উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/ছেলেদের মহাভারত/দ্রোণপর্ব

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

দ্ৰোণপৰ্ব

ষ্মের পতন হইলে কর্ণ আসিয়া কৌরবদিগের পক্ষে যোগ দিলেন৷ কর্ণকে পাইয়া তাঁহাদের উৎসাহের সীমা রহিল না৷ অনেকে বলিল, “ভীষ্ম ইচ্ছা করিয়া পাণ্ডবদিগকে মারেন নাই, কিন্তু কৰ্ণ উহাদিগকে নিশ্চয় বধ করিবেন৷”

 দুৰ্যোধন বলিলেন, “কর্ণ! একজন সেনাপতি স্থির কর।” কর্ণ বলিলেন, “দ্রোণ থাকিতে আর কাহাকে সেনাপতি করিবেন? দ্রোণই সর্বাপেক্ষা একাজের উপযুক্ত৷”

 একথায় দুর্যোধন দ্রোণকে বলিলেন, “গুরুদেব! এখন আপনি সেনাপতি হইয়া আমাদিগকে রক্ষা করুন৷”

 দ্রোণ বলিলেন, “আচ্ছা, আমি সেনাপতি হইয়া যথাসাধ্য যুদ্ধ করিব৷ কিন্তু আমি ধৃষ্টদ্যুম্নকে বধ করিতে পারিব না। সে আমাকে মারিবার জন্যই জন্মিয়াছে।”

 দ্রোণকে সেনাপতি করিয়া কৌরবগণ বলিতে লাগিল, "এবারে পাণ্ডবদের পরাজয় নিশ্চয়!” দ্রোণ দুর্যোধনকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বল দেখি, আমি তোমার জন্য কি কবিব?”

 দুৰ্যোধন বলিলেন, “আপনি যুধিষ্ঠিরকে জীবন্ত ধরিয়া দিন৷” দ্রোণ ইহাতে আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, “যুধিষ্ঠিরই ধন্য; তাহার শত্রু কোথাও নাই! তুমিও তাহাকে মারিতে না চাহিয়া, কেবল ধরিয়া আনিতে চাহিতেছ৷”

 ভালো লোকে ভালোভাবেই কথা নেয়, দ্রোণ মনে করিলেন যে, দুর্যোধন বুঝি যুধিষ্ঠিরকে ভালোবাসিয়াই তাঁহাকে মারিতে চাহেন নাই৷ কিন্তু দুর্যোধনের পেটে যে বাঁকা বুদ্ধি, তাহা তাহার কথাতেই ধরা পড়িল৷ তিনি বলিলেন, “যুধিষ্ঠিরকে মারিলে কি অৰ্জুন আর আমাদিগকে রাখিবে? তাহার চেয়ে তাহাকে জীবন্ত ধরিয়া আনিতে পারিলে, আবার পাশা খেলিয়া বনে পাঠাইতে পারিব৷”

 এ কথায় দ্রোণ বলিলেন, “অৰ্জুন থাকিতে যুধিষ্ঠিরকে ধরিয়া আনার শক্তি দেবতাদেরও নাই৷ অর্জুনকে যদি সরাইতে পার, তবে যুধিষ্ঠিরকে নিশ্চয় আজ ধরিয়া আনিব৷”

 চরের মুখে এই সংবাদ শুনিয়া যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বলিলেন, “তুমি আজ আমার নিকট থাকিয়া যুদ্ধ কর। আমাকে ছাড়িয়া যাইও না।”

 অর্জুন বলিলেন, “আমি বাঁচিয়া থাকিতে আপনার কোনো ভয় নাই। দেবতার সাহায্য পাইলেও কৌরবেরা আপনাকে ধরিয়া নিতে পারিবে না।”

 তারপর আবার যুদ্ধ আরম্ভ হইল, এবং প্রথম হইতেই দ্রোণের তেজে পাণ্ডবেরা নিতান্ত অস্থির হইয়া উঠিলেন। সৈন্য যে কত মরিল তাহার সীমা সংখ্যা নাই। ইহাতে যুধিষ্ঠির প্রভৃতি বীরগণ দ্রোণকে আক্রমণ করায়, যুদ্ধ ক্রমেই ঘোরতর হইয়া উঠিল।

 অভিমন্যুকে আক্রমণ করিতে গিয়া হার্দিক্য বড়ই জব্দ হইলেন। প্রথমে ধনুর্বাণ লইয়া তিনি মন্দ যুদ্ধ করেন নাই; এমনকি, তিনি অভিমন্যুর ধনুক অবাধ কাটিয়া ফেলেন। তখন অভিমন্যু খড়্গ চর্ম হাতে তাঁহার রথে উঠিয়া এক হাতে তাঁহার কেশাকর্ষণ, এক লাথিতে সারথিকে সংহার এবং খড়্গাঘাতে রথের ধবজাটি নাশ করিলেন। তারপর হার্দিকের চুল ধরিয়া তাঁহাকে ঘুরাইতে ঘুরাইতে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিলেন।

 হার্দিক্যের পরে জয়দ্রথ আসিয়াও কম নাকাল হয় নাই। তারপর শল্য আসিতেই অভিমন্যুর হাতে তাঁহার সারথিটি মারা গেল। তাহাতে শল্য ক্রোধভরে গদাহাতে অভিমন্যুকে মারিতে আসিলে, অভিমন্যুও বজ্র হেন মহাগদা উঠাইয়া বলিলেন, “আইস৷” এমন সময় ভীম আসিয়া তাহাকে থামাইয়া শল্যের সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন।

 সে অতি আশ্চর্য যুদ্ধ হইয়াছিল। গদায় গদায় ঠোকাঠুকিতে এমনি আগুনের ফিন্‌কি ছুটিয়াছিল যে, কামারের দোকানেও তেমন হয় না। শেষে দুজনের গদার বাড়িতে দুজনেই ঠিকরাইয়া পড়িলেন। ভীম তখনই আবার উঠিয়া দাঁড়াইলেন, কিন্তু শল্যের জ্ঞান না থাকায় তাহার আর উঠা হইল না।

 তারপর ভীম, কর্ণ, দ্রোণ, অশ্বত্থামা, ধৃষ্টদ্যুম্ন, সাত্যকি প্রভৃতির ঘোর যুদ্ধ চলিল। এই সময়ে কৌরব সেনাগণ ক্ষত-বিক্ষত শরীরে পলায়ন করিতেছিল, দ্রোণ তাহাদিগকে ডাকিয়া বলিলেন, “ভয় নাই!” বলিয়াই তিনি যুধিষ্ঠিরকে আক্রমণ কবিতে চলিলেন। সে সময়ে শিখণ্ডী, উত্তমৌজা, নকুল, সহদেব প্রভৃতির কেহই তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইতে পারিলেন না।

 ইঁহাদিগকে পরাজয় করিয়া তিনি যুধিষ্ঠিরকে আক্রমণ করিবামাত্র বিরাট, দ্রুপদ, কৈকেয়গণ, সাত্যকি, শিবি, ব্যাঘ্রদত্ত, সিংহসেন প্রভৃতি ছুটিয়া আসিয়া তাঁহার পথ আটকাইলেন। কিন্তু তাঁহাদের বাণে দ্রোণের কি হইবে? তিনি দেখিতে দেখিতে ব্যাঘ্রদত্ত আর সিংহসেনের মাথা কাটিয়া একেবারে যুধিষ্ঠিরের রথের কাছে গিয়া উপস্থিত হইলেন। পাণ্ডব সৈন্যেরা তখন “মহারাজকে মারিল!” বলিয়া চ্যাঁচাইতে লাগিল, আর কৌরব সৈন্যেরা “এই ধরিয়া আনিল!” বলিয়া আকাশ ফাটাইল।

 এমন সময় অর্জুন শত্রু সৈন্য কাটিতে কাটিতে আসিয়া সেখানে দেখা দিলেন। তারপর আর কি কেহ ধনুক ধরিতে পাইল? সকলে ভয়েই অস্থির, যুদ্ধ করিবে কে? অর্জুনের ভীষণ বাণবৃষ্টিতে চারিদিক আঁধার হইয়া গেল। তখন আর এতটুকুও বুঝিবার সাধ্য রহিল না যে, ‘এই পৃথিবী, ঐ আকাশ৷’

 আর তখন সন্ধ্যাও হইতেছিল। কাজেই দ্রোণ তখনি যুদ্ধ থামাইয়া দিলেন। সেদিন আর তাহার যুধিষ্ঠিরকে ধরা হইল না।

 দ্রোণের পক্ষে ইহা লজ্জার কথা বটে; আর অর্জুন থাকিতে এ লজ্জা দূর হওয়াও দুর্ঘট৷ সুতরাং যুক্তি হইল যে, পরদিন কৌশলে অর্জুনকে যুধিষ্ঠিরের নিকট হইতে সরাইয়া, আর একবার চেষ্টা করিতে হইবে। দ্রোণ বলিলেন, “অর্জুনকে কেহ যুদ্ধের ছলে দূরে লইয়া যাউক। তখন সে ব্যক্তিকে পরাজয় না করিয়া অর্জুন কখনোই ফিরিবে না। সেই অবসরে আমি যুধিষ্ঠিরকে ধরিয়া আনিব।”

 এ কথায় সুশর্মা, সত্যরথ, সত্যধর্মা, সত্যব্রত, সত্যেষু, সত্যকর্মা প্রভৃতি বীরগণ পঞ্চাশ হাজার সৈন্য সমেত, তখনই অগ্নির সম্মুখে প্রতিজ্ঞা করিলেন, “কাল আমরা অর্জুনকে না মারিয়া যুদ্ধ হইতে ফিরিব না। যদি ফিরি তাহা হইলে, যত মহাপাপ আছে, সকলের শাস্তি যেন আমরা পাই!”

 এমন প্রতিজ্ঞা যে করে, তাহাকে বলে সংশপ্তক”। পরদিন যুদ্ধের সময় এই সংশপ্তকগণ অর্জুনকে ডাকিয়া বলিল, “আইস অর্জুন! যুদ্ধ করি!”

 তাহা শুনিয়া অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে বলিলেন, “দাদা! আমাকে যখন ডাকিতেছে, তখন তো আমি না গিয়া পারি না।” যুধিষ্ঠির বলিলেন, “দ্রোণ আমাকে ধরিয়া নিতে আসিবেন তাহার কি হইবে?” অর্জুন বলিলেন, “আপনার কাছে সত্যজিৎকে রাখিয়া যাইতেছি। ইনি জীবিত থাকিতে আপনার কোন ভয় নাই। সত্যজিৎ মরিলে আপনারা কেহ রণস্থলে থাকিবেন না।”

 সেদিন সংশপ্তকেরা মিলিয়া কি অর্জুনকে কম ব্যস্ত করিয়াছিল? দলে দলে তাহারা আসিয়া প্রাণের মায়া হুড়িয়া তাহার সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিল। এক এক দলকে শেষ করিয়া অর্জুন যেই যুধিষ্ঠিরের নিকটে ফিরিতে যান, অমনি আর একদল আসিয়া বলে, “কোথায় যাও? এই যে আমরা আছি!”

 আর তাহারা যুদ্ধও এমনি ভয়ানক করিয়াছিল যে কি বলিব! ইহাব মধ্যে আবার নারায়ণী সেনারা আসিয়া তাহাকে অস্থির করিয়া তুলিল। তখন অর্জুন রোষভরে “ত্বাষ্ট্র” অস্ত্র উঁড়িয়া মারিলেন। সে অতি অদ্ভুত অস্ত্র। উহা ছুঁড়িবামাত্র শত্রুদিগের মাথায় গোল লাগিয়া গেল। তখন তাহারা নিজ নিজ সঙ্গীকেই দেখিয়া বলে, “এই অর্জুন! কাট ইহাকে!” এইরূপে তিলেকের মধ্যে তাহারা নিজে নিজে কাটাকাটি করিয়া মরিল।

 তথাপি সে যুদ্ধের শেষ নাই। দেখিতে দেখিতে ললিত্থ, মালব, মাবেক প্রভৃতি যোদ্ধাগণ আসিয়া বাণে বাণে আকাশ ঢাকিয়া ফেলিল। তখন কৃষ্ণ বলিলেন, “অর্জুন! তুমি বাঁচিয়া আছ? আমি তো তোমাকে দেখিতে পাইতেছিনা। অমনি অর্জুন বায়ব্যাস্ত্র মারিয়া শত্রুগণের বাণ তো উড়াইয়া দিলেনই, তাহার সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ ঘূর্ণী বাতাস বহিয়া হাতি ঘোড়া সংশপ্তক অবধি সকলকেই শুকনা পাতার মতো উড়িয়া নিল!

 এদিকে দ্রোণাচার্য তাহার কাজ ভুলেন নাই। তিনি যুধিষ্ঠিরকে ধরিতে গিয়া ভয়ানক যুদ্ধ আরম্ভ করিয়াছে। পাণ্ডব সৈন্যগণ তাহাকে কিছুতেই আটকাইতে পারিতেছে না। দ্রোণের হাতে পাণ্ডবপক্ষের বৃক্ষ মরিয়াছেন, সত্যজিৎ মরিয়াছে, দৃঢ়সেন, ক্ষম, বসুদান ইহারাও মরিয়াছেন। যুধিষ্ঠির দেখিলেন বড়ই বিপদ। দ্রোণ সকলকে পরাজিত করিয়া এখন তাহারই দিকে ঝড়ের মতন ছুটিয়া আসিতেছে। সুতরাং তিনি অবিলম্বে ঘোড়া হাঁকাইয়া সেখান হইতে প্রস্থান করিলেন।

 এই সময়ে দুর্যোধন অনেক হতি লইয়া ভীমকে আক্রমণ করেন। ভীম ক্ষণকালের মধ্যেই সে সকল হাতি মারিয়া ফেলাতে, অঙ্গদেশের ম্লেচ্ছ রাজা হাতি চড়িয়া দুর্যোধনকে সাহয্য করিতে আসেন। ইনি মরিলে আসেন ভগদত্ত।

 ভগদত্ত ইন্দ্রের বন্ধু এবং ভয়ানক যোদ্ধা ছিলেন, আর তদপেক্ষাও অতি ভয়ানক একটা হতিতে চড়িয়া আসিয়াছিলেন। ভীম এত হাতি মারিয়াছে, কিন্তু এ হাতিকে মারা দূরে থাকুক, বরং হাতিই তাহাকে শুড়ে জড়াইয়া, পায়ের নীচে ফেলিবার জোগাড় করিয়াছিল। অনেক কষ্টে শুঁড় ছড়াইয়া ভীম হাতির পায়ের তলায় গিয়া লুকাইয়াছিলেন, তাই রক্ষা। আর সকলে তো মনে করিয়াছিল, তাহাকে বুঝি মারিয়াই ফেলিয়াছে।

 এদিকে ভীমকে বাঁচাইবার জন্য যুধিষ্ঠির, ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন অন্যান্য লোকের সহিত ভগদত্তের যুদ্ধ হইতে লাগিল। দশার্ণের রাজা ভগদত্তের হাতে মারা গেলেন। ভগদত্তের হাতি সাত্যকির রথখানিকে শুড় জড়াইয়া হুঁড়িয়া মারিলে সাত্যকি ও তাহার সারথি তাহা হইতে লাফাইয়া পড়িয়া পলায়ন করিলেন। তারপর হাতিটি রাজামহাশয়দিগকে লইয়া লুফালুফি করিতে লাগিল।

 তখন না জানি কিরূপ কাণ্ড হইয়াছিল, আর সকলে কিরূপ চিৎকার করিয়াছিল। সে চীৎকার অর্জুনের কানে গিয়া উপস্থিত হইল। তাহা শুনিয়া তিনি বলিলেন, “ঐ বুঝি ভগদত্ত তাহার হাতি লইয়া সকলকে শেষ করিলেন। শীঘ্র ওখানে চলুন।”

 কিন্তু এদিকে আবার চৌদ্দহাজার সংশপ্তক আসিয়া উপস্থিত! অর্জুন ব্রহ্মাস্ত্রে তাহাদিগকে মারিয়া ফিরিতে চলিয়াছে, এমন সময় আবার সুশর্মা ছয় ভাই সমেত আসিয়া তাহাকে আক্রমণ করিলেন। যাহা হউক, সুশর্মার ভাইকে মারিয়া এবং তাহাকে অজ্ঞান করিয়া, চলিয়া আসিতে অর্জুনের অধিক সময় লাগিল না।

 এদিকে ভগদত্ত তাহার হাতি লইয়া পাণ্ডব সৈন্য শেষ করিতে ব্যস্ত, এমন সময় অর্জুন কৌরব সেনা মারিতে মারিতে সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তারপর দুজনে কি ভীষণ যুদ্ধই হইল। ভগদত্ত হাতির উপরে, অর্জুন রথের উপরে। অর্জুনের রথ তো আর যুদ্ধ করিতে জানে না, কিন্তু ভগদত্তের হাতিটি এক একবার ক্ষেপিয়া রথ গুঁড়া করিয়া দিতে আসে, কৃষ্ণ তখন অনেক কৌশলে পাশ কাটিয়া তাহাকে এড়ান।

 এমন সময় অর্জুন ভগদত্তের ধনুক ও তুণ কাটিয়া, তাহার গায়ে সত্তরটি বাণ বিধাইয়া দিলেন। তখন ভগদত্তও রাগে অস্থির হইয়া, বৈষ্ণব অঙ্কুশ’ নামক অস্ত্র অর্জুনের বুকের দিকে ছুঁড়িয়া মারিলেন। ইহা অতি ভয়ানক অস্ত্র। বিষ্ণু ইহা নরকাসুরকে দেন, নরকাসুর ভগদত্তকে দেয়। এ অস্ত্রের ঘা খাইলে ইন্দ্রেরও প্রাণ বাহির হইয়া যায়। একমাত্র বিষ্ণু ইহা সহ্য করিতে পারেন।

 তাই সে অস্ত্রকে অর্জুনের দিকে আসিতে দেখিয়া কৃষ্ণ (যিনি নিজেই বিষ্ণু) নিজের বুক পাতিয়া দিলেন। তাহার বুকে পড়িয়া তাহা একটি সুন্দর মালা হইয়া গেল।

 ইহাতে অর্জুন একটু বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “আপনি প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন, যুদ্ধে যোগ দিবেন না। এখন সে প্রতিজ্ঞা কিজন্য ভাঙিলেন? আমি অস্ত্র বারণ করিতে পারিতাম না?”

 কৃষ্ণ তাহাকে সে অস্ত্রের কথা বুঝাইয়া দিয়া বলিলেন, “ভগদত্তের হাতে আর তাহা নাই। এখন তুমি উহাকে মার।”

 ইহার অল্পক্ষণ পরেই অর্জুন রাগে ভগদত্তের হাতিকে মারিয়া, অর্ধচন্দ্র বাণে ভগদত্তকেও বধ করিলেন।

 তারপর অচল ও বৃষক নামক শকুনির দুই ভাই অর্জুনের হাতে মারা গেলে, শকুনির সহিত তাহার যুদ্ধ আরম্ভ হয়।

 শকুনি নানারূপ মায়া জানিতেন। প্রথমে তিনি এমন এক কৌশল করিলেন যে তাহাতে নানারূপ উৎকট অস্ত্র কোথা হইতে আসিয়া, কৃষ্ণ আর অর্জুনের গায়ে পড়িতে লাগিল। আর ভয়ংকর জন্তু এবং রাক্ষসগণ তাহাদিগকে মারিতে আসিল। কিন্তু অর্জুনের বাণের সম্মুখে এসকল অস্ত্র বা জন্তু এক মুহূর্তও টিকিতে পারিল না।

 তখন শকুনি হঠাৎ চারিদিক অন্ধকার করিয়া ফেলিলেন।

 অর্জুন জ্যোতিষ্ক অস্ত্রে সে অন্ধকার দূর করিলে, সেই ধুর্ত কোথা হইতে জলের বন্যা আনিয়া সকলকে ভাসাইয়া দিবার আয়োজন করিলেন। অর্জুনের আদিত্যাস্ত্রে জল সহজেই দূর হইল। তারপর আর শকুনির মায়ায় কুলাইল না; তিনি অর্জুনের বাণ খাইয়া পলায়ন করিলেন।

 এইরূপে অর্জুন ক্রমে কৌরব সৈন্যদিগকে নিতান্ত অস্থির করিয়া তোলায় তাহারা আর রণস্থলে টিকিয়া থাকিতে পারিল না। পাণ্ডব সৈন্যগণ ইহাতে উৎসাহ পাইয়া দ্রোণকে আক্রমণ করিবার আয়োজন করিল। তখন যে যুদ্ধ হইয়াছিল, তাহা বড়ই সাংঘাতিক। একদিকে দ্রোণ মহারোষে হাজার হাজার সৈন্য মারিতেছে, অপরদিকে অশ্বত্থামা নীলকে সংহার করিয়াছে। ইহার মধ্যে আবার একদল সংশপ্তক আসিয়া, অর্জুনকে ডাকিয়া লইয়া গিয়াছে।

 বাস্তবিক তখন পাণ্ডব সৈন্যদের একটু বিপদই হইয়াছিল। কিন্তু এমন সময় ভীম সেখানে আসিয়া উপস্থিত হওয়ায়, আবার তাহাদের উৎসাহ দেখা দিল। ততক্ষণে অর্জুনও, সংশপ্তকদিগকে মারিয়া আবার ফিরিয়া আসিয়াছেন। তখন তাহার বাণে কৌরবদের কি দুর্গতিই হইল! তাহারা চ্যাঁচ্যাঁয় আর শুধু বলে কর্ণ! কর্ণ!

 সে ডাক শুনিয়া কর্ণ তখনই তিনটি ভাইসমেত আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ভাই তিনটি তো আসিয়াই অর্জুনের হাতে মারা গেল;নিজে কর্ণও বুকে হাতে সাত্যকির বাণ খাইয়া কম শিক্ষা পাইলেন না। দ্রোণ, দুর্যোধন আর জয়দ্রথ ছুটিয়া আসিয়া তাহাকে না ছাড়াইলে বিপদ হইত।

 তারপর সন্ধ্যা পর্যন্ত দুইপক্ষে ঘোরতর যুদ্ধ চলিল। সন্ধ্যার সময় যুদ্ধ থামাইয়া সকলে শিবিরে আসিলেন।

 সেদিনও যুধিষ্ঠিরকে ধরিতে না পারায়, দুর্যোধনের নিকট লজ্জা পাইয়া, দ্রোণ প্রতিজ্ঞা করিলেন যে, পরদিন চক্রব্যুহ নামক অতি ভয়ংকর ব্যহ প্রস্তুত করিয়া তিনি পাণ্ডবপক্ষের একজন মহারথীকে বধ করিবেন।

 সেদিন প্রভাত হইবামাত্রই সংশপ্তকেরা আসিয়া অর্জুনকে ডাকিয়া লইয়া গেল। এই অবসরে দ্রোণ সেই সাংঘাতিক চক্র’ ব্যুহ রচনা করিয়া পাণ্ডবদিগের সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। পাণ্ডবেরা তখন এমনই বিপদে পড়িলেন যে কি বলিব। অর্জুন অনুপস্থিত, এখন শুধু অভিমন্যু ছড়া আর কেহই সে বৃহে প্রবেশ করিতে জানে না। সুতরাং দ্রোণ সুবিধা পাইয়া সফলকে অস্থির করিয়া তুলিলেন।

 যুধিষ্ঠির আর উপায় না দেখিয়া, অভিমন্যুকেই বলিলেন, “বাব। আমরা তো এ ব্যুহে প্রবেশ করিবার কোন উপায় জানি না। এখন অর্জুন আসিয়া যাহাতে আমাদের নিন্দা না করেন, তাহা কর।”

 অভিমন্যু বলিলেন, “আমি এ বৃহে প্রবেশ করিতে ভয় পাই। কিন্তু আপনি যখন বলিতেছেন, তখন অবশ্যই যাব।”

 এ কথায় যুধিষ্ঠির আর ভীম বলিলেন, “তুমি কেবল পথটুকু করিয়া দাও তারপর তোমার পিছু পিছু আমরা ঢুকিয়া বাকি যাহা করিবার সব করিব।”

 এ কথায় অভিমন্যু তাহার সারথি সুমিত্রকে চক্রব্যুহের দিকে রথ চালাইতে বলিলে, সুমিত্র বিনয় করিয়া বলিল, “কুমার, বড়ই কঠিন এবং ভয়ংকর কাজে হাত দিতেছেন; একবার ভাবিয়া দেখুন।”

 অভিমন্য বলিলেন, “তুমি চল। নিজে ইন্দ্র দেবতাদিগকে লইয়া আসিলেও আজ আমি যুদ্ধ করিব।”

 সুতরাং সারথি আর বিলম্ব না করিয়া রথ চালাইয়া দিল। আর অমনি, হরিণের না পাইলে বাঘ যেমন করিয়া আসে, সেইরূপ করিয়া কৌরব যোদ্ধাগণ বালক অভিমন্যুকে আক্রমণ করিলেন। কিন্তু বয়সে বালক হইলে কি হয়? সেই আঠারো বৎসরের ছেলে দ্রোণের সামনেই ব্যুহ ভেদ করিয়া বড় বড় কৌরবদিগকে একধার হইতে বাণের ঘায়ে অচল করিতে লাগিলেন। কত লোক মরিল, কত পলাইয়া গেল, তাহার কি সংখ্যা আছে? অশ্মকেশর মরিলেন, কর্ণ অজ্ঞান হইলেন, শল্য অজ্ঞান হইলেন, শল্যের ভাই মারা গেলেন, ছেটখাট যোদ্ধার তো কথাই নাই।

 অভিমন্যুর বীরত্ব দেখিয়া দ্রোণ কৃপকে বলিলেন, “ইহার মতো যোদ্ধা বোধহয় আর কোথাও নাই। এ ইচ্ছা করিলে আমাদের সকলকে মারিয়া শেষ করিতে পারে।”

 এ কথা কিন্তু দুর্যোধনের সহ্য হইল না। তিনি বলিলেন, “অর্জুনের পুত্র বলিয়া দ্রোণ ইচ্ছ করিয়াই ইহাকে মারিতেছে না। তাই এই মূর্থের এত স্পর্ধা হইয়াছে। চল, আমরা সকলে মিলিয়া ইহাকে বধ করি।”

 দুঃশাসন বলিলেন, “ইহাকে মারিলে, অর্জুন কাদিতে কাঁদিতে আপনিই মরিয়া যাইবে। অর্জুন মরিলে পাণ্ডবেরাও মরিবে। সুতরাং আমি এখনই ইহাকে মারিয়া আপনার সকল আপদ দুর করিয়া দিতেছি।”

 দুঃশাসন এইরূপ গর্ব করিয়া অভিমন্যুকে মারিতে গেলেন, আর তাহার খানিকক্ষণ পরেই দেখা গেল যে তিনি চিৎ হইয়া রথে পড়িয়া খাবি খাইতেছে, আর সারথি সেই রথ হাঁকাইয়া বায়ুবেগে পলায়ন করিতেছে।

 কর্ণ দুবার আসিয়া দুবারই নাকালের একশেষ হইলেন; তাহার এক ভাই তো মরিয়াই গেল।

 কিন্তু হায়।যাহারা এত উৎসাহ দিয়া অভিমন্যুকে ব্যুহের ভিতরে পাঠাইছিলেন,তাহাদের কেহই তাঁহার সঙ্গে ব্যুহে প্রবেশ করিতে পারিলেন না। একা জয়দ্রথ যুদ্ধ করিয়া তাহাদের সকলকে ফিরাইয়া দিতে লাগিলেন। তিন বাণে সাত্যকি, আট বাণে ভীম, ষাট বাণে দাম, দশবাণে বিরাট, পাঁচ বাণে দ্রুপদ, দশ বাণে শিখণ্ডী, সত্তর বাণে যুধিষ্ঠির, এইরূপে সকলকেই তাহার নিকট পরাজিত হইতে হইল। দ্বৈত বনে ভীমের হাতে মার খাইয়া জয়দ্রথ শিবের তপস্যা করেন। তখন শিব তাহাকে বর দেন যে তুমি অর্জুন ভিন্ন আর চারি পাণ্ডবকে যুদ্ধে পরাজয় করিবে; সেই বরের জোরে আজ জয়দ্রথের এত পরাক্রম।

 এদিকে অভিমন্যু বৃষসেনকে পরাজয়পূর্বক বসাতীকে মারিয়াছেন। তারপর কৌরবপক্ষের অনেকে মিলিয়া তাহাকে আক্রমণ করিলে, তাহাদিগকেও কাটিয়া খণ্ড খণ্ড করিয়াছে; শল্যের পুত্র রুকনরথকে মারিয়া গান্ধব-অস্ত্রে অনেক যোদ্ধাকে অজ্ঞান করত, তাহাদিগকে বধ করিয়াছে।

 বাস্তবিক কেহই তাহার নিকট হইতে অক্ষত শরীরে ফিরিতে পায় নাই। দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, কৃতবর্মা ও হার্দিক এই ছয়জনে এক সঙ্গে তাহাকে আক্রমণ করিতে গিয়া ছয়জনই পরাজিত হইলেন। তারপর ক্রাথের পুত্র আসিয়া মারা গেল। তারপর আবার সেই দ্রোণ প্রভৃতি ছয়জনের পরাজয়;তারপর বৃক্ষারক এবং বৃহহুলের মৃত্যু। আর কত বলিব? ক্রমাগত যোদ্ধারা আসে, আর অভিমন্যুর অস্ত্রে মারা যায়। কৌরবেরা বেশ বুঝিতে পারিলেন যে, আজ ইহার হাতে আর তাহাদের রক্ষা নাই।

 তখন শকুনি বলিলেন, “চল সকলে মিলিয়া উহাকে মারি, নচেৎ ও আমাদের সকলকেই বধ করিবে।”

 কর্ণ তখন দ্রোণকে বলিলেন, “শীঘ্র ইহাকে মারিবার উপায় করুন। নচেৎ আর রক্ষা নাই!”

 এ কথায় দ্রোণ বলিলেন, “উহার কবচ ভেদ করা অসম্ভব। কিন্তু চেষ্টা করিলে, উহার সুক কাটিয়া, সারথি প্রভৃতি মারিয়া উহার যুদ্ধ বন্ধ করিয়া দিতে পার। উহার হাতে ধনুক থাকিতে দেবতাগণেরও উহাকে পরাজয় করিবার সাধ্য নাই। সুতরাং আগে উহার ধনুক কাট; তারপর যুদ্ধ করিও।”

 এই কথায় কর্ণ হঠাৎ বাণ মারিয়া, অভিমন্যুর ধনুকটি কাটিলেন, ভোজ তাহার ঘোড়াগুলিকে মারিলেন, কৃপ সারথিকে বধ করিলেন; এইরূপে তাহাকে সঙ্কটে ফেলিয়া, নিষ্ঠুর ছয় মহারথ এককালে সেই বীর বালককে প্রহার করিতে আরম্ভ করিলেন।

 ধনুক নাই রথ নাই। অভিমন্যু খড়্গ চর্ম লইয়া যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। তাহাও দ্রোণ আর কর্ণের ছলনায় দেখিতে দেখিতে কাটা গেল। চক্র নিলেন, তাহাও চারিদিক হইতে বাণ বিধিয়া অভিমন্যুর দেহ সজারুর দেহের মতো হইয়া গিয়াছে।

 এই সময়েও অভিমন্যু গদাঘাতে সত্তরটি সঙ্গীসমেত কালিকেয় এবং অপর সতেরজন রথীও দট হাতিকে মারিয়া দুঃশাসনের পুত্রের রথ ও ঘোড়া চূর্ণ করেন। তখন দুঃশাসনের পুত্রও গদা লইয়া তাহাকে আক্রমণ করে। দুইজনেই দুজনের গদার বাড়িতে ঠিকরাইয়া পড়েন। কিন্তু দুঃশাসনের পুত্র আগে উঠিয়া অভিমন্যুর মাথায় সাংঘাতিক গদার আঘাত করে। এইরূপ অন্যায় যুদ্ধে সে বালক মহাবীরকে সকলে মিলিয়া নির্দয়ভাবে হত্যা করিল।

 কৌরবগণ তাহাদের পাপকর্ম শেষ করিয়া বড়ই আনন্দিত হইলেন। আর পাণ্ডবদের কথা কি বলিব? তাহাদের দুঃখ লিখিয়া জানানো সম্ভব নহে। অভিমন্যুর মৃত্যুতে সৈন্যরা ভয় পাইয়া পলায়ন করিতেছিল; যুধিষ্ঠির অনেক কষ্টে তাহাদিগকে ডাকিয়া ফিরাইলেন। তারপর সকলে যুধিষ্ঠিরকে ঘিরিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন, কাহারো মুখে কথা বাহির হইল না।

 এদিকে অর্জুন সংশপ্তকদিগকে মারিয়া ফিরিবার সময় কৃষ্ণকে বলিলেন, “আজ কেন আমার মন এত অস্থির হইতেছে? আমার শরীরও যেন অবশ হইয়া পড়িতেছে। মহারাজ যুধিষ্ঠিরের কোনো অমঙ্গল হয় নাই তো?”

 শিবিরে প্রবেশ করিয়াই তাহারা দেখিলেন, চারিদিক অন্ধকার, লোকজনের সাড়াশব্দ নাই। অন্যদিন বাদ্য আর কোলাহলে শিবির পরিপূর্ণ থাকে, আজ তাহার কিছুইনাই। বিশেষত, অভিমন্যু প্রত্যহ, অর্জুন শিবিরে আসিবামাত্র, ভাইদিগকে লইয়া হাসিমুখে তাহার নিকট উপস্থিত হয়; আজ সেই অভিমন্যুই বা কোথায়?

 এ সকল কথা আর বাড়াইয়া বলিয়া ফল কি? অভিমন্যুর মৃত্যুর সংবাদ অর্জুনের কিরূপ কষ্ট হইল, তাহা তোমরা কল্পনা করিয়া লও। অভিমন্যুর মতো পুত্র মরিলে যেমন দুঃখ হইতে পারে, তাহা তাহার অবশ্যই হইল। আর সেই দুঃখে দীর্ঘনিঃশাস ফেলিতে ফেলিতে তিনি প্রতিজ্ঞা করিলেন, “কল্য আমি জয়দ্রথকে বধ করিব। যদি কল্য সেই পাপাত্মা জীবিত থাকিতে সূর্য অস্ত হয়, তবে আমি এইখানেই জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করিব।”

 এই সংবাদ তখনই চরেরা দুর্যোধনের শিবিরে লইয়া গেল। তাহা শুনিয়া জয়দ্রথ ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে সকলকে বলিলেন, “রাজামহাশয়গণ। আপনাদের মঙ্গল হউক! আপনাদের অনুমতি পাইলেই আমি এইবেলা পলায়ন করি!”

 কিন্তু দুর্যোধন তাহাকে সাহস দিয়া বলিলেন, “আমরা এতগুলি লোক থাকিতে তোমার ভয় কি? আমরা তোমাকে রক্ষা করিব।”

 দুর্যোধনের কথায় ভরসা না পাইয়া, জয়দ্রথ দ্রোণের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন। দ্রোণও তাহাকে খুব সাহস দিয়া বলিলেন, “ভয় নাই! আমি এমন ব্যুহ প্রস্তুত করিব যে, অর্জুন তাহা পারই হইতে পারিবে না। আর যদিই বা অর্জুন তোমাকে মারে, তাহা হইলেও তো তোমার স্বর্গলাভ হইবে। সুতরাং ভয় কি?”

 এসকল কথা আবার পাণ্ডবদিগের চরেরা তাহাদের কাছে গিয়া বলিলে কৃষ্ণ অর্জুনের জন্য বড়ই চিন্তিত হইলেন।

 পরদিন দ্রোণ যে ব্যুহ প্রস্তুত করিলেন, তাহা বড়ই অদ্ভুত। এই বৃহ চবিবশ ক্রোশ লম্বা, আর পিছনের দিকে দশ ক্রোশ চওড়া। ইহার সম্মুখ ভাগে শকটের ন্যায়, পশ্চাদ্ভাগ চক্র বা পদ্মের ন্যায়। ইহার ভিতরে আবার লুকাইয়া সূচী নামক একটি ব্যুহ হইল। কৃতবর্মা, কাম্বোজ, জলসন্ধ, দুর্যোধন প্রভৃতি বীরেরা, জয়দ্রথকে তাহাদের পশ্চাতে রাখিয়া, এই সূচী’ ব্যুহে লুকাইয়া রহিলেন। নিজে দ্রোণ বড় ব্যুহের মুখে এবং ভোজ তাহার পশ্চাতে থাকিয়া সকলকে রক্ষা করিতে লাগিলেন।

 সেদিন অর্জুন কি ভীষণ রণই করিলেন। কৌরব সৈন্যের মধ্যে হাহাকার পড়িয়া গেল। তাহারা পলাইবে কি, যেদিকে চাহে সেইদিকেই দেখে অর্জুন। দুঃশাসন অনেক হাতি লইয়া অর্জুনকে আটকাইতে আসিলেন, মুহূর্তের মধ্যে সে সকল হাতি অর্জুনের বাণে খণ্ড খণ্ড হইয়া গেল। তাহার এক একটা বাণে দুই তিনটা করিয়া মানুষ কাটা যাইতে লাগিল।

 এমন সময়, দুর্যোধনের তাড়ায় দ্রোণ অর্জুনকে আক্রমণ করিলেন। কিছুকাল দুইজনে এমনি যুদ্ধ চলিল যে, তাহার আর তুলনা নাই। কিন্তু অর্জুনের আজ অন্য কাজ রহিয়াছে  দ্রোণের কাছে এত সময় নষ্ট করিলে তাহার চলিবে কেন? কাজেই তিনি হঠাৎ তাহার পাশ দিয়া রথ চালাইয়া দিলেন। তাহাতে দ্রোণ বলিলেন, “সে কি অর্জুন! তুমি না শত্রুকে জয় না করিয়া ছাড় না?” অর্জুন বলিলেন, “আপনি তো আমার শত্রু নহে, আপনি আমার গুরু! আমি আপনার পুত্রের সমান শিষ্য। আর আপনাকে কে যুদ্ধে হারাইতে পারে?”

 কিন্তু বুড়া কি সহজে ছাড়িবার লোক? তিনি অর্জুনের পশ্চাতে তাড়া করিলেন, তখন কাজেই অল্প স্বল্প করিয়া তাহাকে বারণ করা আবশ্যক হইল। এরপর ভোজকে পার হইতে হইবে। কিন্তু কৃতবর্মা ইহার মধ্যে পথ আটকাইয়া বসিয়াছে। যাহা হউক, ইহাকে অজ্ঞান করিতে অর্জুনের অধিক সময় লাগিল না।

 কৃতবর্মা অজ্ঞান হইলে আসিলেন শ্রতায়ুধ। ইহার বরুণদত্ত একটা ভয়ংকর গদা আছে। সে গদা কেহই ফিরাইতে পারে না। কিন্তু উহার একটি দোষ এই যে, যুদ্ধে লিপ্ত নহে এমন লোককে মারিলে, উহা উল্টিয়া তাহার প্রভুরই মাথায় পড়ে। শ্রতায়ুধ অর্জুনকে মারিতে গিয়া, সেই গদা কৃষ্ণের উপর ঝাড়িয়া বসিয়াছে! কাজেই, বুঝিতেই পার, অর্জুনের আর শতায়ুধকে মারিবার জন্য পরিশ্রম করিতে হইল না।

 শ্রতায়ুধের পর সুদক্ষিণ; তারপর শতায়ু ও অচ্যুত; তারপর উহাদিগের পুত্র নিয়তায়ু, দীর্ঘায়ু:তারপর সহস্র সহস্র অঙ্গদেশীয় গজারোহী সৈন্য; তারপর বিকটাকার অসংখ্য যবন, পারদ ও শক; তারপর আর-একজন শ্রুতায়ু—এইরূপ করিয়া কত যোদ্ধা মরিল। দুর্যোধন তো দ্রোণের উপর চটিয়াই অস্থির! তিনি বলিলেন, “আপনি আমাদের খান, আবার আমাদেরই অনিষ্ট করেন। আপনি যে মধু মাখানো ক্ষুরের মতো, তাহা আমি জানিতাম না। যাহা হউক, শীঘ্র জয়দ্রথকে বাচাইবার উপায় করুন।”

 দ্রোণ বলিলেন, “আমি কি করিব? আমি বুড়া হইয়া এখন আর ছুটাছুটি করিতে পারি না। অর্জুন একটু ফাক পাইলেই রথ হাঁকাইয়া চলিয়া যায়। কৃষ্ণ এমনি তাড়াতাড়ি রথ চালান যে অর্জুনের বাণ তাহার এক ক্রোশ পিছনে পড়ে। অস্ত্রহাতে ইন্দ্র আসিলেও আমি তাহাকে পরাজয় করিতে পারি, কিন্তু অর্জুনকে পরাজয় করিতে কিছুতেই পারিব না। তুমিই হয় অনেক লোক লইয়া, একবার তাহার সহিত যুদ্ধ করিয়া, দেখ না। আমি তোমার গায়ে এক আশ্চর্য কবচ বাধিয়া দিতেছি ইহাকে কোনো অস্ত্রই ভেদ করিতে পারিবে না।”

 এই বলিয়া দ্রোণাচার্য, জল ছুঁইয়া মন্ত্র পড়িতে পড়িতে, দুর্যোধনের গায়ে সেই অদ্ভুত উজ্জল কবচ বাধিয়া দিলে, দুর্যোধন মহোৎসাহে অর্জুনকে মারিতে চলিলেন।

 এই সময় ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি পাণ্ডবপক্ষের যোদ্ধারা, অনেক সৈন্য লইয়া, দ্রোণকে ভয়ংকর তেজের সহিত আক্রমণ করাতে তাহার সৈন্যসকল তিন দলে ভাগ হইয়া গেল। দ্রোণ অনেক চেষ্টা করিয়াও আর তাহাদিগকে একত্র করিতে পারিলেন না। তখন কি ঘোর যুদ্ধই হইয়াছিল। অশ্বত্থামা, কর্ণ, সৌমদত্ত প্রভৃতি কয়েকজন বড়বড় বীরের হাতে, সকল সৈন্যের পশ্চাতে জয়দ্রথকে রাখিয়া, আর প্রায় সকলেই যুদ্ধে লাগিয়া গিয়াছিলেন। কত যে লোক মরিয়াছিল তাহার গণনা নাই। দ্রোণাচার্যের সহিত ধৃষ্টদ্যুম্ন এই সময়ে খুব যুদ্ধ করিয়াছিলেন। কিন্তু সাত্যকি আসিয়া সাহয্য না করিলে, বুড়ার হতে তাহার বড়ই দুর্দশা হইত। সাত্যকি দেখিলেন যে, দ্রোণ ধূমের খড়্গ, চর্ম, ধ্বজ, ছত্র, ঘোড়া সারথি সমুদায় শেষ করিয়া এক সাংঘাতিক বাণ চড়াইয়া বসিয়াছে। সেই বাণ ছুড়িবামাত্র সাত্যকি চৌদ্দ বাণে তাহা কাটিয়া ফেলাতেই ধৃষ্টদ্যুম্ন সে যাত্রা বাঁচিয়া গেলেন।

 ইহার পর হইতে সাত্যকির সহিত দ্রোণের ভয়ানক যুদ্ধ চলিল। কিন্তু জয় পরাজয় কাহারো হইল না। শেষে যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল, সহদেব, বিরাট প্রভৃতি আসিয়া সাত্যকির সহিত যোগ দিলে, বহুতর কৌরব যোদ্ধাও আসিয়া দ্রোণের সহায় হইলেন।

 এদিকে বেলা প্রায় শেষ হইয়া আসিল;অর্জুন এতক্ষণ কি করিতেছেন? এখনো জয়দ্রথকে পাইতে তাহার অনেক বিলম্ব আছে কিন্তু তাহার চেষ্টার ত্রুটি নাই। তিনি ক্রমাগত বাণাঘাতে কৌ সৈন্য কাটিয়া পথ করিয়া দিতেছে, আর সেই পথে কৃষ্ণ রথ চালাইতেছেন। অর্জুনের বাণ তাহার ধনুক হইতে ছুটিয়া শত্রুর বুকে পড়িতে যে সময় লাগে, তাহার মধ্যে রথ যাইতেছে এক ক্রোশ! সুতরাং ঘোড়াগুলির যে খুবই পরিশ্রম হইবে, তাহা আশ্চর্য কি? কৃষ্ণ দেখিলেন যে, এগুলিকে একটু বিশ্রাম না করাইলে আর কিছুতেই চলিতেছে না।

 অর্জুনের কি আশ্চর্য ক্ষমতাই ছিল। তিনি ঘোড়ার বিশ্রামের জন্য, রথ হইতে নামিয়া সেই মাঠের মধ্যেই বাণের দ্বারা একটা ঘর গাঁথিয়া ফেলিলেন। সেখানে জল ছিল না, তাই একটি সুন্দর সরোববও করিলেন। সে সরোবরে সুমধুর, সুবিমল জল তো ছিলই, তাহার উপর আবার তাহাতে হাঁসও চরিতেছিল, পদ্মফুলও ফুটিয়াছিল।

 শত্রুরা অবশ্য অর্জনের রথ থামিল এবং অর্জুনকে নামিতে দেখিয়া তাহাকে আক্রমণ করিতে ছাড়ে নাই। কিন্তু অর্জুনের বাণের কাছে তাহারা কি আর করিবে? কৃষ্ণ সেই বাণের ঘরের ভিতবে ঘোড়াগুলির সাজ খুলিয়া, তাহাদিগকে দলিয়া মলিয়া, জল খাওয়াইয়া, আবার তাজা করিয়া লইলেন। ইহার পর হইতে রথ আবার বায়ুবেগে ছুটিয়া চলিল। জয়দ্রথ যাইবেন কোথায়? ঐ তাহাকে দেখা যাইতেছে।

 এমন সময় দুর্যোধন জয়দ্রথকে বাচাইবার জন্য অর্জুনকে আক্রমণ করিলেন। এবারে তাহার আর সাহসের সীমা নাই:তাহার গায়ে দ্রোণের বাধা সেই কবচ রহিয়াছে। বাস্তবিকই সে কবচের এমনি আশ্চর্য গুণ যে, অর্জুনের বাছা বাছা বাণগুলি ইহা হইতে ঠিকরাইয়া পড়িতে লাগিল। ইহাতে কৃষ্ণ আর অর্জুন বুঝিতে বিলম্ব হইল না। তখন তিনি বলিলেন, “ঐ কবচসুদ্ধই উহাকে হারাইব।”

 কিন্তু কি মুস্কিল’ অর্জুন মন্ত্র পড়িয়া সাংঘাতিক অস্ত্র সকল নিক্ষেপ করেন, আর অশ্বত্থামা অন্যদিক হইতে বাণ মারিয়া, তাহ মধ্য পথেই কাটিয়া ফেলেন; দুর্যোধনও সেই অবসরে অর্জুন এবং কৃষ্ণকে ক্ষত-বিক্ষত করেন। যাহা হউক, ইহার ঔষধ শীঘ্রই পড়িল। দুর্যোধনের সমস্ত শরীর কবচে ঢাকা, কিন্তু হাত দুখানি খালি। সেই দুখানি হাতেই অর্জুন বাণ মারিতে লাগিলেন। আর দুর্যোধন যাইবেন কোথায়? হাতে বাণ লাগাতে তাহার যুদ্ধ করাই অসম্ভব হইয়া উঠিল। সকলে ছুটিয়া আসিয়া তাহাকে রক্ষা না করিলে, তখনি মহারাজের প্রাণটিও যাইত।

 তারপর জয়দ্রথকে ধরিবার জন্য অর্জুন অতি ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ করিলে কৌরবদের প্রাণ কাঁপিতে লাগিল। অর্জুনের গাণ্ডীবের টঙ্কার ও কৃষ্ণের পাঞ্চজন্য শখের ভীষণ শব্দে কত লোক যে অজ্ঞান হইয়া গেল, তাহার সংখ্যা নাই। তখন ভূরিশ্রবা, শাল্ব, কর্ণ, বৃষসেন, জয়দ্রথ, কৃপ, শল্য, অশ্বথামা এই আটজনে মিলিয়া অর্জুনকে শরজালে আচ্ছন্ন করিলেন। তাহাদের সকল বাণ কাটিয়া সমুচিত প্রতিফল দিতে অর্জুনের কোনো ক্লেশ হইল না।


উপেন্দ্র—৩৭  এদিকে দ্রোণের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের বিষম যুদ্ধ চলিতেছিল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত কাহারো জয়-পরাজয় বুঝা গেল না। বাণ, শক্তি, গদা, দুজনে কতই ছুঁড়িলেন দুজনেরই সমান তেজ। কিন্তু ইহার পরেই দ্রোণ যুধিষ্ঠিরের ঘোড়া আর ধনুক কাটিয়া, তিনটি ভয়ংকর বাণ মারিলে তাহার এমনি বিপদ হইল যে, তখন রথ ঘড়িয়া অস্ত্র ফেলিয়া হাত তুলিয়া দাঁড়ানো ভিন্ন ভিন্ন আর উপায় নাই। দ্রোণ দেখিলেন এই তাহার সুযোগ। অমনি তিনি, সিংহের ন্যায় যুধিষ্ঠিরকে ধরিতে ছুটলেন। হায় হায়! মহারাজা ধরা পড়িলেন!’ বলিয়া চারিদিকে চিৎকার উঠিল। ভাগ্যে সহদেবের রথ কাছে পাইয়া, যুধিষ্ঠির তাহাতে উঠিতে পারিলেন, আর সহদেবের ঘোড়াগুলি দ্রোণের ঘোড়ার চেয়ে অনেক ভালো ছিল, নহিলে সেদিন সর্বনাশই হইত।

 এদিকে রাক্ষস অলঘুষ, খানিক পাণ্ডবদিগকে খুবই জ্বালাতন করিয়া, ভীমের তাড়ায় পলায়ন করে। তারপর সে অন্যত্র গিয়া আবার দৌরাত্ম্য আরম্ভ করাতে, ঘটোৎকচের হাতে আছাড় খাইয়া চুর্ণ হয়। তারপর অনেকক্ষণ দ্রোণের সহিত পাণ্ডবদিগের তুমুল সংগ্রাম চলে।

 এমন সময় দুর হইতে কৃষ্ণের পাঞ্চজন্য শঙ্খের শব্দ শুনা যাইতে লাগিল। গাণ্ডীবের শব্দ এত দূর পৌঁছায় নাই, কাজেই তাহা কেহ শুনিতে পাইল না। এদিকে কৌরবেরাও সিংহনাদ করিতেছে। কাজেই যুধিষ্ঠির ভাবিলেন, বুঝি অর্জুনের কোনো বিপদ ঘটিল। তাই তিনি সাত্যকিকে ডাকিয়া বলিলেন, “তুমি শীঘ্র অর্জুনের কাছে যাও।

 সাত্যকি বলিলেন, “অর্জুন আমাকে আজ আপনার পাশ ছড়িতে নিষেধ করিয়াছেন, আমি কি করিয়া যাই? আপনি অর্জুনের জন্য চিন্তা করিবেন না। আপনাকে রক্ষা করাই আমাদের প্রথম কাজ।”

 কিন্তু যুধিষ্ঠিরকে অর্জুনের জন্য বড়ই ব্যস্ত দেখিয়া শেষে সাত্যকিকে যাইতে হইল। যুধিষ্ঠির ভীমকেও তাহার সঙ্গে পাঠাইতেছিলেন; কিন্তু সাত্যকি তাহাকে বলিলেন, “আমার মতে যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করাই তোমার কর্তব্য।” কাজেই ভীম রহিয়া গেলেন।

 সাত্যকি কৌরবদিগের সহিত ক্রমাগত যুদ্ধ করিয়া অগ্রসর হইতেছেন, এমন সময় দ্রোণ আসিয়া তাহাকে আটকাইলেন। দ্রোণ বলিলেন, “অর্জুন আজ আমার সহিত যুদ্ধ করিতে করিতে কাপুরুষের মতো পাশ কাটিয়া পলায়ন করিল। তুমি যুদ্ধ না করিলে আজ তোমাকে বধ করিব।” বুদ্ধিমান সাত্যকি অমনি বলিলেন, “গুরু যাহা করেন, শিষ্যও তাই করে। আমি অর্জুনের কাছে চলিলাম।”

 সেদিন সাত্যকির বিক্রম কৌরবেরা ভালো করিয়াই জানিতে পারিল। দ্রোণের নিকট হইতে ভোজের নিকট; ভোজের সারথিকে কাটিয়া, কৃতবর্মাকে ঠেঙ্গাইয়া, জলসন্ধ ও মহমাত্রকে মারিয়া আবার দক্ষিণের দিকে, এইভাবে সাত্যকি চলিয়াছে। এমন সময় আবার দ্রোণ আসিয়া তাহার সম্মুখে উপস্থিত। সঙ্গে সঙ্গে দুর্মর্ষণ, দুঃসহ, বিকর্ণ,দুর্মুখ, দুঃশাসন, চিত্রসেন, দুর্যোধন প্রভৃতিও আসিয়া একসঙ্গে তাহাকে আক্রমণ করিয়াছেন। কিন্তু তাহাকে পরাজয় করে কাহার সাধ্য? দুর্যোধন পলায়ন করিলেন, কৃতবর্মা অজ্ঞান হইলেন। তারপর যুদ্ধ চলিল, কেবল দ্রোণ আর সাত্যকিতে। ভয়ংকর যুদ্ধের পর দ্রোণকে হার মানিতে হইল। তারপর সুদর্শন মরিল, কম্বোজ, শক ও যবন—সৈন্যগণ পরাস্ত হইল, দুর্যোধন আবার আসিয়া যথেষ্ট সাজা পাইলেন। বিকটাকার পার্বতীয় সৈন্যগণ, বিশাল পাথর হাতে যুদ্ধ করিতে আসিয়া, তাহারাও সাত্যকির বাণে খণ্ড খণ্ড হইল। তখন কৌরবেরা কে কোথায় পলায়ন করিবেন তাহই ভাবিয়া অস্থির।

 এমন সময় দ্রোণ দুঃশাসনকে সম্মুখে পাইয়া বলিলেন, “কি দুঃশাসন! এখন তোমার বীরত্ব কোথায় গেল? সকলে সাত্যকির ভয়ে পলাইতেছ অর্জুনের হাতে পড়িলে কি করিবে। এই মুখেই কি পাণ্ডবদিগের সহিত বিবাদ করিতে গিয়াছিলে?”

 এই বলিয়া দ্রোণ পাণ্ডবদিগের সহিত আবার যুদ্ধ আরম্ভ করিলে বীরকেতু, সুধন্বা, চিত্রকেতু, চিত্রবর্মা ও চিত্ররথ নামক পাঞ্চাল রাজের পুত্রগণ দেখিতে দেখিতে তাহার হাতে প্রাণত্যাগ করিলেন। তাহাতে ধৃষ্টদ্যুম্ন মনের দুঃখে রাগের ভরে দ্রোণকে আক্রমণ করাতে, কিছুকাল দুজনে যুদ্ধ চলিল। কিন্তু ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণের সম্মুখে টিকিতে পারিলেন না।

 এদিকে সাত্যকি ক্রমে দুঃশাসন ত্রিগর্ত প্রভৃতিকে পরাজয় করিয়া অর্জুনের দিকে চলিয়াছে, আর দ্রোণ পাণ্ডবপক্ষের যোদ্ধার পর যোদ্ধাকে মারিয়া প্রলয় কাণ্ড উপস্থিত করিয়াছে। বৃহৎক্ষেত্র, ধৃষ্টকেতু, চেদিরাজের পুত্র, জরাসন্ধের পুত্র, ধৃষ্টদ্যুম্নের পুত্র ক্ষত্রবর্মা প্রভৃতি কত লোকের দ্রোণের হাতে প্রাণ গেল! সেই পঁচাশি বৎসরের বুড়া রণস্থলে এমনি ছুটাছুটি করিতে লাগিলেন, যেন তিনি যোল বৎসরের বালক।

 মহারাজ যুধিষ্ঠির এই সময়ে চারিদিকে চাহিয়া দেখিতেছিলেন। তখন তাঁহার মনে এই চিন্তা হইল যে, আমি অর্জুনের সন্ধানে সাত্যকিকে পাঠাইলাম, কিন্তু সাত্যকির সাহায্যের জন্য তো কাহাকেও পাঠাই নাই।

 অমনি তিনি ভীমকে সেই কার্যে পাঠাইয়া দিলেন। ভীম খানিক দূর অগ্রসর হইতে না হইতে দ্রোণ তাহাকে বাধা দিয়া বলিলেন, “অর্জুনকে ছাড়িয়াছি, কিন্তু তোমাকে ছাড়িব না।” ভীম বলিলেন, ঠাকুর! অর্জুনকে আপনি দয়া করিয়া ছাড়িয়াছে বলিয়া তো আমার মনে হয় না। সে হয়তো ভদ্রতা করিয়া আপনার মান রাখিয়া গিয়াছে। কিন্তু আমি তো ভালোমানুষ অর্জুন নহি, আমি ভীম! যুদ্ধ করিতে আসিলে গুরু বলিয়া মানিব না।” বলিতে বলিতেই ভীম এক বিশাল গদা ঘুরাইয়া দ্রোণকে ছুড়িয়া মারিয়াছে। বুড়া তখন বাপ’ বলিয়া রথ হইতে এক লাফ! ততক্ষণে ভীম তাহার রথ ঘোড়া সারথি প্রভৃতি একেবারে পুঁতিয়া ফেলিয়াছেন।

 ইহাতে দুর্যোধনের ভ্রাতাগণ ভীমকে আক্রমণ করিলে, তিনি তাহাদের সাতজনকে বধ করিলেন। যাহাদিগকে তিনি সম্মুখে পাইলেন, তাহাদের অল্প লোকই বাঁচিয়া রহিল। এমন সময় তিনি দেখিলেন যে, দ্রোণাচার্য পাণ্ডবপক্ষের যোদ্ধাদিগকে নিতান্ত অস্থির করিয়া তুলিয়াছে। অমনি আর কথাবার্তা নাই,ভীম চক্ষু বুজিয়া দ্রোণের সেই বাণবৃষ্টির ভিতরেই তাহার রথের দিকে ছুটিয়া চলিলেন। তারপর সেই রথখানিসুদ্ধ—হেঁইয়োঃ হোঃ-মার বুড়াকে ছুঁড়িয়া কিন্তু বুড়ার হাড় কি অসম্ভব মজবুত! রথ গুড়া হইল, কিন্তু বুড়া মরিলেন না!

 তারপর আর খানিক দূরে গিয়াই ভীম সাত্যকিকে দেখিতে পাইলেন। আরো খানিক দূরে গিয়া দেখিলেন, ঐ অর্জুন যুদ্ধ করিতেছে! ওঃ! তখন যে ভীমের সিংহনাদ। সিংহনাদ শুনিয়া কৃষ্ণ আর অর্জুনও সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। এইসকল সিংহনাদ মহারাজ যুধিষ্ঠিরের কানে পৌঁছাইলে তাহার যে খুবই আনন্দ হইল, তাহাতে আর সন্দেহ কি?

 এ সকল সিংহনাদ কর্ণের সহ্য না হওয়ায়, তিনি আসিয়া ভীমের সহিত মহাযুদ্ধ আরম্ভ করিয়া দিলেন। কিন্তু খানিক পরেই ভীমের বাণে তাহার ধনুক, ঘোড়া আর সারথি কাটা যাওয়াতে তাহাকে গিয়া বৃষসেনের রথে আশ্রয় লইতে হইল।

 কিন্তু কর্ণ ছাড়িবার লোক নহেন। তিনি আবার আসিয়া ভীমকে বলিলেন, “কি হে পাণ্ডুপুত্র। তুমিও আবার যুদ্ধ করিতে জান নাকি। বড় যে পলাইতেছ?”

 সুতরাং আবার তাহাদের যুদ্ধ আরম্ভ হইল। এবারেও কর্ণ অনেকক্ষণ যুদ্ধ করিয়া শেষে দেখিলেন যে, আবার তাহার ধনুক ঘোড়া সারথি সব কাটা গিয়াছে! তারপর ভীমের অস্ত্র বুকে বিঁধিয়া তাহার প্রাণ যায় যায়! সুতরাং তিনি তাড়াতাড়ি অন্য রথে উঠিয়া পলায়ন করিলেন।

 তথাপি কর্ণের লজ্জা নাই, তিনি আবার আসিয়া ভীমকে আক্রমণ করিলেন। এবারে ধনুক সারথি আর ঘোড়া কাটা গিয়া তাহার দুরবস্থার একশেষ হইতেছে দেখিয়া, দুর্যোধন তাড়াতাড়ি দুর্জয়কে সাহায্য করিতে পাঠাইলেন। কিন্তু সে বেচারা ভালো করিয়া সাহায্য করিবার পূর্বেই মরিয়া গেল।

 যাহা হউক, এবারে কর্ণকে আর পলাইতে হইল না; তাহার জন্য অস্ত্রশস্ত্র সমেত এক নূতন রথ আসিয়া উপস্থিত হইল। দুঃখের বিষয় এই যে ভীম সে রথেরও ঘোড়া আর সারথি সংহার করাতে, তাহাতে চড়িয়া কর্ণের যুদ্ধ করা হইল খুব কমই। এমন সময় দুর্মুখ কর্ণের সাহায্য করিতে আসিলেন। সাহায্য যাহা করিলেন তাহা একটু নূতনরকমের বটে, আর তিনি ইচ্ছা করিয়া যে সেরূপ করিয়াছিলেন, তাহাও অবশ্য কখনোই নহে, কিন্তু তাহাতেই কর্ণের প্রাণ রক্ষা হইল। দুর্মুখ আসিয়াই তো অমনি ভীমের হাতে প্রাণত্যাগপূর্বক, নিজের রথখানি খালি করিয়া দিলেন সে-রথের ঘোড়াগুলি ছিল বড়ই চমৎকার! সুতরাং কিঞ্চিৎ পরেই যখন ভীমের হাতে কর্ণেরও দুর্দশার একশেষ হইল, তখন ঐ ঘোড়াগুলির সাহায্যে তিনি সহজেই রণস্থল হইতে পলায়ন করিলেন।

 তারপর ভীম দুর্যোধনের আর পাঁচটি ভাইকে বধ করিলে, কর্ণ আবার যুদ্ধ করিতে আসেন আর দেখিতে দেখিতে তাহার হাতে জব্দও হন। তাহা দেখিয়া দুর্যোধন তাহার সাতটি ভাইকে পাঠাইবামাত্র, তাহারাও ভীমের হাতে মারা যায়। তারপর আবার কর্ণ আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

 এবারেও ভীমের হাতে কর্ণের দুর্দশা দেখিয়া দুর্যোধন তাহার আর সাতটি ভাইকে বলিলেন, “তোমরা শীঘ্র গিয়া উহাকে বাঁচাও!” হায়! কে কাহাকে বাঁচায়? সাতভাই ভালো করিয়া যুদ্ধ করিতে না করিতেই মরিয়া গেল। তারপর কর্ণের মাথায় কি যে গোল লাগিল তিনি পাণ্ডবদিগকে ছাড়িয়া কৌরবদিগকেই মারিতে আরম্ভ করিলেন।

 কিন্তু ইহার পর হইতেই যেন কর্ণের তেজ আবার ফিরিয়া আসিল। তখন দেখা গেল যে, অনেকক্ষণ দুজনে সমানভাবে যুদ্ধ চলার পর, কর্ণ ক্রমেই ভীমকে কাবু করিয়া আনিতেছে। ক্রমে ভীমের তৃণ, ধনুর গুণ, ঘোড়ার রাশ, সবই কাটা গেল। সারথিটি বাণ খাইয়া অন্য রথে আশ্রয় লইল। ধবজ, পতাকা, কিছুই আস্ত রহিল না। একটা শক্তি ছুঁড়িয়া মারিলেন, তাহও কাটা গেল। শেষে রহিল খড়্গ ও চর্ম। চর্মখানি কর্ণ কাটিয়া ফেলিলেন।

খড়্গটি ভীম ছুঁড়িয়া মারিলে, তাহাতে কর্ণের ধনুক কাটিয়া গেল। কর্ণ তখনি আর এক ধনুক লইয়া, ভীমের উপরে বাণবৃষ্টি করিতে লাগিলেন।

 তখন ভীম কর্ণকে মারিবার জন্য লাফাইয়া তাহার উপর পড়িতে গেলেন। কিন্তু কর্ণ হঠাৎ গুড়ি মারিয়া রথের তলার সঙ্গে মিশিয়া পড়ায়, তাহাকে ধরিতে পারিলেন না। তারপর ভীমের হাত খালি দেখিয়া, কর্ণ তাহাকে তাড়া করাতে, তিনি এমনি বিপদে পড়িলেন যে, বিপদ যাহাকে বলে! কতকগুলি মরা হাতি সেখানে পড়িয়াছিল; ভীম আর উপায় না দেখিয়া তাহারই পিছনে গিয়া লুকাইলেন। কিন্তু হাতি খণ্ড খণ্ড করিতে কর্ণের মতো বীরের আর কতক্ষণ লাগে? তাহাতে ভীম রথের চাকা হাতির মাথা প্রভৃতি কর্ণকে ছুঁড়িয়া মারিতে লাগিলেন। কিন্তু কর্ণের বাণের কাছে তাহাতেই বা কি ফল হইবে?

 তখন ভীম বজ্রমুষ্টি উঠাইয়া এক কীলে কর্ণকে বধ করিতে যাইতেছিলেন। কিন্তু এই মনে করিয়া ক্ষান্ত হইলেন, আমি কর্ণকে মারিলে অর্জুনের প্রতিজ্ঞা মিথ্যা হইবে। কর্ণও ইচ্ছা করিলে তখন ভীমকে মারিতে পারিতেন। কিন্তু তাহারও মনে হইল যে, কুন্তীর নিকটে তিনি প্রতিজ্ঞা করিয়াছে যে ইহাদিগকে মারিবেন না। তাই তিনি ভীমকে ধনুক দিয়া একটা খোঁচা মাত্র মারিলেন। ভীমও তৎক্ষণাৎ ধনুক কাড়িয়া লইয়া, সাঁই শব্দে এক ঘা লাগাইতে ছাডিলেন না।

 তখন কর্ণ রাগে চোখ লাল করিয়া বলিলেন, “মুখ! পেটুক! কাপুরুষ! তুই কেন আবার যুদ্ধ করিতে আসিয়াছিস? তুই তো যুদ্ধের য’ও জানিস না’ যা: পেট ভরিয়া খা গিয়া। আমার মতো লোকের সঙ্গে যুদ্ধ করা তোর কাজ নহে।”

 তাহাতে ভীম বলিলেন, “ছোটলোক! এতবার আমার সঙ্গে হারিয়াছিস তবুও আবার বড়াই করিস! হারজিত তো ইন্দ্রেরও হয়। আয় না একবার মল্লযুদ্ধ করি; দেখি, তোকে কীচক বধ করিতে পারি কিনা।”

 ভীমের সহিত মল্লযুদ্ধ করিতে কর্ণের সাহস হইল না। কিন্তু তিনি এই ঘটনা লইয়া অর্জুনের সামনেই খুব বড়াই করিতে লাগিলেন। যাহা হউক, অর্জুনের কয়েকটি বাণ আসিয়া গায়ে পড়িলে আর তাহার বড়াই রহিল না। তখন তাহার হঠাৎ মনে হইল যে, বড়াই করার চেয়ে পলায়ন করাতে বেশি কাজ দেয়।

 এই সময়ে সাত্যকি অসাধারণ বীরত্বের সহিত যুদ্ধ করিতে করিতে সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কিন্তু তাহাকে দেখিয়া অর্জুনের মনে সুখ হইল না। তিনি সাত্যকিকে যুধিষ্ঠিরের কাছে রাখিয়া আসিয়াছিলেন। তিনি চলিয়া আসাতে না জানি মহারাজের কি বিপদই হইয়াছে। বিশেষত এতক্ষণ যুদ্ধ করিয়া সাত্যকির অস্ত্র প্রায় শেষ হইয়া যাওয়ায়, এখন তাহারও খুবই বিপদ। এদিকে ভূরিশ্রবা “রাশি রাশি অস্ত্রসমেত সুন্দর রথে চড়িয়া তাহাকে আক্রমণ করিতে আসিতেছে, তাহার সহিত যুদ্ধ করিবার সম্বল সাত্যকির মোটেই নাই। কাজেই অর্জুনের রাগ হইবার কথা। এখন সাত্যকিকেই বা তিনি কি করিয়া ফেলিয়া যান, আর যে সামান্য বেলাটুকু অবশিষ্ট আছে, ইহার মধ্যে জয়দ্রথকে মারিতে হইবে, তাহারই বা কি করেন?

 সাত্যকি একে অতিশয় ক্লান্ত, তাহাতে আবার অস্ত্রহীন, কাজেই ভূরিশ্রবা তাহাকে যেন নিতান্তই বাগে পাইলেন। তথাপি সাত্যকির যতক্ষণ কিছুমাত্র অস্ত্র অবশিষ্ট ছিল, ততক্ষণ তিনি কম যুদ্ধ করেন নাই। ভূরিশ্রবা যেমন তাহার ধনুক আর ঘোড়া কাটিলেন, তিনিও তেমন ভূরিশ্রবার ধনুক আর ঘোড়া কাটিতে ছাড়িলেন না। তারপর রথ ছাড়িয়া দুজনের খাযুদ্ধ আরম্ভ হইল। কিন্তু ক্লান্ত শরীরে আর কত করা যায়? সাত্যকি খানিক খাযুদ্ধ করিয়াই কাবু হইয়া পড়িলেন।

 এমন সময় কৃষ্ণ অর্জুনকে বলিলেন, “ঐ দেখ! সাত্যকিকে দুর্বল পাইয়া ভূরিশ্রবা তাহাকে বধ করিতেছে? ইহা অতি অন্যায়। সাত্যকি তোমার শিষ্য, আর তোমার জন্যই আসিয়া বিপদে পড়িল। উহাকে রক্ষা করা তোমার কর্তব্য।”

 এদিকে ভূরিশ্রবা সাত্যকিকে খড়্গাঘাতে ফেলিয়া দিয়া, তাহার চুলে ধরিয়া, বুকে লাথি মারিয়া তাহার মাথা কাটিতে উদ্যত;সাত্যকি প্রাণপণে মাথা নাড়িয়া তাহার আঘাত এড়াইবার চেষ্টা করিতেছেন। এমন সময় অর্জুনের বাণ উল্কার মতো আসিয়া ভূরিশ্রবার ডানহাত কাটিয়া ফেলিল।

 তখন ভূরিশ্রবা অর্জুনকে তিরস্কার করিয়া বলিলেন, “অর্জুন, আমি অন্যের সহিত যুদ্ধ করিতেছিলাম, তুমি কেন আমার হাত কাটিলে?”

 অর্জুন বলিলেন, “আমার শিষ্য আত্মীয় ও বন্ধুকে আমার সম্মুখে বধ করিতে দেখিয়াও নীরব থাকিলে মহাপাপ হইত, তাই কাটিলাম।”

 তখন ভূরিশ্রবা অনাহারে প্রাণত্যাগের জন্য নিজ হাতে শরশয্যা প্রস্তুত করিয়া ইষ্ট দেবতার ধ্যানে বসিলে কৌরবেরা চারিদিক হইতে অর্জুনের নিন্দা আরম্ভ করিল।

 তাহাতে অর্জুন আবার ভূরিশ্রবাকে বলিলেন, “হে ভূরিশ্রবা! আমার পক্ষের লোককে মৃত্যু হইতে রক্ষা করা আমার কর্তব্য কাজ, তাহাই আমি করিয়াছি! কিন্তু বল দেখি, তোমরা যে বালক অভিমন্যুকে মারিয়াছিলে, তাহা তোমাদের কিরূপ কাজ হইয়াছিল?”

 ভূরিশ্রবা নতশিরে অর্জুনের কথা মানিয়া লইলেন, আর বাঁ হাতে নিজের কাটা ডান হাতখানি অর্জুনের সামনে ধরিয়া একথাও জানাইলেন যে, ও হাত কাটিয়া ফেলা উচিতই হইয়াছে।

 এমন সময় সাত্যকি অসহ্য রাগের ভরে খড়্গ লইয়া ভূরিশ্রবার দিকে ছুটিয়া চলিলেন। সকলে চিৎকার করিয়া উঠিল, “আহা! আহা! কর কি?” কিন্তু সাত্যকি কাহারো নিষেধ না শুনিয়া ভূরিশ্রবার মাথা কাটিয়া ফেলিলেন।

 আর বিলম্ব করা চলে না; জয়দ্রথ বধের সময় যায়। তাই অর্জুন শীঘ্র সে কাজ শেষ করিবার জন্য ব্যস্ত হইলেন। দুর্যোধন, কর্ণ, শল্য, কৃপ, অশ্বত্থামা আর দুঃশাসন ইহারাও তখন জয়দ্রথকে পশ্চাতে রাখিয়া মহাতেজে তাহাকে আক্রমণ করিলেন।

 অর্জুন তাহাদের প্রত্যেকের বাণ দুই তিন খণ্ড করিয়া কাটিতেছেন, তাহারাও বারবার অর্জুনকে বাণে আচ্ছন্ন করিতেছে। জয়দ্রথও তখন চুপ করিয়া নাই। কিন্তু অর্জুনকে বারণ করে কাহার সাধ্য? তিনি ক্রমে সকলকে হারাইয়া চৌষট্টি বাণে জয়দ্রথকে অস্থির করিলেন।

 কিন্তু তখনো ছয় মহাবীরের মাঝখানে জয়দ্রথ লুকাইয়া রহিলেন। ইহাদিগকে পরাজয় করিয়া তাহাকে মারা অসম্ভব। এদিকে সূর্য অস্ত যাইতে আর অল্পই বাকি। তখন কৃষ্ণ অর্জুনকে বলিলেন, “আমি মায়াবলে সূর্যকে ঢাকিতেছি, তাহা হইলে জয়দ্রথ ভাবিরে, সূর্য অস্ত গেল, এখন তোমাকে মরিতে হইবে। সুতরাং তখন আর সে লুকাবার চেষ্টা করিবে না। সেই অবসরে কিন্তু তাহাকে বধ করা চাই।”

 এই বলিয়া কৃষ্ণ মায়াবলে সূর্যকে ঢাকিয়া ফেলিলেন, অর্জুনের মৃত্যুকাল উপস্থিত মনে করিয়া কৌরবদিগের আনন্দের সীমা রহিল না। তখন জয়দ্রথ গলা উঁচু করিয়া দেখিতে লাগিলেন, সূর্য যথার্থই অস্ত গিয়াছে কিনা।

 অমনি কৃষ্ণ বলিলেন, “অৰ্জুন, এই বেলা! ঐ দেখ জয়দ্রথ নিশ্চিন্তে গলা উঁচু করিয়া সূর্য দেখিতেছে। এই বেলা উহার মাথা কাটিয়া ফেল।”

 কিন্তু জয়দ্রথের মাথা কাটা সহজ কাজ নহে। উহার জন্মকালে দেবতারা বলিয়াছিলেন, “যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো মহাবীর ইহার মাথা কাটিবেন।” তখন উহার পিতা বৃদ্ধক্ষত্র বলেন, “যে ব্যক্তি আমার পুত্রের মাথা ভূমিতে ফেলিবে, তাহার মাথাও তখনই শতখণ্ড হইবে।” এই বলিয়া বৃদ্ধক্ষত্র বনে গিয়া তপস্যা আরম্ভ করেন। এখন তিনি সমন্তপঞ্চক নামক তীর্থে তপস্যা করিতেছেন।

 এ সকল কথা মনে করিয়া কৃষ্ণ বলিলেন, “সাবধান অৰ্জুন! ইহার মাথাটা তোমার হাতে মাটিতে পড়িলে কিন্তু সর্বনাশ। মাথাটাকে সেই সমন্তপঞ্চক তীর্থে বুড়া বৃদ্ধক্ষত্রের কোলে নিয়া ফেলিতে হইবে।”

 তখন অর্জুন এক বাণেই জয়দ্রথের মাথা কাটিয়া, তাহা মাটিতে পড়িবার পূর্বেই তিনি আর কয়েক বাণে সেটাকে উড়াইয়া সেই সমস্তপঞ্চক তীর্থে, জয়দ্রথের পিতার কোলে নিয়া ফেলিলেন। সেখান হইতে উহা মাটিতে পড়িবামাত্র বৃদ্ধক্ষত্রের মাথা কাটিয়া শতখণ্ড হইয়া গেল।

 তারপর কৃষ্ণ অন্ধকার দূর করিয়া দিলে দেখা গেল যে, তখনো সূর্য একেবারে ডুবিয়া যায় নাই।

 জয়দ্রথেব মৃত্যুতে কৃপ আর অশ্বত্থামা রাগিয়া অর্জুনকে আক্রমণ করিলেন। কিন্তু অর্জুনের বাণ তাঁহারা সহ্য করিতে পারিলেন না।

 সেদিন সন্ধ্যার পরেও আর কেহ শিবিরে যায় নাই। সমস্ত রাত্রি মশাল জ্বালিয়া যুদ্ধ চলিয়াছিল। সে রাত্রিতে দ্রোণ, সাত্যকি, অশ্বত্থামা, ভীম, ঘটোৎকচ প্রভৃতি অতি অদ্ভুত বীরত্ব দেখান, আর অর্জুনের হাতে অসংখ্য লোক মরে। সে সময়ে তাহার বড় ইচ্ছা ছিল যে, কর্ণের সহিত যুদ্ধ করেন; কিন্তু কৃষ্ণের কৌশলে তাহা হয় নাই।

 কর্ণ ঘোরতর যুদ্ধের পর সাত্যকির হাতে পরাজিত হইলেন। তারপর অশ্বত্থামা, কৃতবর্মা প্রভৃতি অনেকেই সাত্যকিকে আক্রমণ করিয়াছিলেন, কিন্তু তাহাকে পরাজয় করিতে কাহারো শক্তি হইল না।

 এদিকে দুর্যোধন যুদ্ধে কিছু করিতে না পারিয়া শেষে দ্রোণকে গালি দিতে আরম্ভ করায় দ্রোণ নিতান্ত দুঃখের সহিত বলিলেন, “দুর্যোধন! কেন বৃথা আমাকে কষ্ট দিতেছ? আমি তো সর্বদাই বলিতেছি যে, অর্জুনকে জয় করা অসম্ভব। পাপ তো কম কর নাই। এখন সে পাপের ফল ভোগ কর।” এই বলিয়া তিনি বাণে বাণে পাণ্ডবদিগকে অস্থির করিয়া তুলিলেন।

 দুর্যোধনও তখন কম তেজ দেখান নাই! হাজার হাজার লোক তাহার হাতে প্রাণত্যাগ করে। তারপর যুধিষ্ঠির আসিয়া ধনুক কাটিয়া দশ বাণেই তাহাঁকে কাতর করিয়া দেন। যুধিষ্ঠির আবার বাণ মারিলে আর দুর্যোধন যুদ্ধ করিতে পারেন নাই।

 দ্রোণ আর ভীমের কথা কি বলিব? দ্রোণ ঘোরতর যুদ্ধ করিয়া কেকয়গণ, ধৃষ্টদ্যুম্নের পুত্রগণ ও শিবিকে বিনাশ করিলেন। আর ভীম কীল মারিয়া কলিঙ্গরাজের পুত্র ধ্রুব, আর লাথির চোটে দুর্মদ এবং দুষ্কর্ণকে সংহার করিলেন।

 ঘটোৎকচ আর অশ্বত্থামার সে সময়ে যে যুদ্ধ হইয়াছিল, তাহা বড়ই অদ্ভুত। রাত্রিতে রাক্ষসদের বল বাড়ে, আর রাক্ষসেরা নানারকম মায়াও জানে, তাহার উপর আবার ঘটোৎকচ অসাধারণ বীর। সুতরাং অশ্বত্থামা যে নিতান্ত সঙ্কটে পড়িয়াছিলেন, তাহাতে সন্দেহ কি? কিন্তু এমন সঙ্কটেও তিনি কিছুমাত্র কাতর হ্ন নাই। ঘটোৎকচের সকল মায়া তিনি তিনবার চূর্ণ করিয়া দিলেন।

 ঐ সময়ে ঘটোৎকচের পুত্র অঞ্জনপর্বা অশ্বত্থামাকে আক্রমণ করিয়া অল্পক্ষণের মধ্যেই মারা গেলে, ঘটোৎকচ অশ্বত্থামার উপরে ঘোরতর বাণবৃষ্টি আরম্ভ করে। সে সকল বাণ অশ্বত্থামা কাটিয়া ফেলিলে সে এমনি অদ্ভুত এক পাহাড় আনিয়া উপস্থিত করিল যে, বলিব! সে পাহাড়ের ঝর্ণা সকল হইতে ক্রমাগত শেল, শূল, মুষল, মুদগর প্রভৃতি অস্ত্র অশ্বত্থামার উপর পড়িতে লাগিল।

 পাহাড় অশ্বত্থামার বাণে চুর্ণ হইলে, ঘটোৎকচ মেঘের রূপ ধরিয়া ক্রমাগত অশ্বত্থামার উপরে প্রস্তরবৃষ্টি আরম্ভ করিল। কিন্তু অশ্বত্থামার বায়ব্য’ অস্ত্রে সে সকল পাথরসুদ্ধ মেঘ কোথায় উড়িয়া গেল, তাহার ঠিক নাই।

 তখনি আবার কোথা হইতে বিকটাকার রাক্ষসগণ অশ্বত্থামাকে গিলিতে আসিল। কিন্তু অশ্বত্থামা তাহাতেও কাতর হইলেন না। রাক্ষসেরা দেখিতে দেখিতে তাহার বাণে খণ্ড খণ্ড হইয়া গেল।

 ইহা দেখিয়া ঘটোৎকচ অশ্বত্থামাকে একটা বজ্র ছুডিয়া মারে। অশ্বত্থামা সেই বজ্র লুফিয়া লইয়া উল্টিয়া ঘটোৎকচকেই আবার তাহা ছুঁড়িয়া মারিলে তাহাতে ঘটোৎকচের ঘোড়া, সারথি আর ধবজ কাটিয়া গেল। এই সময় ধৃষ্টদ্যুম্ন ঘটোৎকচকে সাহায্য করিতেছিলেন, তথাপি অশ্বথামার বাণে সে এতই কাতর হইয়া পড়িল যে, ধৃষ্টদ্যুম্ন তাহার মৃত্যু হইল ভাবিয়া তাড়াতাড়ি সেখান হইতে পলাইয়া গেলেন।

 এদিকে সোমদত্ত ও বাহ্লীকের সহিত ভীম আর সাত্যকির যুদ্ধ চলিয়াছে। সোমদত্তকে ভীম পরিঘের আঘাতে অজ্ঞান করিয়া ফেলিলে তাহার পিতা বাহ্লীক ভীমকে আক্রমণ করেন। বহ্লীকের শক্তির ঘায়ে ভীম অচেতন হইয়া গিয়াছে। কিন্তু মুহূর্ত পরেই আবার উঠিয়া তিনি এমন এক গদা ছুড়িয়া মারিলেন যে, তাহাতে বাহ্লীকের মাথা চূর্ণ হইয়া গেল।

 তারপর ভীম নাগদত্ত, দৃঢ়রথ, বীরবাহ প্রভৃতি দুর্যোধনের নয়টি ভাইকে মারিয়া কর্ণের ভ্রাতা ভূকরথ শকুনির ভাই শতচন্দ্র ও ধৃতরাষ্ট্রের আর সাতটি শ্যালককে সংহার করিলেন।

 আর এক স্থানে যুধিষ্ঠিরকে অনেক লোক মারিতে দেখিয়া, দ্রোণ আসিয়া তাহাকে আক্রমণ করিলেন। কিন্তু কিছুতেই তাহাকে পরাজয় করিতে পারিলেন না। যুধিষ্ঠির তাহার বায়ব্য, বারুশ, যাম, আগ্নেয়, ত্বাষ্ট্র, সাবিত্রী প্রভৃতি সকল অস্ত্র কাটিয়া শেষ করিলেন। দ্রোণের ঐন্দ্র ও প্রাজাপত্য অস্ত্র যুধিষ্ঠিরের মাহেন্দ্র অস্ত্রে কাটা গেল। তখন দ্রোণ রোষভরে ব্রহ্মাস্ত্র হাতে করিলে, যোদ্ধাদের আতঙ্কের সীমাই রহিল না। কিন্তু যুধিষ্ঠির তাহাতে কিছুমাত্র ভয় না পইিয়া, নিজের ব্রহ্মস্ত্রে দ্রোণের ব্রহ্মাস্ত্র বারণ করিলেন। কাজেই দ্রোণের আর যুধিষ্ঠিরকে পরাজয় করা হইল না।

 এই সময় কর্ণ পাণ্ডব সৈন্যদিগকে বড়ই অস্থির করিয়া তোলেন। তাহারা তাহার বাণের জ্বালায় হতবুদ্ধি হইয়া পলায়ন করিতে থাকে। তখন অর্জুন না থাকিলে কি হইত, কে জানে? অর্জুন আসিয়া কর্ণের ধনুক, ঘোড়া আর সারথি কাটিয়া তাহাকে বাণে বাণে সজারুর প্রায় করিয়া দেন। কৃপের রথ সেখানে ছিল তাই রক্ষা, নহিলে সে যাত্রা কর্ণের প্রাণ বাঁচানোই ভার হইত।

 ইহার পর ভীষণ যুদ্ধে সাত্যকির হাতে সোমদত্তের মৃত্যু হয়। যুধিষ্ঠিরও তখন দ্রোণের সহিত খুব যুদ্ধ করিতেছিলেন;এমনকি, মুহূর্তকের জন্য তাঁহাকে অজ্ঞান করিতেও ছাড়েন নাই। কিন্তু কৃষ্ণ তাহাকে বারণ কবিয়া বলিলেন, “উনি সর্বদা আপনাকে ধরিয়া নিবার চেষ্টায় আছেন, উহার সহিত আপনার যুদ্ধ না করাই ভালো।”

 ইহার কিছু পরে কৃতবর্মার সহিত যুদ্ধ করিতে গিয়া যুধিষ্ঠির অজ্ঞান হইয়া যান; অন্যেরা তাড়াতাড়ি তাহাকে সেখান হইতে লইয়া গিয়া তাহার প্রাণ বাঁচায়।

 তারপর আবার অশ্বত্থামা এবং ঘটোৎকচের ঘোরতর যুদ্ধ হয়। এবারেও জয় অশ্বত্থামারই হইল। দুর্যোধন এই সময়ে ভীমকে আক্রমণ করিয়া ক্রমাগত পাঁচবার তাহার ধনুক কাটিলেন। তাহাতে ভীম ধনুক ছাড়িয়া শক্তি ছুঁড়িয়া মারিলে তাহাও দুর্যোধন কাটিতে ছাড়িলেন না। তখন ভীম দুর্যোধনের রথের উপবে এমনি বিশাল এক গদা হুঁডিয়া মারিলেন যে তাহাতে রথ, ঘোড়া, সাবথি সব চুরমার হইয়া গেল। দুর্যোধন ভয়ে কাপিতে কাপিতে নন্দকের রথে উঠিযা প্রাণ বাঁচাইলেন, কিন্তু ভীমের মনে হইল বুঝি রথ আর ঘোড়াব সহিত তিনিও চূর্ণ হইয়াছেন।

 এই সময়ে সহদেবের সহিত কর্ণের যুদ্ধ হয়; আর সহদেব দেখিতে দেখিতে তাহাতে হারিয়া যান। তখন কর্ণ ইচ্ছা করিলেই তাহাকে বধ করিতে পারিতেন, কিন্তু কুন্তীর কথা ভাবিয়া ক্ষান্ত রহিলেন।

 শকুনি কিন্তু নকুলের হাতে খুবই সাজা পাইলেন। শিখণ্ডীরও কৃপের হাতে প্রায় সেইরূপ দশা হইল। তাপর দ্রোণ আর ধৃষ্টদ্যুম্নে, কর্ণ আর সাত্যকিতে;এইরূপ করিয়া কত যে যুদ্ধ হইল, তাহাব শেষ নাই। এদিকে, এ সকল যুদ্ধের ভিতরেই, অর্জুনের গাণ্ডীবের ভয়ংকর শব্দ ক্রমাগত দূর হইতে শোনা যাইতেছিল। তিনি যে এখন কত লোক মারিতেছিলেন, তাহার সংখ্যা নাই। তাহাকে আটকাইতে আসিয়া শকুনি আর তাহার পুত্র উলুক বড়ই লজ্জা  পাইলেন।

 ইহাতে দুর্যোধনের নিকট বকুনি খাইয়া, দ্রোণ আর কর্ণ মহারোষে পাণ্ডব সৈন্য মারিতে আরম্ভ করিলেন। তখন বেচারারা দ্রোণের বিক্রম সহ্য করিতে না পারিয়া পলায়ন করিতে লাগিল। যতক্ষণ না অর্জুন আসিয়া দ্রোণ আর কর্ণকে আক্রমণ করিলেন, ততক্ষণ আর তাহারা যুদ্ধক্ষেত্রে আসিতে সাহসই পায় নাই। খানিক পরে আবার কর্ণ এমনি ভয়ংকর হইয়া উঠিলেন যে, সৈন্যদের কথা দুরে থাকুক, স্বয়ং যুধিষ্ঠিরের ভাবনা হইল, এখন যুদ্ধ করি, না পলায়ন করি।

 অর্জুন আর সহ্য করিতে না পারিয়া কৃষ্ণকে বলিলেন, “শীঘ্র কর্ণের নিকট চলুন, আজ হয় আমি উহাকে বধ করিব, না হয় ঐ আমাকে বধ করিবে।”


উপেন্দ্র —৩৮  কিন্তু কৃষ্ণ তাহাতে অসম্মত হইয়া বলিলেন, “তোমাকে মারিবার জন্য কর্ণ ইন্দ্রের সেই একপুরুষঘাতিনী শক্তি রাখিয়া দিয়াছে অতএব এখন তোমার তাহার কাছে যাওয়া উচিত নহে। ঘটোৎকচকে পাঠাও।”

 তখন অর্জুনের কথায় ঘটোৎকচ গিয়া কর্ণের সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করিল। এদিকে সেই টাসুরের পুত্র অলম্বল নামক রাক্ষস আসিয়া দুর্যোধনকে বলিল, “হেই মোহারাজ্জ! মোকে বোলনা, মুহি পাণ্ডোধেররকে মারকে খাই। ই লোক মোর বাপ্পুকে মারিলেক!”

 দুর্যোধনের ইহাতে কোনো আপত্তি হওয়ার কথা ছিল না। সুতরাং তখন অলম্বল আর ঘটোৎকচে যুদ্ধ আরম্ভ হইল। দুই রাক্ষস মিলিয়া কি অদ্ভুত যুদ্ধই করিয়াছিল! অস্ত্র দিয়া, নখ দিয়া, দাঁত দিয়া, কীল, লাথি, চড় মারিয়া সাদাসিধা যুদ্ধ তো প্রথমে তাহারা করিলই, শেষে আরম্ভ হইল মায়াযুদ্ধ একজন যেইমাত্র আগুন হইল, অমনি আর একজন হইল জল! তখন এ হইল তক্ষক, অমনি ও হইল গরুড়! এ হইল মেঘ, ও হইল ঝড়; মেঘ হইল পর্বত, ঝড় হইল বজ্র। পর্বত হইল হাতি, বজ্র হইল বাঘ! হাতি গেল সূর্য হইয়া বাঘকে পোড়াইতে, অমনি বাঘ আসিল রাহু হইয়া সূর্যকে গিলিতে!

 এইরূপে অসম্ভব অদ্ভুত যুদ্ধের পর ঘটোৎকচ অলম্বলের মাথা কাটিয়া তারপর কর্ণকে আক্রমণ করিল। দুইজনেই বীর, কাহারো তেজ কম নহে। কত বাণ ঘটোৎকচ কর্ণকে মারিল, কত বাণ কর্ণ ঘটোৎকচকে মারিলেন। দুজনের কাঁসার কবচ ছিড়িয়া গেল। দুজনের শরীরই রক্তে লাল হইল। শেষে কর্ণ ঘটোৎকচের ঘোড়া মারিয়া আর রথ ভাঙ্গিয়া দিলে, সে মায়া দ্বারা এমনি কিট চেহারা করিল যে কি বলিব! কর্ণ বাণ মারেন, আর সে হা ঁকরিয়া তাহা গিলে। দেখিতে দেখিতে সে বুড়া আঙ্গুলটির মতন ছোট হইয়া যায়, আবার তখনি বিশাল পর্বতের বেশে আসিয়া উপস্থিত হয়। ইহার মধ্যে তাহার একশতটা মাথা হইয়া গেল। তারপর হঠাৎ আর সে নাই, সে পাতালে ঢুকিয়া গিয়াছে। আবার মুহূর্তেকের ভিতরেই, সে পাহাড় সাজিয়া শূন্যমার্গে আকাশে আসিয়া উপস্থিত। সেই পাহাড় হইতে কত শেল, কত শূল, কত গদা যে কর্ণের মাথায় পড়িল, তাহার অস্তই নাই। তারপর আবার অসংখ্য বিকট রাক্ষস কোথা হইতে আনিয়া উপস্থিত করিল! এইরূপে কত মায়া যে সে দেখাইল, তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না, কিন্তু কর্ণ কিছুতেই কাতর হইলেন না।

 ইহার মধ্যে অলায়ুধ নামক একটা ভয়ংকর রাক্ষস আসিয়া ঘটোৎকচকে আক্রমণ করিল। তখন ভীম ঘটোৎকচের সাহায্য করিতে আসিলে, অলায়ুধের সহিত তাহার ভীষণ যুদ্ধ হইল। অলায়ুধ সেই বকের ভাই, কাজেই ভীমের উপর তাহার বড়ই রাগ। আর সে রাগের উপযুক্ত বলও তাহার ছিল। সুতরাং সে ভীমকে সহজে ঘড়িল না। এই সময়ে ঘটোৎকচ কর্ণকে ছাড়িয়া আসিয়া তাহাকে আক্রমণ না করিলে, হয়তো সে ভীমকে পরাজয়ই করিত।

 ঘটোৎকচ অনেক কষ্টে অলায়ুধকে বধ করিয়া, আবার কর্ণের সহিত যুদ্ধ করিতে গেল। খানিক যুদ্ধের পর সে কর্ণের ঘোড়া আর সারথিকে মারিয়া হঠাৎ আর সেখানে নাই। তারপর আবার আসিয়া সে কি ভয়ংকর মায়াযুদ্ধই যে আরম্ভ করিল, তাহা কি বলিব। তখন অগ্নিকর্ণ মেধসকল আকাশ হইতে ক্রমাগত বন্ধু, উকা, বাণ, শক্তি, প্রাস, মুষল, পরশু, খড়, পটি, তোমর, পরিঘ, গদা, শূল, শতঘ্নী, পাথর প্রভৃতি বর্ষণ করিতে লাগিল। কর্ণের আর তখন এমন শক্তি হইল না যে, তাহা বারণ করেন। ইহার উপরে আবার শত শত রাক্ষস আসিয়া, কৌরবদিগকে সংহার করিতে লাগিল। কর্ণ তথাপি যথাসাধ্য বাণবৃষ্টি করিতেছিলেন, কিন্তু তাহাতে বিশেষ কিছুই হইল না। এদিকে ঘটোৎকচ শতঘ্নী মারিয়া তাহার ঘোড়া কয়টিকে বধ করিয়াছে।

 এমন সময় কৌরবেরা সকলে মিলিয়া কর্ণকে কহিলেন, “আর কি দেখিতেছ? শীঘ্ন ইন্দ্রের সেই একপুরুষঘাতিনী শক্তি দিয়া এই রাক্ষসকে বধ কর।”

 কর্ণ দেখিলেন যে, রাক্ষসের হাতে প্রাণ যায় যায়;কাজেই তখন তিনি নিরুপায় হইয়া, সেই একপুরুষঘাতিনী শক্তি হাতে লইলেন।

 সে শক্তি দেখিবামাত্র ঘটোৎকচ নিজের দেহকে বিশাল পর্বতের ন্যায় বড় করিয়া, উধশ্বাসে পলাইতে লাগিল। জীব-জন্তুরা চিৎকার করিয়া উঠিল, ঝড় বহিল, বজ্রপাত আরম্ভ হইল; আর সেই মহাশক্তি, কর্ণের হাত হইতে ছুটিয়া গিয়া ঘটোৎকচের বুক ভেদ করত, উধর্বমুখে প্রস্থান করিল।

 ঘটোৎকচ পড়িবার সময়, এক অক্ষৌহিণী কৌরব সৈন্য তাহার সেই বিশাল শরীরের চাপে মারা গেল। তাহার মৃত্যুতে পাণ্ডবদের কিরূপ দুঃখ হইল, বুঝিতেই পার। কিন্তু কৃষ্ণ ইহার মধ্যে সিংহনাদপূর্বক অর্জুনকে আলিঙ্গন করিয়া, সেই রথের উপরেই নাচিতে লাগিলেন। ইহাতে অর্জুন ব্যথিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এমন দুঃখের সময় কিজন্য আপনি এত আনন্দ প্রকাশ করিতেছেন?”

 কৃষ্ণ বলিলেন, “আনন্দ করিতেছি এইজন্য যে, কর্ণ সেই শক্তি ঘটোৎকচের উপর মারাতে, তোমার বিপদ কাটিয়া গেল। ঘটোৎকচকে না মারিলে ঐ শক্তি দিয়া সে তোমাকে বধ করিত। এখন উহা তাহার হাত হইতে চলিয়া গেল, এরপর তুমি অনায়াসেই তাহাকে মারিতে পারিবে।”

 কিন্তু ঘটোৎকচের গুণের কথা মনে করিয়া কেহই স্থির থাকিতে পারিল না। জন্মাবধি সে এক মুহূর্তও নিজের সুখের দিকে না চাহিয়া, পাণ্ডবদিগের কত সেবা করিয়াছে, যুধিষ্ঠির সে সকলের কথা বলিতে বলিতে, রাগে এবং দুঃখে অস্থির হইয়া কর্ণকে বধ করিতে চলিলেন। ভীম তো তখন হইতে কৌরবদিগকে এক ধার হইতে মারিতে আরম্ভ করিয়াছেন, এ পর্যন্ত ক্ষান্ত হন নাই।

 এমন সময় অর্জুন সকলকে বলিলেন, “রাত্রি অনেক হইয়াছে, আর তোমরাও অন্ধকারে যুদ্ধ করিয়া নিতান্তই ক্লান্ত হইয়াছ। সুতরাং এই বেলা একটু বিশ্রাম করিয়া লও, চন্দ্র উঠিলে আবার যুদ্ধ করা যাইবে।” অর্জুনের কথায় সকলে সন্তুষ্ট হইয়া, যিনি যেমনভাবে ছিলেন, সেইভাবেই, কেহ ঘোড়ায়, কেহ রথে, কেহ হাতিতে, কেহ সেই রণস্থলের কাদার উপরেই ঘুমাইয়া পড়িলেন। অস্ত্রশস্ত্র যোদ্ধাদিগের হাতেই রহিল।

 শেষ রাত্রিতে চাঁদউঠিলে, আবার যুদ্ধ আরম্ভ হইল। ভোরবেলায় দ্রুপদ, এবং তিনটি পৌত্র সহ বিরাট, দ্রোণের হাতে মারা গেলেন। তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন শোকে অধীর হইয়া প্রতিজ্ঞা করিলেন, “আজ যদি আমি দ্রোণকে বধ না করি, তবে যেন আমার স্বর্গলাভ না হয়।”

 এই বলিয়া তিনি ভীমের সহিত দ্রোণ-সৈন্য আক্রমণ করিলেন। তখনকার যুদ্ধ কি ঘোরতরই হইল। দুর্যোধন ও দুঃশাসন নকুল ও সহদেবের সহিত, কর্ণ ভীমের সহিত, দ্রোণ অর্জুনের সহিত, এমনই যুদ্ধ করিতে লাগিলেন যে, সকলে তাহা দেখিয়া অবাক হইয়া গেল।  দ্রোণ আর অর্জুনের যুদ্ধ কি আশ্চর্য, তাঁহাদের হাতেরই বা কি অদ্ভুত ক্ষমতা, রথেরই বা কি বিচিত্র গতি, আর অস্ত্রেরই বা কি চমৎকার গুণ। কত বড়-বড় অস্ত্র যে দ্রোণ অর্জুনকে মারিলেন, তাহার সংখ্যা নাই। অর্জুন তাহা সকলই কাটিয়া ফেলিলেন। যতই তিনি সে সব অস্ত্র কাটেন, দ্রোণ ততই আহ্লাদিত হইয়া ভাবেন যে, ‘আমি যত পরিশ্রম করিয়া উহাকে শিখাইয়াছিলাম, তাহা সার্থক হইয়াছে।’

 সেদিন অনেকের সহিত অনেকের যুদ্ধ হইয়াছিল। কিন্তু দ্রোণ যেমন তেজের সহিত পাণ্ডব সৈন্য সংহার করিয়াছিলেন, পাণ্ডবেরা তেমন করিয়া কৌরব সৈন্য মারিতে পারেন নাই। দ্রোণের পরাক্রম দেখিয়া তাঁহাদের মনে আতঙ্ক উপস্থিত হইল।

 এমন সময় কৃষ্ণ অর্জুনকে বলিলেন, “অর্জুন! দ্রোণের হাতে অস্ত্র থাকিতে দেবতারাও উহাকে মারিতে পারেন না। অতএব যাহাতে উনি অস্ত্র ছাড়েন, তাহার উপায় করিতে হইবে। কেহ গিয়া উহার কাছে বলুক যে, “অশ্বত্থামা মরিয়া গিয়াছে’ তাহা হইলে উনি অস্ত্র ছাড়িয়া দিবেন।”

 অর্জুন এমন কাজ করিতে কিছুতেই সম্মত হইলেন না, কিন্তু অন্য যোদ্ধারা ইহাতে মত দিলেন, এবং অনেক কষ্টে যুধিষ্ঠিরেরও মত করানো হইল।

 তখন ভীম কি করিলেন শুন। পাণ্ডবপক্ষের ইন্দ্রবর্মার একটা হাতি ছিল, তাহার নাম ‘অশ্বত্থামা’! ভীম গদাঘাতে সেই হাতিটাকে মারিয়া, লজ্জিতভাবে দ্রোণের নিকট আসিয়া চিৎকারপূর্বক বলিতে লাগিলেন, “অশ্বত্থামা মরিয়া গিয়াছে। অশ্বত্থামা মরিয়া গিয়াছে!”

 এ কথায় দ্রোণ প্রথমে বড়ই কাতর হইলেন; কিন্তু তারপর মনে করিলেন যে ‘অশ্বত্থামা অমর, সে কি মরিয়া যাইবে? তারপর খানিক যুদ্ধ করিয়া তিনি যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “যুধিষ্ঠির! অশ্বত্থামা মরিছে এ কথা কি সত্য?”

 দ্রোণ জানেন যে, যুধিষ্ঠির কখনোই মিথ্যা কথা কহেন না, কাজেই তিনি যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করিলেন। কিন্তু হায়! কৃষ্ণ যে ইহার মধ্যে যুধিষ্ঠিরকে কি শিখাইয়া রাখিয়াছে, তাহা তিনি জানেন না। কৃষ্ণ তাহাকে বলিয়াছেন, “মহারাজ! আপনি এই মিথ্যা কথাটুকু না বলিলে, আমরা সকলে আজ দ্রোণের হাতে মারা যাইব। সুতরাং এইটুকু মিথ্যা কথা বলিয়া আমাদিগকে রক্ষা করুন।”

 ইহার উপর আবার ভীম সেই অশ্বত্থামা নামক হাতিটাকে মারিয়া অশ্বথামা মরিয়াছে একথা বলার সুবিধাও করিয়া দিয়াছে। কাজেই যুধিষ্ঠিরের আর তাহা বলিতে তত আপত্তি নাই। তবে কথা এই যে, দ্রোণ তো আর হাতির কথা জিজ্ঞাসা করেন নাই, তিনি তাঁহার পুত্রের কথাই জিজ্ঞাসা করিয়াছেন। সুতরাং কেবল ‘অশ্বত্থামা মরিয়াছে’, এ কথা তাঁহাকে বলিলে মিথ্যা কথাই বলা হয় বৈকি!

 যাহা হউক, যুধিষ্ঠিরের চেষ্টা, যাহাতে দুই দিকই রক্ষা হয়। জয়ও লাভ করিতে হইবে, মিথ্যাও বলা হইবে না। এই ভাবিয়া তিনি দ্রোণকে বলিলেন, “অশ্বত্থামা মরিয়াছে...হাতি।”

 ‘অশ্বথামা মরিয়াছে’ এইকথাগুলি বলিলেন জোরে, দ্রোণ তাহাই শুনিতে পাইলেন। ‘হাতি’ কথাটি বলিলেন অতি মৃদু স্বরে; দ্রোণ তাহা শুনিতে পাইলেন না।

 মহারাজ যুধিষ্ঠিরের রথ কখনো মাটি ছুঁইত না, সর্বদাই চারি আঙ্গুল উচ্চে থাকিত। কিন্তু তিনি মিথ্যা কথা বলার পর হইতে, তাহা মাটিতে নামিয়া পড়িল।

 যুধিষ্ঠিরের মুখে অশ্বত্থামার মৃত্যুর কথা শুনিয়া, দ্রোণ নিতান্তই কাতর হইয়া পড়িলেন। তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁহাকে আক্রমণ করিলেন, তিনি আর আগের মতো যুদ্ধ করিতে পারিলেন না। তথাপি তিনি অনেকক্ষণ যুঝিয়াছিলেন, এবং সহজে কেহ তাঁহার কিছু করিতে পারে নাই।

 এমন সময় ভীম আবার আসিয়া বলিলেন, “কিসের জন্য এত যুদ্ধ করিতেছে? অশ্বত্থামা তো মরিয়া গিয়াছে।”

  তখন দ্রোণ অস্ত্র ফেলিয়া দিয়া বলিলেন, “হে মহাবীর কর্ণ! হে কৃপাচার্য! হে দুর্যোধন! আমি বারম্বার বলিতেছি, তোমরা ভালো করিয়া যুদ্ধ কর! তোমাদের মঙ্গল হউক; আমি অস্ত্রত্যাগ করিলাম।” এই বলিয়া তিনি ভগবানের চিন্তায় মন দিলেন।

 এমন সময় দেখা গেল যে, ধৃষ্টদ্যুম্ন অসি হস্তে দ্রোণকে কাটিতে চলিয়াছেন। রণভূমিসুদ্ধ লোক তাহাতে শিহরিয়া উঠিল। সকলে চিৎকার করিয়া বলিল, “হায় হায়! এমন কাজ করিও না।” অর্জুন রথ হইতে লাফাইয়া পড়িয়া তাহাকে বারণ করিতে ছুটিলেন। কিন্তু হায়! কিছুতেই কিছু হইল না; অর্জুন তাঁহাকে ধরিবার পূর্বেই তিনি তাহার নিষ্ঠুর নীচ কাজ শেষ করিয়া ফেলিলেন।

 দ্রোণের মৃত্যুতে কৌরবেরা ভয়ে হতবুদ্ধি হইয়া পলায়ন করিতে লাগিল। দুর্যোধন পলাইলেন, কর্ণ পলাইলেন, শল্য পলাইলেন, কৃপ কাঁদিতে কাঁদিতে রণস্থল ছাড়িয়া চলিলেন। সকলেই ভাবিলেন যে, আজ বুঝি কৌরব সৈন্য নিঃশেষ হইয়া গিয়াছে।

 অশ্বত্থামা অন্যদিকে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন; তিনি এ বিপদের কিছুই জানিতে পারেন নাই। সকলকে পলায়ন করিতে দেখিয়া, তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমরা কিজন্য এমন করিয়া পলাইতেছ?”

 ইহার উত্তরে যখন তাঁহাকে দ্রোণের মৃত্যু সংবাদ শোনানো হইল, তখন তিনি অশ্রু মুছিতে মুছিতে বলিলেন, “আজ নিশ্চয় আমি পাণ্ডবপক্ষের সকলকে বিনাশ করিব।”

 অশ্বত্থামার নিকট নারায়ণ অস্ত্র নামক একখানি অতি ভয়ংকর অস্ত্র ছিল। সে অস্ত্র ছুঁড়িলে, কাহারো সাধ্য হয় না যে তাহাকে আটকায়। অমরই হউক আর দেবতাই হউক, সে অস্ত্র গায়ে পড়িলে, তাহাকে মরিতেই হইবে। স্বয়ং নারায়ণ এই অস্ত্র দ্রোণকে দেন, দ্রোণের নিকট হইতে তাহা অশ্বথামা পান। সেই অস্ত্র এখন তিনি ধনুকে জুড়িলেন।

 নারায়ন অস্ত্র ছুঁড়িবামাত্র ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত এবং ভূমিকম্প আরম্ভ হইল, সূর্য মলিন হইয়া গেল, চারিদিকে অন্ধকার ঘিরিয়া ফেলিল, সাগর উথলিয়া উঠিল, নদী সকলের স্রোত ফিরিয়া গেল। সেই সাংঘাতির অস্ত্রের ভিতর হইতে, আগুনের মতো অসংখ্য অস্ত্র বারি হইয়া, জ্বলিতে জ্বলিতে, ঘোর গর্জনে পাণ্ডবদিগকে তাড়া করিল। তখন আর কেহই মনে করিল না যে, তাহাদের রক্ষা পাওয়ার কোন উপায় আছে।

 কিন্তু উপায় ছিল; তাহা কৃষ্ণ জানিতেন। তিনি সকলকে বলিলেন, “তোমরা শীঘ্র অস্ত্র ফেলিয়া নামিয়া দাঁড়াও, তাহা হইলে এ অস্ত্রে কিছুই করিতে পারিবে না। অমনি সকলে অস্ত্রত্যাগ করিয়া, হাতি, ঘোড়া, রথ, যিনি যাহার উপর ছিলেন, তাহা হইতে নামিয়া পড়িলেন। কিন্তু ভীম রোখা লোক, তিনি বলিলেন, “অস্ত্র ছাড়িব কেন? এই গদা দিয়ে আমি নারায়ণ অন্ত্রকে পিষিয়া দিব।” বিষম বিপদ আর কি! ভীম কিছুতেই অস্ত্র ছড়িবেন না। নারায়ণ অস্ত্রকে অগ্রাহ্য করিয়া তিনি অশ্বত্থামাকে আক্রমণ করিতে গেলেন; আর নারায়ণ অস্ত্রের ভীষণ অগ্নিও তৎক্ষণাৎ আসিয়া, রথযুদ্ধ তাঁহাকে ঘিরিয়া ফেলিল। তখন কৃষ্ণ আর অর্জুন উধৰ্বশ্বাসে ছুটিযা গিয়া, তাঁহাকে রথ হইতে টানিয়া নামান, আর তাঁহার অস্ত্র কড়িয়া ফেলিয়া দেন, নচেৎ না জানি সেদিন কি হইত!

 এইরূপে ভীম বঁচিয়া গেলেন বটে, কিন্তু জোর করিয়া নামাইবার আর অস্ত্র কাড়িয়া লইবার দরুন, তাঁহার ভয়ানক রাগ হওয়াতে, তিনি সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করিয়া নিশ্বাস ফেলিতে লাগিলেন।

 নারায়ণ অস্ত্র বৃথা হওয়ায়, অশ্বত্থামা ক্রোধভরে অতি ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ করিলে ধৃষ্টদ্যুম্ন, সাত্যকি, ভীম ইঁহাদের কেহই তাঁহার সম্মুখে টিকিয়া থাকিতে পারলেন না। তারপর অর্জুন তাহকে আক্রমণ করিলে, তিনি মন্ত্র পড়িয়া আগ্নেয়াস্ত্র নামক এক মহা অস্ত্র তাহার প্রতি নিক্ষেপ করা মাত্র অতি ভীষণ কাণ্ড উপস্থিত হইল, যেন সৃষ্টি থাকে কি যায়। এরূপ অস্ত্র আর কেহ কখনো দেখে নাই। অশ্বথামা মনে করিয়াছিলেন যে, এ অস্ত্রে পাণ্ডবেরা নিশ্চয় মরিবে। কিন্তু অর্জুন তাহার পরক্ষণেই ব্রহ্মাস্ত্র মারিয়া সে অস্ত্রকে দূর করিয়া দিলেন। তখন অশ্বথামা নিতান্ত নিরাশভাবে “দূর হোক। সব মিথ্যা!” এই বলিতে বলিতে রণস্থল ছাড়িয়া প্রস্থান করিলেন।