উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/ছেলেদের মহাভারত/স্ত্রীপর্ব

স্ত্রীপর্ব

ঠারো দিনের পর কুরুক্ষেত্রের সেই ভীষণ যুদ্ধের শেষ হইল। আঠারো অক্ষৌহিণী লোক এই যুদ্ধে প্রাণ দিযাছে। এখন সেই সকল যোদ্ধার ঘরে ঘরে শোকের আগুন জ্বলিয়া উঠিয়াছে। কিন্তু কেবল শোক করিয়া তো আর চলিবে না, মৃত লোকদের শ্রাদ্ধাদির আয়োজন করা চাই।

 একশত পুত্রের শোক কি সহজ কথা? সামলাইয়া উঠিতে ধৃতরাষ্ট্রের বড়ই কষ্ট হইল। ব্যাস, বিদুর প্রভৃতি অনেকে বুঝাইয়াও তাঁহাকে সহজে শাস্ত করিতে পারিলেন না।

 যাহা হউক, অনেক কষ্টে শেষে তিনি কতক স্থির হইলেন, আর পাণ্ডবদের উপরও তাঁহার রাগ অনেকটা কমিল। ব্যাস তাঁহাকে বুঝাইয়া বলিলেন, “তোমার পুত্রেরা নিতান্তই দুরাচার ছিল। তাহাদের দোষেই এই সর্বনাশ হইয়াছে পাণ্ডবদের ইহাতে কিছুমাত্র অপরাধ নাই।”

 তারপর শ্রাদ্ধের সময় উপস্থিত হইলে, সঞ্জয় আর বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বুঝাইয়া বলিলেন, “মহারাজ এখন শ্রাদ্ধাদির সময় উপস্থিত। শোকের মোহে সে সকল কার্যে অবহেলা করিবেন না।”

 তখন ধৃতরাষ্ট্র, পরিবারের স্ত্রী-পুরুষ সকলকে লইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে যাত্রা করিলেন। কুলবধুগণ বিধবার বেশে পথে বাহির হইলে পৃথিবীসুদ্ধ লোক তাঁহাদের দুঃখে কাদিয়া আকুল হইল।

 এদিকে পাণ্ডবেরাও কৃষ্ণ, সাত্যকি আর দ্রৌপদী প্রভৃতিকে লইয়া কুরুক্ষেত্রের দিকে আসিতেছিলেন। কিছুদূর আসিয়া ধৃতরাষ্ট্র প্রভৃতির সহিত তাহাদের দেখা হইবামাত্র কৌরব নারীগণের দুঃখ যেন দ্বিগুণ বাড়িয়া গেল, কেননা পাণ্ডবেরাই এই দুঃখের কারণ।

 পাণ্ডবেরা একে একে ধৃতরাষ্ট্রের নিকটে যাইয়া নিজ নিজ নাম বলিয়া তাহাকে প্রণাম করিতে লাগিলেন। ধৃতরাষ্ট্র বিরক্তভাবে যুধিষ্ঠিরকে আলিঙ্গন ও তাঁহার সহিত দু একটি কথা কহিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভীম কোথায়?” তখন তাঁহার মুখের ভাব দেখিয়াই বুঝা গিয়াছিল যে, ভীমকে পাইলে তিনি তাঁহাকে বধ না করিয়া ছাড়িবেন না। তাঁহার এরূপ অভিসন্ধির কথা কৃষ্ণ পূর্বেই বুঝিতে পারিয়াছিলেন, তাহার জন্য প্রস্তুত হইয়া আসিতেও ভুলেন নাই। সুতরাং ধৃতরাষ্ট্র ভীমের কথা জিজ্ঞাসা করামাত্র, তিনি একটা লোহার ভীম আনিয়া তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত করিলেন। সেই লোহার মুর্ত্তিটাকে আলিঙ্গন করিবার ছলে, ধৃতরাষ্ট্র তাহাকে এমনি চাপিয়া দিলেন যে, তাহা একেবারে চূর্ণ হইয়া গেল! ধৃতরাষ্ট্রের দেহে লক্ষ হাতির জোর ছিল, সুতরাং তিনি যে লোহার ভীম চূর্ণ করিবেন, তাহা আশ্চর্য নহে। আসল ভীমকে পাইলে না জানি তিনি তাহার কি দশা করিতেন।

 যাহা হউক লোহার ভীম চূর্ণ করা লক্ষ হাতির জোরের পক্ষেও সহজ কথা নহে; সুতরাং ধৃতরাষ্ট্র সে কাজ শেষ করিয়াই রক্ত বমি করিতে করিতে পড়িয়া গেলেন। এদিকে ভীমের যথেষ্ট সাজা হইয়াছে মনে করিয়া, তাঁহার রাগ চলিয়া গেল, তখন আবার তিনি “হা ভীম! হা ভীম!” করিয়া কাঁদিতে ত্রুটি করিলেন না। তাহাতে কৃষ্ণ তাঁহাকে বলিলেন, “মহারাজ! দুঃখ করিবার কোনো প্রয়োজন নাই। ওটা লোহার ভীম, যথার্থ ভীম নহে। ভীমকে বধ করিতে যাওয়া আপনার উচিত হয় নাই। দেখুন, যুদ্ধ বারণ করিতে অশেষ চেষ্টা হইয়াছিল, তথাপি আপনার পুত্রেরা তাহাতে ক্ষান্ত হন নাই; তাহারা ফলেই এখন তাঁহাদের মৃত্যু ঘটিয়াছে। সুতরাং ভীমকে তাহার জন্য দোষী করেন কেন?”

 কৃষ্ণের কথায় ধৃতরাষ্ট্র বলিলেন, “কৃষ্ণ! তোমার কথাই সত্য। শোকে বুদ্ধিনাশ হওয়াতেই আমি ঐরূপ করিয়াছিলাম।” এই বলিয়া ধৃতরাষ্ট্র ভীম, অর্জুন, নকুল আর সহদেবকে আলিঙ্গনপূর্বক আশীর্বাদ করিলেন।

 ধৃতরাষ্ট্র অপেক্ষা গান্ধারীর কথা ভাবিয়াই পাণ্ডবদের মনে অধিক ভয় হইয়াছিল। গান্ধারী সামান্য স্ত্রীলোক ছিলেন না। জীবনে তিনি কখনো একটি অধর্মের কাজ করেন নাইবা একটি অধর্মের কথা মুখে আনেন নাই। অন্ধ স্বামীর দুঃখে তিনি এতই দুঃখিত ছিলেন যে, বিবাহের পরেই তিনি নিজের চক্ষু মোটা কাপড় দিয়া বাঁধিয়া ফেলেন। সে বাঁধন তাঁহার চিরদিন একভাবে ছিল। যুদ্ধের সময় যখন দুর্যোধনেরা জয়লাভের জন্য তাঁহার আশীর্বাদ চাহিতে আসিলেন, তখন গান্ধারী তাঁহাদেব মা হইয়াও এ কথা মুখে আনিতে পারিলেন না যে, ‘তোমাদের জয় হউক’, তিনি বলিলেন ‘ধর্মের জয় হউক’।

 সেই দেবতার ন্যায় তেজস্বিনী ধার্মিকা রমণীর ক্রোধের কথা ভাবিয়াই পাণ্ডবেরা অত্যন্ত ভয় পাইয়াছিলেন। আর ক্রোধও তাঁহার খুবই হইয়াছিল। সেই ক্রোধে পাছে তিনি পাণ্ডবদিগকে শাপ দেন এই ভয়ে ব্যাসদেব পূর্বেই তাঁহাকে সতর্ক করিয়া বলিয়াছিলেন, “মা। তুমিই বলিয়াছিলে ‘ধর্মের জয় হউক’, সেই ধর্মের জয় হইয়াছে। তোমার যে অসাধারণ ক্ষমাগুণ, তাহাই ধর্ম, আর এখন যে ক্রোধ করিতেছ তাহা অধর্ম। মা। ধর্মের উপর যেন অধর্মের জয় না হয়।”

 ইহার উত্তরে গান্ধারী বলিলেন, “ভগবন! পাণ্ডবদিগের উপর আমার ক্রোধ নাই তাহাদের বিনাশ আমি চাহি না। কিন্তু ভীম যে অন্যায়পূর্বক দুর্যোধনকে মারিয়াছে, ইহা আমি সহ্য করিতে পারিতেছি না।”

 তাই ভীম গান্ধারীর নিকট উপস্থিত হইয়া ভয়ে ভয়ে বিনয়ের সহিত বলিলেন, “মা! আমার অপরাধ হইয়াছে। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। ভাবিয়া দেখুন, আপনার পুত্রেরা আমাদিগের বড়ই অনিষ্ট করিয়াছিল।”

 গান্ধারী বলিলেন, “বাছা, আমার একশত পুত্রের মধ্যে যাহার কিছু কম অপরাধ, এমন একটিকেও যদি জীবিত রাখিতে, তাহা হইলেও সে এই দুই অন্ধের নডিস্বরূপ হইতে পারিত। এখন আমাদের পুত্র নাই কাজেই তুমি আমাদের পুত্রের মতন হইলে।”

 তারপর যুধিষ্ঠির তাঁহার নিকট আসিয়া জোড়হাতে বলিলেন, “দেবী। আমিই আপনাদের দুঃখের মূল। আমি অতি নরাধম আমাকে শাপ দিন।”

 গান্ধারী এ কথায় কোনো উত্তর না দিয়া, কেবল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন। সেই সময়ে যুধিষ্ঠির গান্ধীরীর পায়ে ধরিতে গেলে, গান্ধারী তাঁহার চোখের বাঁধনের ফাঁক দিয়া যুধিষ্ঠিরের আঙ্গুলের নখ দেখিতে পান। তদবধি যুধিষ্ঠিরের নখ মরিয়া গেল। তাহা দেখিয়া অর্জুন, সহদেব এবং নকুল ভয়ে আর তাঁহার নিকট আসিলেন না। তখন গান্ধারী তাঁহাদিগকে ডাকিয়া স্নেহের সহিত কথাবার্তা বলিতে লাগিলেন।

 তারপর পাণ্ডবেরা কুন্তীর নিকটে গেলেন। এত দুঃখ-কষ্টের পর তাঁহাদিগকে, পাইয়া আর তাঁহাদিগকে অস্ত্রাঘাতে জর্জরিত এবং দ্রৌপদীকে পুত্রশোকে আকুল দেখিয়া, না জানি কুন্তীর কতই কষ্ট হইয়াছিল। কিন্তু সে কষ্টের দিকে মন না দিয়া, তিনি দ্রৌপদীকে সান্ত্বনা দিতে লাগিলেন।

 তারপর সকলে মিলিয়া সেখান হইতে রণস্থলে গেলেন। তখন নিজ নিজ আত্মীয়গণের মৃত শরীর দেখিয়া তাঁহাদের যে দারুণ দুঃখ হইল, তাহার কথা অধিক বলিয়া আর কি হইবে? সেই মৃতদেহগুলির সৎকারই হইল তখনকার প্রথম কাজ। বহুমূল্য কাষ্ঠ, ঘৃত, চন্দনাদিতে অসংখ্য চিতা প্রস্তুত করিয়া যত্নপূর্বক সে কাজ শেষ করা হইলে, সকলে স্নান ও জলাঞ্জলি (অথাৎ যাহারা মরিয়াছে, তাহাদের উদ্দেশ্যে অঞ্জলি ভরিয়া জল) দিবার জন্য গঙ্গা তীরে উপস্থিত হইলেন।

 এই সময় কুন্তী কাঁদিতে কাঁদিতে পাণ্ডবদিগকে বলিলেন, “বৎসগণ! কর্ণের জন্য জলাঞ্জলি দাও, সে তোমাদের জ্যেষ্ঠ ভাই ছিল৷”

 হায়! চিরকাল কর্ণের সহিত সাংঘাতিক শক্রতা করিয়া তাঁহাকে আহ্লাদপূর্বক নিধনের পর ইহা কি নিদারুণ সংবাদ! সে সংবাদ শুনিয়া পাণ্ডবদিগের ন্যায় বীরপুরুষেরাও আর স্থির থাকিতে পারিলেন না।

 তখন যুধিষ্ঠির দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে কুন্তীকে বলিলেন, “মা। তুমি আমাদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার কথা গোপন করিয়া কি অন্যায় কাজই করিয়াছ! আমরা তাহাকে বধ করিয়াছি, এ কথা ভাবিয়া এখন বুক ফাটিয়া যাইতেছে। হায়! এ কথা আগে বলিলে কি আর এ নিষ্ঠুর যুদ্ধ হইত?”