাদিগকে ঘোড়ার গাড়ী করিয়া তথায় লইয়া গেল। হোটেল বাড়ীটি ত্রিতল, আমরা ত্রিতলের একখানি ঘর থাকিবার জন্য পাইলাম। ঘরের ভিতর যাইয়া দেখি একখানি ক্যাম্প খাট ও একখানি চৌকি রহিয়াছে এবং ভূমিতে একখানি সতরঞ্চি পাতা। প্রতিদিন ১ টাকা করিয়া ভাড়া দিতে হইবে। আহারের জন্য একবেলা খাইলে পাঁচ আনা, আর দুই বেলা খাইলে আট আনা, প্রাতে দুই তিন রকম নিরামিষ তরকারী দুই রকম ডাউল এবং বৈকালে তরকারী ভাত ও রুটি এবং একখানি করিয়া পাপরপোড়া। পোড়া পাপর দেখিয়া তাহাই আমার দিল্লীর লাড্ডু, বলিয়া মনে হইয়াছিল। আমার ভাই ও আমি উভয়ে মধ্যাহ্ন ভোজন শেষ করিয়া একখানি গাড়ী করিয়া দিল্লীর সহরে যেখানে দরবার হইয়াছিল তাহা দেখিয়া সে দিন ফিরিয়া বাসায় আসিলাম। পরদিন আবার গাড়ী করিয়া হোটেলওয়ালার সমস্ত প্রাপ্য চুকাইয়া দিয়া জিনিষপত্র লইয়া দিল্লীর সমস্ত দর্শনযোগ্য স্থান দেখিবার জন্য যাত্রা করিলাম। হোটেলের ম্যানেজার পথপ্রদর্শকরূপে আমাদের সঙ্গে চলিল। আমরা প্রথমে যুধিষ্টির যেখানে য়াজসূয় যজ্ঞ করিয়াছিলেন সেই ইন্দ্র প্রস্থে যাইলাম। সেখানে আর্য্যকীর্ত্তির ভগ্নাবশেষ চিহ্নমাত্র স্থানে স্থানে রহিয়াছে বাদশা সেইখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করিয়া দিয়াছেন। রাজসূয় যজ্ঞের হোমকুণ্ড এখন একটি প্রাচীর বেষ্টিত মঞ্চ। হুমায়ুন বাদসা সেই মঞ্চ দেখিবার উদ্দেশে উচ্চ প্রাচীরে উঠিতে গিয়া পড়িয়া মারা যান। এক্ষণে হুমায়ুন টুম্ব নামে খ্যাত স্বীয় সমাধিভবন প্রস্তুত করাইতে ছিলেন। বেগম স্বামীর মৃত দেহ সেইখানে সমাধিস্থ করেন ও সমাধিভবন সম্পূর্ণ করাইয়া দেন। আমরা ইন্দ্রপ্রস্থ দেখিয়া হুমায়ুন টুম্ব দেখিতে যাইলাম। হুমায়ুন টুম্বে যাইয়া তত্রস্থ বাদসার ও তাঁহার পরিবারের সকলের সমাধিভবন দেখিলাম। সেই বাড়ীর কারুকার্য্য দেখিয়া শিল্পকল্পনার ঐশ্বর্য্য উপলব্ধি হয়। আর সমাধি দেখিয়া ঐশ্বর্য্যের নশ্বরত্বও মনে পড়ে। মুসলমানের ধর্ম্মগ্রন্থ কোরানের বচন বাড়ীময় খোদিত রহিয়াছে। সেখানে বাদসার গুরু ফকিরেরও সমাধি। ফকিরের সেই ঘরটিতে চন্দনকাষ্ঠের ছাদ হইতে সূত্র সংযোগে কতগুলি বৃহৎ পক্ষী বিশেষের ডিমের খোলা চারদিকে টাঙ্গান আছে সেরূপ পক্ষীর ডিম সচরাচর দেখা যায় না। খোলাটি আস্ত রাখিয়া তাহা শাঁস বাহির করিয়া ফুল দিয়া সাজাইয়া একজন মোল্লা বসিয়া পূজা করিতেছে। বাদসার মেয়ে জাহানারা পৃথ্বিরাজকে ভালবাসিয়াছিল কিন্তু পৃথ্বিরাজ তাহাকে প্রত্যাখ্যান করায় সেই প্রেমিকা এই সমাধিস্থ ফকিরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়া মনের দুঃখে দেওয়ানা হইয়া জীবনের অবশিষ্ট দিন নিরবে প্রতিদান-আশা-শূন্য প্রেমের ধ্যান করিয়া অন্তিমে চির প্রেমময়ের কাছে চলিয়া গিয়াছে, তাহার ও দেহ এইখানে সমাধিস্থ আছে।
ওখান হইতে পৃথ্বিরাজের দুর্গ এবং হস্তিনাপুরীতে পৃথিরাজের প্রতিষ্ঠিত যোগমায়ার মন্দির দেখিয়া মথুরায় রওনা হইলাম। মথুরায় পৌঁছিয়া যমুনার ধারে একজন পাণ্ডার বাড়ীতে উঠিয়া পরে মথুরার দর্শনযোগ্য স্থান সকল দেখিতে বাহির হইলাম। মথুরায় দর্শন যোগ্য বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নাই, তবে কৃষ্ণের কংশ বধের বৃত্তান্ত সকল যে ভাবে গড়িয়া রাখিয়াছে তাহা দেখিলে আশ্চর্য্য হইতে হয়। কৃষ্ণ কংশকে কেশাকর্ষণ করিয়া মারিতেছেন, কংসের কারাগার, কৃষ্ণের সূতিকাগার, প্রভৃতি নানা দৃশ্য এইরূপে চিরস্থায়ী হইয়া আছে। যমুনায় কংশরধ করিয়া যেখানে কৃষ্ণ বিশ্রাম করিয়াছিলেন সেই ঘাটের নাম বিশ্রাম ঘাট। এখানকার পাণ্ডারা বড় অসৎলোক, আমাদের বৃন্দাবন যাইবার কথা শুনিয়া “ব্রজবাসী গলার ফাঁসি” ইত্যাদি বচন আওড়াইয়া ভয় দেখাইল ও নিজে চারি টাকায় মথুরা ও বৃন্দাবন দেখাইবার ফুরণ করিয়া লইল; পরে বৃন্দাবনে যাইয়া আমাদের নূতন লোক দেখিয়া দুই একটি স্থান মাত্র দেখাইয়া ফিরাইয়া আনিতেছিল, তখন একজন ব্রজবাসী আসিয়া মথুরার পাণ্ডার হস্ত হইতে রক্ষা করিল। সে সঙ্গে থাকিয়া বৃন্দাবনের সমস্ত দ্রষ্টব্য দেখাইয়াছিল, তাহার নাম বড় মজার—ছোট-মোট-সাড়ে-তিনভাই। বৃন্দাবনে যাহা যাহা দেখিয়াছি তাহার মধ্যে শেঠেদের ঠাকুরবাড়ী এবং গোবিন্জির মন্দির উল্লেখযোগ্য। শেঠেদের ঠাকুরবাড়ীতে সুবর্ণের তালবৃক্ষ আছে এবং পূজার বাসন সব স্বর্ণনির্ম্মিত। মন্দিরের ভূমিতে শেঠের মূর্ত্তি অঙ্কিত, দুই হাত জোড় করিয়া আছে; সেখানকার পুরোহিত তাহার ভাবার্থ বলিল যে, গোবিন্দের নিকট হাতজোড় করিয়া জানাইতেছে—প্রভু আমার কি সাধ্য, এই সকলই তোমার ইচ্ছা। তাহার পার্শ্বদেশে উক্ত শেঠের অন্ধ ম্যানেজারের মূর্ত্তি অঙ্কিত আছে এই ম্যানেজারের অন্ধ হইবার কারণ উক্ত মন্দির যখন শেঠ নির্ম্মাণ করে তখন ম্যানেজার বলে যে, ইহা শ্বেত পাথরের নির্ম্মাণ করিতে হইলে অত্যন্ত ব্যয় পড়িবে, লাল পাথরের করিলে কমে হইবে। কালীয়দমন কুঞ্জবন প্রভৃতি দেখিয়া আমরা একেবারে আগরা রওনা হইলাম; আমাদের পথপ্রদর্শক ব্রজবাসিকে চলিয়া আসিবার সময় কিছু পুরস্কার দিয়া আসিলাম।
সেইদিনই সন্ধ্যাবেলায় আগ্রায় আসিয়া পৌঁছিলাম আগ্রাতে পৌঁছিয়াই ষ্টেসন হইতে গাড়ী করিয়া হোটেলের অনুসন্ধানে যাত্রা করিলাম এবং একটা ধর্ম্মসভার কাছে একটি হোটেল পাওয়া গেল। সে হোটেলটি বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দোতলা বাড়ী আসবাব সব দিল্লির হোটেলের মতনই আছে তবে বেশির মধ্যে একটি টেবিল। এই হোটেলটিও ব্রাহ্মণের। আমরা সেখানে পৌছিবামাত্র দুই জন চাকর আসিয়া আমাদের কি কি আবশ্যক জিজ্ঞাসা করিয়া তৎক্ষণাৎ মুখ হাত ধুইবার গরম জল ও চা আনিয়া দিল এবং ১৫ মিনিট পরে গরম গরম আহার্য্য আনিয়া উপস্থিত করিল। এখানকার ঘরভাড়া ৷৷৹ আনা রোজ। আবার দিল্লিরই মত একজন প্রদর্শক আসিয়া আমাদের বলিল—আগ্রার কেল্লা ইত্যাদি সব দেখিবেন ত? তাহা হইলে আমাকে কিছু অগ্রিম দিন, কেল্লা দেখিবার পাস আনিতে ৷৷৹ আনা খরচ হইবে। আমরা ৵৹ আনা পয়সা তাহাকে বায়নাস্বরূপ অগ্রিম দিলাম, সে বলিয়া গেল—আমি পাস লইয়া রাখিব আপনারা যথা সময়ে দেখিতে পাইবেন। তখন রাত্রি হইয়াছিল আমরাও শ্রান্ত ছিলাম সুতরাং নিদ্রার নিমিত্ত শয়ন করিলাম। পরদিন প্রভাত হইতে না হইতে আমরা উঠিয়া প্রাতঃকৃত্য সমাধা করিবার পূর্ব্বেই হোটেলের দরজার কাছে বস্ত্র, পাথরের জিনিষ, নানাবিধ কাঠের জিনিষ আনিয়া ফেরীওয়ালাগণ বিক্রয় করিবার নিমিত্ত নানাপ্রকার সাধ্যসাধনা আরম্ভ করিল, কাজেই সকলের নিকট কিছু কিছু ক্রয় করিলাম। পরে গাড়ী আনিয়া আমরা তাজমহলাদি দেখিতে বাহির হইলাম। তাজমহলের বিশেষ বর্ণনা করা এখানে নিস্প্রয়োজন কারণ তাহা অনেকেই দেখিয়াছেন। দেখিলাম তাজমহলের একটি গেট গর্ভমেণ্ট মেরামত করিয়া দিয়াছেন তাহার খরচ শুনিলাম সোত্তর হাজার টাকা আর ভিতরের ভিত্তিগাত্রে প্রায় একহাত জায়গা মেরামত করিয়াছেন তাহারও ব্যয় পড়িয়াছে শুনিলাম দশ হাজার টাকা। কবর আদি আর যাহা দর্শনযোগ্য ছিল তাহা দেখিয়া কেল্লার নিকট আসিয়া শুনিলাম আমাদের প্রদর্শক তখনও আসে নাই। হোটেলটি কেল্লার নিকটে কাজেই আমরা হোটেলেই ফিরিয়া আসিলাম। আমাদের হোটেলওয়ালার একখানি টাঙ্গা গাড়ী আছে আমরা সেই গাড়ীতেই সমস্ত দেখিতে বাহির হইয়াছিলাম। আমরা হোটেলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিবার পর সেই প্রদর্শক আমাদের সংবাদ দিল তখন আমরা হোটেলওয়ালার সেই টাঙ্গাখানি আনাইয়া কেল্লা দেখিতে চলিলাম। কেল্লার দ্বারে গিয়া দেখি আমাদের প্রদর্শক পাস লইয়া দাঁড়াইয়া আছে। গেটে একজন গোরা পাহারা আছে সে পাস খানি লইয়া আমাদের ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দিল। আমরা ভিতরে যাইয়া আগে গেটকয়টি দেখিলাম—প্রথম অমরসিংহ রাজ্য জয় করিয়া একটি প্রকাণ্ড হস্তি আনিয়া সেই গেটে বসিয়াছিলেন তাই তাহার নাম Elephant বা হাতি-গেট এই গেটের দুই পার্শ্বে অমরসিংহের বাস ভবন এবং অমরসিংহের প্রবেশসূচক যে নহবৎ বাজিত দুইধারে তাহার দুইটি ঘর রহিয়াছে, অপর একটি গেট দিয়া যমুনার জল কেল্লার ভিতর আসিত, ষোধবাই সেই জলে স্নান করিতেন, সেই গেটের নাম Water বা, জলের গেট; গভর্ণমেণ্ট সেই গেট বন্ধ করিয়া দিয়াছেন। আর একটি গেটের নিম্ন দিয়া বরাবর যমুনা পর্যন্ত একটি সুরঙ্গ পথ রহিয়াছে, প্রতি অমাবস্যায় ও পূর্ণিমায় যোধবাই সেই পথে যমুনায় স্নান করিতে যাইতেন, তাহাও গভর্ণমেণ্ট বন্ধ করিয়া দিয়াছেন। জাহাঙ্গীর বাদসার তিন স্ত্রী ছিল মারিয়ম খৃষ্টান, যোধবাই হিন্দু, আর বানু বেগম মুসলমান। যোধবাইই এই যবন গৃহে যবন পতির সহধর্ম্মিনী হইয়াও আপনার হিন্দুধর্ম্মের স্বতন্ত্রতা রক্ষা করিয়াছিলেন। কেল্লার ভিতর একটি গোবিন্দজীর মন্দির ছিল, আরঙ্গজেব বাদসা হইয়া তাহা ভাঙ্গিয়া দিয়াছিলেন। আমরা নীচে দেখিয়া উপরে যাইবার সময় বাগানে দেখি একটি প্রকাণ্ড বাটি রহিয়াছে তাহার দুইধারে দুইটি সিঁড়ী, তাহাতে বাদসা স্নান করিতেন, তাহার নাম Bathing cup অর্থাৎ স্নানের বাটি। উপরে উঠিয়া তিনটি বেগমের তিনটি পৃথক মহল দেখিলাম। যোধবাই বেগমের মহলে ভিত্তি গাত্রে বিবিধ অলঙ্কার ও টাকা কড়ি প্রভৃতি রাখিবার নিভৃত স্থান খখাদিত আছে। এই মহলের একস্থানে একটি প্রকাণ্ড বারান্দা রহিয়াছে সেখানে বাদসা বেগম বসিয়া মৎস্য ধরিতেন, পয়ঃপ্রণালী দিয়া যমুনার জল ভিতরে আসিত। যেখানে নওরোজার দিন বাজার বসিত সেই স্থানটাও দেখিলাম আর একস্থানে পুরুষদের জন্য ঐরূপ বাজার বসিত তাহাও দেখিলাম। বাদসার ভজনালয় অর্থাৎ মসজিদ দেখিলাম তাহা এত বড় যে তাহাতে পাচ সাত শত লোক একত্রে ভজনা করিতেন। অন্দর মহল হইতে একটি পথ আছে সেই পথ দিয়া প্রতি শুক্রবার বেগমেরা মসজিদে আসিতেন। অন্দর মহলেও বেগমদের জন্য একটি স্বতন্ত্র মসজিদ আছে। বেগমদের লুকোচুরি খেলিবার আর একটি প্রকাণ্ড বাড়ী আছে, চারিদিকে লুকান পথ আছে। একটি পাসা খেলিবার বাড়ী আছে তাহার মেজেতে পাসার ছক অঙ্কিত; যোলটি সুন্দরী বালিকাকে চার বর্ণের কাপড় পরাইয়া ঘুঁটি সাজান হইত, বেগম পাসা ফেলিয়া চাল বলিতেন আর এই সজীব ঘুঁটি ছকের নির্দিষ্ট ঘরে যাইয়া বসিত। বেগমদের স্নানাগার দেখিলাম; গোলাপ জল, ঠাণ্ডা জল, গরম জল প্রভৃতির ফোয়ারা শুরু হইয়া রহিয়াছে। একস্থানে এক জোড়া বৃহৎ চন্দন কাষ্ঠের দরজা দেখিলাম তাহা কোন হিন্দু রাজাকে জয় করিয়া আনিয়া রাখা হইয়াছিল। বাঁদিদের কারাগার রহিয়াছে বাঁদির দোষ করিলে সেই কারাগৃহে বন্দী হইত। কেল্লাটি আগাগোড়া প্রস্তর নির্ম্মিত সেই মণিমাণিক্য খচিত ময়ুরসিংহাসনের পরিবর্ত্তে একটি কৃত্রিম প্রস্তর নির্ম্মিত সিংহাসন রহিয়াছে তাহাও স্থানে স্থানে মাতাল গোরারা ভাঙ্গিয়া দিয়াছে লোহার পতক মারিয়া সংস্কার করিয়া রাখা হইয়াছে। ছাতের উপরে বাদসার প্রকাণ্ড কষ্টিপাথরের সিংহাসন এই সিংহাসনে মিউটিনির সময় একটি গোলা আসিয়া লাগিয়াছিল তাহার দাগ দেখা যায়। সিংহাসনের এক স্থানে একটি লম্বা ফাট আছে তৎসম্বন্ধে প্রবাদ এই যে, গোরা জুতাশুদ্ধ পা রাখিয়াছিল তাই ফাটিয়া রক্তধারা নির্গত হইয়াছিল। যেখানে জাহাঙ্গীর বন্দী হইয়াছিলেন সেই বন্দিশালাও দেখিলাম।
আগ্রা দেখা হইলে আমার ভ্রমণ শেষ করিয়া যোড়শ দিবসের দিন বাটি আসিয়া পৌঁছিলাম।