উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/ছেলেদের মহাভারত/শান্তিপর্ব

শান্তিপর্ব

দবধি যুধিষ্ঠির এ কথা জানিতে পাবিলেন যে, কর্ণ তাঁহাদের জ্যেষ্ঠ ভাই, সেই অবধি তাঁহার শোকে এবং না জানিয়া তাঁহাকে বধ করার জন্য দুঃখ আর অনুতাপে, তিনি একেবারে অধীর হইয়া পড়িলেন। যে বাজ্যের জন্য এমন ঘটনা ঘটে, তাহার প্রতি তাঁহার এতই ঘৃণা জন্মিয়া গেল যে, আর কিছুতেই সে রাজ্য ভোগ করিতে তাঁহার ইচ্ছা হইল না। ভাইদিগকে ডাকিয়া তিনি বলিলেন, “আমার রাজ্য করিতে ইচ্ছা নাই, রাজ্য ছাড়িয়া বনে গিয়া আমি তপস্যা করিব৷”

 এ কথায় সকলের মাথায় যেন আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। যে রাজ্যের জন্য এত ক্লেশ, এত রক্তপাত, সে রাজ্য হাতে পাইয়া কোন রাজা তাহা পালন এবং রক্ষার অবহেলা করিতে পারে? বনে যাওয়াই যদি কর্তব্য হয়, তবে এত কাণ্ডের কি প্রয়োজন ছিল? না হয় এই রাজ্য দ্বারা দান যজ্ঞাদি, ধর্ম কাজই হউক-না। ইহা ছাড়িয়া দিলে কি প্রশংসার কাজ হইবে?

 এইরূপে ভীম,অৰ্জুন,নকুল, সহদেব, দ্রৌপদী সকলে মিলিয়া যুধিষ্ঠিরকে কত বুঝাইলেন, কিন্তু কিছুতেই যুধিষ্ঠিরের মন শান্ত হইল না। তিনি সবিনয়ে ব্যাসকে বলিলেন, “ভগবন্! ধর্মের কথা আমাকে আরো ভালো করিয়া বলুন। কিরূপে একজন লোকে রাজ্যও করিতে পারে, আর ধর্মও করিতে পারে, এ কথা না বুঝিতে পারিয়া আমার মনে বড়ই চিন্তা হইতেছে৷”

 তখন ব্যাস তাঁহাকে বলিলেন, “যদি ভালো করিয়া ধর্মের কথা শুনিতে তোমার ইচ্ছা হইয়া থাকে, তবে কুরুকুলপিতামহ ভীষ্মের নিকটে যাও, তিনি তোমার সংশয় দূর করবেন। তিনি দেহত্যাগ না করিতে করিতে শীঘ্র তাহার নিকট যাও।”

 কৃষ্ণও বলিলেন, “মহারাজ! অতিশয় শোক করা আপনার মতো লোকের উচিত নহে। মহর্ষি ব্যাস যাহা বলিলেন, আপনি তাহাই করুন!”

 যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর হইতে সকলে নগরের বাহিরেই বাস করতেছিলেন, এ পর্যন্ত তাহাদের হস্তিনায় প্রবেশ হয় নাই। ব্যাস এবং কৃষ্ণের উপদেশ এবং ভীষ্মের কথা শুনিবার আশায় মনে কতকটা শান্তি লাভ করাতে, এখন যুধিষ্ঠির হস্তিনায় যাইতে প্রস্তুত হইলেন।

 তখন শুভ্র, সুন্দর, সুসজ্জিত যোড়শ বৃষযুক্ত শ্বেত রথে যুধিষ্ঠিরকে তুলিয়া, অর্জুন তাহার উপরে নির্মল শ্বেতছত্র ধারণ করিলেন, নকুল, সহদেব শুভ্র চামর লইয়া ব্যজন করিতে লাগিলেন, ভীম বল্লা হস্তে সেই রথের সারথি হইলেন। কৃষ্ণ শেত রথে চড়িয়া সঙ্গে চলিলেন; ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী, দ্রৌপদী প্রভৃতি সকলে, কেহ শিবিকায়, কেহ রথে, তাহাদের অনুগামী হইলেন।

 নগরবাসীগণের তখন আর আনন্দের সীমা রহিল না। তাহারা যত্নে রাজপথ, গৃহতোরণাদি সাজাইয়া কোলাহল করিতে লাগিল। জনতার জয়গীতে, দুন্দুভী রব শঙ্খনাদ আর দ্বিজগণের আশীর্বাদ মিলিয়া, সে সময়ে এমনি একটি সুখের ব্যাপার হইয়াছিল যে, তাহার আর তুলনাই নাই।

 ইহার মধ্যে চার্বাক নামক একটা দুষ্ট রাক্ষস, ভিক্ষুকের বেশে আসিয়া বড়ই রসভঙ্গ করিয়া দিল। হতভাগা দুর্যোধনের বন্ধু, পাণ্ডবদিগের অনিষ্টের চেষ্টায় ঘুরিয়া বেড়ায়। ব্রাহ্মণেরা যুধিষ্ঠিরকে আশীর্বাদ করিতেছেন, তাহাতে দুষ্ট আসিয়া বলে কি, “মহারাজ। ব্রাহ্মণগণ জ্ঞাতি বধের জন্য আপনাকে দুষ্ট রাজা বলিয়া গালি দিতেছি। আপনার জীবনে কোনো প্রয়োজন নাই, আপনার মৃত্যুই শ্রেয়।”

 এ কথা শুনিয়া ক্রোধে অনেকক্ষণ পর্যন্ত ব্রাহ্মণগণের কথা সরিল না। ইহার মধ্যে যুধিষ্ঠির বলিলেন, “হে দ্বিজগণ! আপনারা দয়া করিয়া আমাকে গালি দিবেন না; আমি অবিলম্বে প্রাণত্যাগ করিব!”

 তখন ব্রাহ্মণেরা ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, “মহারাজ, আমরা আপনাকে গালি দেই নাই। আপনার মঙ্গল হউক! এই দুরাত্মা দুর্যোধনের বন্ধু, চার্বাক নামক রাক্ষস। দুর্যোধনের বন্ধু বলিয়াই দুষ্ট আপনাকে গালি দিয়াছে, আমরা কিছুই বলি নাই। আপনি কোনো ভয় করিবেন না।” এই বলিয়া ব্রাহ্মণেরা বিষম রোষনয়নে চার্বাকের দিকে চাহিবামাত্র দুরাত্মার প্রাণ বাহিয় হইয়া গেল।

 তারপর বিধিমতে যুধিষ্ঠিরের অভিষেক হইয়া গেলে, তিনি উপযুক্ত লোকদিগের হাতে রাজ্যের কাজ বাটিয়া দিলেন। ভীম হইলেন যুবরাজ, বিদুর হইলেন মন্ত্রী, সঞ্জয় আয় ব্যয়পরীক্ষক, নকুল সৈন্য পরিদর্শক, অর্জুন শত্রু ও দুষ্ট শাসক, সহদেব দেবরক্ষক, ধৌম্য দেবসেবা সম্পাদক। সকলের প্রতিই আদেশ রহিল যে, “ধৃতরাষ্ট্র যখন যেরূপ আজ্ঞা দেন, তাহারই মতে চলিতে হইবে।

 এইরূপে রাজকার্যের সুন্দর ব্যবস্থা করিয়া, যুধিষ্ঠির ভীষ্মের নিকট যাইতে প্রস্তুত হইলেন। সেই শরশয্যার দিন হইতে ভীষ্ম সেইভাবেই যুদ্ধক্ষেত্রে থাকিয়া, সূর্যের উত্তরায়ণের (অর্থাৎ আকাশের উত্তর ভাগে যাওয়ার অপেক্ষা করিতেছে। উত্তরায়ণ আরম্ভ হইলেই সেই মহাপুরুষের দেহত্যাগের সময় হইবে। তাঁহার সহিত দেখা করিবার জন্য কৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব, সাত্যকি, কৃপ, সঞ্জয় প্রভৃতি রথে চড়িয়া যাত্রা করিলেন।

 কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হইয়া তাঁহারা দেখিলেন যে, সেই মহাবীরের মৃত্যুশয্যার চারিদিকে মুনি-ঋষিগণ ঘিরিয়া বসায়, সে স্থানের এক অপূর্ব শোভা হইয়াছে। দূর হইতে তাহ দেখিয়াই, সকলে রথ হইতে নামিয়া, তথায় উপস্থিত হইলেন।

 তখন কৃষ্ণ ভীষ্মের নিকটে গিয়া, বিনয়ের সহিত তাঁহাকে বলিলেন, “হে কুরুপিতামহ! আপনার তুল্য মহৎ লোক এই পৃথিবীতে কেহই নাই ধর্মের সকল তত্ত্বই আপনার জ্ঞাত। রাজা যুধিষ্ঠির শোকে অতিশয় কাতর হইয়াছেন; এ সময়ে আপনি দয়া করিয়া তাঁহাকে উপদেশ দিলে, তাঁহার শান্তিলাভ হইতে পারে৷”

 যুধিষ্ঠির লজ্জায় ভীষ্মের নিকটে গিয়া কথা বলিতে সাহস পান নাই। কিন্তু ভীষ্মের কথা শুনিয়া তিনি বলিলেন, “যুধিষ্ঠির তো যুদ্ধ করিয়া ক্ষত্রিয়ের ধর্মই পালন করিয়াছেন। সুতরাং ইহাতে তাঁহার লজ্জিত হইবার কোনো কারণ নাই৷”

 তখন যুধিষ্ঠির ভীষ্মের নিকট আসিয়া ভক্তিভরে তাঁহার পদধূলি গ্রহণ করিলে, ভীষ্ম তাঁহার মস্তক আঘ্রাণপূর্বক বলিলেন, “তোমার কোনো ভয় নাই,মন খুলিয়া আমাকে সকল কথা জিজ্ঞাসা কর৷”

 এই সময় কৃষ্ণ ভীষ্মের সকল জ্বালা-যন্ত্রণা এবং দুর্বলতা দূর করিয়া দিলেন।

 তারপর বহুদিন পর্যন্ত, যুধিষ্ঠির প্রত্যহ সেই মহাপুরুষের নিকট আসিয়া, যেসকল অমূল্য উপদেশ পাইয়াছিলেন, তোমরা বড় হইয়া তাহার কথা পড়িবে। এমন উপদেশ যে সে দিতে পারে না। তাই যুধিষ্ঠির উপদেশ লইতে আসিলে নারদ তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, “এই মহাত্মা ধর্মের সকল সংবাদ জানেন, ইনি বাঁচিয়া থাকিতে তাহা শুনিয়া লও৷”