উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/ছেলেদের মহাভারত/মহাপ্রস্থানিকপর্ব

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

মহাপ্রস্থানিকপর্ব

দু বংশের বিনাশ ও কৃষ্ণের দেহত্যাগের কথা শুনিয়া য

আর যুধিষ্ঠির পৃথিবীতে থাকিতে চাহিলেন না৷ সুতরাং তিনি এখন মহাপ্রস্থানই (অর্থাৎ প্রাণত্যাগের উদ্দেশ্যে হিমালয়ে প্রস্থান) কর্তব্য বুঝিয়া অর্জুকে বলিলেন, “ভাই! আমি ভাবিয়াছি শীঘ্রই দেহত্যাগ করিব৷ এখন তোমরা কি করিবে, স্থির কর৷”

 অর্জুন বলিলেন, “আমিও তাহাই স্থির করিয়াছি৷”

 এ কথা শুনিয়া ভীম,নকুল, সহদেব এবং দ্রৌপদী বলিলেন, “আমরাও তাই করিব৷”

 এইরূপে সকলের পরামর্শ স্থির হইলে, পরীক্ষিৎকে হস্তিনার রাজা করিয়া যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব এবং দ্রৌপদী মহাপ্রস্থানে উদ্যত হইলেন৷ প্রজাগণ কাতরস্বরে তাহাদিগকে বারণ করিল; কিন্তু তাঁহারা আর মর্তবাসে সম্মত হইলেন না৷

 এইরূপ সময়ের করণীয় অনুষ্ঠানাদি শেষ হইলে, পাণ্ডবগণ এবং দ্রৌপদী মহামূল্য বস্ত্রাভরণ পরিত্যাগপূর্বক, বল্কল পরিয়া হস্তিনা নগরকে শোকসাগরে ভাসাইয়া চিরকালের জন্য তথা হইতে যাত্রা করিলেন। ঐ সময়ে একটি কুকুরও তাহাদের অনুগামী হইল। এ সময়ে পশ্চাৎ হইতে ডাকিতে নাই। নগরবাসীরা নীরবে, নতশিরে বহুদূর অবধি তাহাদের সঙ্গে চলিল কিন্তু কেহ তাহাদিগকে ফিরিতে বলিল না।

 ক্রমে সকলেই ঘরে ফিরিল, কিন্তু সেই কুকুরটি ফিরিল না।

 পাণ্ডবেরা তথা হইতে ক্রমাগত পূর্বদিকে চলিতে চলিতে, অসংখ্য গিরিনদী পার হইয়া, শেষে লোহিত সাগরের তীরে উপস্থিত হইলেন। এ পর্যন্ত গাণ্ডীব এবং অক্ষয় তূণ অর্জুনের সঙ্গেই ছিল। সেই সময়ে এক পর্বতাকার পুরুষ পাণ্ডবদিগের পথরোধ করত বলিলেন, “হে পাণ্ডবগণ! আমি অগ্নি, কৃষ্ণ তাহার চক্র পরিত্যাগ করিয়াছেন; এক্ষণে অর্জুনও গাণ্ডীব পরিত্যাগ করুন। উহাতে আর তাঁহার কোনো প্রয়োজন নাই; উহা বরুণকে ফিরাইয়া দিতে হইবে।”

 এ কথায় অর্জুন গাণ্ডীব ও অক্ষয় তূণ জলে নিক্ষেপ করায় অগ্নি চলিয়া গেলে, পাণ্ডবগণ দক্ষিণ মুখে চলিয়া শেষে লবণ সমুদ্রের তীরে উপস্থিত হইলেন। তথা হইতে সমুদ্রের তীর দিয়া দক্ষিণ-পশ্চিমে ও তারপর ক্রমাগত পশ্চিমদিকে, বহুদূর চলিয়া, আবার সমুদ্রতীর প্রাপ্ত হইলে, জলের উপরে দ্বারকার মঠাদির চূড়াসকল দেখা গেল।

 তারপর তাঁহারা ক্রমাগত উত্তরদিকে চলিয়া, অবশেষে হিমালয়ে আরোহণ করিতে লাগিলেন।

 এই সময়ে সহসা দ্রৌপদীর অঙ্গ অবশ হইয়া গেল। তিনি আর চলিতে না পারিয়া সেই স্থানেই পড়িয়া গেলেন। তাহা দেখিয়া ভীম যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ! দ্রৌপদী তো কখনো কোনো অপরাধ করেন নাই, তবে কেন ইহার পতন হইল?”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “দ্রৌপদী আমাদের অপেক্ষা অর্জুনকে অধিক ভালোবাসিতেন সেই পাপেই তাহার পতন হইয়াছে।”

 এই বলিয়া যুধিষ্ঠির ভগবানের চিন্তা করিতে করিতে পথ চলিতে লাগিলেন। মহাপ্রস্থানের যাত্রীকে ফিরিয়া তাকাইতে নাই, সুতরাং তিনি দ্রৌপদীর পানে চাহিয়া দেখিলেন না।

 কিছুকাল পরে সহদেবও অবশ হইয়া পড়িয়া গেলেন। তখন ভীম যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ! সহদেব অতি সুশীল ছিল এবং সর্বদাই আমাদের সেবা করিত। সে কি অপরাধে পতিত হইল?”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “সর্বাপেক্ষা বিদ্বান বলিয়া সহদেবের অহংকার ছিল। তাহাতেই উহার পতন হইয়াছে।”

 এই বলিয়া যুধিষ্ঠির একমনে ভগবানকে ভাবিয়া চলিতে লাগিলেন। সহদেবের দিকে ফিরিয়া চাহিলেন না।

 তারপর দ্রৌপদী ও সহদেবের শোকে অবশ হইয়া নকুল পড়িয়া গেলে ভীম পুনরায় যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ! নকুল পরম ধার্মিক ছিল; সে কিজন্য পতিত হইল?”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “নকুল ভাবিত, তাহার মতো সুন্দর লোক পৃথিবীতে নাই। তাহতে তাহার পতন হইয়াছে। চল! উহাদের দিকে আর ফিরিয়া তাকাইবার প্রয়োজন নাই।”  এই বলিয়া যুধিষ্ঠির, আর ফিরিয়া না চাহিয়া, একমনে পথ চলিতে লাগিলেন।

 কিঞ্চিৎ পরে দ্রৌপদী, সহদেব এবং নকুলের জন্য শোক করিতে করিতে অর্জুনও পড়িয়া গেলেন। তাহাতে ভীম জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ! মহাত্মা অর্জুন হাস্যচ্ছলেও কদাচ মিথ্যা কথা বলে নাই; তাহার কেন পতন হইল?”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “অর্জুন অহংকারপূর্বক বলিয়াছিল যে, সে একদিনেই সকল শত্রু সংহার করিবে, কিন্তু তাহা করিতে পারে নাই। সে অন্য বীরগণকে তুচ্ছ করিত। এইজন্যই আজ তাহাকে পড়িতে হইল।”

 এই বলিয়া যুধিষ্ঠির স্থিরচিত্তে ভীম আর সেই কুকুরকে লইয়া চলিতে লাগিলেন।

 কিছুকাল পরে ভীমেরও শরীর অবশ হইয়া গেল। তিনি ভূপতিত হইয়া উচ্চৈঃস্বরে যুধিষ্ঠিরকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ! আমি আপনার অতি প্রিয়পাত্র, আমার কি অপরাধ হইয়াছিল?”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “তুমি অন্যকে না দিয়া নিজে অপরিমিত আহার করিতে আর তোমার তুল্য বলবান কেহ নাই, বলিয়া অহংকার করিতে। ইহাই তোমার অপরাধ!”

 এই বলিয়া ভীমের দিকেও আর না চাহিয়া, যুধিষ্ঠির স্থিরচিত্তে পথ চলিতে লাগিলেন। সেই কুকুর তখনো তাহার সঙ্গে ছিল। অনন্তর যুধিষ্ঠির আর অল্প দূর গমন করিলেই ইন্দ্র উজ্জ্বল রথারোহণে তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “এই রথে উঠ, তোমাকে স্বর্গে লইয়া যাইতেছি।”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “আমার দ্রৌপদী এবং প্রিয় ভাইসকল পথে পড়িয়া আছে। তাহাদিগকে ছাড়িয়া আমার স্বর্গে যাইতে ইচ্ছা নাই।”

 তাহা শুনিয়া ইন্দ্র বলিলেন, “উহারা তো তোমার পূর্বেই স্বর্গে গিয়াছেন, উহাদের জন্য কেন দুঃখ করিতেছ? তুমি তোমার এই শরীর সমেতই স্বর্গে গিয়া তাহাদিগকে দেখিতে পাইবে।”

 তখন যুধিষ্ঠির বলিলেন, “দেবরাজ! এই কুকুর আমাকে ভালোবাসিয়া এতদূর আমার সঙ্গে আসিয়াছে, ইহাকে ছাড়িয়া আমি কেমন করিয়া স্বর্গে যাইব? সুতরাং দয়া করিয়া ইহাকেও আমার সঙ্গে আসিতে দিন।”

 ইন্দ্র বলিলেন, “আজ তুমি স্বর্গে গিয়া দেবোচিত সুখ লাভ করিবে, আজ কেন একটা কুকুরের জন্য চিন্তিত হইতেছ? ওটা থাকুক; তুমি আইস!”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “স্বর্গের সুখ লাভ করিতে হইলে যদি আমার পরম ভক্ত এই কুকুরটিকে পরিত্যাগ করিতে হয়, তবে সে সুখে আমার প্রয়োজন নাই।”

 ইন্দ্র বলিলেন, “যে কুকুরের সঙ্গে বাস করে, সে স্বর্গে যাইতে পারে না। সুতরাং শীঘ্র ওটাকে পরিত্যাগ কর!”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “ও আমাকে ভালোবাসে, সুতরাং আমি নিজের সুখের জন্য উহাকে পরিত্যাগ করিতে পারিব না।”

 ইন্দ্র বলিলেন, “তুমি দ্রৌপদীকে আর তোমার ভাইদিগকে পরিত্যাগ করিতে পারিলে, আর একটা কুকুরকে ছড়িতে পারিবে না?”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “আমি তো উহাদিগকে পরিত্যাগ করি নাই, উহাদের মৃত্যু হইয়াছে। ছেলেদের মহাভারত WS)8C) জীবিত থাকিতে আমি কখনো উহাদিগকে ছাড়িয়া যাই নাই। মৃত্যুর পর আব উহাদিগকে ছাড়া না ছাড়া আমাব হাতে ছিল না, কাজেই কি কবিব ?” তখন সেই কুকুর, হঠাৎ তাহাব পশুবেশ পরিভাগপূর্বক, সাক্ষাৎ ধর্মকাপে পরম স্নেহভবে যুধিষ্ঠিরকে বলিলেন, “বৎস, আমি তোমাকে পবীক্ষা কবিবার জন্যই কুকুরের বেশে তোমার সঙ্গে আসিয়াছিলাম। তুমি যে, তোমাব ভক্ত কুকুরটির জন্য স্বৰ্গও ছড়িতে প্রস্তুত হইয়াছ ইহাতে বেশ বুঝিলাম, তোমার মতো ধাৰ্মিক আর স্বর্গেও নাই। তুমি এই দেহেই স্বর্গে যাইতে পাইবে।” তখন সকল দেবতারা মিলিয়া, দিব্য রথে করিয়া মহানন্দে যুধিষ্ঠিরকে স্বর্গে লইয়া গেলেন৷ তিনি তথায় উপস্থিত হইবামাত্র, নারদ উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিলেন, “যুধিষ্ঠিব ভিন্ন আর কেহই সশরীরে স্বর্গে আসিতে পারেন নাই! ইনিই সকল ধার্মিকের শ্রেষ্ঠ৷”

 নারদের কথা শেষ হইলে যুধিষ্ঠির বলিলেন, “আমার ভাইয়েরা যেখানে গিযাছে, সে স্থান ভালোই হউক আর মন্দই হউক, আমিও সেখানে যাইব৷ তাহাদিগকে ছাডিযা আমি থাকিতে চাহি না৷”

 তাহা শুনিয়া ইন্দ্র বলিলেন, “মহারাজ! তুমি নিজ পুণ্যবলে এখানে আসিয়াছ, এইখানেই থাক৷ উঁহারা তোমার সমান পুণ্য সঞ্চয় করিতে পারেন নাই৷ উঁহারা কেমন কবি আসিবেন?”

 যুধিষ্ঠির তথাপি বলিলেন, “দ্রৌপদী আর আমার ভাইসকল যেখানে, আমি সেইখানেই যাইতে চাহি৷ উহাদিগকে ছাড়িয়া এখানে থাকিতে আমার কিছুতেই ইচ্ছা হইতেছে না৷”