উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/ছেলেদের মহাভারত/স্বর্গারোহণপর্ব

স্বর্গারোহণপর্ব

ধিষ্ঠির স্বর্গে গিয়া দেখিলেন যে, দুর্যোধন সেখানে পরম সুখে বসিয়া আছেন, কিন্তু ভীমার্জুন প্রভৃতি কেহই তথায় নাই৷ ইহাতে তিনি নিতান্ত আশ্চর্য এবং দুঃখিত হইলে, নাবদ তাঁহাকে বুঝাইয়া বলিলেন, “দুর্যোধন ধর্মযুদ্ধে প্রাণ দিয়াছে, আর তিনি ঘোব বিপদেও ভীত হন নাই৷ এই পুণ্যেই তাঁহাব স্বর্গলাভ হইয়াছে!”

 তখন যুধিষ্ঠিব দেবতাদিগকে বলিলেন, “হে দেবতাগণ, আমি তো এখানে কর্ণকে দেখিতে পাইতেছি না৷ যে সকল রাজা আমার জন্য যুদ্ধে প্রাণ দিয়াছিলেন, তাঁহারাই বা এখন কোথায়? তাঁহাবা কি স্বর্গে আসিতে পান নাই? তাঁহাদিগকে ছাড়িয়া আমি এ স্থানে কিরূপে থাকিব? কর্ণের জন্য আমার প্রাণে বড়ই ক্লেশ হইতেছে আমি তাঁহাকে দেখিতে চাই৷ ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব, দ্রৌপদী ইঁহাদিগকে দেখিতে আমার বড়ই ইচ্ছা হইতেছে৷ আমি সত্য কহিতেছি, তাঁহাদিগকে ছাড়িয়া আমি এখানে থাকিতে পাবিব না৷ উঁহাবা যেখানে নাই, সেখানে থাকিয়া আমার কি সুখ? উঁহারা যেখানে আছে, সেই স্থানই আমার স্বর্গ!”

 একথায় দেবগণ বলিলেন, “বৎস! তোমার যদি উহাদিগের নিকট যাইবার নিতান্ত ইচ্ছা হইয়া থাকে, তবে শীঘ্র সেখানে যাও৷ ইন্দ্র আমাদিগকে তোমার সকল ইচ্ছই পূর্ণ করিতে বলিয়াছে, সুতরাং আমরা তাহা করিব!”

 এই বলিয়া তাঁহারা একজন দেবদূতকে ডাকিয়া বলিলেন, “তুমি শীঘ্র ইহাকে নিয়া ইহার আত্মীয়গণের সহিত দেখা করাও৷”

 দেবদূত তখনি যুধিষ্ঠিরকে পথ দেখাইয়া লইয়া চলিল৷ সে বড়ই ভীষণ পথ; পাপীরা উহতে চলাফেরা করে৷ মশা, মাছি কীট, ভল্লুকাদিতে এবং অস্থি, রক্ত-মাংসের কর্দম ও

ছেলেদের মহাভারত

পুতিগন্ধে সেই ঘোর অন্ধকার পথ পরিপূর্ণ। চারিদিকে ভীষণ অগ্নি। লৌহচঞ্জ কাক ও গৃধিনীগণ দলে দলে তথায় উড়িয়া বেড়াইতেছে। পর্বতাকার সুচমুখ ভূতগণ তথায় ছুটাছুটি করিতেছে তাহাদের কোনোটা রক্তমাখা, কোনোটার হাত-পা কাটা, কোনোটার নাড়ি-ভুড়ি বাহি হইয়া পড়িয়াছে। সেখানকার নদীর জল আগুনের মতো গরম; গাছে পাতা দূরের মতো ধারাল। চারিদিকে লোহার কলসীতে ফুটন্ত তেলের মধ্যে ভাজা হইতে হইতে পাপীরা চীকার করিতেছে। কি ভয়ংকর স্থান! যুধিষ্ঠির তাহা দেখিয়া দূতকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়! এ পথে আর কতদূর যাইতে হইবে?” দেবদূত বলিলেন, “মহারাজ, আপনার কষ্ট হইলে, দেবতারা আপনাকে ফিরাইয়া নিতে বলিয়াছেন। সুতরাং যদি বলেন, এখান হইতে ফিরি।” এ কথায় যুধিষ্ঠির সেখান হইতে ফিরিলেন, আর অমনি চারিদিক হইতে, অতি কাতরস্বরে কাহারা বলিতে লাগিল, “হে মহারাজ! দয়া করিয়া আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করুন! আপনার আগমনে সুন্দর বাতাস বহিয়া আমাদিগকে অনেক শীতল করিয়াছে। অনেকদিন পরে আপনাকে দেখিয়া আমাদের বড় সুখ হইতেছে, আপনি দয়া করিয়া আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করুন।” চারিদিক হইতে এইরূপ কাতর বাক্য শুনিয়া, যুধিষ্ঠিরের বড়ই দয়া হইল, কিন্তু উহা কাহার শব্দ, কোথা হইতে আসিতেছে, তিনি কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। তখন তিনি বলিলেন, “হে দুঃখী লোকসকল! তোমরা কে? আর কিজন্য তোমরা কষ্ট পাইতেছ?” যুধিষ্ঠির এই কথা কহিবামাত্র চারিদিক হইতে একসঙ্গে, “আমি কর্ণ!” “আমি ভীম!” “আমি অর্জুন!” “আমি নকুল!” “আমি সহদেব!” “আমি দ্রৌপদী!” “আমরা আপনার পুত্রগণ!” এইরূপে সকলে পরিচয় দিতে লাগিলেন। তখন যুধিষ্ঠির ভাবিলেন, হায়! কি কষ্ট! আমার পুণ্যবান প্রিয়তমেরা এমন কি পাপ করিয়াছে যে, তাহাদিগকে এ স্থানে আসিতে হইল? আর দুষ্ট দুর্যোধনই বা এমন কি পুণ্য করিয়াছে যে, সে সবান্ধবে স্বর্গে বসিয়া সুখ ভোগ করিতে পাইল? এ অতি অবিচার। এইরূপ চিন্তা করিয়া যুধিষ্ঠির দেবদূতকে বলিলেন, “মহাশয়। আপনি যাহাদের দূত, তাহাদিগকে বলুন যে, আমি এই স্থানেই থাকিলাম। আর আমি সেখানে যাইব না। আমার ভাইয়েরা আমাকে পাইয়া সুখী হইয়াছে।” দেবদুত এ সকল কথা ইন্দ্রকে জানাইলে, দেবতারা সকলে সেই ভয়ংকর স্থানে যুধিষ্ঠিরের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন দেখিতে দেখিতে সেখানকার সকল অন্ধকার, দুর্গন্ধ এবং ভয় দূর হইয়া, সে স্থান স্বর্গের নায় সুন্দর হইয়া গেল। তারপর ইন্দ্র যুধিষ্ঠিরকে বলিলেন, “মহারাজ! দেবতারা তোমার উপর অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছে। আর তোমাকে কষ্ট পাইতে হইবে না; তোমার পুণ্যের বলে সর্বাপেক্ষা উচ্চ ফল লাভ হইয়াছে। নরক দেখিতে হইল বলিয়া তুমি বিরক্ত হইও না। সকল রাজাকেই একবার নরক দেখিতে হয়। পাপ-পুণ্য সকলেরই থাকে। যাহার পাপ অধিক, সে আগে অল্পকাল স্বর্গে থাকিয়া, পরে নরক ভোগ করে। যাহার পুণ্য অধিক, সে আগে নরকে থাকিয়া, শেষে স্বর্গ ভোগ করে। এইজন্যই তোমাকে আগে নরক দেখাইয়াছি। তুমি যে অশ্বত্থামার বধের

উপে-৪৪

উপেন্দ্রকিশাের রচনাসমগ্র

কথা বলিয়া দ্রোণকে ফাকি দিয়াছিলে, সেই পাপে তােমাকে নরক দেখিতে হইল। এইরূপ অল্প অল্প পাপ ভীমার্জুন, দ্রৌপদী প্রভৃতি সকলেরই ছিল, তাই সকলকেই কিছু কিছু কষ্ট পাইতে হইয়াছে। কিন্তু এখন আর তাহাদের কোনাে কষ্ট নাই, তাহারা সকলেই স্বর্গে গিয়াছে। তােমার পক্ষের রাজাদেরও সকলেরই স্বর্গলাভ হইয়াছে। এখন তুমি শােক পরিত্যাগপূর্বক আমার সঙ্গে আইস, সকলকেই দেখিয়া সুখী হইবে। ঐ দেখ, দেনদী মন্দাকিনী বহিয়া যাইতেছে উহার জলে স্নান করিলে, আর তােমার শােক, তাপ, হিংসা, ক্রোধ প্রভৃতি কিছুই থাকিবে না।” সকলের শেষে ধর্ম যুধিষ্ঠিরকে বলিলেন, “বৎস! আমি তােমার উপর বড়ই সন্তুষ্ট হইয়াছি। বারবার তােমাকে পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম যে, তােমার তুল্য ধার্মিক আর নাই। তুমি যে তােমার ভাইদিগকে ছাড়িয়া স্বর্গ ভােগ করিতে চাও নাই, ইহাতেও তােমার মহত্ত্বের প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে। এখন তুমি আমার সঙ্গে ঐ মন্দাকিনীর পবিত্র জলে স্নান কর।” মন্দাকিনীর জলে স্নান করামাত্র যুধিষ্ঠিরের মানুষ দেহ দূর হইয়া দেবতুল্য অপরূপ উজ্জ্বল মূর্তি দেখা দিল। তখন তিনি ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব, দ্রৌপদী, কুন্তী, মাদ্রী, পাণ্ডু, ভীষ্ম, দ্ৰোণ প্রভৃতি আত্মীয়গণ এবং কৃষ্ণের সহিত মিলিয়া স্বর্গের অতুল আনন্দে মগ্ন হইলেন।