উনিশে মে: ভাষার সংকট/কথাকবিতা/রূপকথার তৃতীয় ভুবন

রূপকথার তৃতীয় ভুবন

আবার ইঁদুরের উপদ্রব।

 ইঁদুর তো নয়, ধেড়ে গন্ধছুঁচো। রান্নাঘরের পাইপ বেয়ে দোতলায় উঠে খেয়ে যায় এঁটোকাঁটা আবর্জনা, দুর্গন্ধের মধ্যে ছড়িয়ে যায় এক বিভ্রান্তির রহস্য। মোহকারী এক সুবাস। রূপকথার থার্ড বাইলেন-এ এমন ঘটনা নিত্য নৈমিত্তিকের।

 থার্ড বাইলেন এর ঘটনা, মানে তৃতীয় উপপথের।

 মহাসড়ক নয়, রাজসড়কও নয়, গলির গলি তস্যগলি, যার নাম কানাপথ। তেমনি এক প্রান্তিক গলিতে হামলা হয় প্রায়শ। ফার্স্ট সেকেণ্ড-এর গেরস্তরা এখন বেশ চালাক চতুর, লোহার জালি লাগিয়ে রাখে পাইপের মুখে। তৃতীয় উপসড়কের বোকা বাসিন্দা এখনও বসুধার সবাইকে কুটুম ডাকতে ভালবাসে, ষাঁড়ের গুঁতো খেতে বলদকেই ডাকে। তাই পাইপের মুখেও বসায়নি কোনো পাহারা।

 অন্যের ভাঁড়ারে এসে টাইম পাস করে যাওয়া গন্ধ ইঁদুরকে নিয়ে এক ছোটোগল্প লেখা হয়েছিল বরাক উপত্যকায়। হাসি ঠাট্টায় সেদ্ধ করে পরিবেশিত হয়েছিল সত্য, ম্যাজিক ফ্যাজিকও ছিল। পশ্চিম দেশে এক ধর্মীয় উৎসবে নাকি এসব হয়, হাসি ঠাট্টা ভাঁড়ামি দিয়ে জমিয়ে দেওয়া হয় উৎসেবর আনন্দ, বলা হয় কার্নিভ্যাল। গল্প উপন্যাসে তেমন আড়াল না নিয়ে সত্য কথা কী করে বলবে লেখক; মানীর মানহানি করলে যে শক্তিধরের আইন বলে কলম বিক্রিই বন্ধ হয়ে যাবে। তাই সে-গল্পের নাম ‘রূপকথার থার্ড বাইলেন’।

 শিবের গীত তো গাওয়া হচ্ছে সেই কোন আদ্যিকাল থেকে, তাই ব্যতিক্রম কিছু হলো না। দুর্বোধ্য গানের ভূমিকা দিয়েই যখন শুরু হলো তখন কিছু প্রয়োজনীয় স্পষ্টীকরণ দিয়ে বিষয়ে যাওয়াই ভালো।

 ইঁদুর অনুপ্রবেশে কিন্তু কোনো ভুবনের গল্প নেই, বরং ভুবন বিকৃতির কথা আছে, তাই তৃতীয় নেই থার্ড আছে, পথ নেই, সড়ক নেই, লেনও নেই, আছে বাইলেন। আর বাংলার ভাষা ভুবনও এত পরিসরহীন ঘিঞ্জিও নয় যে ঢুকে যাবে বাইলেন-এ। ভাষার ভুবন আছে ভুবনেই। ধর্মোন্মাদ কিছু বাঙালির ইচ্ছায় ভাষাভুবন দু-ভাগ হয়েছিল কোনও কালে। অনাদরের এক তৃতীয় ভাগও গড়ে উঠেছিল বরাক উপত্যকায় তখন, মান্যতাহীন এই ভাষাভুবনকে কেউ কেউ ঔপনিবেশিক ছিটমহলও বলেন, কেউ তাও বলেন না, নামও শোনেননি যে। না শোনাই ভাল, এসব আপাত-বিভাগে বিশ্বাস না করাই ভাল, কারণ মানুষের ভাষাপৃথিবী কখনো খণ্ডিত হয় না। তাই, বাংলার ভাষাভুবনও এক এবং অখণ্ড।

 কিন্তু ধন্দ হয় গলিপথ নিয়ে, আর গলির বাসিন্দাদের নিয়ে। মনের বিত্তে উচ্চ না হলেও রাজারাজড়ার মতো প্রভুত্বকামী প্রথম গলির বাসিন্দার অল্পে সুখ হয় না। মিনি মাগনায় যে প্লট পাওয়া যায় চাঁদের জমিতে। না না, চাঁদের কথাটা নিতান্তই উপমা। আসলে, একটা গলি, পেরিয়ে গেলে যে দুর্গম থার্ড বাইলেন, ওখানে আছে বিস্তীর্ণ প্রান্তর, রোদ মহাশয় ওখানে যেমন ইচ্ছে ঝিকিমিকি খেলতে বেরোন ভোরের বেলা, ফার্স্টগলির ইটকাঠের চৌকো জ্যামিতিক ছায়া বেশি, আলো কমের ধমক নয়, শুধু কি প্রান্তর। আছে পাহাড়, নদী, নৌকো আর সত্যি মাছের রাজ্যপাট হাওর বিলে। ফার্স্ট হওয়ার হ্যাপা পোয়াতে পোয়াতে জেরবার, ভিড়ে ভিড়াক্কার, সবাই প্রথম হতে চায়। প্রথম লেনের বার, পাব এমন কী খালাসিটোলাও ইদানীং বড় আক্রা, রেস্ত কুলোয় না, নির্জনতাও নেই। থার্ড গলির নদীটাও বড় একলা সুন্দরী, নদীর পারে ‘তেতই’ না ‘বরই’ কী যেন বলে এক গাছের নিচে কেমন মিনি পয়সায় বসিয়ে দেওয়া যায় বাংলার ঠেক। কেউ করেনি মানা। ‘বাংলা’ শব্দের নেশায় তো বাংলাই সমৃদ্ধ হয়। বাড়ির লোক গলির লোকও কেউ নেই দেখতে আসার। এত দুর্গম যে বললে কেউ বিশ্বাসই করবে না থার্ড বাইলেনের অস্তিত্ব। তাই বলেন, এখানে একটা স্থায়ী কেন্দ্র হোক, বিলিতি খেয়ে অভ্যাস নষ্ট হয়ে গেছে, এই বাংলায় কেমন একটা মুগ্ধকারী অ্যারোমা আছে। আসব, বারবার আসব। প্রথম গলির রাজনীতির মতো সাহিত্যও করা যায় নেশা চড়লে, বলা যায়, আমরা ‘বসন্তের কোকিল’ নই, আমরা ‘ডুমুরের ফুল’ও নই।

 বিগলিত থার্ড বাইলেন বাসিন্দাদের তো আর হারিয়ে যাওয়ার কিছু নেই, তাই বিসর্জনও নেই, সদাই আবাহন। প্রথম পক্ষের ভাঁড়ারে কম পড়লেই তাই নর্দমার পাইপ বেয়ে চলে যাওয়া যায় অরক্ষিত পুরীতে।

 বাংলা ভাষার তৃতীয় ভুবন বরাক উপত্যকা। এখানে কিছুই অরক্ষিত নয়। বাংলা ভাষাকে সুরক্ষিত রাখতে উনিশ শো একষট্টির উনিশে মে এগারোজন ভাই বোন আত্মত্যাগ করেছে এই ভুবনে। এরপরেও বারেবারে ঘটেছে আত্মত্যাগের ঘটনা, ঘটেই চলেছে। কই, গর্বিত প্রথম ভুবন থেকে তো কেউ কোনোদিন বলেন নি, যাই উনিশে মে, দিয়ে আসি এক মুঠো ফুল। যেমন যাই নগ্ন পদে, শ্রদ্ধাবনত চিত্তে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির ভোরে, ঢাকায়। এবার কলকাতায় উনিশে মে উদ্যাপিত হয়েছে আঠেরোই মে, এক অখ্যাত প্রেক্ষাগৃহে। উদ্যোক্তারা সবাই ভাষাপ্রেমী। পরদিন, মানে উনিশে মে দিবসেই আমাদের উপত্যকারই এক সাংবাদিক সাহিত্যিক ও চিত্রকরের উদ্যোগে উদ্যাপিত হলো সাড়ম্বরে, কিন্তু কেন ভাই, এক জুতো-ব্যবসায়ীর ছবি সামনে রেখে শ্রদ্ধার্ঘ জানিয়ে কেন উনিশে মে উদযাপন। আমাদের উপত্যকার তিন বিখ্যাত কবি কবিতা পাঠ করলেন। আঠেরো এবং উনিশ দু-দিনই উপস্থিত ছিলেন আমাদের পরম প্রিয় অমিতাভ চৌধুরি ও দোহারের কালিকা প্রসাদ। দু-দিনেই কালিকা প্রসাদ শিলচর রেলস্টেশনের নাম ভাষাশহিদের নামে করার জন্য জনমত প্রভাবিত করেন, অমিতাভ চৌধুরি স্মৃতিচারণে ফিরিয়ে নিয়ে যান একষট্টির উনিশে মে। আপাতদৃষ্টিতে অশ্রদ্ধার কিছু হয়তো হয়নি আঠেরোই মে’র উদ্‌যাপনে কিংবা জুতো-ব্যবসায়ীর ছবি সামনে রেখে সভা করায়। কারণ, ভারত দেশের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় আমাদের প্রথম ভুবন। এখানে সরকারি কাজেও বাংলা চলে না, অধুনার সাহিত্য একাডেমি সভাপতি ধর্মতলার দোকানে দোকানে ঘুরেও পারেননি বাংলা সাইনবোর্ড লেখাতে। সেই তিনিই আবার সগর্বে বলে থাকেন উনিশে মে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, বিচ্ছিন্নতার ঘটনা। আরও একজন সুশীল বিদ্বান বলেন, স্বাধীনতার পরে রক্তমূল্যে ভাষাচেনার ঘটনা ঘটেনি ভারতবর্ষে (সুনন্দ সান্যাল)। সেইসব শ্রদ্ধেয়জনেরা বরাক উপত্যকার উপনিবেশে এসে এক নতুন পৃথিবীর সন্ধান পেয়ে যান। একটি বই এর বিজ্ঞাপন নিয়ে খুব মজা হয়েছিল বছর ত্রিশ পঁয়ত্রিশ আগে। বই এর নাম এবং দাম পাশাপাশি, একটু উষ্ণতার জন্য পনেরো টাকা। বরাক উপত্যকার উষ্ণতার জন্যও অর্থ বরাদ্দ থাকে জাহাজ ভাড়া, আতিথেয়তা অধিক কিছুও থাকে। এবং ধন্য হয়ে ফিরে যান ভুলে যাওয়ার জন্য। কিছুদিন পর আবার ইচ্ছে হয় যাওয়ার। ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে মাঝারি দৈনিকের পোস্ট এডিট পৃষ্ঠায় আধকলাম লেখা হয় তাদের নিয়ে, যাদের তুষ্ট রাখলে ‘আবার খাব’ বলা যায়। আপাতত এই চলছিল বরাক উপত্যকায়, কেউ এর বেশি প্রত্যাশাও করেনি। উপেক্ষিত ভুবন নিয়ে কলকাতায় কেউ লেখালেখি করে না। জাটিঙ্গা, মধুরা নদী নিয়ে কবি কেউ কেউ লিখেছেন। অনেক আগে মনোজ বসুর লেখায় হাইলাকান্দি উল্লিখিত হয়েছে। প্রথম ভুবনের লেখকের সময় কোথায় জানার, জেনে লেখার। এমন কীই বা আছে এই উপত্যকায়। ভুবনে। কোথাকার কোন ভুবনেশ্বর বাচস্পতি কিংবা নগেন্দ্রচন্দ্র শ্যাম, রাজমোহন নাথ, সুধীর সেন থেকে কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারী, সুজিৎ চৌধুরি, তপোধীর ভট্টাচার্য, শ্যামলেন্দু চক্রবর্তীদের আর কিসের উত্তরাধিকার। তৃতীয় ভুবনের ‘তৃতীয়’শব্দেই তবে শ্রেণী-বৈষম্য স্পষ্ট। দ্বিতীয় ভুবনের এক কথাকার, বাঙালির প্রিয়তম গল্পকার হাসান আজিজুল হকও বরাক উপত্যকা তথা ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা সাহিত্য চর্চার বিষয়ে, কিছু না জেনেই সম্পাদনা করেন ‘অসীমান্তিক’ গল্প সংকলন এবং স্বীকারও করেন, অকপটে লেখেন সত্য কথা এরকম, ‘সত্যকথা এই যে উত্তর-পূর্ব ভারতের গল্প সম্বন্ধে আলাদাভাবে কোনো অবয়ব আমি গড়ে তুলতে পারিনি। আমার পাঠও খুব কম।’ প্রশ্ন করাই যায়, হাসান আজিজুল হক তবে সম্পাদনা করতে গেলেন কেন। খ্যাতির বিড়ম্বনা না উপনিবেশতত্ত্বের সম্প্রসারণ। অপরিচয় দোষের নয়, কিন্তু পরিচিত হতে বাধা কোথায়। নাকি, বড়োর পিরিতি ওরকম হয়। তাহলে ‘বড়ো’ শব্দের সংজ্ঞার্থ কী। নিজে যারে বড়ো বলে। ওদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমাদের নির্ভরশীলতা কলকাতা-ঢাকাকে ছাড়তেই চায় না। এ বিষয়ে সুজিৎ চৌধুরির বিশ্লেষণ প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন,

১. স্বদেশি মেট্রোপলিটান শহরগুলোর সঙ্গে মফস্‌সল অঞ্চলের এক ধরনের ঔপনিবেশিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। আমাদের কলকাতা মুখিতা তারই দ্যোতক।

২. এখানকার মানুষের রুটিরুজির সংগ্রাম, মানবিক সম্পর্কের সংকট, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়ের পটভূমি সমস্তই যদি কলকাতার চশমা দিয়ে বিশ্লেষিত হয় তবে তা পণ্ডশ্রম হতে বাধ্য।

৩. দেশবিভাগের আগে বাংলা সাহিত্যের একটিমাত্র কেন্দ্র ছিল, আজ ঢাকায় দ্বিতীয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত, প্রয়োজনবোধে ঈশান বাংলায় বাংলা সাহিত্যের তৃতীয় কেন্দ্রের সূচনাকে ত্বরান্বিত করতে হবে। (অনীশ্বর ১৯৮১)

 তাহলে তো কথা হয়েই গেল। ১৯৮১ ইংরেজিতে যদি সুজিৎ চৌধুরি চোখে আঙুল দিয়ে সারকথা বলে দিতে পারেন, ত্রিশ বছর পরেও কেন তার উত্তরসূরিরা পারছেন না। কলকাতার চশমা না হলে আমাদের কোনো দেখা, দেখার মতো হয় না। কেন কোনো স্পর্দ্ধিত লেখক এখনও শিলচরকে উপনিবেশ ভাবেন, হাসান আজিজুল হক তবু স্বীকার করেছেন। অশিক্ষিত সবজান্তার মতো বলেননি শিলচরের বাঙালি মানে কিছু শিক্ষাহীন, রুচিহীন অসভ্য মানুষ, যারা নিজেদের সিলেটি বলে। ওদের কথা বলার ভাষাও উদ্ভট, কেউ বোঝে না এমনকি সিলেটিরাও বোঝে না। শহর শিলচর আর তার অধিবাসীদের খলনায়ক করে বাংলার এককালের প্রধান শারদীয় সাহিত্যের রত্নখনি ‘আনন্দবাজারে’ লেখা হয় উপন্যাস, এই শরতে।

 সেই উপন্যাস পড়ে বরাকজন বলেছেন, গেল গেল কী গেল। শিলচরে একটি প্রবাদ আছে ‘হাগল বেটির লাজ নাই, দেখল বেটির লাজ’। বরাক উপত্যকাবাসীর লজ্জাও তাই সেই বিখ্যাত ঔপন্যাসিকের জন্য। ‘উত্তরাধিকার’ উপন্যাস লেখকের এই উত্তরাধিকার কে বহন করবে। বিখ্যাত সিনেমার ‘কালিয়া’র মতো দশা হবে না তো। নিজের গুলি নিজেকেই না হজম করতে হয়। ঔদ্ধত্যের পরিণতি তো ওরকমই হয়, পাঠক ছেড়ে গেলে লেখকের আর রইল কী। ইদানীং এক সাহিত্য পত্রিকায় রত্নদীপ দেব নামে এক গবেষকের প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়েছে লেখকের অবিনয়: ‘সপ্তাহ খানেক আগে ‘বারোমাস বইমেলা’ বিপণির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিলচরে এসেছিলেন সাম্প্রতিককালের অগ্রণী কথা সাহিত্যিক...। এদিন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি দৃপ্ত কণ্ঠেই জানিয়েছিলেন সুনীল-শীর্ষেন্দু-বুদ্ধদেব এবং তিনি ছাড়া এ মুহূর্তে বাংলা সাহিত্যে এমন আর কোনো কথাসাহিত্যিক নেই যাদের বই এর চাহিদা পাঠক সমাজে রয়েছে। পরবর্তী স্তরে তিনি আর একটু বাড়িয়েই বলেন ‘সত্যিকারের মার্কেট যাচাই করে দেখুন না, দেখবেন আমরা চারজনই বেস্টসেলার।’ (দ্বিরালাপ-৪৮)

 এই না হলে বিখ্যাত লেখক।

 কেউ কেউ বলেছেন প্রতিবাদ করতে হবে। প্রতিবাদের আওয়াজ পৌঁছে দিতে হবে। কিন্তু কেন প্রতিবাদ। তাঁর কাজ তিনি করেছেন, কামড়ে দিয়েছেন। প্রতিবাদ নয়, দরকার প্রতিষেধক, আর তাঁকে চোখে চোখে রাখা। ভুল তথ্য সংগ্রহের জন্য যেন আর আসতে না পারেন উপত্যকায়। উপমহাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতিতে শিলচর-হাইলাকান্দি-করিমগঞ্জ তথা সিলেটির অবদানকথা জানাতে শ্রদ্ধেয় নামের উল্লেখ মানে, নেম ড্রপিং এ নামকে শুধু নামিয়ে আনাই হবে। তাই, বরাক উপত্যকার গর্বিত নাম জানানোর কোনো দায় নেই এ প্রতিবেদনের। তাই, কোনো প্রতিবাদ নয়, ধিক্কার জানানোই দরকার এবং উপত্যকার বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ পড়ুয়া যদি ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে পারেন তবেই বালির বাঁধ প্রকট হবে।

 দিন কয়েক আগে এক সাময়িক পত্রিকার সম্পাদক দূরভাষে জানিয়েছিলেন তাঁর দৃঢ়তার কথা। বলেছিলেন, তাঁর পত্রিকার বিশেষ সংখ্যার প্রকাশ অনুষ্ঠান হয় সাড়ম্বরে, কলকাতার সাহিত্যিক শিল্পী আনিয়ে উদ্বোধন করার মতো আর্থিক সচ্ছলতা থাকলেও স্থানীয় সাহিত্যিক, গুণীজনের হাত দিয়েই উন্মোচিত হয় পত্রিকা। সাধুবাদযোগ্য প্রচেষ্টা সম্পাদক মহাশয়ার।

 কলকাতার ঢাকার লেখকদের সঙ্গে কী সম্পর্ক উপত্যকার লেখকদের। আদান-প্রদানের সুস্থ সম্পর্কই তো হওয়া উচিত। কিন্তু হয়েছে কি। বাস্তবে দোভাষীহীন আলাপচারিতায় উঠে আসে না কিছুই। নির্যাসহীন এক লুকোচুরি। কোনো সম্পর্কই হয় না, জলচলই নয়, পিরিতি। ওরা যে শিলচর-হাইলাকান্দি-করিমগঞ্জের লাটভবনে একদিন দু-দিন একহপ্তা কাটিয়ে যান। লেখালেখি নিয়ে জ্ঞান বিতরণ করেন মাগনায়। কই, এত এত দৈনিক থেকে সাময়িক পত্রিকা সাহিত্য পত্রিকা আছে এখানে কোথাও তো একটি লেখা দিয়ে কৃতার্থ করেন না। কোনো কোনো পত্রিকার কর্ণধার যথেষ্ট সম্মানমূল্য দিয়ে লেখা কিনতে আগ্রহী ছিলেন, দেন নি। কথা উঠতে পারে, তথ্য সত্য নয়, অনেকের অনেক লেখা ছাপা হয়েছে বরাক উপত্যকার কাগজে। হার মানতেই হয়, ছাপা হয় সত্যি, তবে দায়িত্ব নিয়ে এটাও বলা যায়, যা ছাপা হয় তার প্রতিটিই জেরক্স কপির লেখা। মূল লেখাটি কলকাতায়, ঢাকায় ছাপা হওয়ার পর স্থান তৃতীয়ের। একটি প্রান্তিক প্রাগৈতিহাসিক ভুবনের জন্য নতুন লেখার কষ্ট কেন করবেন বিখ্যাত। পাঠক কোথায়। শিলচরের অপরিচিত পাঠকের জন্য লিখে কী লাভ। এবার উল্টোটা এ উপত্যকার কোনো লেখকের লেখা ছাপা হচ্ছে ওদেশে। তপোধীর ভট্টাচার্যর ব্যতিক্রম নিয়ে কথা হবে হয়তো। হোক না, ব্যতিক্রমটাই নিয়ম হোক। উল্টোটাই হোক। বরাক উপত্যকার কবি-সাহিত্যিক-প্রাবন্ধিকরা প্রধান ভুবনে অপরিহার্য হয়ে উঠুন। উপনিবেশ প্রভুদের হঠিয়ে উপত্যকার লেখকরাই কেন হয়ে উঠছেন না নিজেদের প্রভু। বাংলা সাহিত্যের অপরিহার্য নাম।

 এর জন্য চাই মানসিকতার পরিবর্তন। হিন্দুকুশ পর্বতে উনানী সিকন্দরের সঙ্গে এদেশীয় সম্রাটের যথাযোগ্য সম্পর্ক যদি স্থাপিত না হয় তবে কেন পণ্যনায়কদের কিনে আনা। সভাপতি আর প্রধান অতিথি ভাড়া করা। পণ্ডিতের পূজা নিয়ে বিরোধ নেই কোথাও, তিনি সর্বত্র পূজ্যতে। তবে চাল আর কাঁকরের বাছাই ঠিক হলেই বেরিয়ে আসবে পাথুরে অসত্য, আর তখন পণ্যবাহী লেখককে নিয়ে কোনো মাথাব্যথা থাকবে না বরাক উপত্যকাবাসীর।

 রূপকথার থার্ড বাইলেনেও আর থাকবে না ইঁদুরের উপদ্রব।

দ্বিরালাপ ৫১। ডিসেম্বর ২০১০।