উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/ছেলেদের মহাভারত/ভীষ্মপর্ব

ভীষ্মপর্ব

দ্ধ আরম্ভ করিবার পূর্বে এইরূপ নিয়ম হইল যে, যে ব্যক্তি অস্ত্র ফেলিয়া যুদ্ধ ছাড়িয়া দিয়াছে, যে আশ্রয় চাহিতেছে, আর যে অন্যের সহিত যুদ্ধে ব্যস্ত, এরূপ লোককে কে বধ করিবে না। যুদ্ধের সময় ছাড়া অন্য সময় দুই দলের লোকই বন্ধুর মতো ব্যবহার করবে। গালির উত্তরে শুধু গালিই দিবে, অস্ত্রাঘাত করিবে না। যুদ্ধের স্থান হইতে কেহ বাহির হইয়া গেলে, আর তাহাকে মারিবে না। রথী রথীর সহিত, হাতি হাতির সহিত, ঘোড়া ঘোড়ার সহিত, পদাতি পদাতির সহিত, এইভাবে যুদ্ধ হইবে। মারিবার সময় বলিয়া মারিবে। অচেতন লোককে, আর সারথি, সহিস, অস্ত্রবাহক, বাজনদার ইহাদিগকে কখনো প্রহার করিবে না।

 এই সময়ে, ভয়ানক যুদ্ধ উপস্থিত জানিয়া, ব্যাসদেব ধৃতরাষ্ট্রকে দেখিতে আসিলেন। ধৃতরাষ্ট্রের তখন নিতান্তই দুঃখের অবস্থা। পুত্রগণের ব্যবহার, আর যুদ্ধের ভীষণ ফলের কথা ভাবিয়া তিনি আর কুল কিনারা পাইতেছে না। এমন সময় ব্যাসদেব আসিয়া তাহাকে অনেক বুঝাইয়া বলিলেন, “যাহা হইবার, তাহা হইবেই তুমি দুঃখ করিও না। যদি যুদ্ধ দেখিতে চাও, আমি তোমাকে চক্ষু দিতে পারি৷”

 ধৃতরাষ্ট্র বলিলেন, “আত্মীয়গণের মৃত্যু আমি দেখিতে পারিব না। আপনার কৃপায় যুদ্ধের সকল সংবাদ যেন শুনিতে পাই৷”

 এ কথায় ব্যাস সঞ্জয়কে দেখাইয়া বলিলেন, “তোমার এই সঞ্জয়ের নিকট তুমি সকল কথাই শুনিতে পাইবে। আমার বরে, যুদ্ধের কোনো সংবাদই ইহার অজানা থাকিবেনা। দেখা হউক, অদেখা হউক, সকল ঘটনাই, এমনকি, লোকের মনের কথা পর্যন্ত, সে জানিতে পারিয়া তোমাকে শুনাইবে। যুদ্ধের ভিতর গিয়াও সে সুস্থ শরীরে ফিরিয়া আসিবে; অস্ত্রে তাহার কোনো অনিষ্ট হইবে না৷”

 এই কথা বলিয়া ব্যাসদেব আবার ধৃতরাষ্ট্রকে বলিলেন, “এ কাজটা ভালো হইতেছে না; তুমি ইহাদিগকে বারণ কর। তোমার রাজ্যের এতটা কি প্রয়োজন যে, তাহার জন্য এমন পাপ করিতে যাইতেছ? পাণ্ডবদের রাজ্য তাহাদিগকে ফিরাইয়া দাও৷”

 ধৃতরাষ্ট্র বলিলেন, “আমি তো যাহাতে ধর্ম হয় তাহাই চাই, কিন্তু উহারা যে আমার কথা শুনে না৷”

 এইরূপ কথাবার্তার খানিক পরে ব্যাসদেব সেখান হইতে চলিয়া গেলেন।

 এদিকে পাণ্ডব ও কৌরবদিগের সৈন্য সকল যুদ্ধক্ষেত্রে সামনাসামনি ব্যূহ বাঁধিয়া দাঁড়াইয়াছে যুদ্ধ আরম্ভ হইতে আর বিলম্ব নাই।

 ব্যূহ বাঁধা কাহাকে বলে জান? সৈন্যেরা তো যুদ্ধের সময় তাহাদের ইচ্ছামত এলোমেলোভাবে দাঁড়াইতে পায় না; তাহাদিগকে কোনো একটা বিশেষ নিয়মে, বেশ জমাটরূপে গুছাইয়া দাঁড় করাইতে হয়। এইরূপ কায়দা করিয়া দাঁড়ানোর নাম ‘ব্যূহ’। এক একরকম ব্যয়ে এক একরকম নাম; যেমন ‘চক্র’ ব্যূহ, ‘গরুড়’ ব্যূহ ইত্যাদি।

 পাণ্ডবদিগের ব্যূহ দেখিয়া দুর্যোধন দ্রোণকে বলিলেন, “গুরুদেব! দেখুন, পাণ্ডবদের কত সৈন্য, ধৃষ্টদ্যুম্ন তাহাদের ব্যূহ নির্মাণ করিয়াছে। উহাদের দলে খুব বড় বীর আছে তেমনি আমাদেরও তাহার চেয়ে বেশি আছে। তাহা ছাড়া, আমাদের সৈন্য ঢের, উহাদের সৈন্য কম। আমাদের ব্যূহের মাঝখানে ভীষ্ম রহিয়াছেন;তাহাকে রক্ষা করিবার জন্য ব্যূহে ঢুকিবার পথে পথে আপনারা সকলে আছেন৷”

 এ কথা শুনিয়া ভীষ্ম সিংহনাদপূর্বক তাঁহার শঙ্খে ফুঁ দিলেন। সেই শঙ্খের সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার শঙ্খ, শিঙ্গা, ঢাক প্রভৃতি বাজিয়া রণস্থলে তুমূল কাণ্ড উপস্থিত করিল।

 ইহার উত্তরে পাণ্ডবদিগের পক্ষ হইতে, কৃষ্ণের ‘পাঞ্চজন্য’, অর্জুনের ‘দেবদত্ত’, ভীমের ‘পৌণ্ড্র’, যুধিষ্ঠিরের ‘অনন্তবিজয়’, নকুলের ‘সুঘোষ’, আর সহদেবের ‘মণিপুষ্পক’ নামক মহাশঙ্খের ভয়ংকর শব্দের সহিত, ধ্রুপদ, বিরাট, সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী প্রভৃতি সকলের শঙ্খের শব্দ মিলিয়া আকাশ পাতাল কাঁপাইয়া কৌরবদিগের আতঙ্ক জন্মাইয়া দিল।

 তখন অর্জুন গাণ্ডীব হাতে করিয়া কৃষ্ণকে বলিলেন, “একবার দুই দলের মাঝখানে রথ লইয়া চলুন, কে কে যুদ্ধ করিতে আসিয়াছে—দেখিয়া লই।”

 এ কথায় কৃষ্ণ দুই দলের মাঝখানে রথ লইয়া গেলে, অর্জুন দেখিলেন যে, খুড়া, জ্যাঠা, মামা, ভাই, পুত্র, ভ্রাতুস্পুত্র, বন্ধু, প্রভৃতি যত ভক্তি মান্য, স্নেহ এবং ভালোবাসার পাত্র, সকলেই যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত;রাজ্যের জন্য সকলেই কাটাকাটি করিয়া প্রাণ দিতে আসিয়াছে। ইহা দেখিয়া দুঃখে তাহার বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল। তিনি কাদিতে কঁদিতে কৃষ্ণকে বলিলেন, “হায়! আমি কাহাকে মারিয়া রাজ্য লইতে আসিয়াছি! এমন রাজ্য পাইয়া ফল কি? এইরূপ ভয়ানক পাপ করার চেয়ে, শত্রুর হাতে মারা যাওয়াই তো ভালো৷”

 এই বলিয়া তিনি গাণ্ডীব ফেলিয়া কাঁদিতে লাগিলেন।

 সেদিন কৃষ্ণ সঙ্গে না থাকিলে, আর কি অর্জুনের যুদ্ধ করা হইত? তাহার মনের দুঃখ দূর করিয়া, তাহা দ্বারা যুদ্ধ করাইতে, কৃষ্ণকে অনেক পরিশ্রম করিতে হইয়াছিল। তখন কৃষ্ণ তাহাকে যে সকল উপদেশ দেন, তাহাতে ‘ভগবদগীতা’ নামক অমূল্য পুস্তকই হইয়া গিয়াছে বড় হইয়া তোমরা তাহা পড়িবে। যাহা হউক, কৃষ্ণের উপদেশে অর্জনের মন শান্ত হওয়াতে, আবার তাহার যুদ্ধের উৎসাহ আসিল।

 এমন সময় মহারাজ যুধিষ্ঠির, বর্ম আর অস্ত্র পরিত্যাগপূর্বক রথ হইতে নামিয়া কিসের জন্য ভীষ্মের রথের দিকে হাঁটিয়া চলিয়াছে। তাহাকে ঐরূপ করিতে দেখিয়া কৃষ্ণ, অর্জুন, ভীম, নকুল, সহদেব আর অন্যান্য বীরেরাও তাহার সঙ্গে চলিয়াছেন; কিন্তু ইহাদের কেহই যুধিষ্ঠিরের কার্যের অর্থ বুঝিতে পারিতেছেন না। ভীম, অর্জুন, নকুল আর সহদেব বলিলেন, “দাদা! যুদ্ধ আরম্ভ হয় হয়, এমন সময় আপনি আমাদিগকে ফেলিয়া কোথায় চলিয়াছেন?”

 যুধিষ্ঠির তাহাদের দিকে ফিরিয়া চাহিলেন, কিন্তু কথা বলিলেন না। তখন কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া, তাহাদিগকে বলিলেন, “উনি যুদ্ধাবম্ভের পূর্বে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, শল্য প্রভৃতি গুরুজনকে প্রণাম করিতে চলিয়াছে, ইহাতে উহার জয়লাভ হইবে।”

 এদিকে কৌরবপক্ষের লোকেরাও যুধিষ্ঠিরকে ঐরূপ করিতে দেখিয়া, নানা কথা বলিতে আরম্ভ করিয়াছে। কেহ বলিল, ‘কাপুরুষ! ভয় পাইয়াছে!’ কেহ বলিল, ‘তাই ভীষ্মের পায়ে ধরিতে চলিয়াছে৷’ কেহ বলিল, ‘এমন ভাই থাকিতে এত ভয়, ছিঃ!’

 যাহা হউক, যুধিষ্ঠির ততক্ষণে ভীষ্মের নিকট উপস্থিত হইয়া, তাহার পায়ে ধরিয়া বলিলেন, “দাদামহাশয়! আপনার সহিত যুদ্ধ করিব, অনুমতি দিন আর আশীর্বাদ করুন৷”

 ভীষ্ম বলিলেন, “আশীর্বাদ করি ভাই, তোমার জয় হউক! তুমি না আসিলে হয়তো আমার রাগ থাকিত, কিন্তু তুমি আসাতে বড়ই সুখী হইলাম। বল, তোমার আর কি চাই। ভাই, মানুষ টাকার দাস। দুর্যোধনের টাকায় আমি আটকা পড়িয়াছি, কাজেই তোমার হইয়া যুদ্ধ করিতে পারিব না। আর যাহা চাও তাহাই দিব৷”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “আপনাকে কি করিয়া পরাজয় করিব, দয়া করিয়া তাহা বলিয়া দিন৷”

 ভীষ্ম বলিলেন, “আমাকে পরাজয় করার সাধ্য কাহারো নাই, আর এখন আমার মরিবার সময়ও উপস্থিত হয় নাই। তুমি আবার আমার নিকট আসিও৷”

 তখন যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে প্রণাম করিয়া দ্রোণের নিকট গেলেন। দ্রোণের সহিতও তাহার ঐরূপ কথাবার্তা হইল। তাহাকে পরাজয় করিবার উপায়ের কথা জিজ্ঞাসা করিলে দ্রোণ বলিলেন, “আমি বাচিয়া থাকিতে আমাকে পরাজয় করিতে পারিবে না; আমাকে মারিয়া ফেলিবার চেষ্টা কর। সত্যবাদী লোকের মুখে নিতান্ত অপ্রিয় সংবাদ শুনিলেই, আমি অস্ত্র ঘড়িয়া দিব। এমনি সময় আমাকে মারিবার সুযোগ৷”

 সেখান হইতে যুধিষ্ঠির কৃপের নিকট গেলেন। সেখানেও ঐরূপই কথাবার্তা হইল। কৃপ বলিলেন, “আমি অমর, কাজেই আমাকে মারা সম্ভব হইবে না। কিন্তু তথাপি নিশ্চয় তোমার জয় হইবে; আমি সর্বদা তোমাকে আশীর্বাদ করিব৷”

 কৃপের নিকট হইতে যুধিষ্ঠির শল্যের নিকট গেলেন এবং যুদ্ধের সময় কর্ণের তেজ কমাইয়া দিবার কথা তাহাকে স্মরণ করাইয়া দিলেন। শল্য বলিলেন, “আমি তাহা নিশ্চয় করিব। নির্ভয়ে যুদ্ধ কর, তোমার জয় অবশ্য হইবে৷”

 ইহার মধ্যে কৃষ্ণ কর্ণকে বলিলেন, “কর্ণ, ভীষ্ম থাকিতে তো তুমি আর এ পক্ষে যুদ্ধ করিতেছ না, ততদিন আমাদের পক্ষ হইয়া যুদ্ধ কর না কেন?”

 এ কথার উত্তরে কর্ণ বলিলেন, “আমি কিছুতেই দুর্যোধনের অনিষ্ট করিতে পারিব না৷”

 ফিরিয়া আসিবার সময় যুধিষ্ঠির উচ্চৈঃস্বরে কৌরবদিগকে বলিলেন, “এখানে যদি আমার বন্ধু কেহ থাকেন, তবে তিনি আসুন আমরা পরম আদরে তাহাকে আমাদের দলে লইব৷”

 এ কথায় ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র যুযুৎসু আহ্লাদের সহিত বলিলেন, “মহারাজ! আমি আপনার হইয়া যুদ্ধ করিব৷”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “এস ভাই। তুমি আমাদের হইলে৷”

 তারপর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। সে যে কি ভয়ানক যুদ্ধ, তাহা লিখিয়া বুঝাইবার সাধ্য আমার নাই। সে যুদ্ধে বৃষ্টির ধারার ন্যায় ক্রমাগত বাণ পড়িয়াছিল; ঝড়ের সময় যেমন গাছের ফল পড়ে, সেইরূপ করিয়া লোকের মাথা কাটিয়া পড়িয়াছিল, কাটা মানুষের পাহাড় হইতে রক্তের নদী বহিয়া চলিয়াছিল। তখনকার ভয়ানক শব্দের কথা আর কি বলিব! তেমন শব্দ আর কখনো হয় নাই।

 সে সময়ে ভীষ্ম, দ্রোণ, অর্জুন, ভীম প্রভৃতি বড়বড় যোদ্ধাদের বীরত্ব ও ক্ষমতা দেখিয়া, দেবতারা পর্যন্ত আশ্চর্য হইয়া যান। অনেকবারই তাহাদিগকে একথা মানিতে হইয়াছে যে, এমন অদ্ভুত কাজ আমরাও করিতে পারি কি না সন্দেহ। ইহাদের এক একজনে যখন রাগিয়া দাঁড়াইয়াছে, তখন শত যোদ্ধা মিলিয়াও তাহাকে আটকাইতে পারে নাই। হাজার হাজার লোক মারিয়া তবে তাহারা থামিয়াছেন। ভীষ্ম, দ্রোণ বা অর্জুনের এক এক বাণে, অথবা ভীমের এক এক গদাঘাতে, এক একটা হাতি তৎক্ষণাৎ মারা যাইতে ক্রমাগতই দেখা গিয়াছে।

 পাণ্ডবদের পুত্রেরাই[] কি কম যুদ্ধ করিয়াছিলেন? অভিমন্যুর যুদ্ধ দেখিয়া ভীষ্ম প্রভৃতিরা বারবার বলিয়াছেন, “ঠিক যেন অর্জুন৷” ভীষ্মের সহিত তাহার খুবই যুদ্ধ হয়। তখন ভীষ্ম অনেক চেষ্টা করিয়া তাহার কিছু করিতে পারেন নাই। অভিমন্যু তাহার সমুদয় বাণ কাটিয়া রথের ধ্বজা উড়াইয়া দিয়াছিলেন।

 আহা! উত্তরের কথা মনে করিয়া বাস্তবিকই দুঃখ হয়। বেচারা সেদিন ভালো করিয়া যুদ্ধ করিতে না করিতেই শল্যের হাতে মারা গেলেন। তিনি এক প্রকাণ্ড হাতিতে চড়িয়া শল্যকে আক্রমণ করেন। হাতি শল্যের রথের ঘোড়াগুলিকে মারিয়া ফেলিল। কিন্তু শল্য তাহার পরেই উত্তরকে এমন ভয়ংকর একটা শক্তি ছুড়িয়া মারিলেন যে, তাহা তাঁহার বর্ম ভেদ করিয়া, একেবারে তাঁহার দেহের ভিতর ঢুকিয়া গেল। সেই শক্তির ঘায়েই উত্তর হাতি হইতে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিলেন।

 উত্তরের দাদা শ্বেত ইহাতে অসহ্য শোক পাইয়া রাগের সহিত কৌরবদিগকে আক্রমণ করেন। খানিক যুদ্ধের পর একটা ভয়ানক বাণের ঘায় তিনি অজ্ঞান হইয়া গেলে, তাহার সারথি তাঁহাকে লইয়া প্রস্থান করে। কিন্তু অল্পক্ষণের ভিতরেই তিনি আবার আসিয়া যুদ্ধ আরম্ভ করেন। এবার তিনি শল্যকে এমন তেজের সহিত আক্রমণ করিলেন যে, ভীষ্ম প্রভৃতি বীরেরা আসিয়া সাহায্য না করিলে, শল্যের প্রাণরক্ষা করাই কঠিন হইত। ভীষ্মের দল আসাতে শল্যও বাঁচিয়া গেলেন, আর যুদ্ধও আবার অতি ঘোরতর হইয়া উঠিল। সেই যুদ্ধে ভীষ্ম কত লোককে যে মারিলেন, তাহার সংখ্যা নাই।

 শ্বেতও সেই সময়ে অসাধারণ বীরত্ব দেখাইয়াছিলেন। সৈন্যরা তাঁহার তেজ সহ্য করিতে পাবিয়া, ভীষ্মের নিকট গিয়া আশ্রয় লয়। ভীষ্ম ছাড়া আর কেহই শ্বেতের সম্মুখে স্থির থাকিতে পারেন নাই। এমনকি, ভীষ্মও এক একবার স্বেতের হাতে রীতিমত জব্দ হইতে লাগিলেন। একবার তো সকলে মনে করিল, বুঝি বা শ্বেতের হাতে তাঁহার মৃত্যুই হয়।

 তখন ভীষ্ম যারপরনাই রাগের সহিত শ্বেতকে অনেকগুলি বাণ মারিলেন; শ্বেতও তাহার সব আটকাইয়া, ভল্ল দ্বাবা তাঁহার ধনুক কাটিয়া ফেলিলেন। ভীষ্ম অমনি আর এক ধনুক লইয়া, শ্বেতের রথের ঘোড়া ধবজ আর সারথিকে মারিয়া ফেলাতে কাজেই তাঁহাকে রথ হইতে লাফাইয়া পড়িতে হইল। তখন তিনি ধনুক রাখিয়া ভীষ্মকে একটা ভয়ংকর শক্তি ছুঁড়িয়া মারেন, কিন্তু তাহা ভীষ্মের বাণে খণ্ড খণ্ড হইয়া যায়। শক্তি বৃথা হওয়ায়, শ্বেদ গদা লইয়া যেই ভীষ্মের উপরে তাহা ছুঁড়িতে যাইবেন, অমনি ভীষ্ম তাহা এড়াইবার জন্য রথ হইতে লাফাইয়া পড়িলেন। সে গদা রথের উপরে পড়িলে আর রথ, ঘোড়া, সারথি, কিছুই অবশিষ্ট রহিল না।

 এদিকে দ্রোণ, কৃপ, শল্য প্রভৃতি যোদ্ধারা সাহায্যের জন্য সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন; ভীষ্মের নতুন রথ আসিযাছে। শ্বেতের পক্ষেও সাত্যকি, ভীম, ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। সুতরাং কিছুকাল সকলে মিলিয়া আবার যুদ্ধ চলিল। এমন সময় ভীষ্ম কি যে এক সাংঘাতিক বাণ ছুঁড়িয়া বসিলেন, শ্বেতের তাহা বারণ করিবার কোনো ক্ষমতাই হইল না, সে বাণ তাঁহার বর্ম ও শরীর ভেদ করিয়া মাটির ভিতরে ঢুকিয়া গেল।

 শ্বেতের মৃত্যুর পর সেদিন আর পাণ্ডবদের যুদ্ধে উৎসাহ রহিল না। এদিকে ভীষ্ম শ্বেতকে মারিয়া, এতই তেজের সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন যে, মনে হইল, বুঝি এখনি তিনি সকলকে মারিয়া শেষ করেন। তখন সন্ধ্যাও হইয়াছিল, কাজেই যুধিষ্ঠির সেদিনের মতন যুদ্ধ শেষ করিয়া দিয়া দুঃখের সহিত শিবিরে ফিরিলেন।

 সে রাত্রিতে যুধিষ্ঠিরের মনে বড়ই চিন্তা হইতে লাগিল। তিনি সকলকে বলিলেন, “এমনভাবে বন্ধুবান্ধবকে মরিতে দেখিয়া আমার বড়ই কষ্ট হইতেছে। কাল হইতে তোমরা আরো ভালো করিয়া যুদ্ধ কর।”

 যুধিষ্ঠিরের চিন্তা দেখিয়া সকলে মিলিয়া তাহাকে উৎসাহ দিতে লাগিলেন। ইহাতে তাহার মন অনেকটা শান্ত হওয়ায়, পরদিনের যুদ্ধের পরামর্শ আরম্ভ হইল। তখন যুধিষ্ঠির ধৃষ্টদ্যুম্নকে বলিলেন, “এবারে ‘ক্রৌঞ্চারুণ’ ব্যহ করিয়া সৈনা সাজাইবে।”

 পরদিন ‘ক্রৌঞ্চারুণ’ ব্যুহ করিয়া পাণ্ডবদিগের সৈন্য সাজান হইল। কৌরবেরাও তাদের সৈন্য দিয়া অন্যরূপ এক ব্যুহ প্রস্তুত করিলেন। সেদিনকার যুদ্ধও নিতান্তই ভয়ানক হইয়াছিল।

 সেইদিন অর্জুনের যুদ্ধে কৌরবেরা বড়ই অস্থির হইয়া উঠে। তাহা দেখিয়া দুর্যোধন ভীষ্মকে বলিলেন, “দাদামহাশয়! আপনারা থাকিতে কি অর্জুন সব সৈন্য মারিয়া শেষ করিবে? একটু ভালো করিয়া যুদ্ধ করুন।”

 তখন অর্জুন আর ভীষ্মে এমনি ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল যে, তেমন যুদ্ধ আর হয় নাই। সে যুদ্ধ দেখিয়া অন্য সকলের উৎসাহ বাড়িয়া যাওয়াতে, তাহারা পাগলের মতো হইয়া কাটাকাটি আরম্ভ করিল।

 ধৃষ্টদ্যুম্ন আর দ্রোণেও সেদিন কম যুদ্ধ হয় নাই। যুদ্ধ করিতে কবিতে ধৃষ্টদ্যুম্নের সারথি ঘোড়া আর ধনুক কাটা গেল। তখন তিনি ভাবিলেন যে, গদা লইয়া দ্রোণকে আক্রমণ করিবেন। কিন্তু রথ হইতে নামিবার পূর্বেই দ্রোণ সেই মহাগদা কাটিয়া খণ্ড খণ্ড করিলেন, তারপর ধৃষ্টদ্যুম্ন ঢাল তলোযার লইয়া দ্রোণকে মারিতে চলিলেন কিন্তু তাহার বাণের মুখে অগ্রসর হয়, কাহার সাধ্য? ধৃষ্টদ্যুম্ন ঢাল দিয়া বাণ কাটাইতে ব্যস্ত রহিলেন, তাহাব আর যুদ্ধ করা হইল না।

 এই সময় ভীম ধৃষ্টদ্যুম্নের সাহায্য করিতে আসিয়া কি অদ্ভুত কাণ্ডই দেখাইলেন! কলিঙ্গ আর তাহার পুত্র শত্রুদেব কিছুকাল তাহার সহিত খুব যুদ্ধ করিয়াছিলেন, এমনকি, তাহাদের ভয়ে তাহার সঙ্গের চেদি দেশীয় সৈন্যগুলি তাহাকে ফেলিয়া পলায়ন কবিতেও ত্রুটি করে নাই। শত্রুদেব ভীমের ঘোড়া অবধি মারিয়া ফেলেন। কিন্তু তাহার পরেই ভীম এমন এক গদা ছুঁড়িয়া মারিলেন যে, তাহাতে শত্রুদেব আর তাহার সারথির শরীর চূর্ণ হইয়া গেল।

 তারপর ভানুমানের সহিত ভীমের যুদ্ধ হয়। ভানুমান ছিলেন হাতির উপরে আর ভীম মাটির উপরে। ভীম খড়্গ হাতে একলাফে সেই হাতির উপরে উঠিয়া, ভানুমান এবং হাতি উভয়কেই কাটিয়া ফেলিলেন। তারপর ভীম হাতি, ঘোড়া যাহা সম্মুখে পান, তাহাই খড় দিয়া খণ্ড খণ্ড করেন। লাথির চোটে কত মানুষ পুঁতিয়া গেল। হাঁটুর গুঁতায় কত যোদ্ধা ঠিকরাইয়া পড়িতে লাগিল। এ সকল কাণ্ড দেখিয়া কে কোথায় পলাইবে তাহার ঠিকানাই রহিল না।

 তারপর ভীম কলিঙ্গ আর কেতুমানকে মারিয়া, দুইহাজার সাতশত কলিঙ্গ সেনা বধ করিলেন।

 আর এক স্থানে দুর্যোধন অনেক যোদ্ধা লইয়া অভিমন্যুকে ঘিরিয়াছে। অভিমন্যুর তাহাতে কিছুমাত্র ভয় হয় নাই। কিন্তু অর্জুন যখন দেখিলেন যে তাহার পুত্রকে দুরাত্মারা ঘিরিয়া ফেলিয়াছে তখন আর তিনি তাহার কাছে আসিয়া থাকিতে পারিলেন না। এদিকে ভীষ্ম, দ্রোণ প্রভৃতি বড় বড় বীরেরা অর্জুনকে আটকাইবার জন্য আসিয়া উপস্থিত। তখন অর্জুন এমনি ভয়ানক যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন যে, তাহাকে আটকান দূরে থাকুক, উহাদের নিজের প্রাণ বাঁচানোই ভার হইল। চারিদিকে খালি যোদ্ধাদের মাথা কাটিয়া পড়িতেছে, ইহা ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। সর্বনাশ উপস্থিত দেখিয়া, ভীষ্ম তাড়াতাড়ি দ্রোণাচার্যকে ডাকিয়া বলিলেন, “ঐ দেখ, অর্জুন কি আরম্ভ করিয়াছে! আজ আর উহার সঙ্গে পারা যাইবে না। বেলাও শেষ হইয়াছে শীঘ্র যুদ্ধ থামাইয়া দাও।”

 কাজেই তখন যুদ্ধ শেষের শিঙ্গা বাজিয়া উঠিল; কৌরব সৈন্যেরাও বলিল, “আঃ বাঁচিলাম!”

 পরদিন কৌরবেরা গরুড় ও পাণ্ডবেরা অর্ধচন্দ্র’ ব্যুহ করিয়া সৈন্য সাজাইলেন। সেদিন ভীষ্ম, দ্রোণ, অর্জুন, দ্রৌপদীর পাচ পুত্র, ভীম, ঘটোৎকচ, ধৃষ্টদ্যুম্ন, যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব প্রভৃতি সকলেই খুব যুদ্ধ করেন। যুধিষ্ঠির আর ধৃষ্টদ্যুম্ন এমনি যুদ্ধ করিয়াছিলেন যে, ভীষ্ম আর দ্রোণ দুজনে মিলিয়াও তাহাদিগকে নিবারণ করিতে পারেন নাই। কৌরব-সৈন্যেরা ভীষ্ম দ্রোণের কথা না শুনিয়া তাহাদের সম্মুখে পলাইতে লাগিল।

 ইহা দেখিয়া দুর্যোধন ভীষ্মকে বলিলেন, “সৈন্য সব মারা যাইতেছে, আর আপনারা চুপ করিয়া আছেন! ইহাতে বোধহয়, পাণ্ডবদের উপকার করাই আপনাদের উদ্দেশ্য। এমন জানিলে আমি কখনোই যুদ্ধ করিতে আসিতাম না।”

 এ কথায় ভীষ্ম বলিলেন, “পাণ্ডবেরা যে কত বড় বীর, তাহা তোমাকে বারবার বলিয়াছি। আমি বুড়া মানুষ, তথাপি আমার যথাসাধ্য যুদ্ধ করিতেছি, দেখ।”

 এই বলিয়া ভীষ্ম ক্রোধভরে এমনি যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন যে কাহার সাধ্য তাহার সামনে দাঁড়ায়! চারিদিকে কেবল হায় হায়!’ রক্ষা কর?’ বাবা গো!’ এইরূপ শব্দ। পাণ্ডব পক্ষের এক এক যোদ্ধার নাম করিয়া তিনি বলেন, “এই তোমাকে কাটলাম!” আর অমনি তাহার মাথা কাটিয়া পড়ে! সেই বুড়ো মানুষ তখন এমনি বেগের সহিত ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলেন যে, তাহার বাণই কেবল দেখা গিয়াছিল, কিন্তু তাহাকে দেখিতে পাওয়া যায় নাই।

 এইরূপ অবস্থা দেখিয়া কৃষ্ণ অর্জুনকে বলিলেন, “অর্জুন! এই তো সময়। তুমি বলিয়াছিলে ভীষ্ম, দ্রোণ সকলকে মারিবে; এখন তোমার কথা রাখ।”

 অর্জুন বলিলেন, “শীঘ্র ভীষ্মের নিকট রথ লইয়া চলুন।”

 কিন্তু অর্জুন অনেক যুদ্ধ করিয়াও ভীষ্মকে পরাজয় করিতে পারিলেন না। বুড়া বাণে বাণে কৃষ্ণ অর্জুনকে ক্ষত-বিক্ষত করিয়া হাসিতে লাগিলেন। কৃষ্ণ বলিয়াছিলেন যুদ্ধ করিবেন না; কিন্তু ভীষ্মের কাণ্ড দেখিয়া তাহার মনে হইল যে, চুপ করিয়া থাকিলে বা তিনি এখনই পাণ্ডবদিগের সকলকে মারিয়া শেষ করেন। কাজেই তিনি রাগে অস্থির হইয়া বলিলেন, “আজই আমি কৌরবদিগের সকলকে মারিয়া যুধিষ্ঠিরকে রাজা করিব।”

 এই বলিয়া তিনি তাহার সেই সুদর্শন চক্র নামক আশ্চর্য অস্ত্র হাতে ভীষ্মকে মারিবার জন্য ছুটিয়া চলিলেন। ভীষ্মের তাহাতে কিছুমাত্র ভয় বা দুঃখের চিহ্ন দেখা গেল না। তিনি কৃষ্ণকে নমস্কার করিয়া বলিলেন, “তুমি সকল দেবতার শ্রেষ্ঠ, তোমার হাতে মরিলে তো আমি অমনি স্বর্গে যাই। এখনই আমাকে কাট।”

 এমন সময় অর্জুন নিতান্ত লজ্জিত ও কাতরভাবে আসিয়া কৃষ্ণের পায়ে ধরিয়া বলিলেন, “আপনি শান্ত হউন, আমি আর যুদ্ধে অবহেলা করিব না।”

 একথায় কৃষ্ণ সন্তুষ্ট হইয়া, আবার আসিয়া ঘোড়ার রাশ হাতে লইলেন। ইহার পর সন্ধ্যা পর্যন্ত অর্জুন যে কি ভীষণ যুদ্ধ করিলেন, তাহা আর কি বলিব। তাহার গাণ্ডীব হইতে অদ্ভুত ইন্দ্র-অস্ত্র এবং আগুনের মতন উজ্জ্বল আরো অসংখ্য বাণ উল্কা ধারার ন্যায় অবিরাম ছুটিয়া গিয়া কৌরবদিগকে ধানের মতো কাটিতে লাগিল। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, শল্য, ভূরিশ্রবা, বাত্নীক প্রভৃতি সকলে হরিয়া গেলেন। তাহা দেখিয়া কৌরব-সৈন্যেরা সেই যে রণস্থল হইতে চাঁচাইয়া ফু দিল, আর শিবিরের ভিতরে না গিয়া থামিল না।

 পরদিন আবার মহারণ আরম্ভ হইল। প্রথমে ভীষ্ম, অর্জুন আর অভিমন্যু প্রভৃতি ঘোর যুদ্ধ করেন। তারপর ধৃষ্টদ্যুম্ন কিছুকাল সাংযমনির পুত্রের সহিত যুদ্ধ করিয়া, গদাঘাতে তাহার মাথা গুঁড়া করিয়া দেন।

 কিন্তু সেদিনকার যুদ্ধে বাস্তবিক ভয়ানক কাণ্ড যদি কেহ করিয়া থাকেন, তবে সে ভীম! ভীম গদা হাতে হাতি, ঘোড়া, রথী, পদাতি সকলকে পিষিতে আরম্ভ করিলে দুর্যোধন তাহাকে মারিবার জন্য অনেকগুলি সৈন্য পাঠাইয়া দেন। সে সকল সৈন্য মারা গেলে, কিছুকাল ভীষ্ম আর অলম্বুষের সহিত সাত্যকির যুদ্ধ চলে। তারপর দুর্যোধনের সহিত ভীমের দেখা হয়। দুর্যোধন একবার বাণাঘাতে ভীমকে অজ্ঞান করিয়া দেন। ভীম অবিলম্বে আবার উঠিয়া দুর্যোধনকে মারেন আট বাণ, আর শল্যকে পচিশ। শল্য বেগতিক দেখিয়া তখনই পলায়ন করিলেন।

 তখন সেনানী, সুষেণ, জলসন্ধ, সুলোচন, উগ্ন, ভীমরথ, ভীম, বীরবাহু, আলোপুর, দুর্মুখ, দুধ, বিবিসু, বিকট এবং সম নামক দুর্যোধনের চৌদ্দ ভাই একসঙ্গে আসিয়া ভীমকে আক্রমণ করেন। ভীমের তাহাতে সন্তোষ ভিন্ন অসন্তোষের কোনো কারণ ছিল না। তিনি তাহাদিগকে হাতের কাছে পাইয়া, মনের সুখে এক একটি করিয়া সংহার করিতে লাগিলেন। প্রথমে সেনানী, তারপর জলসন্ধ, তারপর সুষেণ, তারপর উগ্র, বীরবাহু, ভীমরথ, সুলোচন—দেখিতে দেখিতে সাতটির প্রাণ গেল। ইহার পর আর বাকি সাতটির উধর্বশ্বাসে পলায়ন ভিন্ন উপায় রহিল না।

 এ সকল কাণ্ড দেখিয়া ভীষ্ম কৌরবদিগকে কহিলেন, “ঐ দেখ, ভীম বোকাগুলিকে পাইয়া একেবারে শেষ করিল! তোমরা শীঘ্র যাও।”

 সে কথায় ভগদত্ত ভীমকে আক্রমণ করিয়া, খানিক যুদ্ধের পর, একেবারে তাহাকে অজ্ঞান করিয়া ফেলেন। ভীম অজ্ঞান হওয়ামাত্রই বিশাল বিশাল হতির উপরে অগণ্য রাক্ষস লইয়া ঘোর বেগে ঘটোৎকচ আসিয়া উপস্থিত। তখন ভগদত্তকে বাচানোই কঠিন হইল। ততক্ষণ সন্ধ্যাও হইয়া আসিতেছিল। সুতরাং ভীষ্ম তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ করিয়া সেদিনকার মতন কৌরবদিগকে ঘটোৎকচের হাত হইতে রক্ষা করিলেন।

 পরদিন প্রভাতে কৌরবেরা মকর’ ব্যুহ ও পাণ্ডবেরা ‘শ্যেন’ ব্যহ করিয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন।

 প্রথমে ভীমার্জুন আর ভীষ্মের যুদ্ধ হইল, তারপর দ্রোণ আর সাত্যকির। সাত্যকি দ্রোণের হাতে একটু জল হইয়া আসিলে ভীম দ্রোণকে অনেক বাণ মারিয়া তাহাকে ছড়াইয়া দেন।ইহাতে ভীষ্ম, দ্রোণ আর শল্য রোষভরে ভীমকে আক্রমণ করায় অভিমন্যু দ্রৌপদীর পুত্রগণসহ ভীমের সাহায্য করিতে লাগিলেন।

 এমন সময় শিখণ্ডী ধনুর্বাণ হাতে ভীষ্মকে আক্রমণ করিলেন। কিন্তু ভীষ্ম তো আর তাহার সহিত যুদ্ধ করিবেন না। শিখণ্ডী যতই বাণ মারেন, ভীষ্মের তাহাতে ভ্রুক্ষেপ নাই।

 ততক্ষণে দ্রোণ সেখানে আসিয়া উপস্থিত হওয়ায়, শিখণ্ডীকে পলায়ন করিতে হইল। তারপর সকলে যুদ্ধে মাতিয়া রণস্থলে ভীষণ কাণ্ড উপস্থিত করিলেন। বেলা যায়, তথাপি যুদ্ধের বিরাম নাই। সেদিন সাত্যকি দুর্যোধনের অনেক সৈন্য মারেন। দুর্যোধন দশ হাজার সৈন্য পাঠাইয়া তাহাকে থামাইতে চেষ্টা করিয়াছিলেন, সেই দশ হাজার সৈন্যও তাহার হাতে মারা গেল।

 এই সময়ে ভূরিশ্রবা আসিয়া সাত্যকিকে ঘোরতররূপে আক্রমণ করাতে তাহার সঙ্গের লোকেরা তাহাকে ফেলিয়া পলায়ন করিল। সাত্যকির দশ পুত্র তাহার সাহায্যের জন্য ছুটিয়া আসিলেন। কিন্তু ভূরিশ্রবার বজ্রসম বাণের আঘাতে, দেখিতে দেখিতে তাহাদের দেহ চুর্ণ হইয়া গেল। তারপর বেলা আর অতি অল্পই অবশিষ্ট ছিল, কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যেই অর্জুন পঁচিশ হাজার মহারথী মারিয়া শেষ করিলেন। এইরূপে সেদিনকার যুদ্ধ শেষ হইল।

 পরদিন পাণ্ডবদের মকর’ ব্যুহ এবং কৌরবদের ‘ক্রৌঞ্চ’ ব্যুহ করিয়া সৈন্য সাজানো হইল। সেদিনকার যুদ্ধে ভীম এবং ধৃষ্টদ্যুম্নের যে বীরত্ব দেখা গিয়াছিল, তাহার তুলনা দুর্লভ। ভীমকে দেখিতে পাইয়াই দুঃশাসন তাহার আর বারোটি ভাইকে ডাকিয়া বলিলেন, “এস ভাইসকল। আজ ইহাকে মারিব।”

 তখন হাজার হাজার রথী লইয়া তেরো বীর ভীমকে আক্রমণ করিলেন। ভীমের তাহা গ্রাহ্যই হইল না; তিনি ভাবিলেন, আগে রথীগুলিকে শেষ করিয়া লই! তারপর তিনি গদা হাতে রথ হইতে নামিয়া, একদিক হইতে কৌরব সৈন্য মারিতে আরম্ভ করিলেন।

 এদিকে ধৃষ্টদ্যুম্ন যুদ্ধ করিতে করিতে সেখানে আসিয়া ভীমের শুন্য রথখানি দেখিয়া ব্যস্তভাবে সারথিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হায়! হায়। শূন্য রথ কেন? ভীম কোথায়?”

 সারথি বলিল, “তিনি কৌরব মারিবার জন্য গদা হাতে নামিয়া গিয়াছেন।”

 ভীম যে পথে গিয়াছেন, গদার ঘায় ক্রমাগত হাতি মারিয়া গিয়াছে। সেই হাতিগুলি দেখিয়া তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করিতে বিলম্ব হইল না। ভীম তখন ছোট সৈন্য শেষ করিয়া রাজা মারিতে ব্যস্ত। অতঃপর তাহারা দুজনে মিলিয়া যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। এই সময়ে দুর্যোধনের কতকগুলি ভাই সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইবামাত্র, ধৃষ্টদ্যুম্ন সম্মোহন অস্ত্র দ্বারা তাহাদিগকে অজ্ঞান করিয়া ফেলাতে বেচারারা যুদ্ধ করিতে পাইল না!

 ইহার পর দ্রোণ ধৃষ্টদ্যুম্নের সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করিয়া পাণ্ডবদিগকে বড়ই অস্থির করিয়া তোলেন। পাণ্ডবগণ কিছুতেই তখন তাহাকে বারণ করিতে পারেন নাই। তারপর ভীষ্ম আর অর্জুন কিছুকাল ভয়ানক যুদ্ধ হয়। এইরূপে সমস্ত দিনই নানা স্থানে তুমুল যুদ্ধ হইয়াছিল। কিন্তু কোন ঘটনা সেদিন ঘটে নাই।

 সেদিনকার যুদ্ধ শেষ হইলে, যুধিষ্ঠির ভীম আর ধৃষ্টদ্যুম্নকে আদর করিয়া মনের সুখে শিবিরে গেলেন।

 পরদিন কৌরবদিগের হইল মণ্ডপ’ ব্যুহ আর পাণ্ডবদের বস্ত্র ব্যুহ। সেদিন প্রথম বেলায় বিরাটের পুত্র শঙ্খ দ্রোণের হাতে মারা যান।

 সাত্যকি আর অলম্বুষে সেদিন খুব যুদ্ধ হইয়াছিল। অলম্বুষ রাক্ষস, ঘোর মায়াবী। তাই সে আগে মায়া দ্বারা সাত্যকিকে ভুলাইতে চেষ্টা করে। কিন্তু সাত্যকি অর্জুনের ছাত্র, তাঁহার নিকট ইন্দ্র-অস্ত্র শিক্ষা করিয়াছিলেন; সেই ইন্দ্র-অস্ত্র দিয়া তিনি রাক্ষসের সকল মায়া উড়াইয়া দিলেন। তখন সে পলাইতে পারিলে বাঁচে।

 অর্জুনের পুত্র ইরাবান, বিন্দ ও অনুবিন্দের সহিত যুদ্ধ করিয়া তাহাদিগকে পরাজয় করেন। ঘটোৎকচ ভগদত্তকে আক্রমণ করিয়াছিলেন। কিন্তু ভগদত্ত অসাধারণ যোদ্ধা;তাহার যুদ্ধ কেহ সহিতে পারে না। ঘটোৎকচ কিছুকাল তাহার সহিত খুব তেজের সহিত যুদ্ধ করিয়া শেষে পলায়ন করিতে বাধ্য হইল।

 শল্য সেদিন নকুল ও সহদেবকে আক্রমণ করিতে গিয়া, শেষে একটু জব্দ হন। মেঘ যেমন সূর্যকে ঢাকে, সহদেব তেমনি করিয়া বাণের দ্বারা শল্যকে ঢাকিয়া ফেলিয়াছিলেন। শল্য সহদেবের মামা; কাজেই তাহার বাণে আচ্ছন্ন হইয়াও তিনি অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন। খানিক বেশ জোরের সহিতই যুদ্ধ চলিয়াছিল। তারপর সহদেবের এক বাণ খাইয়া শল্য আর বসিয়া থাকিতে পারিলেন না। সারথি দেখিল, মদ্ররাজ অজ্ঞান হইয়া গিয়াছেন, সুতরাং সে রথ লইয়া প্রস্থান করিল।

 বেলা দুই প্রহরের সময় শ্রতায়ু যুধিষ্ঠিরের বাণ খাইয়া পলায়ন করেন। ভীষ্ম, দ্রোণ আর অর্জুনও সেদিন বহু সৈন্য বধ করেন। তারপর ক্রমে সন্ধ্যা হইল, সেদিনকার যুদ্ধও থামিল।

 পরদিন প্রভাতে কৌরবে সাগরের মতো ভয়ানক এক ব্যুহ প্রস্তুত করিলেন। তাহা দেখিয়া যুধিষ্ঠির ধৃষ্টদ্যুম্নকে বলিলেন, “তুমি শৃঙ্গাটক’ ব্যুহ রচনা কর।”

 সেদিন সকালবেলায় ভীষ্ম অসীম তেজের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। সে সময়ে এক ভীম ছাড়া আর এমন কেহই উপস্থিত ছিল না যে তাহাকে আটকায়। ভীম ভীষ্মকে আক্রমণ করিলেন; আর দুর্যোধন ভ্রাতাগণসহ তাহাকে রক্ষা করিতে লাগিলেন। ভীমের প্রথম কাজই হইল, ভীষ্মের সারথিটিকে সংহার করা। সারথি নাই, ঘোড়া কে থামাইবে? তাহারা রথ লইয়া রণস্থলময় ছুটাছুটি করিতেছে। সেই ফাঁকে ভীমও দুর্যোধনেব ভাই সুনাভের মাথাটি কাটিয়া বসিয়া আছে। সুনাভের মৃত্যুতে আদিত্যকেতু, বশী, কুণ্ডধার, মহোদর, অপরাজিত, পণ্ডিত ও বিশালাক্ষ নামক দুর্যোধনের আর সাত ভাই ক্ষেপিয়া ভীমকে মারিতে লাগিল। ভীমও তাহাদিগকে সম্মুখে পাইয়া আর সংহার করিতে বিলম্ব করিলেন না।

 তাহা দেখিয়া দুর্যোধন কাঁদিতে কাঁদিতে ভীষ্মকে বলিলেন, “দাদামহাশয়, ভীম তো ভাইগুলিকে মারিয়া ফেলিল। আপনার যুদ্ধে উৎসাহ নাই!”

 ভীষ্ম বলিলেন, “আগে তো শুন নাই! ভীম কি তোমাদিগকে পাইলে ছড়িবে? আমি আর দ্রোণ যথাসাধ্য যুদ্ধ করিতেছি, করিবও।”

 অর্জুনের পুত্র ইরাবান সেদিন অসাধারণ বীরত্ব দেখাইয়াছিলেন। শকুনি আর তাহার ছয় ভাই মিলিয়া ইরাবানকে আক্রমণ করেন। সাতজনে মিলিয়া চারিদিক হইতে মারে, কাজেই ইরাবান প্রথমে তাহাদিগের কিছু করিয়া উঠিতে পারেন নাই। তাহার শরীর অস্ত্রের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হইয়া গেল, দর দর ধারে রক্ত পড়িতে লাগিল। তখন ইরাবান অসিচর্ম (খড়্গ ও ঢাল) হাতে রথ হইতে নামিলেন। শত্রুরা এই সুযোগে তাহাকে মারিতে চেষ্টার ত্রুটি করে নাই। কিন্তু তাহারা আর কোনো অনিষ্ট করিবার পূর্বে শকুনি ছাড়া তাহাদের আর সকলে ইরাবানের খড়্গে খণ্ড খণ্ড হইয়া গেল।  ভাইদিগের মৃত্যুতে শকুনি পলায়ন করিলে, দুর্যোধন ইরাবানকে মারিবার নিমিত্ত আর্যশৃঙ্গ নামক এক ভয়ংকর রাক্ষসকে পাঠাইয়া দিলেন। দুরাত্মা যুদ্ধ করিতে আসিয়াই মায়াবলে দুই হাজার অশ্বারোহী রাক্ষস অনিয়া ফেলিল। রাক্ষসের দল মারামারি করিতেছে, সেই অবসরে মায়াবী আর্যশৃঙ্গ আকাশে উঠিয়া গিয়াছে। কিন্তু ইরাবানও মায়া জানিতেন, কাজেই আকাশে উঠিয়াও রাক্ষস তাহার কিছু করিতে পারিল না, তিনি খড়্গ দিয়া দুষ্টকে ক্ষত-বিক্ষত করিতে লাগিলেন।

 ইরাবান নাগের দেশের লোক। নাগেরা যুদ্ধের সংবাদ পাইয়া দলে দলে তাহার সাহায্য করিতে আসিয়া উপস্থিত হইল। রাক্ষসও তখন গরুড় হইয়। সেই কল সাপ গিলিতে আরম্ভ করিল।

 হায়! ইহাতে কি সর্বনাশ হইল! এই ব্যাপার দেখিয়া ইরাবান এমন আশ্চর্য হইয়া গেলেন যে, যুদ্ধের কথা আর তাঁহার একেবারে মনে নাই। সেই সুযোগে দুষ্ট রাক্ষস তাহার মাথা কাটিয়া ফেলি। অর্জুন অনাদিকে ভয়ানক যুদ্ধে ব্যস্ত, ইরাবানের মৃত্যুর কথা তিনি তখন জানিতে পারিলেন না। ভীষ্ম, দ্রোণ, ভীম, দ্রুপদ প্রভৃতিও তখন এত্যেকে হাজার হাজার করিয়া সৈন্য মাবিতেছেন। সে সময়ের অবস্থা কি ভীষণ: যোদ্ধাদিগের কি বিষম রাগ, যেন সকলকে ভূতে পাইয়াছে। ঘটোৎকচ, ভীম, দ্রোণ, ভগদত্ত ইহরা সকলেই অতি অদ্ভুত বীরত্ব দেখাইলেন। সেদিন বিকালবেলার অর্ধেক যুদ্ধ ঘটোৎকচ একেলাই কবিয়াছিল। তখন তাহার ভয় বা ক্লান্তি কিছুই দেখা যায় নাই।

 ভীমকে মারিবার জন্য দুর্যোধনের ভ্রাতারা দ্রোণকে সহায় করিয়া খুবই তেজের সহিত যুদ্ধ করিতে আসেন। কিন্তু ভীম যখন দ্রোণের সাক্ষাতেই তাহাদের এক একটি করিয়া ক্রমাগত বুঢ়োরস্ক, কুণ্ডলী, অনাধৃষ্য, কুণ্ডভেদী, বৈরাট, বিশালাক্ষ্য, দীর্ঘবাহু, সুবাহু ও কনকধবজ এই নয়টিকে বধ করিলেন, তখন অবশিষ্টেরা তাহকে সাক্ষাৎ যমের মতো ভাবিয়া আর পলাইবার পথ পান না।

 ইহারা পলাইয়া গেলে, ভীম অন্যান্য যোদ্ধাগণকে নারিতে আরম্ভ করিলেন। তখন ভীষ্ম, দ্রোণ, ভগদত্ত, কৃপ ইহাদের সাধ্য হইল না যে তাহাকে বারণ করেন।

 রাত্রি হইল, তথাপি যুদ্ধের শেষ নাই। ঘোর অন্ধকার হইলে তবে সেদিন সকলে শিবিরে গেলেন।

 রাত্রিতে দুর্যোধন কর্ণ আর শকুনিকে বলিলেন, “পাণ্ডবদিগকে কেহই মারিতে পারিতেছে না, ইহার কারণ কি? আমার মনে বড়ই ভয় হইয়াছে।”

 এ কথায় কর্ণ বলিলেন, “ভীষ্ম কেবল বড়াই করেন,আসলে তাহার ক্ষমতা নাই। উহাকে অস্ত্র পরিত্যাগ করিতে বলুন, দেখিবেন, আমি দুদিনের মধ্যে পাণ্ডবদিগকে মারিয়া শেষ করিব।”

 দুর্যোধন তখনই ভীষ্মের শিবিরে গিয়া তাঁহাকে প্রণামপূর্বক বলিলেন, “দাদামহাশয়! পাণ্ডবদিগকে মারিতে বিলম্ব করিতেছে কেন? আপনার যদি তাহাদিগকে মারিতে ইচ্ছ না থাকে, তবে না হয় একবার কর্ণকে বলিয়া দেখুন না। তিনি তাহাদিগকে বধ করিবেন।”

 এমন অপমানের কথায় ভীষ্মের মনে নিতান্তই ক্লেশ হইবে, তাহা আশ্চর্য কি? তিনি খানিক চক্ষু বুজিয়া চুপ করিয়া রহিলেন;তারপর বলিলেন, “আমি প্রাণপণে তোমার উপকার

উপেন্দ্র —৩৫ করিতেছি তথাপি তুমি কেন আমাকে এমন কঠিন কথা বলিতেছ? যে পাণ্ডবেরা খাণ্ডবদাহ করিল, নিবাত কবচগণকে মারিল, তোমাকে গন্ধর্বের হাত হইতে বাঁচাইল, বিরাটনগরে তোমাদিগকে হারাইয়া গরু ছাড়াইয়া নিল, আর তোমাদের পোশাক লইয়া উত্তরাকে পুতুল খেলিতে দিল, তাহারা যে অসাধারণ বীর ইহা কি বুঝিতে পার না? যাহা হউক, কাল আমি এমন যুদ্ধ করিব যে লোকে চিরদিন সেই যুদ্ধের কথা বলিবে।”

 পরদিন যুদ্ধ বড়ই ভয়ানক হইল। সকালবেলায় দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র আর অভিমন্যুকে মারিতে আসিয়া বাক্ষস অলম্বুষ খুব জব্দ হয়। তারপর দ্রোণ, অর্জুন, সাত্যকি, অশ্বথামা প্রভৃতি অনেকক্ষণ যুদ্ধ করেন। মধ্যাহ্নকাল হইতে যুদ্ধক্রমেই ঘোরতর হইয়া উঠিতে লাগিল। অর্জুন তখন এমন যুদ্ধ করিয়াছিলেন যে কৌরব সৈন্যেরা পলাইবারও অবসর পায় নাই।

 কিন্তু শেষবেলায় একেলা ভীষ্ম পাণ্ডবদিগকে একেবারে অস্থির করিয়া তুলিলেন। কাহার এমন ক্ষমতা হইল না যে তাহাকে আটকায়। ভীষ্মের ধনুষ্টঙ্কার অন্যসকল শব্দকে ডুবাইয়া দিল। তাহার বাণ যাহার গায়ে লাগিল, তাহাকে ভেদ না করিয়া ছাড়ল না। পাণ্ডব সৈন্যেরা অস্ত্র ফেলিয়া এলোচুলে চ্যাঁচাইয়া পলাইতে লাগিল;কাহার সাধ্য তাহাদিগকে ফিরায়। কৃষ্ণ ক্রমাগত অর্জুনকে বলিতেছে, “অর্জুন, কি দেখিতেছ? ভীষ্মকে মার!”

 অর্জুন বলিলেন, “রাজ্যের জন্য যদি এমন কাজই করিতে হয়, তবে আর বনে গিয়া ক্লেশ পাইলাম কেন? আচ্ছা চলুন আপনার কথাই রাখিতেছি।”

 কিন্তু অর্জুন কিছুতেই ভীষ্মকে বারণ করিতে পারিলেন না। তাহা দেখিয়া কৃষ্ণ চাবুক হাতে নিজেই ভীষ্মকে মারিতে চলিলেন। ইহাতে অর্জুন লজ্জিত হইয়া আরো উৎসাহের সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন বটে, কিন্তু তাহাতে ভীষ্মের তেজ কমা দূরে থাকুক, বোধ হইল যেন আরো বাড়িয়া গিয়াছে। আগুন লাগিলে উলুবনের যেমন দশা হয়, ভীষ্মের হাতে পড়িয়া পাণ্ডব সৈন্যদেরও প্রায় তেমনি হইল।

 যতক্ষণ আলো ছিল, ততক্ষণ ভীষ্ম এইরূপ করিয়া যুদ্ধ করেন। তারপর অন্ধকার আসিয়া সৈন্যদিগকে বাঁচাইয়া দিল।

 সেরাত্রে পাণ্ডবেরা ভীষ্মের নিকট গিয়া, তাহাকে প্রণামপূর্বক কাতরভাবে বলিলেন, “দাদামহাশয়! আমরা তো কিছুতেই আপনার সঙ্গে পারিয়া উঠিতেছি না। আমাদের রাজ্য পাওয়ার কি উপায় হইবে? আর এত লোক যে মরিতেছে, তাহাই বা কিরূপে বারণ হইবে? আপনাকে বধ করিবার উপায় বলিয়া দিন।”

 ভীষ্ম বলিলেন, “আমার হাতে অস্ত্র থাকিলে দেবতারাও আমাকে পরাজয় করিতে পারে না। আমি অস্ত্র ত্যাগ করিলে আমাকে মারা সম্ভব হইতে পারে। সুতরাং এক উপায় বলিয়া দিই। শিখণ্ডীকে দেখিলে আমি অস্ত্র ত্যাগ করি, অর্জুন এই শিখণ্ডীকে সম্মুখে রাখিয়া আমার গায় বাণ মারুক। এই আমার বধের উপায়; আমি অনুমতি দিতেছি তোমরা মনের সুখে আমায় প্রহার কর। আমার এই কথামত কাজ করিলে, নিশ্চয় তোমাদের জয়লাভ হইবে।”

 এইরূপ কথাবার্তার পর পাণ্ডবেরা সেখান হইতে চলিয়া আসিলেন। শিবিরে আসিয়া অর্জুন কৃষ্ণকে বলিলেন, “ছেলেবেলায় খেলা করিতে করিতে, ধুলাসুদ্ধ দাদামহাশয়কে জড়াইয়া ধরিয়া তাহার গায়ে ধূলা মাখাইয়া দিতাম। কোলে উঠিয়া ডাকিতাম, বাবা। তিনি বলিতেন, “আমি তোমার বাবা নই, তোমার বাবার বাবা!’ সেই দাদামহাশয়কে কি করিয়া মারিব? আমি তাহা পারিব না। মরি সেও ভালো।”

 যাহা হউক, কৃষ্ণের উপদেশে অর্জুনের মনের এই দুঃখ শীঘ্রই দূর হইয়া গেল। ভীষ্মকে না মারিলে জয় নাই; সুতরাং যে উপায়েই হউক তাহাকে মারিতে হইবে।

 রাত্রি প্রভাত হইলে পাণ্ডবেরা রণবাদ্য বাজাইয়া যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইলেন। আজ শিখণ্ডী সকলের আগে, অপর যোদ্ধারা তাহার পশ্চাতে।

 যুদ্ধ আরম্ভ হইবামাত্র, ভীষ্ম পূর্বদিনের ন্যায় একধার হইতে পাণ্ডব সৈন্য শেষ করিতে লাগিলেন। শিখণ্ডী তাহাকে বারণ করিবার জন্য ক্রমাগত বাণ মারিতেছেন, তাতে তাহার ভূক্ষেপ নাই। শিখণ্ডীর বাণ খাইয়া তিনি হাসেন আর বলেন, “তোমার যাহা খুশি কর, আমি তোমার সহিত যুদ্ধ করিব না।”

 শিখণ্ডী তাহার উত্তরে বলিলেন, “তুমি যুদ্ধ কর আর না কর আমার হাতে আজ তোমার রক্ষা নাই।”

 এইরূপে শিখণ্ডী ভীষ্মকে বাণ মারিতেছে, আর ভীষ্ম তার দিকে না তাকাইয়া ক্রমাগত পাণ্ডবদিগের সৈন্য মারিতেছেন;পাণ্ডবেরা তাহাকে কোনমতেই বারণ করিতে পারিতেছেন না। তাহা দেখিয়া অর্জুন মহারাষে কৌরব সৈন্য মারিতে আরম্ভ করিলেন।

 দুর্যোধনের নিজের এমন ক্ষমতা নাই যে তিনি অর্জুনকে আটকান, কাজেই তিনি ভীষ্মকে বলিলেন, “দাদামহাশয়! অর্জুন তো সব মারিয়া শেষ করিল, আপনি ভালো করিয়া যুদ্ধ করুন।

 তাহা শুনিয়া ভীষ্ম বলিলেন, “আমি তোমার নিকট প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম যে, রোজ দশ হাজার সৈন্য মারিব। তাহার মতে আমি রোজ দশহাজার সৈন্য মারিয়াছি। আজ যুদ্ধে প্রাণ দিয়া, তুমি যে এতদিন আমাকে অন্ন দিয়াছ, সেই ঋণশোধ করিব।”

 এই বলিয়া তিনি প্রাণপণে যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন।

 এদিকে শিখণ্ডীর বাণের বিরাম নাই। অর্জুন ক্রমাগত তাহাকে উৎসাহ দিয়া বলিতেছে, “ভয় নাই! দাদামহাশয়কে আক্রমণ কর! আমি বাণ মারিয়া তাহাকে বধ করিব।”

 অর্জুনকে বারণ করিবার জন্য দুঃশাসন প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু খানিক যুদ্ধের পরেই অর্জুনের বাণ সহিতে না পারিয়া, ভীষ্মের রথে গিয়া তাহাকে আশ্রয় নিতে হইয়াছে।

 এদিকে ভগদত্ত, কৃপ, শল্য, কৃতবর্মা, বিন্দ, অনুবিন্দ, জয়দ্রথ, চিত্রসেন, বিকর্ণ, দুর্মর্ষণ, ইহারা সকলে মিলিয়া ভীমকে আক্রমণ করিয়াও তাহার কিছুই করিতে পারেন নাই। তাহাদের হাজার হাজার বাণ সহ্য করিয়া ভীম তাহাদের সকলকে বাণে বাণে অস্থির করিয়া দিয়াছেন।

 এমন সময় অর্জুন আসিয়া ভীমের সহিত মিলিলেন। তখন কৌরবদেরও ভীষ্ম, দুর্যোধন, বৃহদ্বল প্রভৃতি সকলে সেখানে আসিলে, যুদ্ধ বড়ই ভীষণ হইয়া উঠিল। এই গোলমালের ভিতরে শিখণ্ডী তাহার নিজের কাজ ভুলেন নাই। সুযোগ পাইলেই তিনি ভীষ্মের গায়ে বাণ মারিতেছে।

 যুধিষ্ঠির এই সময়ে খুব কাছে ছিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া ভীষ্ম বলিলেন, “যুধিষ্ঠির! অনেক প্রাণী বধ করিয়াছি আমার আর বাঁচিয়া থাকিতে ইচ্ছা নাই। আমাকে যদি সুখী করিতে চাহ, তবে শীঘ্র অর্জুনকে লইয়া আমাকে বধ কর।”

 যুধিষ্ঠির ভীষ্মের মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া, সকলকে ডাকিয়া বলিলেন, “তোমরা শীঘ্র আইস। আজ ভীষ্মের সহিত যুদ্ধে জয়লাভ করিতে হইবে।”

 ইহার পর হইতে শিখণ্ডীকে সম্মুখে করিয়া, পাণ্ডবগণ ভীষ্মের বধের জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কৌরবেরাও সকলে মিলিয়া তাহাদিগকে বাধা দিবার কোনোরূপ আয়োজনই করিতে বাকি রাখিলেন না। তখন যে কিরূপ ঘোরতর যুদ্ধ হইয়াছিল, তাহা বর্ণনা করিবার শক্তি আমার আর নাই।

 আর ভীষ্মের কথা কি বলিব? আজ মরিতে হইবে, এই তার প্রতিজ্ঞা। যেমন করিয়া মরিলে ক্ষত্রিয় স্বর্গে যায়, সেইরূপ করিয়া মরিতে হইবে। রণস্থলে ধর্মযুদ্ধে শক্ত সংহার করিতে করিতে প্রাণ দেওয়া অপেক্ষা, ক্ষত্রিয়ের আর গৌরবের কথা হইতে পারে না। ভীষ্মের ন্যায় মহাবীর আর মহাপুরুষ আজ সেই গৌরবের সুযোগ পাইয়া, আর তাহা ছড়িতে প্রস্তুত নয়। তাই তিনি আজ মরিবার জন্য যুদ্ধ করিতেছে। ঐ দেখ, পাণ্ডবদের দলের সোমক নামক সৈন্যগণ দেখিতে দেখিতে তাহার বাণে শেষ হইয়া গেল। ঐ শুন, মেঘ গর্জনের ন্যায় তাহার ধনুকের শব্দ অবিরাম শুনা যাইতেছে। কৃষ্ণ, অর্জুন আর শিখণ্ডী ব্যতীত কেহই সে ধনুকের সম্মুখে টিকিতে পারিতেছে না।

 শিখণ্ডী ভীষ্মের বুকে দশ বাণ মারিলেন। ভীষ্ম তাহা গ্রাহ্য করিলেন না। অর্জুন ক্রমাগত তাহাকে বলিতেছে, “মার! মার?” শিখণ্ডী উৎসাহ পাইয়া বাণে বাণে ভীষ্মকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। সেই মহাপুরুষ, সে সকল বাণের দিকে ভুক্ষেপ না করিয়া, একদিকে অর্জুনকে নিবারণ, আর একদিকে পাণ্ডব সৈন্য সংহার করিতে ব্যস্ত।

 এই সময়ে দুঃশাসন একা পাণ্ডবদিগের সকলের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া ভীষ্মকে রক্ষা করিতেছিলেন। তখন তাহার বীরত্ব দেখিয়া কেহই প্রশংসা না করিয়া থাকিতে পারে নাই। অর্জুন ভিন্ন আর কেহই তাহাকে এড়াইয়া যাইতে পারিলেন না।

 শিখণ্ডী ভীষ্মকে বাণ মারিতে এক মুহূর্তও অবহেলা করিতেছে না। ভীষ্ম হাসিতে হাসিতে তাহার সকল বাণ অগ্রাহ্য করিয়া, ক্রমাগত পাণ্ডব সৈন্য বধ করিতেছে। দুর্যোধন প্রভৃতি সকলে প্রাণপণে ভীষ্মের সাহায্যের জন্য ব্যস্ত; কিন্তু অর্জুনের তেজে তাহাদের সকল চেষ্টাই বিফল হইতেছে। অর্জুনের গাণ্ডীব হইতে ভীষণ বাণ বৃষ্টির আর বিরাম নাই, কৌরব সৈন্যদের আর বুঝি কিছু অবশিষ্ট থাকিল না। কৃপ, শল্য, দুঃশাসন, বিকর্ণ, বিংশতি সকলেই পলাইয়া গেলেন। মৃতদেহে রণস্থল ছাইয়া গেল।

 কিন্তু ভীষ্ম একাই যে অদ্ভুত কাজ করিতেছিলেন, অন্যেরা পলাইয়া যাওয়াতে তাহার কিছুমাত্র ক্ষতি হইল না।

 অর্জুনের কাছে পাণ্ডবপক্ষের যে সকল রাজা ছিলেন, ভীষ্ম তাহাদের সকলকেই মারিয়া শেষ করেন। দশ হাজার গজারোহী, সাতজন মহারথ, চৌদ্দ হাজার পদাতি, এক হাজার হাতি, দশ হাজার ঘোড়া, তাহা ছড়া বিরাটের ভাই শতানীক প্রভৃতি হাজার হাজার যোদ্ধা সেদিন তাঁহার হতে মারা যান।

 এমন সময় কৃষ্ণ অর্জুনকে বলিলেন, “অর্জুন, তুমি শীঘ্র ভীষ্মকে বারণ কর। উহাকে মারিতে পারলেই জয় হইবে।”

 অমনি অর্জুন বাণে বাণে ভীষ্মকে আচ্ছন্ন করিলেন। ভীষ্ম সে সকল বাণ খণ্ড খণ্ড করিতে কিছুমাত্র বিলম্ব করিলেন না। তারপর ভীম, ধৃষ্টদ্যুম্ন, অভিমন্যু, সাত্যকি, ঘটোৎকচ প্রভৃতি পাণ্ডবপক্ষের সকলে তাহার বাণে অস্থির হইয়া উঠিলে, অর্জুন তাহাদিগকে রক্ষা করিলেন।

 শিখণ্ডীর বিশ্রাম নাই, আবার অর্জুন তাহার সাহায্য করিতেছে। সাত্যকি চেকিতান, ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট, দ্রুপদ, নকুল, সহদেব, অভিমন্যু, দ্রৌপদীর পুত্রগণ প্রভৃতি সকলে মিলিয়াও তাহাকে বাণ মারিতে ত্রুটি করিতেছে না। তথাপি ভীষ্ম কিছুমাত্র কাতর নহে। তাহার যুদ্ধ তেমনি চলিয়াছে।

 এমন সময় অর্জুন ভীষ্মের ধনুক কাটিয়া ফেলিলেন। তাহা দেখিয়া দ্রোণ, কৃতবর্মা, জয়দ্রথ, ভূরিশ্রবা, শল, শল্য ও ভগদত্ত মিলিয়া অর্জুনকে আক্রমণ করিতে যাওয়ায়, সাত্যকি, ভীম, ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট, ঘটোৎকচ আর অভিমন্যু অর্জুনের সাহায্যের জন্য ছুটিয়া আসিলেন। এদিকে শিখণ্ডী বাণে বাণে ভীষ্মকে আচ্ছন্ন করিয়াছেন। ভীষ্ম ধনুক হাতে লইলেই অর্জুন তাহা কাটিয়া ফেলিতেছে। তাহাতে ভীষ্ম এক শক্তি ছুড়িয়া মারিলে, তাহাও তিনি কাটিতে বাকি রাখেন নাই।

 তখন ভীষ্ম মনে মনে বলিলেন, কৃষ্ণ না থাকিলে এখনো আমি এক বাণেই পাণ্ডবদিগকে মারিতে পারি’ কিন্তু আমি পাণ্ডবদিগকে মারিব না, শিখণ্ডীর সহিতও যুদ্ধ করিব না। এই আমার মরিবার সুযোগ।’

 ভীষ্মের মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া, অপর বসুগণ আকাশ হইতে বলিলেন, “তাহাই ঠিক, ভীষ্ম! আর যুদ্ধে কাজ নাই।”

 এ কথায় স্বর্গে দুন্দুভি বাজিয়া উঠিল। দেবতারা ভীষ্মের উপর পুষ্পবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। আর এই সময় হইতে ভীষ্ম অর্জুনের সহিত যুদ্ধের চেষ্টা ছাড়িয়া দিলেন। এতক্ষণ শিখণ্ডী তাহাকে যেসকল বাণ মারিতেছিলেন তাহা তাহার গ্রাহ্যই হয় নাই। অতঃপর অর্জুন গাণ্ডীব লইয়া তাহার গায়ে ভয়ংকর বাণসকল বর্ষণ করিতে লাগিলেন। ভীষ্ম তখনো অন্যান্য যোদ্ধাগণের সহিত যুদ্ধ করিতেছিলেন, কিন্তু অর্জুনের বাণে জর্জরিত হইয়াও তিনি তাহাকে আর আঘাত করিলেন না। অর্জুন অবসর পাইয়া ক্রমাগত তাহার ধনুক কাটিয়া তাহার উপর বাণ মারিতে লাগিলেন।

 এই সময় দুঃশাসন ভীষ্মের কাছে ছিলেন। ভীষ্ম তাহাকে বলিলেন, “দুঃশাসন! এ সকল তো শিখণ্ডীর বাণ নয়, এগুলি নিশ্চয় অর্জুনের। দেখ আমার বর্ম ভেদ করিয়া বাণগুলি শরীরের ভিতরে প্রবেশ করিতেছে।”

 এই বলিয়া তিনি অর্জুনের প্রতি একটা শক্তি ছুড়িয়া মারিলে, অর্জুন তিন বাণে তাহা খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। তারপর ভীষ্ম ঢাল আর খড়্গ হাতে লইয়া মনে করিলেন, হয় মরিব, না হয় সকলকে মারিব। কিন্তু তিনি খড়্গ চর্ম হাতে রথ হইতে নামিবার পূর্বেই তাহাও অর্জুন কাটিয়া শত খণ্ড করিলেন।

 এদিকে কৌরবেরা ভীষ্মকে রক্ষার জন্য কত চেষ্টাই করিতেছেন, কিন্তু পাণ্ডবেরা তাহাদিগকে কিছুই করিবার অবসর দিতেছে না। অর্জুনের বাণে ভীষ্মের শরীর এরূপ ক্ষতবিক্ষত হইয়াছে যে, আর দু আঙ্গুল স্থানও অবশিষ্ট নাই। এইরূপে ক্ষত-বিক্ষত হইয়া, সূর্যাস্তের কিঞ্চিৎ পূর্বে, ভীষ্ম রথ হইতে পড়িয়া গেলেন। পৃথিবী কাপিয়া উঠিল। ‘হায় হায়! শব্দে দেবতারা চিৎকার করিয়া উঠিলেন। হায় হায়!’ শব্দে যোদ্ধাগণ কাদিতে লাগিল। শরীরে এত বাণ বিধিয়া ছিল যে, রথ হইতে পড়িয়াও ভীষ্ম শুন্যেই রহিয়া গেলেন; তাহার শরীর মাটি ছুঁইতে পাইল না। লোকে মৃত্যুর সময় কোমল বিছানায় শয়ন করে কিন্তু ভীষ্মের হইল শরশয্যা’, অর্থাৎ বাণের বিছানা।

 সেই মহাবীর শরশয্যায় শুইয়া স্বর্গের কথা ভাবিতে লাগিলেন। তখন আকাশ হইতে দেবতারা জিজ্ঞাসা করলেন, “হে মহাবীর! হে মহাপুরুষ! সূর্য এখন আকাশের দক্ষিণভাগে রহিয়াছে। মহাপুরুষের মৃত্যুর ইহা সময় নহে। তুমি এমন সময়ে প্রাণত্যাগ করিবে?”

 ভীষ্ম বলিলেন, “আমি তো প্রাণত্যাগ করি নাই।”

 মানস সরোবরবাসী হংসগণ আকাশে উড়িয়া যাইতেছিল। তাহারা বলিল, “এখন সূর্যদেব আকাশের দক্ষিণভাগেই রহিয়াছে;মহাত্মা ভীষ্ম কি এমন সময়ে প্রাণত্যাগ করিবেন?”

 ভীষ্মদেব সেই হংসগণকে দেখিয়া ক্ষণকাল চিন্তা করিলেন। উহারা তাহারই মাতা গঙ্গা দেবীর প্রেরিত হংসরূপী মহর্ষিগণ।

 তাই তিনি বলিলেন, “হে হংসগণ! পিতার বরে আমি মৃত্যুকে বশ করিয়াছি। সত্য কহিতেছি সূর্যদেব আকাশের উত্তরভাগে না গমন করিলে আমি প্রাণত্যাগ করিব না।”

 ভীষ্ম রথ হইতে পড়িবামাত্র যুদ্ধ থামিয়া গেল। পাণ্ডবদের দলে মহাশঙ্খ বাজিয়া উঠিল; ভীম আনন্দে নৃত্য করিতে লাগিলেন। দ্রোণ এ সংবাদ শুনিবামাত্র অজ্ঞান হইয়া রথ হইতে পড়িয়া গেলেন। তারপর যোদ্ধাগণ কবচ পরিত্যাগ করিয়া হেঁটমুখে জোড়হাতে সেই মহাবীরের নিকট আসিয়া দাঁড়াইলেন।

 তখন ভীষ্ম বলিলেন, “হে মহারথগণ! তোমাদের মঙ্গল তো? তোমাদিগকে দেখিয়া বড়ই সুখী হইলাম। দেখ, আমার মাথা ঝুলিয়া পড়িয়াছে, বালিশ দাও।”

 রাজা মহাশয়েরা তৎক্ষণাৎ রাশি রাশি কোমল রেশমী বালিশ আনিয়া উপস্থিত করিলেন। তাহা দেখিয়া ভীষ্ম হাসিয়া বলিলেন, “এ বালিশ তো এ বিছানার উপযুক্ত নয়। বৎস অর্জুন, উপযুক্ত বালিশ দাও।”

 অর্জুন কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “দাদামহাশয়! কি করিতে হইবে আজ্ঞা করুন।”

 ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! তুমি ধনুর্দ্ধরগণের শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিমান আর ক্ষত্রিয়ের ধর্মে শিক্ষিত। মাথা ঝুলিতেছে, উপযুক্ত বালিশ দাও।”

 তখন অর্জুন, ভীষ্মের পদধূলি লইয়া, তিন বাণে তাহার মাথা উঁচু করিয়া দিলেন। তাহাতে ভীষ্ম পরম সন্তোষের সহিত অর্জুনকে আশীর্বাদ করিয়া সকলকে বলিলেন, “এই দেখ, অর্জুন আমার উপযুক্ত বালিশ দিয়াছেন।”

 তারপর ভীষ্ম আবার বলিলেন, “যতদিন না সূর্যদেব আকাশের উত্তরভাগে যাইবেন, ততদিন আমি এইভাবেই থাকিব, সূর্যদেব আকাশের উত্তরভাগে আসিলে আমি প্রাণত্যাগ করিব। আমার চারিদিকে পরিখা করিয়া (অর্থাৎ খাল কাটিয়া) দাও। আর তোমরা শত্রুতা ছড়িয়া যুদ্ধে ক্ষান্ত হও।”

 তারপর দুর্যোধন ভালো ভালো চিকিৎসক ও ঔষধ লইয়া সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলে, ভীষ্ম বলিলেন, “উহা দিয়া আমার কি হইবে? এখন আমার চিকিৎসার সময় নহে, আমাকে পোড়াইবার সময়।”  সুতরাং চিকিৎসকেরা তাহাদের ঔষধ লইয়া ফিরিয়া গেল। তারপর রাত্রি হইলে সে স্থানে প্রহরী রাখিয়া সকলে শিবিরে গমন করিলেন।

 রাত্রি প্রভাত হইলে, পুনরায় সকলে ভীষ্মের নিকট আসিয়া তাহাকে নমস্কার করিলেন। ক্রমে স্ত্রী, বালক, বৃদ্ধ সকলে তাহাকে দেখিবার নিমিত্ত সেখানে আসিতে লাগিল। কন্যাগণ তাহার উপরে ফুলের মালা চন্দনচুর্ণ ও খই ছড়াইতে লাগিল। গায়ক নর্তক ও বাদ্যকরগণ সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। রাজারা বিনীতভাবে তাহার চারিদিক ঘিরিয়া বসিলেন। তখন সেখানকার শোভা হইল যেন স্বর্গের শোভা।

 এমন সময় ভীষ্ম বলিলেন, “জল দাও।”

 অমনি সকলে ব্যস্ত হইয়া নানারূপ মিষ্টান্ন এবং সুশীতল জল আনিয়া উপস্থিত করিল। তাহা দেখিয়া ভীষ্ম কহিলেন, “এ পৃথিবী হইতে আমি বিদায় লইয়াছি সুতরাং এখানকার মানুষেরা যে জল খায় আমি আর তাহা খাইব না। অর্জুন কোথায়?”

 অর্জুন জোড়হাতে বলিলেন, “কি করিতে হইবে দাদামহাশয়?”

 ভীষ্ম বলিলেন, “দাদা! বিছানা দিয়াছ, বালিশ দিয়াছ এখন তাহার উপযুক্ত জল দাও।”

 অর্জুন ভীষ্মের মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া, অমনি গাণ্ডীবে পর্জনাস্ত্র যোজনা করিলেন। সে অস্ত্র ভীষ্মের দক্ষিণ পার্শ্বের ভূমিতে নিক্ষেপ করামাত্রই, তথা হইতে অতি পবিত্র নির্মল জলের উৎস উঠিতে লাগিল। আহা, কি সুগন্ধ! কি মধুর শীতল জল! সে জল পান করিয়া ভীষ্মের প্রাণ জুড়াইল। তিনি অর্জুনকে বার বার আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন, “তোমার সমান ধনুর্দ্ধর এ জগতে আর নাই। দুর্যোধন আমাদের কথা শুনিল না; সুতরাং সে নিশ্চয় মারা যাইবে।”

 দুর্যোধন কাছেই ছিলেন, আর ভীষ্মের কথা শুনিয়া অতিশয় দুঃখিতও হইয়াছিলেন। তাঁহাকে দেখিতে পাইয়া ভীষ্ম বলিলেন, “দুর্যোধন! অর্জুন যাহা করিল, দেখিলে তো? এমন কাজ আর কেহই করিতে পারে না। এই পৃথিবীতে অর্জুন আর কৃষ্ণ ভিন্ন আগ্নেয়, বরুণ, সৌম্য, বায়ব্য, বৈষ্ণব, ঐন্দ্র, পাশুপত, পারমেষ্ট, প্রাজাপত্য, ধাত্র, কাষ্ট্র, সাবিত্র ও বৈবস্বত অস্ত্র সকলের কথা কেহ জানেন না। তুমি এইবেলা পাণ্ডবদিগের সহিত সন্ধি কর, আমার মৃত্যুতেই এই যুদ্ধের শেষ হউক। আমি সত্য কহিতেছি আমার কথা না শুনিলে নষ্ট হইবে।”

 এই কথা বলিয়া ভীষ্ম চুপ করিলেন; সকলে শিবিরে চলিয়া গেলেন। এমন সময় কর্ণ সেখানে আসিয়া ভীষ্মকে প্রণাম করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “হে কুরুশ্রেষ্ঠ! যে প্রতিদিন আপনার দৃষ্টিপথে পড়িয়া আপনাকে ক্লেশ দিত, আমি সেই রাধেয় (রাধার পুত্র)।”

 ভীষ্ম কষ্টে চক্ষু মেলিয়া চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন, সেখানে অপর লোক নাই, কেবল প্রহরীরা আছে॥ তখন প্রহরীদিগকে সরাইয়া দিয়া এক হাতে কর্ণকে আলিঙ্গনপূর্বক তিনি বলিলেন, “কর্ণ। তুমি আসিয়া ভালো করিয়াছ। আমি নারদ আর ব্যাসের মুখে শুনিয়াছি, তুমি রাধার পুত্র নহ, তুমি কুন্তীর পুত্র। তুমি দুষ্টের দলে জুটিয়া পাণ্ডবদিগের নিন্দা করিতে, তাই আমি তোমাকে কঠিন কথা কহিতাম; কিন্তু আমি কখনো তোমার মন্দ ভাবি নাই। তোমার মতন ধার্মিক, দাতা, আর বীর এ পৃথিবীতে নাই এ কথা আমি জানি। এখন তুমি তোমার ভাইদিগের সহিত মিলিয়া থাক; আমার মৃত্যুতেই এই যুদ্ধ শেষ হইয়া যাউক।”

 কিন্তু এ কথায় কর্ণের মন ফিরিল না। তিনি বলিলেন, “পাণ্ডবদের সহিত আমার শত্রুতা কিছুতেই দূর হইবার নহে৷ আপনি অনুমতি করুন, আমি যুদ্ধ করিব৷ আর, আপনার নিকট যদি কোনো অপরাধ করিয়া থাকি, তাহা ক্ষমা করুন৷”

 ভীষ্ম বলিলেন, “যদি যুদ্ধ করিবেই, তবে রোষহীন মনে পুণ্য কামনায় যুদ্ধ করিয়া ক্ষত্রিয়ধর্ম পালনপূর্বক স্বর্গে চলিয়া যাও৷”


  1. দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র জন্মিয়াছিলেন। তাদের নাম প্রতিবিন্ধ্য, সুতসোম, শ্রুতকর্মা, শতানিক আর শ্রুতসেন। সুভদ্রার এক পুত্র, তার নাম অভিমন্যু।