উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/ছেলেদের মহাভারত/উদ্যোগপর্ব

উদ্যোগপর্ব

ভিমনু আর উত্তরার বিবাহের পরে, বিরাটের বাড়িতে রাজা এবং যোদ্ধাদিগের মস্ত এক সভা হইল৷ বিবাহে যাহারা আসিয়াছেন, তাহারা সকলেই বড়-বড় বীর এবং সকলেই পাণ্ডবদিগের বন্ধু৷ ইহারা পরামর্শ করিতে লাগিলেন যে, এখন কি উপায়ে পাণ্ডবেরা নিজ রাজ্য ফিরিয়া পাইতে পারেন৷ সেই কপট পাশা খেলায় হরিয়া, পাণ্ডবেরা বারো বৎসর বনবাস আর এক বৎসর অজ্ঞাতবাসের প্রতিজ্ঞা করেন৷ সে প্রতিজ্ঞার্তাহারা অক্ষরে অক্ষরে পালন করিয়াছেন৷ তথাপি দুরাত্মা দুর্যোধনের দল এখন বলিতেছে যে, তেরো বৎসর না যাইতেই তাহাদের সন্ধান পাইয়াছে৷ আসলে তাহদের রাজ্য ছাড়িয়া দিবার কিছুমাত্র ইচ্ছ নাই৷ তাই পাণ্ডবদিগের বন্ধুগণ স্থির করিলেন যে, যদি সহজে উহারা রাজ্য ছাড়িয়া না দেয়, তবে যুদ্ধ করিয়া তাহ আদায় করিতে হইবে৷

 এদিকে দুর্যোধন প্রভৃতিও চুপ করিয়া বসিয়াছিলেন না৷ পাণ্ডবেরা যে তাঁহাদের রাজ্য সহজে ছড়িবেন না, একথা তাঁহারা বেশ জানিতেন৷ সুতরাং দুই দলেই যুদ্ধের আয়োজন আরম্ভ হইল৷ একদিকে যেমন সৈন্য-সামন্ত এবং অস্ত্রশস্ত্রের জোগাড় হইতে লাগিল, অন্যদিকে তেমন বড়-বড় বীরদিগকে ডাকিয়া নিজেদের দলে আনিবার চেষ্টারও ক্রটি হইল না৷

 কৃষ্ণের সাহায্য পাওয়া একটা মস্ত কথা৷ সেজন্য দুর্যোধন আর অর্জুন প্রায় এক সময়েই দ্বারকায় যাত্রা করেন, একই সময়ে সেখানে উপস্থিত হন৷ কৃষ্ণ তখন নিদ্রায়৷ দুর্যোধন আগেই তাহার শয়নঘরে গিয়া, তাহার মাথার নিকটে একটি বড় আসন অধিকার করিলেন; পরে অর্জুন আসিয়া বিনীতভাবে কৃষ্ণের পায়ের কাছে বসিলেন৷

 ঘুম ভাঙ্গিলে প্রথমে পায়ের দিকেই চোখ পড়ে৷ কাজেই কৃষ্ণ জাগিয়া আগে দেখিলেন অৰ্জুনকে, তারপর দেখিলেন দুর্যোধনকে৷ দুজনকেই তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিজন্য আসিয়াছ?”

 দুৰ্যোধন হাসিমুখে বলিলেন, “যুদ্ধে আপনার সাহায্য চাহিতে আসিয়াছি৷ আর আমি আগে আসিয়াছি, কাজেই আমার কথাই আপনাকে রাখিতে হইবে৷”

 কৃষ্ণ বলিলেন, “আপনি আগে আসিয়াছেন সত্য৷ আর আমি আগে অৰ্জুনকে দেখিয়াছি একথাও সত্য৷ সুতরাং আমি দুজনকেই সাহায্য করিব৷ একদিকে নারায়ণী সৈন্য নামক আমার অতি ভয়ংকর এক অর্বুদ সৈন্য থাকিবে, অপরদিকে আমি শুধু হাতে থাকিব, কিন্তু যুদ্ধ করিব না৷ এই দুয়ের মধ্যে যাহার যাহা ইচ্ছা নিতে পার৷ অর্জুন বয়সে ছোট, সুতরাং তাহাকেই আগে জিজ্ঞাসা করি৷ বল তো অর্জুন, ইহার কোনটা তোমার পছন্দ হয়?”

 অৰ্জুন বলিলেন, “আমি সৈন্য চাহি না, আপনাকেই চাহি৷”

 কাজেই অর্জুন পাইলেন কৃষ্ণকে, আর দুর্যোধন পাইলেন এক অর্বুদ সৈন্য। দুজনেই মনে করিলেন, আমি খুব জিতিয়াছি।

 সেখান হইতে দুর্যোধন বলরামের নিকট গেলেন। কিন্তু বলরাম বলিলেন, “আমি তোমাদের কাহাকেও সাহায্য করিব না, তোমরা প্রস্থান কর।”

 এদিকে কৃষ্ণ আর অর্জুন স্থির করিলেন যে যুদ্ধের সময় কৃষ্ণ অর্জুনের সারথি হইবেন।

 শল্য কি করিয়াছিলেন শুনিবে? সে হাসির কথা, শল্য পাণ্ডবদিগের মাতুল, মাদ্রীর ভাই। তিনি, পাণ্ডবদিগের সাহায্য করিবার জন্য, বিস্তর সৈন্য লইয়া তাহার রাজ্য মদ্রদেশ হইতে যাত্রা করিলেন। পথে দুর্যোধন, তাহাকে হাত করিবার জন্য, তাহার এতই সমাদর করিতে লাগিলেন যে, তাহাতে দেবতারও মন ভুলিয়া যায়। যেখানেই শল্য বিশ্রাম করিবেন, সেইখানেই দুর্যোধন চমৎকার একটি বৈঠকখানা করিয়া রাখিয়াছে। বৈঠকখানাগুলি দেখিয়া শল্য ভাবিলেন, ‘বাঃ। পাণ্ডবেরা আমার কতই যত্ন করিতেছে!’ এ যে দুর্যোধনের চাতুরি, তাহা তিনি বুঝিতেই পারিলেন না। একটা বৈঠকখানার কারুকার্য তাহার বড়ই ভালো লাগায়, তিনি বলিলেন, “ইহার কারিগরকে ডাক, বকশিস দিব।” অমনি নিজে দুর্যোধন কারিগর সাজিয়া আসিয়া উপস্থিত! শল্য তাহাকে বলিলেন, “কারিগর বল, তুমি কি পুরস্কার চাও? আমি তাহাই দিতেছি।”

 দুর্যোধন বলিলেন, “মামা। আপনার কথা যেন মিথ্যা না হয়। আমি এই চাই যে, আপনি আমার দলে আসিয়া সেনাপতি হউন।”

 সে-সকল লোক কথায় বড় খাঁটি ছিলেন। শল্যের আর পাণ্ডবদিগের সাহায্য করা হইল না। দুর্যোধনকে তিনি বলিলেন, “আচ্ছা তুমি ঘরে যাও, আমি যুধিষ্ঠিরের সহিত দেখা করিয়া আসিতেছি।”

 যুধিষ্ঠিরের সহিত দেখা হইলে, শল্য তাহাকে এই বলিয়া আশীর্বাদ করিলেন, “তোমাদের দুঃখেব শেষ হইযাছে, এখন তোমাদের শত্রুদিগকে মারিয়া সুখে রাজ্য কর।” তারপর পথে দুর্যোধনের ফাঁকিতে পড়িয়া যেসকল কথা বলিযা আসিয়াছে, তাহা জানাইলেন। সে কথায় যুধিষ্ঠির বলিলেন, “মামা! আপনি আপনার কথা রাখিয়া ভালোই করিয়াছেন? কিন্তু আমাদের একটি উপকার করিতে হইবে। কর্ণ আর অর্জুনের যুদ্ধ উপস্থিত হইলে, আপনি কর্ণের সারথি হইয়া, এমন উপায় করিবেন, যাহাতে তাহার তেজ কমিয়া যায়।”

 শল্য বলিলেন, “সে বিষয়ে তোমরা কোনো চিন্তা করিও না। আমার যতদূর সাধ্য তোমাদের উপকার নিশ্চয় করিব।”

 এইরূপে বড় বড় বীরগণ ক্রমে দুই দলের সাহায্যার্থ উপস্থিত হইতে লাগিলেন।

 পাণ্ডবদিগের দলে প্রথমে আসিলেন সাত্যকি। ইনি অসাধারণ যোদ্ধা, কৃষ্ণের আত্মীয় এবং অর্জুনের ছাত্র ও বন্ধু। ইহার সঙ্গে এক অক্ষৌহিণী সৈন্য আসিল। তারপর চেদি দেশের রাজা মহাবীর ধৃষ্টকেতু এক অক্ষৌহিণী-সৈন্য লইয়া আসিলেন। তারপর মগধের রাজা জরাসন্ধের পুত্র জয়ৎসেন এক অক্ষৌহিণী সৈন্য লইয়া আসিলেন। তারপর মহাবীর পাণ্ড্য এক অক্ষৌহিণী সৈনা লইয়া আসিলেন।

 তারপর দ্রুপদ, বিরাট ইহারাও অনেক লক্ষ যোদ্ধা আর সৈন্যের জোগাড় করিলেন। এইরূপে পাণ্ডবদের পক্ষে সাত অক্ষৌহিণী সৈন্য হইল।

 দুর্যোধনের দলে—ভগদত্তের এক অক্ষৌহিণী, ভূরিশ্রবার এক অক্ষৌহিণী, শল্যের এক অক্ষৌহিণী, কৃতবর্মার এক অক্ষৌহিণী, জয়দ্রথের এক অক্ষৌহিণী, কম্বোজের রাজা সুদক্ষিণের এক অক্ষৌহিণী, ইহা ছাড়া দক্ষিণাপথ, অবন্তী প্রভৃতি নানা দেশ হইতে আরো পাঁচ অক্ষৌহিণী, সবশুদ্ধ এগারো অক্ষৌহিণী সৈন্য হইল।

 এইরূপে দুই দল যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইলেন। আর অল্পদিনের মধ্যেই ভয়ংকর মারামারি কাটাকাটি আরম্ভ হইবে, রক্তে দেশ ভাসিয়া যাইবে, ঘরে ঘরে কান্না উঠিবে। দেশের যত ক্ষত্রিয় বীর, প্রায় সকলেই যুদ্ধের জন্য ব্যস্ত হইয়াছে। হায়! আর অল্পদিন পরে হয়তো উহাদের কেহই বাঁচিয়া থাকিবে না।

 যুদ্ধ কি ভয়ংকর কাজ, আর ক্ষত্রিয়ের কর্ম কি কঠিন! মানুষকে মারিয়া মানুষ মনে করিবে যে, ধর্ম করিলাম! কয়েকজন লোক একটা রাজ্য লইয়া ঝগড়া করিতেছে, তাহার জন্য দেশশুদ্ধ লোক কাটাকাটি করিয়া মরিবে।

 এমন যুদ্ধ কে সহজে করিতে চায়? পাণ্ডবেরা তো তাহা চাহে নাই। তাহারা বলিয়াছিলেন “আমাদের সমুদয় রাজ্য না দেয়, কেবল আমরা নিজ হাতে যেটুকু জয় করিয়া লইয়াছিলাম তাহাই দেউক। তাহাও যদি না দেয়, পাঁচজনকে পাঁচখানি গ্রাম মাত্র দিলেও আমরা সন্তুষ্ট হই।”

 কিন্তু দুষ্ট লোকে লোভে পড়িলে কি আর তাহার ভালো মন্দ জ্ঞান থাকে? কত লোক দুর্যোধনকে বুঝাইল, কিছুতেই তাহার চৈতন্য হইল না। ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, সঞ্জয় প্রভৃতি সকলে মিলিয়া কত চেষ্টা করিলেন। কিন্তু যে ইচ্ছা করিয়া শুনিবে না, তাহার কাছে কথা বলিয়া কি ফল? কর্ণ শকুনি প্রভৃতিরা, দুর্যোধনকে ক্রমাগত যুদ্ধ করিবার জন্য উৎসাহ দিয়া, এমন করিয়া তুলিয়াছেন যে, তিনি আর কাহারো কথায় কান দিতে চাহেন না।

 ধৃতরাষ্ট্র মুখে দুর্যোধনের নিন্দা করিয়াছিলেন, আর পাণ্ডবদিগেব সহিত বন্ধুতা করার কথা বারবার বলিয়াছেন। কিন্তু তিনি তাহা সরলভাবে বলেন নাই, কাজেই তাহার কথায় কোনো ফল হয় নাই।

 সকলের শেষে কৃষ্ণ এই যুদ্ধ থামাইবার জন্য অনেক চেষ্টা করেন। কিন্তু তাহার কথা রাখা দূরে থাকুক, দুর্যোধন তাহাকে অপমান করিতেও ত্রুটি করেন নাই। রাজা দিবার কথায় রাজি করিতে না পারিয়া, কৃষ্ণ দুর্যোধনের নিকট পাঁচ ভাইয়ের জন্য পাঁচখানি গ্রাম মাত্র চাহিলেন। তাহার উত্তরে দুর্যোধন বলিলেন কি যে, “খুব সরু ছুঁচের আগায় যতটুকু জায়গা বিধে, তাহার অর্ধেকও বিনা যুদ্ধে দিব না!"

 ইহার উপরে আবার বুদ্ধিমানেরা কৃষ্ণকে বাঁধিয়া রাখিতে চাহিয়াছিলেন! কিন্তু তাহার চেহারা দেখিয়া, আর কাজে তাহা করিতে সাহস হয় নাই। তিনি ধমকের চোটে দুষ্টদিগকে জব্দ করিয়া, সেখান হইতে চলিয়া আসেন।

 আসিবার পূর্বে কৃষ্ণ কর্ণকে নির্জনে ডাকিয়া বলিলেন, “কর্ণ, তুমি কাহার সহিত যুদ্ধ করিতে যাইতেছ? জান কি, পাণ্ডবেরা তোমার ছোট ভাই? তুমি এখনই আমার সঙ্গে চল, তোমার ভাইদের সহিত তোমার পরিচয় করিয়া দিই। পাণ্ডবেরা তোমাকে চিনিতে পারিলে, তোমায় মাথায় করিয়া রাখিবেন। তখন এই পৃথিবীর রাজা হইবে তুমি, আর পাণ্ডবদের প্রধান কাজ হইবে, তোমার সেবা করা, আর তোমার আজ্ঞা পালন করা। তুমি আর অর্জুন দুই মিলিয়া এই পৃথিবীতে কত বড়-বড় কাজ করিবে আর তাহা দেখিয়া আমাদের চক্ষু জুড়াইয়া যাইবে।”

 কর্ণ বলিলেন, “কৃষ্ণ! তোমার সকল কথাই সত্য। কিন্তু তুমি আমাকে কি মনে করিয়াছ? দুর্যোধনের অনুগ্রহে আমি রাজ্য পাইয়া সুখে বাস করিতেছি। এই দুর্যোধনকে আমার ভরসায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করিয়া দিয়া, আমি তাহাকে ছাড়িয়া যাইব? লোকে তো জানে, আমি অধিরথ সারথির পুত্র। এখন যুদ্ধের আরম্ভেই যদি আমি পাণ্ডবদিগের সহিত মিলিতে যাই, তবে সকলে বলিবে আমি কাপুরুষ। না কৃষ্ণ! তোমার কথা আমি রাখিতে পারিব না!”

 বনবাসে যাইবার সময় কুন্তীকে পাণ্ডবেরা বিদুরের বাড়িতেই রাখিয়া যান। কৃষ্ণও যুদ্ধ থামাইবার চেষ্টায় আসিয়া এবারে বিদুরের বাড়িতেই ছিলেন। কাজেই তাহার নিকট কুন্তীর কোনো কথাই জানিতে বাকি থাকে নাই৷

 কৃষ্ণ চলিয়া যাইবার পবে, যুদ্ধের কথা ভাবিয়া কুন্তীর প্রাণে বড়ই ক্লেশ হইতে লাগিল। পুত্রগণ যুদ্ধ করিয়া একজন আর একজনকে মারিবে, মার প্রাণে একথা কি সহ্য হইতে পারে? তাই তিনি মনে করিলেন তিনি নিজে একবার চেষ্টা করিয়া দেখিবেন৷

 কর্ণ রোজ গঙ্গায় স্নান করিয়া সূর্যের স্তব করিতেন। স্নানের সময় কুন্তী গঙ্গার ধারে গিয়া, এই স্তবের শব্দে তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করিলেন, এবং তাহারই ছায়ায় বসিয়া, স্তব শেষ হইবার জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। স্তবের শেষে কর্ণ তাহাকে নমস্কার করিয়া জোড়হাতে কহিলেন, “হে দেবি, আমি অধিরথ এবং রাধার পুত্র কর্ণ, আপনাকে নমস্কার করিতেছি। আপনার কি চাহি?”

 কুন্তী বলিলেন, “বাছা, তুমি আমারই পুত্র। রাধার পুত্র তুমি কখনই নহ, সারথির ঘরে তোমার জন্মও হয় নাই। নিজের ভাইদিগকে না চিনিতে পারিয়া, কেন বাবা তুমি দুর্যোধনের সেবা করিতেছ? তোমার ভাইদের কাছে তুমি আইস। যেমন কৃষ্ণ বলরাম দুভাই, তেমনি আমার কর্ণ আর অর্জুন হউক। পাঁচ ভাইয়ের প্রভু হইয়া সুখে রাজ্য কর। সারথির পুত্র বলিয়া যেন তোমার দুর্নাম না থাকে৷”

 এ কথায় কর্ণ বলিলেন, “আপনার কথায় আমার শ্রদ্ধা হইতেছে না। জন্মকালে আপনি আমাকে ফেলিয়া দিয়াছিলেন; মায়েব কাজ আমার প্রতি কিছুই করেন নাই। এখন যে আমাকে স্নেহ দেখাইতেছে, তাহাও কেবল আপনার পুত্রদিগের উপকারের জন্য। এমন অবস্থায়, আমি আপনার কথায় দুর্যোধনকে ছাড়িতে যাইব কেন? তবে, আপনি কষ্ট করিয়া আসিয়াছেন, তাই এই পর্যন্ত বলিতে পারি যে, যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল, সহদেব ইহাদেব কাহারো আমি কোনো অনিষ্ট করিব না। কিন্তু অর্জুনকে ছাড়িতে আমি কিছুতেই প্রস্তুত নহি। যুদ্ধে হয় আমি তাহাকে মারিব, না হয় সে আমাকে মাবিবে। আপনার পাঁচ পুত্রই লোকে জানে, তাহার অধিক পুত্র আপনার থাকা ভালো নহে৷”

 এই বলিয়া কর্ণ সেখান হইতে চলিয়া গেলেন। কুন্তীও কাঁদিতে কাঁদিতে ঘরে ফিরিলেন৷

 যুদ্ধ আর কিছুতেই থামিল না। সুতরাং তাহার আয়োজন বিধিমতে হইতে লাগিল। কুরুক্ষেত্রের প্রকাণ্ড মাঠের ভিতর দিয়া হিরণ্ববতী নদী বহিতেছে। সেই নদীর ধারে যুধিষ্ঠির তাহার সৈন্য সাজাইতে লাগিলেন। দুর্যোধনের লোকেরাও তাহারই সামনে আসিয়া শিবির প্রস্তুত করিল। দেখিতে দেখিতে সেই মাঠের চেহারা এমনি বদলাইয়া গেল যে, তাহাকে চেনা ভার। খাল পুকুর, রাস্তা, তাঁবু ইত্যাদিতে সে মাঠ নগরের মতো হইয়া গিয়াছে। তাহার ভিতরে মিস্ত্রী, মজুর, পাচক, বৈদ্য, কিছুই অভাব নাই। আটা, ঘি, ডাল, চাউল, ঔষধপত্র, কাঠ, কয়লা ইত্যাদি কোনো দরকারি জিনিষেরই ত্রুটি দেখা যায় না।

 আর অস্ত্রের কথা কি বলিব? মানুষের বুদ্ধিতে মানুষকে মারিবার যতরকম উৎকট উপায় হইতে পারে, সকলই প্রস্তুত। রাশি রাশি তোমর (লোহার কাটা পরানো ডাণ্ডা) আছে; ইহার ঘায় হাড় গুড়া এবং বুক ফোঁড়া এক সঙ্গেই হইতে পারে। ভালো মত এপিঠ-ওপিঠ করিয়া ফুড়িতে হইলে তাহার জন্য শক্তির (লোহার বল্লম) আয়োজন যথেষ্ট হইয়াছে। পাশ (ফাঁস) আছে আঁটি আঁটি। এ জিনিস শত্রুর গলায় লাগাইয়া টানিলে, বুঝিতেই পার। আর যদি শত্রুর চুলে ধরিয়া টানিয়া তাহাকে কাবু করিতে হয়, তাহার জন্য অসংখ্য ‘কচ-গ্রহ-বিক্ষেপ’ (লম্বা লাঠির আগায় সাংঘাতিক আঠা) রহিয়াছে। কিংবা যদি আঁকশি লাগাইয়া তাহাকে টানিবার দরকার পড়ে, সে আঁকশিরও ঐ পর্বতাকার ঢিপি! এ অস্ত্রের নাম ‘কর-গ্রহ-বিক্ষেপ’। বালি তৈল আর ঝোলা গুড়ের অন্তই নাই। এসব জিনিস গরম করিয়া শত্রুর গায় ঢালিয়া দিতে হইবে; তাহার জন্য এই বড়-বড় হাতাও আছে। মুখ বাঁধা ভারী ভারী হাঁড়ির ভিতরে ভয়ানক ভয়ানক সাপ। শত্রুর ভিড়ের মধ্যে এই সকল হাঁড়ি ফেলিয়া দিতে পারিলে বেশ কাজ দেয়! ধুপ-ধুনা জ্বালাইয়া ফেলিতে পারিলেও মন্দ হয় না, তাহার ঢিপি পর্বত প্রমাণ, কুল কাঁটার মতন বাঁকানো কাটা পরানো ভয়ানক বল্লম, তাহার নাম ‘অঙ্কুশ তোমর’, এ অস্ত্র শত্রুর পেটে বিধাইয়া টানিলে পেটের ভিতরের জিনিস তখনই বাহির হইয়া আসে।

 ইহা ছাড়া ঢাল, তলোয়ার, খাড়া, বর্শা, লাঠি, গদা, তীর, ধনুক প্রভৃতি সাধারণ অস্ত্র যে কত আছে তাহার তো হিসাবই হয় না। দা, কুড়াল, খুন্তি, কোদাল, এমনকি লাঙ্গল পর্যন্ত বাদ যায় নাই।

 এসকল অস্ত্র বোধহয় সাধারণ সৈন্যদের জন্য। বড়-বড় ক্ষত্রিয় যোদ্ধারা এসকল অস্ত্রের কোনো কোনোটা ব্যবহার করিতেন না, এমন নহে মোটের উপর তাহাদের যুদ্ধ-কৌশল ইহা অপেক্ষা অনেক উঁচুদরের। আর তাহাদের অস্ত্রশস্ত্রও যে অতি আশ্চর্যরকমের, তাহাও আমাদের দেখিতে বাকি নাই।

 সকল আয়োজন শেষ হইলে দুর্যোধন জোড়হাতে ভীষ্মকে বলিলেন, “হে পিতামহ! আপনি যুদ্ধবিদ্যায় শুক্রের সমান পণ্ডিত, আপনি আমাদের সেনাপতি হউন। আপনার পশ্চাতে আমরা নির্ভয়ে যুদ্ধ করিতে যাইব৷”

 ভীষ্ম বলিলেন, “আচ্ছা তাহাই হউক। তোমাকে কথা দিয়াছি, সুতরাং তোমার হইয়া যথাসাধ্য যুদ্ধ করিব;কিন্তু আমার কাছে তোমরা যেমন, পাণ্ডবেরাও তেমনি। এইজন্য আমি কখনো তাহাদিগকে বধ করিতে পারিব না। তোমার অপর শত্রু আমি রোজ হাজার হাজার মারিব৷”

 কর্ণের বড়ই লম্বা-চওড়া কথা কহিবার অভ্যাস, সেজন্য তিনি ভীষ্মের নিকট অনেক বকুনি খান, কাজেই দুজনের মধ্যে একটু চটাচটি আছে। তাহার উপরে আবার দুর্যোধনের দলের রথী এবং মহারথীদিগের নাম করিতে গিয়া, ভীষ্ম কর্ণকে অর্ধরথ (অর্থাৎ আধখানা রথী) বলাতে এই বিরোধ আরো বাড়িয়া গেল।

 শেষে ভীষ্ম বলিলেন, “কর্ণ আমার সঙ্গে বড়ই রেষারেষি করে, আমি তাহার সঙ্গে মিলিয়া যুদ্ধ করিতে পারিব না৷” তাহাতে কর্ণ বলিলেন, “আমিও ভীষ্ম থাকিতে এ যুদ্ধে হাত দিতেছি না। উনি মারা যাউন, তারপর আমি অর্জুনের সহিত যুদ্ধ করিব।”

 এইরূপে দুর্যোধনের পক্ষে ভীষ্মকে সেনাপতি করিয়া, অন্যান্য যোদ্ধারা তাহার অধীনে যুদ্ধ করিতে প্রস্তুত হইলেন।

 পাণ্ডবদিগের পক্ষে দ্রুপদ, বিরাট, সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন, ধৃষ্টকেতু, শিখণ্ডী ও জরাসন্ধের পুত্র সহদেব, এই সাতজনকে সেনাপতি করা হইল; ধৃষ্টদ্যুম্ন হইলেন প্রধান সেনাপতি। ইহাদের আবার পরিচালক হইলেন অর্জুন।

 এই সময়ে দুর্যোধন একদিন উলুক নামক এক দূতকে বলিলেন, “তুমি পাণ্ডবদিগকে আর কৃষ্ণকে, খুব করিয়া গালি দিয়া আইস।”

 কিরূপ গালি দিতে হইবে, তাহাও দুর্যোধন অবশ্য বলিয়া দিলেন;তত কথা লিখিবার স্থান নাই। আর থাকিলেই বা তাহা লিখিয়া দরকার কি? ভালো কথা হইত তবে না হয় লিখিতাম। দুর্যোধনের হুকুম পাওয়া মাত্র উলুক পাণ্ডবদিগের নিকট গিয়া, তাহার কথাগুলি অবিকল মুখস্থ বলিয়া দিল।

 এই সকল গালির উত্তরে পাণ্ডবেরা বলিলেন, “উলুক! দুর্যোধনকে বলিবে যে তাহার উচিত সাজা পাওয়ার সময় উপস্থিত হইয়াছে, আর বেশি বিলম্ব নাই।”

 উলুক চলিয়া গেলে পাণ্ডবেরা সৈন্য ভাগ করিয়া গুছাইতে লাগিলেন। বড়বড় সেনাপতিগণ কে কোন্ কোন্ দলের কর্তা হইবেন, এ সকল ঠিক করাই সকলের প্রথম কাজ। এ কাজ শেষ হইয়া গেলে আর আয়োজনের কিছুই বাকি রহিল না; এখন শত্রু আসিলেই হয়।

 দুর্যোধনের দলেও অবশ্য এইরূপ আয়োজন চলিতেছিল। দুই পক্ষের যোদ্ধাদিগের কে কেমন বীর, ভীষ্ম দুর্যোধনকে তাহা সুন্দররূপে বুঝাইয়া দিয়া বলিলেন, “তোমার জন্য আমি পাণ্ডবদিগের সহিত যথাসাধ্য যুদ্ধ করিব। কৃষ্ণই হউন, আর অর্জুনই হউন, কাহাকেই আমি সহজে ছাড়িব না। উহাদেব মধ্যে কেবল শিখণ্ডীব গায়ে আমি অস্ত্রাঘাত করিতে প্রস্তুত নহি, আব সকলের সহিতই যুদ্ধ করিব।”

 এ কথায় দুর্যোধন আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা কবিলেন, “কেন? শিখণ্ডীর গায়ে আপনি যে অস্ত্রাঘাত করিবেন না, তাহার কারণ কি?”

 ভীষ্ম বলিলেন, “স্ত্রীলোকের গায়ে হাত তুলিতে নাই, তাই মারিব না।”

 দুর্যোধন বলিলেন, “শিখণ্ডী তত দ্রুপদের পুত্র। সে স্ত্রীলোক হইল কিরূপে?”

 ভীষ্ম বলিলেন, “শিখণ্ডীর কথা তবে বলি, শুন। আমার ভাই বিচিত্রবীর্যের সহিত বিবাহ দিবার জন্য আমি কাশীরাজার তিনটি কন্যাকে স্বয়ম্বর সভা হইতে জোর করিয়া লইয়া আসি। ইহাদের বড়টির নাম অম্বা। অম্বা বলিল, ‘আমি মনে মনে শাল্বকে বিবাহ করিয়াছি। কাজেই আমি তাহাকে ছাড়িয়া দিয়া আর দুটি মেয়ের সহিত ভাইয়ের বিবাহ দিলাম।

 ‘অম্বা শাল্বের কাছে গেল, কিন্তু আমি তাহাকে জোর করিয়া আনায় অপমান বোধ করিয়া, আর হয়তো কতকটা আমার ভয়েও, সে তাহাকে বিবাহ করিতে সম্মত হইল না। এইরূপে সেই কন্যা নিতান্ত দুঃখে পড়িয়া ভাবিল, এখন কোথায় যাই? শাল্ব অপমান করিল, পিতার ঘরে গেলেও তাহারা আমাকে ঘৃণা করিবে। হায়! ভীষ্মই আমার এই দুঃখের কারণ? উহাকে শাস্তি দিতে পারিলে তবে আমার মন শান্ত হয়। এই মনে করিয়া সে কত দেশ যে ঘুরিল, কত মুনি-ঋষির নিকট নিজের দুঃখের কথা বলিয়া কাদিল। শেষে আমার

গুরু পরশুরাম, তাহার প্রতি দয়া করিয়া আমায় শাসন করিতে আসিলেন৷ তাহার সহিত আমার ঘোর যুদ্ধ হইয়াছিল। তাহাতে তিনি আমাকে হারাইতে না পারিয়া, অম্বাকে বলিলেন,‘আমি তো অনেক যুদ্ধ করিলাম, কিন্তু ভীষ্ম আমাকে হারাইয়া দিল। আমার আর ক্ষমতা নাই, তুমি চলিয়া যাও৷’

 “তারপর অম্বা, অনেক তপস্যা করিয়া, আমাকে মারিবার জন্য শিবের নিকট বরলাভ করে। সেই বরের জোরে সে এখন শিখণ্ডী হইয়া জন্মিয়াছে। আমি জানি, এ সেই অম্বা—এ পুরুষ মানুষ নহে। কাজেই আমি ইহার গায়ে অস্ত্রাঘাত করিতে পারিব না৷”

 যুদ্ধের পূর্বে দুর্যোধন ভীষ্মকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “দাদামহাশয়, আপনি একেলা যথাসাধ্য যুদ্ধ করিলে কত সময়ের মধ্যে পাণ্ডবদিগের সকল সৈন্য মারিয়া শেষ করিতে পারেন?”

 ভীষ্ম বলিলেন, “আমি ইচ্ছা করিলে এক মাসে পাণ্ডবদের সকল সৈন্য মারিতে পারি৷”

 এই কথা একে একে দ্রোণ, কৃপ, অশ্বথামা আর কর্ণকে জিজ্ঞাসা করিলে, দ্রোণ বলিলেন, “আমিও এক মাসে পারি৷”

 কৃপ বলিলেন, “আমার দুমাস লাগে৷”

 অশ্বথামা বলিলেন, “আমার দশদিন লাগে৷”

 কর্ণ বলিলেন, “আমি পাঁচদিনেই উহাদের সকল সৈন্য মারিয়া শেষ করিতে পারি৷”

 কর্ণের কথা শুনিয়া ভীষ্ম হো হো শব্দে হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “অৰ্জুনের সঙ্গে কিনা এখনো দেখা হয় নাই, তাই তুমি এমন কথা বলিতেছ৷”

 যুধিষ্ঠিরের চরেরা ভীষ্ম দ্রোণ প্রভৃতির এই সকল কথা শুনিয়া তাহা যুধিষ্ঠিরের নিকট গিয়া বলাতে, তিনি অর্জুনকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “অৰ্জুন, তুমি কতক্ষণে কৌরবদিগের সৈন্য মারিয়া শেষ করিতে পার?”

 অৰ্জুন বলিলেন, “কৃষ্ণ সহায় থাকিলে, আমি এক নিমিষে সকল শেষ করিয়া দিতে পারি। শিব আমাকে পাশুপত নামক যে অস্ত্র দিয়াছিলেন তাহা আমার নিকট আছে। ইহা দিয়া তিনি প্রলয়ের সময় সকল সৃষ্টি নাশ করেন। এ অস্ত্রেব সংকেত ভীষ্মও জানেন না, দ্রোণও জানেন না, কৃপ, অশ্বথামা বা কর্ণও জানেন না। এ সকল বড়-বড় অস্ত্র সাধারণ যুদ্ধে ব্যবহার করিতে নাই। আমরা সাদাসিধা যুদ্ধ করিয়াই জয়লাভ করিব৷”

 কুরুক্ষেত্রের পশ্চিমভাগে, দুর্যোধনের শিবির হইয়াছিল। যুদ্ধের দিনের, নির্মল প্রভাতে, তাঁহার লোকেরা স্নানান্তে মালা আর সাদা কাপড় পরিয়া অসীম উৎসাহ ভরে সেইখানে আসিয়া দাঁড়াইলেন।

 মাঠের পূর্বভাগে পশ্চিমমুখ হইয়া যুধিষ্ঠিরের দলও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। সহস্ৰ সহস্র ঢাক আর অযুত শঙ্খ মহাঘোররবে তাঁহাদিগকে উৎসাহিত করিতেছে।