উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/ছেলেদের মহাভারত/কর্ণপর্ব
কর্ণপৰ্ব
চদিন ঘোরতর যুদ্ধের পর দ্রোণ প্রাণত্যাগ করিলেন। ইহার পর কাহাকে সেনাপতি করা যায়, এ বিষয়ে পরামর্শ আরম্ভ হইলে, অশ্বথামা বলিলেন, “মহাবীর কর্ণও অসাধারণ যোদ্ধা, অতএব তাঁহাকেই আমরা সেনাপতি করিয়া, শত্রুদিগকে বিনাশ করিব৷”
তখন দুর্যোধন বলিলেন, “হে কর্ণ! তোমার মতো যোদ্ধা তো আর কেহই নহে, সুতরাং তুমিই এখন আমাদের সেনাপতি হও৷”
এ কথায় কর্ণ বলিলেন, “মহারাজ! আমি পূর্বেই বলিয়াছি যে, পাণ্ডবদিগকে পরাজয় করিব। এখন আমি তোমার সেনাপতি হইতেছি, সুতরাং মনে কর যেন পাণ্ডবেরা হারিয়া গিয়াছে৷”
তখনই ধূমধামের সহিত কর্ণকে সেনাপতি করা হইল। তারপর রাত্রি প্রভাত হইবামাত্র দেখা গেল যে, ‘সাজ! সাজ!’ বলিয়া সকলে যুদ্ধের জন্য ব্যস্ত। কর্ণকে সেনাপতি করিয়া, আবার কৌরবদিগের সাহস ফিরিয়া আসিয়াছে। তাহদের এই বিশ্বাস হইয়াছে যে, ভীষ্ম আর দ্রোণ স্নেহ করিয়া পাণ্ডবদিগকে ছাড়িয়া দিয়াছিলেন, কিন্তু এবার কর্ণের হাতে আর তাঁহাদের রক্ষা নাই। সুতরাং সেদিন যুদ্ধ আরম্ভের সময় সকলেরই খুব উৎসাহ দেখা গেল।
আজ বিশাল হাতিতে চড়িয়া ভীম যুদ্ধে নামিয়াছে। যাহার সহিত প্রথমে তাহার যুদ্ধ হইল, তাহার নাম ক্ষেমমুর্তি,তিনিও হাতির উপরে এবং অসাধারণ বীরও বটে, প্রথমে যুদ্ধ অনেকটা সমানে সমানেই চলিল;এমনকি, ক্ষেমমূর্তিই আগে নারাচের গায়ে ভীমের হাতিকে মারিয়া ফেলিলেন। ভীম সেই হাতি পড়িবার পূর্বেই তাহা হইতে লাফাইয়া পড়িয়া ক্ষেমমূর্তির হাতিকে এমনি লাথি মারিলেন যে, হাতি তাহাতে চেপ্টা হইয়া মাটির ভিতর ঢুকিয়া গেল। তখন ক্ষেমমূর্তি মাটিতে নামিয়া রোষভরে যুদ্ধে অগ্রসর হওয়ামাত্র ভীম গদাঘাতে তাহার প্রাণ বারি করিয়া দিলেন।
তারপর অশ্বত্থামার সহিত ভীমের অনেকক্ষণ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধ করিতে করিতে, শেষে দুজনেই অজ্ঞান হইয়া যাওয়ায়, সারথিরা তাহাদিগকে লইয়া প্রস্থান করে।
এদিকে অর্জুনকে অবশিষ্ট সংশপ্তকদিগের সহিত ঘোর যুদ্ধে রত দেখিয়া অশ্বত্থামা তাহাকে আক্রমণ করিলেন, এবং বেশ একটু জব্দও হইলেন। তখন অর্জুন আবার সংশপ্তকদিগকে আক্রমণ করামাত্র আবার অশ্বত্থামা আসিয়া উপস্থিত। কিন্তু এবারে হাতে বুকে ও মাথায় বাণের খোঁচা খাইয়া অশ্বথামা একটু বিশেষরূপে সাজা পাইলেন। তাহার ঘোড়াগুলিরও কম দুর্দশা হইল না। ইহার উপর আবার তাহাদের রাশ কাটিয়া যাওয়াতে, তাহারা অশ্বত্থামাকে লইয়া সেখান হইতে যে ছুট দিল আর রণক্ষেত্রের বাহিরে না গিয়া থামিল না। অশ্বত্থামাও ভাবিলেন, ভালোই হইয়াছে।
তারপর আর একজন অর্জুনকে আক্রমণ করিলেন, তাহার নাম দণ্ডধার। তিনি মরিলে আসিলেন তাহার ভাই দণ্ড। দণ্ড মরিলে আবার সংশপ্তকেরা আসিল।
অপরদিকে কর্ণও পাণ্ড্যকে বধ করিয়া বিস্তর পাণ্ডব সৈন্য মারিয়াছে। তারপর নকুলকে আক্রমণ করাতে দুজনে যুদ্ধ চলিয়াছে। দুজনেই দুজনের বাণে আচ্ছন্ন, মেঘের ছায়ার ন্যায় বাণের ছায়ায় রণস্থল ঢাকিয়া গিয়াছে। এমন সময় কর্ণের বাণে নকুলের ধনুক কাটা গেল, তারপর দেখিতে দেখিতে তাহার সারথি, ঘোড়া, রথ, অস্ত্র সকলই গেল, আর তাহার যুঝিবার ক্ষমতা রহিল না। তখন তিনি পলায়নের আয়োজন করামাত্র কর্ণ আসিয়া তাহার গলায় ধনুকের ফাঁস লাগাইয়া দেওয়াতে বেচারার সে পথও বন্ধ হইয়া গেল। কর্ণ ইচ্ছা করিলেই তখন নকুলকে বধ করিতে পারিতেন, কিন্তু কুন্তীর কথা মনে করিয়া, কেবল এই বলিয়াই ছাড়িয়া দিলেন, “যাও, ঘরে যাও! আর বড় বড় কৌরবদের সহিত যুদ্ধ করিতে আসিও না!”
ইহার পর আর কর্ণের বিক্রম সহ্য করিতে না পারিয়া, সৈন্যদের দুগতির একশেষ হইয়া উঠিল।
এদিকে কৃপের হাতে পড়িয়া ধৃষ্টদ্যুম্নেরও প্রায় সেই দশা। অনেকে ভাবিল, তিনি বুঝি বা মারাই যান। সারথি তাহাকে বলিল, “বড়ই তো বিপদ দেখিতেছি, রথ ফিরাইব নাকি?” ধৃষ্টদ্যুম্ন বলিলেন, “আমি ঘামিয়া কাঁপিয়া আর মাথার ঠিক রাখিতে পারিতেছি না। চল এই বামুনকে ছাড়িয়া শীঘ্র ভীম বা অর্জুনের কাছে যাই।” সারথি তাহাই করিল।
দুর্যোধন আর যুধিষ্ঠিরের যুদ্ধ অতি অদ্ভুত হইয়াছিল। দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরের ধনুক কাটিলেন, যুধিষ্ঠির তৎক্ষণাৎ অন্য ধনুক লইয়া দুর্যোধনের ধনুক কাটিয়া তাহার উত্তর দিলেন। যুধিষ্ঠিরের তিন বাণ দুর্যোধনের বুকে আসিয়া পড়িল, দুর্যোধন তাহা গ্রাহ্য না করিয়া, উল্টিয়া যুধিষ্ঠিরকে পাঁচ বাণ আর একটা শক্তি মারিলেন। সেই শক্তি কাটা গেলে, দুর্যোধন মারিলেন একটা ভল্ল; তাহার উত্তরে যুধিষ্ঠিরের এক বাণ আসিয়া তাহার গায়ে বিষম বিধিয়া গেল। তখন দুর্যোধন বিশাল গদা হাতে যুধিষ্ঠিরকে মারিতে গিয়া তাহার শক্তির ভীষণ ঘায়ে রথের উপরে অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছে, এমন সময় ভীম আসিয়া যুধিষ্ঠিরকে বারণ করিয়া বলিলেন, “আমি প্রতিজ্ঞা করিয়াছি দুর্যোধনকে মারিব, সুতরাং আপনার এখন উহাকে মারা উচিত নহে।”
এ কথায় যুধিষ্ঠির দুর্যোধনকে ছাড়িয়া দিলেন। তারপর সন্ধ্যা পর্যন্ত বড়ই ভয়ানক যুদ্ধ চলিল। এই সময়ে সর্বাপেক্ষা অধিক বীরত্ব দেখান কর্ণ আর অর্জুন। দুজনেই অসংখ্য সৈন্য বিনাশ করেন। বিশেষত কর্ণের অত্যন্ত বাড়াবাড়ি আরম্ভ হইলে, অর্জুন এমনি অসাধারণ যুদ্ধ করেন যে কৌরবেরা তাহা দেখিয়া, ভয়ে চক্ষু বুজিয়া, আর্তনাদ করিতে থাকেন। তাহাদের ভাগ্যবলে এই সময়ে সন্ধ্যা আসিয়া উপস্থিত হইল। তখন তাহারা যুদ্ধ শেষ করিতে আর কিছুমাত্র বিলম্ব করিলেন না।
কর্ণ সর্বদাই বড় বড় কথা কহেন। সেদিন নাকালের একশেষ হইয়াও তিনি বলিলেন, “অর্জুন আজ হঠাৎ অস্ত্র বৃষ্টি করিয়া আমাদিগকে ফাঁকি দিয়াছে, কিন্তু কাল আমি তাহাকে জব্দ করিব।”
রাত্রি প্রভাত হইলে কর্ণ দুর্যোধনকে বলিলেন, “আজ হয় আমি অর্জুনকে মারিব, না হয় সে আমাকে মারিবে। কিন্তু আমার একজন ভালো সারথি চাই। আমার বিজয় নামক বিশ্বকর্মাকৃত যে আশ্চর্য ধনুক আছে, তাহা অর্জুনের গাণ্ডীবেব চেয়ে কম নহে। এখন কৃষ্ণের মতো একটি সারথি পাইলেই, আমি পাণ্ডবদিগকে অনায়াসে পরাজয় করিতে পারি।”
তারপর তিনি বলিলেন, “শল্য যদি আমার সারথি হন, তবে নিশ্চয় অর্জুনকে বধ করিব। মহাবীর শল্য কৃষ্ণ অপেক্ষাও ভালো সারথি আর আমি তো অর্জুনের চেয়ে বড় যোদ্ধা আছিই। সুতরাং শল্য আমার সারথি হইলে, দেবাসুরগণও আমার হাত হইতে বাঁচিয়া যাইতে পারিবেন না।”
তখন দুর্যোধন শল্যকে বলিলেন, “মামা! আপনাকে কর্ণের সারথি হইতে হইতেছে।”
একথায় শল্য রাগে চোখ ঘুরাইয়া বলিলেন, “কি এত বড় কথা! আমাকে বল সূতপুত্রের (সারথির ছেলে) সারথি হইতে! আমি কি তাহার চেয়ে কম, যে আমি তাহার সারথি হইতে যাইব? চলিলাম আমি এখান হইতে!”
ইহাতে দুর্যোধন ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, “রাম রাম! আপনি কেন তাহার চেয়ে কম হইতে যাইবেন? কৃষ্ণ কি অর্জুনের চেয়ে কম? আমি তো মনে করি যে অর্জুনের চেয়ে বড়, আর আপনি কৃষ্ণের চেয়েও বড়!”
এ কথায় শল্য বলিলেন, “তুমি যে আমাকে কৃষ্ণের চেয়ে বড় বলিলে, ইহাতে আমি বড়ই তুষ্ট হলাম। আচ্ছা তবে আমি কর্ণের সারথি হইব, কিন্তু আমার একটা নিয়ম থাকিল। আমার যাহা খুশি তাহাই আমি কর্ণকে বলিব।”
কর্ণ তাহাতেই রাজি হইয়া রথে উঠিলেন। আর উঠিয়াই শল্যকে বলিলেন, “রথ চালাও। আমি এখনি অর্জুন, ভীম, নকুল, সহদেব আর যুধিষ্ঠিরকে সংহার করিব।”
ইহাতে শল্য বলিলেন, “সূতপুত্র! ইন্দ্রও যাঁহাদিগকে ভয় করেন, তুমি কোন সাহসে তাহাদিগকে অবহেলা করিতেছ? যুদ্ধ আরম্ভ হইলে আর তোমার মুখে এমন কথা শুনা যাইবে না।”
কর্ণ বলিলেন, “আজ যদি যম, বরুণ, কুবের আর ইন্দ্রও বন্ধু বান্ধব লইয়া অর্জুনকে রক্ষা করিতে আসেন, তথাপি আমি তাহাদিগকে সুদ্ধ অর্জুনকে পরাজয় করিব।”
শল্য বলিলেন, “তোমার ক্ষমতা খুব আছে বটে, কিন্তু কথা কও তাহার চেয়ে অনেক বেশি! তুমি কখনোই অর্জুনের সমান নহ। পলায়ন না করিলে, আজ তাহার হাতে তোমার প্রাণ যাইবে।”
কর্ণ বলিলেন, “যখন অর্জুন আমাকে পরাজয় করিবে, তখন আসিয়া তাহার বড়াই করিও।”
তখন শল্য, “বেশ কথা! তাহাই হইবে।” বলিয়া রথ চালাইয়া দিলেন।
কর্ণ পাণ্ডব সৈন্য দেখিলেই বলিলেন, “তোমাদের মধ্যে যে অর্জুনকে দেখাইয়া দিবে, তাহাকে গাড়ি ভরিয়া রত্ন দিব, ছয় হাতির রথ দিব, একশত গ্রাম দিব, আর কৃষ্ণ আর অর্জুনকে মারিয়া তাহাদের সকল ধন দিব।”
এ কথায় শল্য হাসিয়া বলিলেন, “তোমার অত হাতি টাতি কিছুই দিতে হইবে না, অর্জুনকে অমনিই দেখিতে পাইবে।”
এতক্ষণে কণের রাগ হইল; তিনি বলিলেন, “তুমি নিতান্ত মুখ, যুদ্ধের কিছুই জান না। তুমি চুপ কর; তোমার মতো একশোজনে আসিয়া বকিলেও আমি ভয় পাইব না।”
শল্য বলিলেন, “তাই তো! তোমার দেখিতেছিমাথা খারাপ হইয়াছে! চিকিৎসার দরকার!”
এইরূপে ক্রমাগত উপহাস করিয়া, শল্য কর্ণেব মন ভাঙ্গিয়া দিলেন। ইহার অর্থ আর কিছুই নহে, কর্ণের তেজ কমাইয়া দিবার জন্য পাণ্ডবদিগের নিকট যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন, সেই প্রতিজ্ঞা পালন করা। যুদ্ধের সময়ও একটু সুযোগ পাইলেই, “ঐ দেখ অর্জুন কেমন বীর, তুমি উহার সঙ্গে পারিবে না।” এইরূপ নানাকথা বলিয়া তিনি বেচারাকে ব্যস্ত করিয়া তোলেন।
তথাপি কর্ণ যেরূপ যুদ্ধ করিতে লাগিলেন তাহা অতি অদ্ভুত। অর্জুন যত কৌরব সৈন্য মারিলেন, কর্ণ তাহা অপেক্ষা কম পাণ্ডব সৈন্য মারিলেন না, ধৃষ্টদ্যুম্ন, দ্রৌপদীর পুত্রগণ, সাত্যকি, ভীম, সহদেব, শিখণ্ডী যুধিষ্ঠির ইহারা সকলে তাহার নিকট হইতে হঠিয়া গেলেন।
যুধিষ্ঠির কর্ণের সহিত খুব যুদ্ধ করিয়াছিলেন। যুধিষ্ঠিরের বাণে কর্ণ একবার অজ্ঞান হইয়া যান, কিন্তু শীঘ্রই আবার উঠিয়া আসিয়া যুধিষ্ঠিরের পার্শ্বরক্ষক দুটিকে মারিয়া ফেলেন। তারপর ষাট বাণে তাহাকে কাতর করিয়া কর্ণ সিংহনাদ করিতেছেন, এমন সময় সাত্যকি, চেকিতান, যুযুৎসু, ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি অনেক যোদ্ধা আসিয়া তাহাকে চারিদিক হইতে আক্রমণ করিলেন।
তথাপি কর্ণ কিছুমাত্র চিন্তিত হইলেন না। তাহার বাণে চারিদিক ছারখার হইয়া যাইতে লাগিল। যুধিষ্ঠিরের ধনুক আর বর্ম কাটিয়া, তিনি তাহাকে এমনি সংকটে ফেলিলেন যে কি বলিব। যুধিষ্ঠির এক শক্তি খুঁড়িয়া মারিলেন, কর্ণের বাণে তাহাও দুই খণ্ড হইয়া গেল। তারপর যুধিষ্ঠির চারিটা তোমর মারিয়া কর্ণকে কাতর করিলেন বটে, কিন্তু কর্ণ তথাপি তাহার ধ্বজ, তৃণ, রথাদি নাশপূর্বক তাহাকে বাণাঘাতে ব্যাকুল করিতে ছড়িলেন না।
উপেন্দ্র —৩৯ তখন যুধিষ্ঠির অন্য রথে চড়িয়া পলায়নের আয়োজন করিলে, কর্ণ অমনি ছুটিয়া গিয়া, তাহার কাঁধে হাত দিলেন।
এমন সময় শল্য বলিলেন, “কর কি সূতপুত্র! উহাকে ধরিলেই উনি তোমাকে ভস্ম করিয়া ফেলিবেন।”
যাহা হউক, কুন্তীর কথা কর্ণের মনে ছিল; তাই তিনি যুধিষ্ঠিরের আর কোনো অনিষ্ট করিলেন না, কেবল কিছু গালি দিয়াই তাহাকে ছাড়িয়া দিলেন। যুধিষ্ঠিরকে হারিতে দেখিয়া, কৌরবেরা তাহার সৈন্য মারিয়া শেষ করিতে লাগিল, আর ভীম, সাত্যকি প্রভৃতি বীরগণের হাতে তাহার শাস্তিও পাইল ভালো মতোই। দুর্যোধন চিৎকারপূর্বক তাহাদিগকে বলিতে লাগিলেন, “তোমরা পলায়ন করিও না, পলায়ন করিও না।” কিন্তু তাহার কথা কে শুনে।
ইহা দেখিয়া কর্ণ শল্যকে বলিলেন, “শীঘ্র ভীমের নিকট রথ লইয়া চল।” ভীম তখন কর্ণের সহিত যুদ্ধ করিবার জন্য সিংহনাদপূর্বক সেই দিকেই আসিতেছিলেন। তাহা দেখিয়া শল্য কর্ণকে বলিলেন, “ঐ দেখ ভীম আসিতেছে। আজ সে তাহার বহুদিনের রাগ তোমার উপর ঝাড়িবে!”
তারপর ভীমের আর কর্ণের ঘোরতর যুদ্ধ হইল। যুদ্ধ করিতে করিতে ভীম কর্ণকে এমনি ভয়ঙ্ককর বাণ ছুঁড়িয়া মারিলেন যে, তাহা পর্বতে লাগিলে পর্বতও ফাটিয়া যাইত। সে বাণ খাইয়া আর কর্ণকে যুদ্ধ করিতে হইল না। তিনি তখনি চিৎ হইয়া রথের ভিতরে পড়িয়া অজ্ঞান হওয়ায় শল্য তাকে সেখান হইতে লইয়া গিয়া তাহার প্রাণরক্ষা করিলেন।
কর্ণের পরাভব দেখিয়া দুর্যোধন তাহার ভাইদিগকে যুদ্ধে পাঠাইলেন। তারপর সে বেচারাদের যে দুর্দশা। যুদ্ধ ভালো করিয়া আরম্ভ হইতে না হইতেই তাহাদের ছয়জন মরিয়া গেল। আর সকলে তখন ভাবিল, বুঝি যম আসিয়াছে। কাজেই তাহারা ঊধর্বশ্বাসে পলায়ন করিল।
তখন আবার কর্ণ আসিয়া ভীমকে আক্রমণ করাতে, ভীম এক বিশিকের ঘায় তাহাকে অস্থির করিয়া দিলেন। কর্ণ তথাপি তাহাতে না চটিয়া ভীমের ধনুক আর রথ চূর্ণ করিলেন। তাহাতে ভীম মহারোষে গদা লইয়া এমনি যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন যে, কৌরবদিগের সাতশত হতি দেখিতে দেখিতে ঘণ্ট হইয়া গেল। তখন আর কৌরবদের পলায়ন ভিন্ন কথা নাই।
এদিকে কর্ণ যুধিষ্ঠিরকে সামনে পাইয়া, তাহাকে এমনি তাড়া করিয়াছে যে, তিনি পলাইবার পথ পান না। তাহাতে ভীম ছুটিয়া আসিয়া আবার কর্ণকে আক্রমণ করিলেন। ততক্ষণে কৃপ অশ্বত্থামা, কৃতবর্মা প্রভৃতি বীরগণও সেখানে উপস্থিত হইলে অনেকক্ষণ সাংঘাতিক যুদ্ধ চলিল!
অর্জুন এই সময়ে সংশপ্তক, নারায়ণী সৈন্য প্রভৃতির সহিত ঘোরতর যুদ্ধে ব্যস্ত। উহাদের মধ্যে সুশর্মা অর্জুনের সহিত ভয়ানক যুদ্ধ করেন, এমনকি, একবার তাহাকে অজ্ঞান করিতেও ছাড়েন নাই। অর্জুন ঐন্দ্রান্ত্র মারিয়া তাহাদের সকলকেই জব্দ করিয়া দিলেন।
অশ্বথামা আর যুধিষ্ঠিরে অনেকক্ষণ খুব যুদ্ধ হইয়াছিল। এই যুদ্ধে সাত্যকি মাঝে মাঝে যুধিষ্ঠিরের সাহায্য করিয়াছিলেন। কিন্তু অশ্বত্থামার বাণে যুধিষ্ঠির ক্রমে এমনই আচ্ছন্ন হইয়া পড়িলেন যে, তখন আর তাহয় সেখান হইতে প্রস্থান করা ভিন্ন উপায় রহিল না।
অশ্বখামা সেদিন অর্জুনের সঙ্গেও কম যুদ্ধ করেন নাই। এমনকি, তাহার তেজে অর্জুনকে কাতর হইতে হয়। তখন কৃষ্ণ আশ্চর্য হইয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করেন, “আজ কেন তোমার তেজ কমিয়া গেল? গাণ্ডীব কি তোমার হাতে নাই? না কি হাতে লাগিয়াছে?
যাহা হউক, এরূপভাবে অনেকক্ষণ যায় নাই। শেষে অশ্বত্থামাকে নিতান্তই নাকাল হইয়া সেখান হইতে চলিয়া যাইতে হয়।
ইহার পরে অশ্বত্থামা ধৃষ্টদ্যুম্নকে আক্রমণ করেন। ধৃষ্টদ্যুম্নের ধনুক, রথ, ঘোড়া, সারথি প্রভৃতি মুহূর্তের মধ্যে চূর্ণ হইয়া গেল। তারপর তাহাকে খালি হাতে পাইয়া, অশ্বত্থামা বাণে বাণে তাহাকে ক্ষত-বিক্ষত করিলেন। কিন্তু তথাপি তিনি তাহাকে বধ করিতে পারিলেন না। তখন তিনি ছুটিয়া তাহাকে ধরিতে আসিলে, কৃষ্ণ অর্জুনকে বলিলেন, “ঐ দেখ, ধৃষ্টদ্যুম্নের কি দুর্দশা!” তখন অর্জুন অশ্বত্থামাকে আক্রমণ করিয়া ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রাণ রক্ষা করিলেন।
এই সময়ে কর্ণ প্রভৃতি বীরেরা, যুধিষ্ঠিরকে ধরিবার চেষ্টায়, তাহাকে আক্রমণ করেন। কর্ণের বাণে নিতান্ত ক্লেশ পাইয়াও যুধিষ্ঠির অনেকক্ষণ এমনি তেজের সহিত যুদ্ধ করেন যে, তাহাতে কৌরবদলে হাহাকার উপস্থিত হয়। কিন্তু শেষকালে কর্ণের বাণ একেবারেই অসহ্য হইয়া উঠাতে, তিনি সারথিকে বলিলেন, “শীঘ্র এখান হইতে রথ লইয়া চল।”
তাহাতে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা “ধর! ধর!” বলিয়া তাহার পিছু পিছু তাড়া করিল। কিন্তু পাণ্ডব সৈন্যেরা ছুটিয়া আসিয়া তাহাদিগকে এমনি শিক্ষা দিল যে, আর তাহারা বেয়াদবি করিতে সাহস পাইল না।
এদিকে রাজা যুধিষ্ঠির, বাণাঘাতে নিতান্ত কাতর হইয়া, নকুল ও সহদেবের সঙ্গে ধীরে ধীরে শিবিরে চলিয়াছেন, ইতিমধ্যে আবার কর্ণ আসিয়া তাহার গায়ে বাণ মারিতে আরম্ভ করিলেন। তাহারা তিনজনে মিলিয়াও কর্ণকে কিছুতেই বারণ করিতে পারিলেন না। কর্ণের বাণে যুধিষ্ঠিবের ঘোড়া আর পাগড়ি, নকুলের ঘোড়া, রাশ আর ধনুক, দেখিতে দেখিতে কাটিয়া গেল। সর্বনাশের আর অধিক বাকি নাই, এমন সময় শল্য কর্ণকে বলিলেন, যুধিষ্ঠিরকে লইয়া ব্যস্ত হইয়াছ, অর্জুনের সহিত কখন যুদ্ধ করিবে? ইহাকে মারিয়া ফল কি? আগে অর্জুনকে মার। আর ঐ দেখ, দুর্যোধন ভীমের হাতে পড়িয়াছে, ইহাদিগকে ছাড়িয়া আগে তাহাকে বাঁচাও!”
এ কথায় কর্ণ তাড়াতাড়ি দুর্যোধনকে সাহায্য করিতে গেলেন, যুধিষ্ঠিরও রক্ষা পাইলেন; আঘাতের যাতনায় তিনি এতই কাতর হইয়াছিলেন যে, শিবিরে আসিয়াই তাহাকে শয়ন করিতে হইল।
এদিকে আবার অশ্বত্থামা আর অর্জুনের যুদ্ধ আরম্ভ হইয়াছে। এবারেও অশ্বত্থামার তেজের কোনো অভাব নেই কিন্তু তাহার সারথি হত আর ঘোড়া ক্ষিপ্ত হওয়ায় তিনি একটু বিপদে পড়িয়াছেন। ঘোড়াগুলি অর্জুনের বাণে অস্থির হইয়া, রথ রথী সকল সুদ্ধ রণস্থল হইতে ছুট দিল। তারপর পাণ্ডব যোদ্ধাগণের তাড়া খাইয়া, কৌরবদিগের সৈন্যগুলিও পলায়ন করিতে পারিলে বাঁচে।
তখন দুর্যোধন কর্ণকে বিনয় করিয়া বলিলেন, “ঐ দেখ, তুমি থাকিতেই সৈন্যগুলি পলায়ন করিতেছে! আর তাহারা তোমাকেই ডাকিতেছে।”
এ কথায় কর্ণ তাহার বিজয় নামক বিশ্বকর্মানির্মিত সেই আশ্চর্য পুরাতন ধনুকে ভার্গব অস্ত্র জুড়িয়া নিক্ষেপ করিলে আর পাণ্ডব সৈন্যদের দুর্দশার অবধি রহিল না। তখন তাহারা দাবানলভীত জন্তুর ন্যায় চ্যাঁচাইতে লাগিল। সেই চিৎকার শুনিয়া অর্জুন কৃষ্ণকে বলিলেন, “ঐ দেখুন, ভার্গবাস্ত্রে সৈনাগণের কি দুর্দশা হইতেছে। শীঘ্র কর্ণের নিকট রথ লইয়া চলুন।”
কিন্তু কৃষ্ণ ভাবিলেন যে, কর্ণ আরো খানিক যুদ্ধ করিয়া ক্লান্ত হইলে, অর্জুন সহজেই তাহাকে বধ করিতে পারিবেন, কাজেই তিনি কর্ণের দিকে না গিয়া অর্জুনকে বলিলেন, “মহারাজ যুধিষ্ঠির কর্ণের বাণে বড়ই কাতর হইয়াছে। আগে তাহাকে শান্ত করিয়া, তারপর কর্ণকে মারা যাইবে।”
তখন তাহারা তাড়াতাড়ি শিবিরের দিকে আসিতেছেন, এমন সময় অশ্বত্থামা আসিয়া মহারোষে অর্জুনকে আক্রমণ করিলেন। যাহা হউক, অশ্বত্থামাকে পরাজয় করিতে অনেক সময় লাগিল না। তারপর ভীমের হাতে কৌরবদিগের নিবারণের ভার দিয়া তাহারা যুধিষ্ঠিরকে দেখিতে গেলেন।
সেখানে অনেক কথাবার্তার পর তথা হইতে চলিয়া আসিবার সময় অর্জুন এই প্রতিজ্ঞা করলেন, “আজ হয় আমি কর্ণকে মারিব, না হয় কর্ণ আমাকে মারিবে।”
এদিকে ভীম সেই অবধি আর এক মুহুর্তের জন্যও যুদ্ধে ক্ষান্ত হয় নাই। আজকার যুদ্ধে তাহার বড়ই আনন্দ বোধ হইতেছে। তিনি সারথি বিশোককে ডাকিয়া বলিলেন, “বিশোক, আমার বড়ই উৎসাহ হইতেছে, এখন আর কোন রথটা স্বপক্ষের কোনটা বিপক্ষের তাহা বুঝিতে পারিতেছিনা। একটু সতর্ক থাকিও, যেন শক্র বোধে মিত্রকে মারিয়া না বসি। আজ প্রাণ ভরিয়া শত্রু মারিব। দেখ তো, অস্ত্রশস্ত্র কি পরিমাণ আছে।”
বিশোক বলিল, “এখনো দশ হাজার শর, দশ হাজার ক্ষুর, দশ হাজার ভল্প, দু হাজার নারাচ, তিন হাজার প্রদর, আর অসংখ্য গদা, অসি, মুদগর, শক্তি আর তোমর রহিয়াছে। আপনি নিশ্চিন্তে যুদ্ধ করুন, অস্ত্র ফুরাইবার কোনো ভয় নাই।”
এই সময়ে অর্জুন কৌরব সৈন্য ছারখার করিয়া, অতি ভয়ংকর যুদ্ধ করিতেছিলেন। সেই যুদ্ধের ঘোরতর শব্দ ভীমের নিকট আসিয়া পৌছিলে, তিনিও যারপরনাই উৎসাহ পাইয়া সিংহাদ করিতে করিতে কৌরবদিগকে একেবারে পিষিয়া দিতে লাগিলেন। তখন আর কেহই তাহার সম্মুখে দাঁড়াইতে পারিল না।
অন্যদিকে কর্ণও পাণ্ডব সৈন্যদিগকে মারিয়া আর কিছু রাখেন নাই। তাহারা তখন ভয়ে এমনি হইয়াছে যে, আর যুদ্ধ করিবার জন্য তাদের হাত উঠে না।
বাস্তবিক তখন দুই পক্ষের কত লোক যে মরিয়াছিল, তাহার সংখ্যা করে কাহার সাধ্য? দুই পক্ষের প্রায় প্রত্যেক বড় বড় বীরই সে সময়ে হাজার হাজার সৈন্য বিনাশ করিয়াছিলেন।
ইহার মধ্যে একবার দুঃশাসন ভীমকে আক্রমণ করেন। ইহাতে প্রথমেই ভীমের বাণে তাহার ধনুক আর ধবজ কাটা যায়, নিজের কপালেও একটি বাণ বিধে, তারপর এক বাণ আসিয়া তাহার মাথা কাটিয়া ফেলে। তখন দুঃশাসন তাড়াতাড়ি অন্য ধনুক লইয়া ভীমকে বারোটি বাণ মারেন, এবং নিজ হাতে ঘোড়ার রাশ ধরিয়া এক ভীষণ বাণে তাহাকে অজ্ঞান করিতেও ছাড়েন নাই। ইহার উপর আবার তিনি এক বাণে ভীমের ধনুক কাটিয়া তাহার সারথিকে নয়টি, এবং তাহাকে বহুতর বাণ মারাতে, ভীম রাগের ভরে তাহাকে একটা শক্তি ছুঁড়িয়া মারেন।
দুঃশাসন আকর্ণ (কান অবধি, অর্থাৎ যথাসাধ্য) ধনুক টানিয়া দশ বাণে সেই জ্বলন্ত উল্কাবৎ শক্তি খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। তারপর তিনি বাণে বাণে ভীমকে জর্জরিত করিতে থাকিলে ভীম তাহাতে বিষম ক্রোধভরে বলিলেন, “তুমি তো আমাকে খুবই মারিলে, এখন আমার এই গদাটিকে সামলাও দেখি!” বলিতে বলিতে তিনি এক বিশাল গদা দুঃশাসনকে ছুঁড়িয়া মারিলেন। দুঃশাসনও ভীমকে একটা শক্তি মারিলেন বটে, কিন্তু তাহা অর্ধপথে গদায় ঠেকিয়া খণ্ড খণ্ড হইয়া গেল। তারপর সেই দারুণ গদা, দুঃশাসনের রথ আর সারথিকে চূর্ণ করিয়া, তাহার মাথায় পড়িলে, তিনি তাহার আঘাতে দশ ধনু দূরে বিক্ষিপ্ত হইলেন।
এই অবস্থায় দুঃশাসনকে যাতনায় ছটফট করিতে দেখিয়া ভীমের সেই পুরাতন প্রতিজ্ঞার কথা মনে হইল। এই দুরাত্মাই দ্রৌপদীকে সেই সভায় চুলে ধরিয়া আনিয়া অপমান করিয়াছিল; তখন ভীম বলিয়াছিলেন, আমি ইহার বুক চিরিয়া রক্ত খাইব।
সেই প্রতিজ্ঞার কথা মনে হওয়া মাত্র ভীম কর্ণ, দুর্যোধন, কৃপ, অশ্বত্থামা প্রভৃতিকে ডাকিয়া বলিলেন, “আজ আমি এই পাপাত্মা দুঃশাসনকে বধ করিব, তোমাদের সাধ্য থাকে তো ইহাকে রক্ষা কর।” তারপর তিনি ঝড়ের ন্যায় আসিয়া দুঃশাসনকে পদতলে পেষণপূর্বক তাহার বুকে তলোয়ার বসাইয়া দিলেন। সেই তলোয়ারের ঘায়ে দুঃশাসনের গরম রক্ত সবেগে বাহির হওয়ামাত্র, ভীম মহানন্দে তাহা পান করিয়া বলিলেন, “আহা! কি মিষ্টি! দধি দুগ্ধ বা ঘৃত পানেও আমি এত সুখী হই না।”
ভীমকে দুঃশাসনের রক্ত খাইতে দেখিয়া, সৈন্যেরা “বাবা রে! রাক্ষস রে!” বলিয়া উদ্ধশ্বাসে পলাইতে লাগিল। এদিকে ভীম তাহার ভীষণ প্রতিজ্ঞা পালনপূর্বক, দুঃশাসনের মাথা কাটিয়া বলিলেন, “অতঃপর দুর্যোধন পশুকে মারিয়া, পদাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ করিতে হইবে।”
এই সময়ে দুর্যোধনের দশ ভাই, রোষভরে ভীমকে আক্রমণ করাতে ভীম দশ ভল্পে সেই দশজনকে সংহার করিলেন। এ সকল কাণ্ড দেখিয়া, আর ভীমের তখনকার সিংহনাদ শুনিয়া, অন্যরা তো পলায়ন করিতেই পারে, নিজে কর্ণই ভয়ে আড়ষ্ট, তাহার মুখে কথা সরে না! তখন শল্য তাহাকে বলিলেন, “এখন ওরূপ হইলে চলিবে না, তোমার কাজ কর।”
কিন্তু কর্ণের পুত্র বৃষসেন এই সময়ে খুব যুদ্ধ করিয়াছিলেন। তাহার বাণে নকুলের ধনুক, রথ, খড়্গ প্রভৃতি কাটা গিয়া অল্পক্ষণের ভিতরেই নিতান্ত সংকট উপস্থিত হইল। ভীম, অর্জুন, কৃষ্ণ প্রভৃতিও তাহার বাণে অক্ষত রহিলেন না। এইরূপে অর্জুনের সহিত তাহার যুদ্ধ বাধিয়া যাওয়াতে, অর্জন কর্ণকে ডাকিয়া বলিলেন, “তোমরা সকলে মিলিয়া অভিমন্যুকে মারিয়াছিলে। আমি তোমাদের সম্মুখেই বৃষসেনকে মারিতেছি, ক্ষমতা থাকে তো রক্ষা কর।”
তারপর অর্জুন হাসিতে হাসিতে দশ বাণে বৃষসেনকে ক্ষত-বিক্ষত করিয়া আর চারিটি সুরে তাহার ধনুক, দুটি হাত আর মাথা কাটিয়া ফেলিলেন ইহাতে কর্ণের প্রাণে কিরূপ লাগিয়াছিল, বুঝিতেই পার। ইহার পরেও কিন্তু আর তিনি চুপ করিয়া থাকিতে পারেন? কাজেই তখন অর্জুনের সহিত তাহার যুদ্ধ আরম্ভ হইল।
এ সময়ে অশ্বত্থামা দুর্যোধনের দুটি হাত ধরিয়া বলিলেন, “মহারাজ, আর কেন? এখন ক্ষান্ত হও। আর পাণ্ডবদিগের সহিত যুদ্ধের প্রয়োজন নাই। যুদ্ধের মুখে ছাই। আমাদের সকলেই মরিয়া গিয়াছে, কয়েকটি মাত্র বাঁচিয়া আছি। এখন যুদ্ধ হইতে তুমি ক্ষান্ত হও, নহিলে নিশ্চয় মারা যাইবে।” কিন্তু দুর্যোধন সেই উপকারী বন্ধুর কথায় কান দিলেন না। তিনি বলিলেন, “অর্জুন বড়ই ক্লান্ত হইয়াছে কর্ণ এখনি তাহাকে বধ করিবেন।”
এদিকে কর্ণ আর অর্জুনের যুদ্ধ আরম্ভ হইয়াছে। যোদ্ধারা সিংহনাদ করিয়া আর চাদর উড়াইয়া তাহাদিগকে উৎসাহ দিতেছে। এমন যুদ্ধ কি সচরাচর হয়? তাই আজ দেবতারা অবধি, আকাশ পরিপূর্ণ করিয়া, তামাশা দেখিতে আসিয়াছে।
বাণ বাণ! কেবলই বাণের পর বাণ। অর্জুন মারেন, কর্ণ কাটেন; কর্ণ মারেন, অর্জুন কাটেন। অর্জুনের এক বাণে পৃথিবী, আকাশ সূর্য অবধি জ্বলিয়া উঠিল। যোদ্ধাদের কাপড়ে আগুন! বেচারারা বুঝি পলাইবার পূর্বেই মারা যায়। উহার নাম আগ্নেয়-অস্ত্র। উঃ! কি ঘোরতর হড়-হড় ধকধক শব্দ! গেল বুঝি সব!
ঐ দেখ, কর্ণ বরুণাস্ত্র ছুঁড়িয়াছে। ঐ কালো কালো মেঘে আকাশ ছইয়া গেল! কি ঘোর অন্ধকার! কি ভয়ানক বৃষ্টি! সৃষ্টি বুঝি তল হয়!
অমনি দেখ, কি বিষম ঝড় বহিল! মেঘ বৃষ্টি উড়াইয়া নিল;সৃষ্টি বাঁচিল! অর্জুন বায়ব্য অস্ত্র মারিয়াছে, তাহাতেই এত ঝড়!
আর একটা অস্ত্র আরো ভীষণ। ইহা অর্জুন ইন্দ্রের নিকট পাইয়াছিলেন। অস্ত্রের অদ্ভুত গুণে গাণ্ডীব হইতে কত সুর, কত নালীক, কত অঞ্জলীক, কত নারাচ, কত অর্ধচন্দ্রই বাহির হইতেছে। এবারে বুঝি আর কর্ণের রক্ষা নাই।
কিন্তু কর্ণ মরিলেন না। তিনি ভার্গবাস্ত্রে অর্জুনের সকল অস্ত্র দূর করিলেন। আর লোকও মারিলেন কতই। কর্ণের কি অসীম তেজ! কৃষ্ণ আর অর্জুনকে তিনি কি ব্যস্তই করিলেন! তখন ভীম ক্রোধভরে বলিলেন, “ও কি, অর্জুন! মন দিয়া যুদ্ধ কর!”
কৃষ্ণ বলিলেন, “অর্জুন! তোমার উৎসাহ দেখিতেছি না কেন?”
তাহাতে অর্জুন ব্রহ্মাস্ত্র মারিলে কর্ণ তাহাও কাটিতে ছাড়িলেন না। কিন্তু ইহার পর যে অর্জুন আর একটা ব্রহ্মাস্ত্র মারিলেন, সে বড়ই ভয়ানক! কত যোদ্ধাই তাহাতে মরিল। কিন্তু তথাপি বাণক্ষেপে ত্রুটি নাই বৃষ্টিধারার মতো তাহার বাণ পড়িতেছে।
তখন অর্জুনের আঠারোটি বাণ ছুটিয়া চলিল। তাহার তিনটি বিধিল কর্ণের গায়ে, একটিতে কাটিল তাহার ধবজ, আর চারটি খাইলেন শল্য। বাকি দশটিতে রাজপুত্র সভাপতির মাথাটি কাটা গেল। বাণের আর অন্তই নাই:হাতি, রথী, পদাতি সবই বুঝি কাটিয়া শেষ হয়। এবারে কর্ণ কাবু হইবেন। কিন্তু হায়! অর্জুনের ধনুকের গুণ যে ছিড়িয়া গেল, এখন উপায়? কর্ণ সুযোগ পাইয়া কত বাণই মারিতেছে। কৃষ্ণকে ষাট, অর্জুনকে আট, ভীমকেও অনেক, সৈন্যগুলিকে তো অসংখ্য। সর্বনাশ হইল বুঝি; দেখ কৌরবদের কত আনন্দ।
যাহা হউক, ঐ অর্জুনের ধনুকে আবার গুণ চড়িল। আর কর্ণের বাণের সে তেজ নাই, এখন অর্জুনের বাণেই আকাশ অন্ধকার। ঐ কর্ণের গায়ে উনিশ বাণ পড়িল, শল্যর গায়ে দশটি বিধিল। কর্ণ রক্তে লাল হইয়া গিয়াছেন।
কিন্তু তথাপি তিনি অর্জুনকে তিন বাণ, আর কৃষ্ণকে পাঁচ বাণ মারিতে ছাড়েন নাই। ঐ পাঁচটি বাণ পাঁচটা মহাসর্প। কৃষ্ণকে বিঁধিয়া উহারা আবার কর্ণের নিকট ফিরিয়া যাইতে যাইতে, মধ্যপথে অর্জুনের ভল্লে খণ্ড খণ্ড হইল। অর্জুনের আর দশ বাণে কর্ণের কি দশা হইয়াছে দেখ। অর্জুনের কি অতুল বিক্রম, কি ভীষণ বাণ বৃষ্টি। আকাশ আঁধার হইল; কর্ণের রথ কাটিয়া গেল। তাহার সঙ্গের একটি রক্ষকও বাঁচিয়া নাই; অপর কৌরবেরা, অর্জুনের ভয়ে, তাহাকে ফেলিয়া পলায়ন করিতেছে। কৌরবদের মধ্যে কেবল কর্ণই ভয় পান নাই; তিনি অর্জুনের সামনেই বাণবৃষ্টি করিতেছেন।
এমন সময় কোথা হইতে ঐ সাপটা আসিয়া কর্ণের তৃণের ভিতরে ঢুকিল; এ সেই অশ্বসেন, খাণ্ডব দাহের সময় সে অনেক কষ্টে পাতালে ঢুকিয়া প্রাণ বাঁচাইয়াছিল। সেই রাগে, সে আজ কর্ণের বাণের ভিতরে ঢুকিয়া অর্জুনকে বধ করিতে আসিয়াছে, কর্ণ ইহার কিছুই জানেন না। অশ্বসেন যে বাণের ভিতরে ঢুকিয়াছে, তাহারো চেহারা সাপের মতো। কর্ণ অর্জুনকে মারিবার জন্য এই বাণ বহুকাল যাবৎ পরম যত্নে চন্দন চূর্ণের ভিতরে রাখিয়াছে।
এখন অর্জুনকে কিছুতেই আঁটিতে না পারিয়া, কর্ণ সেই দারুণ বাণ ধনুকে জুড়িয়া বসিয়াছে। তাহার সঙ্গে সঙ্গেই উল্কাবৃষ্টি আরম্ভ হইয়াছে, আকাশে আগুন ধরিয়া গিয়াছে। এ বাণ লাগিলে আর অর্জুনের রক্ষা নাই। ইহাকে আটকাইবার ক্ষমতাও কিছুই নাই। তাই বাণ ছুঁড়িবার সময় কর্ণ বলিলেন, “অর্জুন! এইবারে তুমি গেলে!” উঃ! কি ভয়ংকর বাণ! সর্বনাশ হয় বুঝি।
এমন সময় কৃষ্ণ হঠাৎ পায়ে চাপিয়া অর্জুনের রথখানিকে মাটির ভিতরে বসাইয়া দিলেন; ঘোড়াগুলি হাঁটু গাড়িয়া রহিল। আর কর্ণের বাণ অর্জুনের গায়ে পড়িতে পাইল না, তাহার সেই ইন্দ্রদত্ত আশ্চর্য মুকুটখানি গুড়া করিয়া দিল, অর্জুন বাঁচিয়া গিয়া সাদা পাগড়ি বাধিয়া লইলেন।
সাপের বাছা ঠকিয়া গিয়া বড়ই চটিল। সে কর্ণকে গিয়া বলিল, “কর্ণ, তুমি আমাকে না দেখিয়াই বাণ মারিয়াছিলে, তাই অর্জুনের মাথা কাটিতে পারি নাই এবারে আমাকে দেখিয়া বাণ মার, নিশ্চয় উহাকে বধ করিব।”
কিন্তু কর্ণ বড় অহংকারী লোক, তিনি অন্যের সাহায্য নিতে প্রস্তুত নহে। কাজেই দুষ্ট সাপ নিরাশ মনে ফিরিয়া চলিল। কৃষ্ণকে ফাঁকি দিয়া সে কোথায় যাইবে? তিনি অমনি অর্জুনকে তাহার কথা বলিয়া দিলেন, আর দেখিতে দেখিতে দুষ্ট সাপ খণ্ড খণ্ড হইয়া গেল। ততক্ষণে কৃষ্ণও রথখানিকে তুলিয়া লইয়াছে, আর কি ভয়ানক যুদ্ধই চলিয়াছে! কৃষ্ণকে বারোটি আর অজুনকে নব্বুইটি বাণ মারিয়া, কর্ণের আনন্দের সীমা নাই। অর্জুন তাহা সহিবেন কেন? তিনি কর্ণকে তেমনি শিক্ষা দিলেন। ঐ কর্ণের মুকুট আর কুণ্ডল উড়িয়া গেল! ঐ তাহার বর্ম ছিন্নভিন্ন হইল! আহা! এখন না জানি ঐ দারুণ বাণগুলি তাহার গায়ে কিরূপ বিঁধিতেছে। রক্তে শরীর ভাসিয়া গেল। ঐ তাহার বুকে ভীষণ বাণ ফুটিল, আর তাহার জ্ঞান নাই। তখন আর অর্জুনের উদার হৃদয় তাহাকে বাণ মারিতে চাহিল না; সেজন্য কৃষ্ণ তাহাঁকে তিরস্কার করিলেন।
কর্ণের জ্ঞান হইল, আবার যুদ্ধ চলিল। কিন্তু এবারে বুঝি আর তাহার রক্ষা নাই। ঐ তাহার রথের চাকা বসিয়া গেল! আহা! এই বিপদের সময় আবার বেচারা তাঁহার সেই পরশুরামের দেওয়া বড়-বড় অস্ত্রের কথা সব ভুলিয়া গিয়াছে।
নিজেরই পাপের ফল! পরশুরামকে ফাঁকি দিয়া তিনি তাহার নিকট অস্ত্র শিখিতে গেলেন; বলিলেন, “আমি ব্রাহ্মণ।” পরশুরাম যথার্থই ব্রাহ্মণ বোধে তাহাকে অশেষরূপ অস্ত্রশস্ত্র দিয়া বিধিমতে যুদ্ধবিদ্যা শিখাইলেন। তারপর একদিন দেখেন কি যে এ-ব্রাহ্মণ নয়, ক্ষত্রিয়! কাজেই তখন তিনি শাপ দিলেন, “মৃত্যুকালে তুই এ সকল ভুলিয়া যাইবি৷”
তারপর আর একবার দৈবাৎ এক ব্রাহ্মণের বাছুর মারিয়া ফেলাতে সেই ব্রাহ্মণ তাহাকে শাপ দেন, “যুদ্ধের কালে যখন তোর বড়ই আতঙ্ক হইবে, ঠিক সেই সময় তোর রথের চাকা বসিয়া যাইবে৷”
সেই সকল পুরাতন পাপের শাস্তি আজ আসিয়া একসঙ্গে উপস্থিত হইল। আহা! ঐ দেখ, তিনি হাত ছুঁড়িয়া আক্ষেপ করিতেছেন। কিন্তু বীরের তেজ না কি বিপদেও লোপ পায় না, তাই এখনো তিনি অর্জুনের সহিত ঘোর যুদ্ধে মত্ত! ইহার মধ্যেও কৃষ্ণের হাতে তিন, আর অর্জুনকে সাত বাণ মারিতে ছাড়েন নাই। তাহাতে অর্জুনের বাণ খাইয়া মন্ত্রপূর্বক ব্রহ্মাস্ত্র ছাড়িয়াছেন। তাহাতে অর্জুন ঐন্দ্রাস্ত্র মারিলে, তাহাও আটকাইয়াছেন। তারপর আবার অর্জুনের ব্রহ্মাস্ত্র প্রভৃতি অশেষ বাণে জর্জরিত হইয়াও না জানি কিরূপে কর্ণ তাঁহার ধনুকের গুণ কাটিলেন: অর্জুন তৎক্ষণাৎ নূতন গুণ পরাইয়াও তাঁহাকে আঁটিতে না পারায় কৃষ্ণ তাঁহাকে আরো বড়-বড় অস্ত্র মারিতে বলিতেছে।
হঠাৎ কর্ণের রথের চাকা আরো অনেক বসিয়া গেল! বেচারা, তাহা উঠাইবার জন্য, প্রাণপণে কি টানাটানিই করিতেছেন! পৃথিবী তাহাতে চারি আঙ্গুল উঁচু হইয়া গেল, কিন্তু চাকা যে কিছুতেই উঠিতেছে না। এইবারে কর্ণের চোখে জল আসিল; তিনি অর্জুনকে বলিলেন, “অর্জুন! তুমি বড়ই ধার্মিক, আর মহাশয় লোক একটু অপেক্ষা কর, আমার রথের চাকাটা তুলিয়া লই।”
তাহার উত্তরে কৃষ্ণ বলিলেন, “সূতপুত্র! বড় ভাগ্য যে এখন তোমার ধর্মের কথা মনে হইয়াছে! কিন্তু যখন ভীমকে বিষ খাওয়াইবার পরামর্শ দিয়াছিলে, দ্রৌপদীকে সভায় আনিয়া অপমান করিয়াছিলে, ছলপূর্বক যুধিষ্ঠিরকে পাশায় হারাইয়াছিলে, জতুগৃহে পাণ্ডবদিগকে পোড়াইতে গিয়াছিলে, আর সকলে মিলিয়া বালক অভিমন্যুকে বধ করিয়াছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল?
এ কথার আর কি উত্তর দিবেন? তাই লজ্জায় কর্ণের মাথা হেঁট হইল। বিষমরোষে ব্রাহ্ম, আগ্নেয়, ব্যায়ব্যাদি অস্ত্র বর্ষণপূর্বক তিনি আবার যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন, এবং অচিরে ভীষণ একটা অস্ত্রে অর্জুনকে অজ্ঞান করিয়া ব্যস্তভাবে রথ হইতে নামিলেন, যদি এই অবসরে তাহার চাকা আবার উঠানো যায়। কিন্তু হায়! চাকা কিছুতেই উঠিল না।
কৃষ্ণ অর্জুনকে বলিলেন, “এই বেলা কর্ণকে মার। উহাকে রথে উঠিতে দিও না।” সে কথায় অর্জুন অঞ্জলীক নামক ভীষণ অস্ত্র গাণ্ডীবে জুড়িবামাত্র ভয়ে সকলের প্রাণ উড়িয়া গেল; আর দেখিতে দেখিতে সেই মহাস্ত্র ঘোর গর্জনে প্রচণ্ড তেজে ছুটিয়া গিয়া কর্ণের মাথা কাটিয়া ফেলিল। তখন সকলে অবাক হইয়া দেখিলেন, কর্ণের দেহ হইতে অপরূপ দীপ্তি নির্গত হইয়া সূর্যের সহিত মিলাইয়া যাইতেছে।
আজ আর পাণ্ডবদের আনন্দের সীমা নাই। ভীম সিংহনাদপূর্বক নৃত্য করিতেছে; আর সকলে শঙ্খ বাজাইয়া জয় ঘোষণায় মত্ত। বেচারা কৌরবগণ ভয়ে বিহ্বল হইয়া, পলায়নের পথও পাইতেছে না। এমন সময় সন্ধ্যা আসিয়া পড়িল দুর্যোধন, ‘হা কর্ণ! হা কর্ণ!’ বলিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে শিবিরে চলিলেন।
আজ সঞ্জয়ের মুখে এই সংবাদ শুনিবামাত্রই, মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র অজ্ঞান হইয়া পড়িলেন। ভীষ্ম, দ্রোণের মৃত্যু সংবাদেও তিনি এত ক্লেশ পান নাই।