উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/ছেলেদের রামায়ণ/অযোধ্যাকাণ্ড
অযোধ্যাকাণ্ড
জা দশরথের বয়স প্রায় ষাট বৎসর হইয়াছে। এত বয়স হইলে কতখানি বুড়ো হয় বুঝিতে পার। কাজেই তিনি এখন আর রাজ্যের কাজের জন্য আগের মতন পরিশ্রম করিতে পারেন না। আর রামও এতদিনে বিদ্যায়, বুদ্ধিতে, জোরে, সাহসে,—যত রকম গুণ হইতে পারে, সকল গুণেই—সকলের বড় হইয়া উঠিয়াছেন। ইহা দেখিয়া দশরথ একদিন মন্ত্রীদিগকে বলিলেন, ‘আমি এখন বুড়ো হইয়াছি, আর কতদিনই বা বাচিব। তাই আমি মনে করিতেছি যে রামকে যুবরাজ করিয়া দেই।’ এই বলিয়া তিনি মন্ত্রী পাঠাইয়া দেশ বিদেশে সংবাদ দিলেন, ‘আমি একটা মস্ত সভা করিব।’
খবর পাইয়া পৃথিবীর যত ভাল ভাল রাজা আর বড় লোক সকলে দশরথের সভায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সেই সভায় দশরথ বললেন, ‘দেখ, এতদিন আমি যতদূর পারিয়াছি রাজ্যের কাজ করিয়াছি। এখন আমার অনেক বয়স হইয়াছে, চুল পাকিয়া গিয়াছে গায়ের জোর কমিয়া গিয়াছে। এই বুড়া বয়সে আমি আর রাজ্যের জন্য এত পরিশ্রম করিতে পারি না। আমার রাম এখন বড় হইয়াছেন, আর তাহার গুণের কথা তোমরা সকলেই জান। এজন্য আমি এখন তাহার হাতে রাজ্যের ভার দিতে চাহিতেছি। তাহাতে তোমরা কী বল?’
এ কথায় সকলে বলিল, ‘মহারাজ, রামের গুণের কথা কী বলিব! পৃথিবীতে এমন আর নাই! দেশের লোক রামকে যে কত ভালবাসে, তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না। আপনি রামকে যুবরাজ করিয়া দিন, দেখিয়া আমাদের চক্ষু জুড়াক।’
তখন দশরথ বলিলেন, ‘সুন্দর চৈত্র মাস আসিতেছে বনে ফুল ফুটিয়াছে। আপনারা শীঘ্র আয়োজন করুন। এই সুন্দর সময়ে রামকে যুবরাজ করিতে হইবে!’ এই কথা শুনিয়া সভার লোক এতই আনন্দিত হইল যে, তাহদের কোলাহলে সভার ঘর ফাটে আর কি!
দশরথের কথায় মন্ত্রী সুমন্ত্র তখনি রামকে লহয়া আসিলেন। দশরথ পরম আদরের সহিত তাহাকে কাছে বসাইয়া বলিলেন, ‘বাবা, তোমার যেমন গুণ, সকলে তোমাকে তেমনি ভালবাসে। এখন তুমি যুবরাজ হও, তাহা দেখিয়া সকলে সুখী হউক।’ রামের যাহারা বন্ধু, তাহারা শুনিবামাত্র ছুটিয়া গিয়া কৌশল্যাকে খবর দিল। সে সংবাদে কৌশল্যা কিরূপ খুশি হইয়াছিলেন, আর তাহাদিগকে কত পুরস্কার দিয়াছিলেন, তাহা বুঝিতেই পার।
স্থির হইল যে, পরদিনই রামকে যুবরাজ করা হইবে। সে সংবাদে অযোধ্যায় হুলুস্থুল পড়িয়া গেল। অযোধ্যার লোকেরা মনের আনন্দে আর ঘরের ভিতরে না থাকিতে পারিয়া পথে আসিয়া কোলাহল করিতে লাগিল। গাড়ি ঘোড়া লইয়া আর চলিবার জো রহিল না। সকলের মুখে খালি রামের কথা! কেহ বলিতেছে, বাঃ, মহারাজ কী ভাল কাজই করিলেন!, কেহ বলিতেছে, ‘মহারাজ চিরজীবী হউন! ‘
রাণী কৈকেয়ীর একটা দাসী ছিল। তাহার নাম ছিল মন্থরা;কিন্তু তাহার পিঠে একটা মস্ত কুঁজ ছিল বলিয়া সকলে তাহাকে কুঁজী বলিয়া ডাকিত। যেমন কদাকার চেহারা, তেমনি তাহার কুটিল মন ছিল। উহার ঐ মস্ত কুঁজটার ভিতরে বুঝি খালি হিংসা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কৈকেয়ী ঐ দাসীটিকে বাপের বাড়ি হইতে আনিয়াছিলেন, কাজেই তাহাকে বড় আদর করিতেন।
সকালবেলা লোকের কলরব শুনিয়া কুঁজী ছাতে উঠিয়া দেখিতে গেল কিসের গোলমাল। সেখানে গিয়া দেখিল যে, রাস্তায় চন্দনের জল আর পদ্মের পাপড়ি ছড়ানো হইয়াছে, নিশান উড়িতেছে আর চারিদিকে কেবল গান বাজনা আর কোলাহল শুনা যায়। ইহাতে কুঁজীর মনে বড়ই ভাবনা উপস্থিত হইল। উহার কাছেই একটি ঝি রেশমী কাপড় পরিয়া হাসিমুখে দাঁড়াইয়া ছিল। কুঁজী তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘হ্যা ঁগা, রামের মা কৌশল্যা কিসের জন্য লোককে এত টাকা দিতেছে? ও যে কৃপণ, তবুও এমন করিয়া টাকা দিতেছে, ব্যাপারখানা কী?’ ঝি বলিল, ‘কাল যে রাম যুবরাজ হইবেন। ‘
এই কথা শুনিয়া আর কি কুঁজী হিংসায় স্থির থাকিতে পারে? সে হিংসায় যে তার কুঁজ তখন ফাটিয়া যায় নাই, ইহাই আশ্চর্য! ফাটিলে ভালই ছিল। কৈকেয়ী তখন শুইয়া ছিলেন। কুঁজী সেখানে ছুটিয়া আসিয়া তাঁহাকে তাড়া—কি তাড়া! বড় যে শুইয়া আছ? দেখিতেছ যে তোমার সর্বনাশ হইয়া গেল? শীঘ্র উঠ! ‘
কুঁজীর রাগ দেখিয়া কৈকেয়ী আশ্চর্য হইয়া বলিলেন,’ কী হইয়াছে মন্থরা? আমার কোন বিপদ হইয়াছে কি? তুমি এত ব্যস্ত হইয়াছ কেন?’ মন্থরা দাঁত মুখ খিচাইয়া বলিল, ‘তোমার যাতে সর্বনাশ হয় তাহাই হইয়াছে! কাল মহারাজ রামকে যুবরাজ করিবেন! ‘
এ কথা শুনিয়া কৈকেয়ীর এত আনন্দ হইল যে তিনি তখনই একখানা দামী গহনা কুঁজীকে পুরস্কার দিয়া ফেলিলেন। কুঁজী তাহা দূরে ফেলিয়া দিয়া কহিল, কী বোকা! এমন বিপদে পড়িয়াও আবার আমোদ করিতেছ! রাম রাজা হইলে ভরতের সর্বনাশ হইবে না বুঝি? আর তুমিও বুঝে তখন কৌশল্যা রাণীর দাসী হইয়া থাকিবে না? ‘
কৈকেয়ী বলিলেন, মন্থরা, রাম বড়ই ধার্মিক আর তিনি যখন বড় ছেলে তখন তাহারই তো রাজ্য পাওয়া উচিত। রাম আমাকে যেমন যত্ন করেন ভরতও তেমন করে না। আমি ভরতকে যেমন ভালবাসি, রামকেও তেমনি ভালবাসি। রাম রাজা হইলে দেখিবে, তিনি ভাইদিগকে কত সুখে রাখিবেন। ‘
কুঁজী লম্বা নিশ্বাস ছাড়িয়া বলিল, হায় হায়, এ কেমন মেয়ে গোয় আমি তোমার ভালোর জন্য এত করি, আর তুমি আমার কথায় কানই দাও না! রাম রাজা হইলে নিশ্চয় ভরতকে তাড়াইয়া দিবে, না হয় মারিয়া ফেলিবে:আর সেই রামের যে মা, কৌশল্যা রাণী, তাহাকে তো এতদিন তুমি অগ্রাহ্যই করিয়াছ। সে কি তখন তাহার শোধ সইতে ছড়িবে? তাই বলি,এই বেলা যাহাতে ভরত রাজ্য পায় আর রাম বনে চলিয়া যায়, তাহার উপায় দেখ।’
হায় হায়, কুঁজী হতভাগী কেন পৃথিবীতে জন্মিয়াছিল? কৈকেয়ীর মন তো আগে মন্দ ছিল না! দুষ্ট কুঁজীই তো তাঁহার ভিতরে হিংসা ঢুকাইয়া দিল। কুঁজী যখন ভরতকে রাম মারিয়া ফেলিবে বলিয়া ভয় দেখাইল, তখন কৈকেয়ী বলিলেন, ‘মন্থরা আজই আমি রামকে বনে পাঠাইয়া ভরতকে রাজা করিব। এখন এই কাজটি কেমন করিয়া হইতে পারে বল।’
কুঁজী বলিল, ‘সেকি! তুমি কি সব ভুলিয়া গিয়াছ? সেই যে দণ্ডক-বনের ভিতরে বৈজয়ন্ত নগরে সম্বর অসুর ছিল, দেবতাদের সঙ্গে তাহার ভয়ানক যুদ্ধ হয় সেই যুদ্ধে আমাদের রাজা দেবতাদের সাহায্য করিতে গিয়াছিলেন, তোমাকে সঙ্গে নিয়াছিলেন। রাজা ভয়ানক অস্ত্রের ঘা খাইয়া যুদ্ধের জায়গাতেই অজ্ঞান হইয়া গেলেন, তখন তুমিই তাহাকে সেখান হইতে লইয়া আসিয়া বাঁচাইলে। তাহাতে তিনি তোমাকে দুইটি বর দিতে চাহিলেন;তুমি বলিলে, “যখন ইচ্ছা হয় লইব”। এ-সকল কথা তো তোমার মুখেই শুনিয়াছি। এখন কেন সেই বর চাহিয়া লও না? এক বরে রামকে বনে পাঠাও, আর এক বরে ভরতকে রাজা কর। তাহা হইলেই আপদ চুকিয়া যাইবে। এক কাজ কর। তুমি ময়লা কাপড় পরিয়া, মুখ ভার করিয়া, মেঝেতেই পড়িয়া থাক। রাজা আসিলে কথাটিও কহিবে না, খালি রাগ করিবে আর কাঁদিবে। রাজা তোমাকে যে ভালবাসেন! তোমার রাগ দেখিলে নিশ্চয়ই ভয় পাইবেন, আর যাহা চাও তাহাই দিয়া তোমাকে খুশি করিবেন। কিন্তু খবরদার! আগে রাজার মুখ দিয়া এই কথাটি বাহির করিয়া লইবে যে তুমি যাহা চাও তাহাই তিনি দিবেন। এইরকম করিয়া তাহাকে কথায় আটকাইয়া তারপর বর দুইটি চাহিবে। তাহা হইলে আর তাহার “না” বলিবার জো থাকিবে না!'
এইরূপ করিয়া কুঁজী কৈকেয়ীর মন একেবারে খারাপ করিয়া দিল। তখন তাঁহার মুখে কুঁজীর প্রশংসা আর ধরে না! এরপর ময়লা কাপড় পরিয়া, গহনা ভাঙিয়া, রাগের ভরে মেঝেতে শুইতে আর কতক্ষণ লাগে।
এদিকে রাজা দশরথ রামের সংবাদ লইয়া কৈকেয়ীর মহলে আসিয়া দেখেন—কৈকেয়ীর মুখে কথা নাই গায়ে অলঙ্কার নাই, তিনি মেঝেতে পড়িয়া কেবলই কদিতেছেন। কী সর্বনাশ! কৈকেয়ীর কী হইয়াছে? কে তাহার এমন দশা করিল? বেচারা বুড়া রাজা ব্যস্ত হইয়া এইরূপ কত কথা ভাবিতে লাগিলেন। কিন্তু কে তাহাকে বলিয়া দিবে কৈকেয়ীর কী হইয়াছেঃ রাজা কত মিষ্ট করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কৈকেয়ী, তোমার কি কোন অসুখ হইয়াছে? না কেহ তোমাকে কিছু বলিয়াছে? না তুমি কাহারও উপর রাগ করিয়াছ?’ কৈকেয়ী কোন কথারই উত্তর দিলেন না।
শেষে রাজা বলিলেন, ‘তোমার কি কিছু চাই? বল সেটা কোন জিনিস, এখনই তাহা দিতেছি। তখন কৈকেয়ী বলিলেন, আগে প্রতিজ্ঞা কর দিবে, তবে বলিব। রাজা বলিলেন, এই পৃথিবীতে রামের মতন আমি কাহাকেও ভালবাসি না। সেই রামের নাম লইয়া আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি, তুমি যাহা চাইবে তাহাই দিব।’
এ কথা শুনিয়া কৈকেয়ী বলিলেন, ‘দেবতারা শুনুন, রাজা কী প্রতিজ্ঞা করিতেছেন। মহারাজ, সেই দেবাসুর যুদ্ধের কথা মনে কর। সেই যে তুমি ভয়ানক ঘা খাইয়াছিলে, আর আমি তোমাকে বাঁচাইয়াছিলাম। তখন যে আমাকে দুটি বর দিতে চাহিয়াছিলে, আর আমিবলিয়াছিলাম দরকার হইলে লইব, আজ সেই দুই বর আমাকে দিতে হইবে। এখন তুমি প্রতিজ্ঞা করিয়া যদি না দাও তবে আমি নিশ্চয় মরিয়া যাইব।’
নিষ্ঠুর কৈকেয়ী বুঝিয়াছিলেন যে রাজা একবার দিব বলিলে আর প্রাণ গেলেও দিব না’ বলিতে পারিবেন না। তাই এখন সময় বুঝিয়া বলিলেন, রামকে চৌদ্দ বৎসরের জন্য সন্ন্যাসী সাজাইয়া দণ্ডক বনে পাঠাইতে হইবে, আর ভরতকে রাজা করিতে হইবে।”
হায়, কী নিষ্ঠুর কথা! সেই ভয়ানক কথা শুনিয়াই দশরথ অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া গেলেন। খানিক পরে একটু জ্ঞান হইল। তখন তিনি ভয়ানক রাগের সহিত কৈকেয়ীর দিকে চাহিয়া বলিলেন, ওরে নিষ্ঠুর দুষ্ট কৈকেয়ী, রাম তোর কি করিয়াছে? রাম এমন করিয়া তোর সেবা করে, আর তুই কি না তাহার সর্বনাশ করিতে বসিয়াছিস? কোন দোষে আমি রামকে তাড়াইব? হায় হায়, রাম গেলে আমি বাচিব কেমন করিয়া!'
এইরূপে কৈকেয়ীকে বিস্তর গালি দিয়া, তারপর দশরথ অতিশয় কাতরভাবে বলিতে লাগিলেন, কৈকেয়ী, তোমার পায়ে পড়ি, এমন কথা মুখে আনিও না! রাম তোমার যেমন সেবা করে, ভরতও তো তেমন করে না। আর বড় ছেলেই যে রাজা হয়, তাহাও তো তুমি জান। আমার রামের কত গুণ! এমন রামকে তোমার জন্য এরূপ নিষ্ঠুর কথা আমি কী করিয়া বলিব?'
শেষে তিনি আবার বিনয় করিয়া বলিলেন, কৈকেয়ী, আমি বুড়া হইয়াছি, আর বেশীদিন বাঁচিব না। আমাকে দয়া কর! আমার আর যাহা আছে সকলই দিতেছি, তোমার পায়ে পড়ি রামকে ছাড়িবার কথা আমাকে বলিও না!
দশরথ এইরূপে কত দুঃখ কত মিনতি করিলেন, কতবার অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া গেলেন। কিন্তু নিষ্ঠুর কৈকেয়ীর কিছুতেই দয়া হইল না। তিনি বলিলেন, মহারাজ, একবার বর দিয়া আবার এমন করিয়া কাঁদিতেছ? তুমি তো খুব ধার্মিক দেখিতেছি লোকে শুনিলে বলিবে কী? তুমি যাহাই বল, ও-বর আমি কিছুতেই ছাড়িব না। রামকে যদি তুমি রাজা কর তবে তখনই আমি বিষ খাইয়া মরিব।’
আহা, বুড়া বেচারার কষ্ট! এমন দুঃখ আর কেহ কি কখন পাইয়াছেঃ রাজা কখনও কাঁদেন, কখনও কৈকেয়ীকে গালি দেন। কখনও বলেন, ‘হায়, কৌশল্যা কী বলিবেন?’ কখনও বলেন, হায় সীতার কী দশা হইবে?’ কখনও আবার অজ্ঞান হইয়া যান। জ্ঞান হইলে আবার কখনও কৈকেয়ীকে বকেন, কখনও রামের জন্য দুঃখ করেন। একবার কৈকেয়ীর পা ধরিতে গেলেন, কিন্তু ততক্ষণ তাঁহার জ্ঞান রহিল না।
এইরূপ কবিয়া সমস্ত রাত্রি কাটিয়া গেল। কৈকেয়ীর দয়া হওয়া দূরে থাকুক, তিনি আরও বিদ্রুপ করিয়া বলিতে লাগিলেন, মহারাজ, সত্য কথা বল বলিয়া যে বড় অহঙ্কার করিয়া থাক, এখন আমাকে বর দিবার বেলা তাহা কোথায় গেল? রাত ভোর হইয়া গেল, তখনও সেই একই কথা, মহারাজ, প্রতিজ্ঞা করিয়াছ, এখন বর না দিয়া যাইবে কোথায়? শীঘ্র রামকে বনে পাঠাও, আর আমার ভরতকে রাজা কর! ‘
শেষে দশরথ বুঝিতে পারিলেন যে, আর রামকে বনে না দিয়া উপায় নাই। তখন তিনি বলিলেন, আমি যখন প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, তখন আর কী বলিব? তোর যাহা ইচ্ছা কর। আমি কেবল একটিবার রামকে দেখতে চাই।’
ততক্ষণে সূর্য উঠিয়াছে সেদিনকার কাজ আরম্ভ করিবার সময় হইয়াছে। রামকে যুবরাজ করিবার সকল আয়োজন প্রস্তুত। পুরোহিত বশিষ্ঠ মুনি মন্ত্রী সুমন্ত্রকে ডাকাইয়া বলিলেন, সুমন্ত্র, সব প্রস্তুত, সকলেই আসিয়াছেন, সময়ও হইয়াছে শীঘ্র মহারাজকে সংবাদ দাও। সুমন্ত্র সংবাদ দিতে গেলেন। এদিকে যে সর্বনাশ হইয়াছে তিনি তাহার কিছুই জানেন না। তিনি অন্যান্য দিনের মত গিয়া রাজাকে বলিলেন, মহারাজ, সব প্রস্তুত এখন মহারাজের অনুমতি হইলেই রামকে যুবরাজ করা যায়।’
সুমন্ত্রের কথা শুনিয়া রাজার দুঃখ দ্বিগুণ হইয়া উঠিল। তখন সুমন্ত্র চমকিয়া গিয়া দেখিলেন যে, রাজার চোখ লাল, আর তাঁহাকে বড়ই কাতর দেখা যাইতেছে। তিনি ইহার কিছুই বুঝিতে না পারিয়া মনের দুঃখে কেবল জোড়হাত করিয়া দাড়াইয়া রহিলেন। রাজার কথা করিবার শক্তি নাই। তাহা দেখিয়া মিথ্যাবাদী কৈকেয়ী নিজেই কহিলেন, “দেখ সুমন্ত্র, রাজার মনে কিনা বড়ই আনন্দ হইয়াছে, তাই রাত্রে তাঁহার ঘুম হয় নাই। এখন তিনি একটু ঘুমাইবেন। তুমি রামকে এইখানে লইয়া আইস। একথায় সুমন্ত্র রামকে আনিতে গেলেন।
রাম তাঁহার নিজের বাড়িতে সীতার কাছে বসিয়া আছেন, এমন সময় সুমন্ত্র সেখানে গিয়া বলিলেন, “যুবরাজ, মহারাজ আর রাণী কৈকেয়ী আপনাকে দেখিতে চাহেন; শীঘ্র সেখানে চলুন। রাম তখনই তাহার সঙ্গে চলিয়া আসিলেন। আসিবার সময় পথের লোকেরা তাহার কতই প্রশংসা করিতে লাগিল, কতই আশীর্বাদ করিল।
রাজা দশরথ ভয়ানক দুঃখে অবশ হইয়া আছেন;কৈকেয়ী কাছে বসিয়া আছেন। এমন সময় রাম আসিয়া তাহদের দু-জনকে প্রণাম করিলেন। দশরথ কেবল একটিবার তাহার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “রাম!’ আর কথা বাহির হইল না; খালি চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। তাহা দেখিয়া রামের মনে কী পর্যন্ত দুঃখ আর চিন্তা হইল, সহজেই বুঝিতে পার। তিনি কৈকেয়ীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, মা, আমি কি না জানিয়া কোন দোষ করিয়াছি? বাবা কেন কথা কহিতেছেন না? তাহাকে কেন এমন কাতর দেখিতেছি? কোনও মন্দ সংবাদ আসিয়াছে কি? আপনি তো বাবাকে কিছু বলেন নাই?’
কৈকেয়ী বলিলেন, “তোমার বাবার রাগও হয় নাই, কোন বিপদও হয় নাই। রাজার একটা কাজ করিতে ইচ্ছা হইয়াছে, তোমার ভয়ে তাহা বলিতে পারিতেছেন না। রাজা যখন কাজটা করিবেন বলিয়াছেন, তখন তুমি কিন্তু তাহাতে কোনরূপ বাধা দিও না;তাহা হইলে যে পাপ হইবে! রাম বলিলেন, মা, এমন কথা কেন বলিতেছেন? বাবা যে কাজ করিবেন বলিয়াছেন, আমি কখনই তাহাতে বাধা দিব না। বাবার কথা কি অমান্য করিতে পারি?'
তাহা শুনিয়া কৈকেয়ী বলিলেন, কথাটি বাপু আর কিছুই নয়। তোমার বাবা আগে আমাকে দুটি বর দিবেন বলিয়াছিলেন, সেই বর আমি আজ চাহিয়াছি। একটা বর এই যে, তুমি মাথায় জটা লইয়া গাছের ছাল পরিয়া, চৌদ্দ বৎসরের জন্য দণ্ডক বনে যাইবে। আর একটা বর চাহিয়াছি যে এই যে সব আয়োজন হইয়াছে, তাহা দিয়া ভরতই রাজা হইবে। তুমি বাছ রাজ্যের লোভ ছাড়িয়া দাও। মহারাজের কষ্ট হইতেছে বলিয়া মুখে এ সকল কথা বলিতে পারিতেছেন না, তাই আমি বলিলাম। পিতার কথা তোমার রাখা উচিত।’
এ কথা শুনিয়া দশরথ দুঃখের নিশ্বাস ফেলিলেন। কিন্তু রাম একটুও দুঃখিত না হইয়া বলিলেন, “আচ্ছ মা, তাহাই করিব। এমন কী কাজ আছে, বাবা বলিলে যাহা না করিতে পারি?আজই ভরতকে আনিতে দূত পঠাইয়া দিন। আমিও আজই বনে চলিয়া যাইতেছি। কিন্তু বাবা কেন, নিজে আমাকে এ কথা বলিলেন না?’
কৈকেয়ী বলিলেন, “বেশ বেশ, ভরতকে আনিতে আজই ঘোড়ায় চড়িয়া লোক যাইবে। আর তুমিও দেখিতেছি বনে যাইবার জন্য বড়ই ব্যস্ত হইয়াছ। শীঘ্র যাও, শীঘ্র যাও! মহারাজের বড় লজ্জা হইয়াছে, তাই কথা বলিতেছেন না। কিন্তু তুমি যতক্ষণ চলিয়া না যাইতেছ, ততক্ষণ তাহার স্নানাহার নাই।’
এই কথা শুনিয়া দশরথ ‘হায় হায়’ করিতে করিতে আবার অজ্ঞান হইয়া গেলেন। বনে যাইবার কথায় রামের কোন কষ্টই হয় নাই, কিন্তু পিতার দুঃখে তিনি অস্থির হইলেন ‘হায়, পিতার একটু সেবাও করিতে পারিলাম না, কারণ এখনই বনে যাইতে হইবে!’ কাজেই কোন রকমে রাজাকে একটু তুলিয়া বসাইয়া তাহাকে সেখান হইতে চলিয়া আসিতে হইল।
কৈকেয়ীর ব্যবহারে লক্ষ্মণ রাগে অস্থির হইয়া উঠিলেন, কিন্তু রামের কিছুমাত্র দুঃখের ভাব দেখা গেল না। তিনি লক্ষ্মণকে সঙ্গে করিয়া ধীরে ধীরে কৌশল্যার বাড়িতে চলিলেন। সেখানে মেয়েরা সুন্দর সাজ পোশাক পরিয়া তাহারই জন্য আমোদ আহ্লাদ করিতেছিল। তাহা দেখিয়াও তাহার দুঃখ হইল না। তাহার মনে কেবল এই ভাবিয়া দুঃখ হইল যে, তিনি গেলে হয়ত তাহার পিতা মাতা মরিয়া যাইবেন।
রামের বনবাসের কথা ততক্ষণে অনেকেই শুনিয়াছে, আর সকলেই কাঁদিয়া কাঁদিয়া রাজার নিন্দা করিতেছে। কিন্তু মা কৌশল্যা তখনও ইহার কিছুই জানিতে পারেন নাই। রাম যুবরাজ হইবেন তাহাই তিনি জানেন;আর তাঁহারই জন্য মনের সুখে দেবতার পূজা করিতেছেন। এমন সময় রাম সেখানে উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে প্রণাম করিলেন। কৌশল্যা আনন্দে তাহার গায়ে হাত বুলাইতে বুলাইতে কহিলেন, বাবা, আজ তুমি যুবরাজ হইবে। আশীর্বাদ করি, অনেক দিন সুখে বাঁচিয়া থাক। ধর্মে তোমার মতি হউক, আর সকলে তোমাকে ভালবাসুক।’
রাম বলিলেন, ‘মা, তোমার বড় দুঃখের সময় আসিয়াছে। তুমি তো জান না, মা, আমি এখনই দণ্ডকবনে যাইব। মহারাজ ভরতকে রাজ্য দিবেন, আমাকে তপস্বীর বেশ ধরিয়া চৌদ্দ বৎসরের জন্য বনে যাইতে হইবে।’
আমরা অনেক সময়ে লোকের কষ্ট বুঝিতে পারি। কিন্তু হয়, আমাদের এমন কী সাধ্য আছে যে, মা কৌশল্যার প্রাণের কষ্ট বুঝিতে পারিব? তিনি অজ্ঞান হইয়া গেলেন, সকলে সেবা করিয়া তাঁহাকে সুস্থ করিল। জ্ঞান হইলে পর তিনি বলিলেন, বাছ রাম, তুমি যদি না হইতে তবে আমার এত কষ্ট হইত না। এখন তোমাকে হারাইয়া আমি কী করিয়া বাঁচিব? হায় হায়, আমার বুকটা কি লোহার, যে এত দুঃখেও ফাটিয়া গেল না? আমার কি মরণ নাই? আহা, যমের ঘরে বুঝি আমার মত দুঃখিনীর জন্য একটু জায়গা হইবে না। বাছ, তুমি যেখানে যাইবে, আমিও সেইখানে যাইব। আমাকে তোমার সঙ্গে লইয়া চল।’
কৌশল্যার দুঃখ দেখিয়া লক্ষ্মণ কাদিতে কাদিতে বলিলেন, মা, দাদা কিসের জন্য বনে যাইবেন? মহারাজ এখন বুড়া হইয়াছেন, তাহার কি মাথার ঠিক আছে? তাহ না হইলে কেন স্ত্রীর কথায় ভুলিয়া এমন লোককে বনে পাঠাইতেছেন? এমন রাজার কথা না শুনিলে কী হয়?'
তারপর তিনি রামকে বলিলেন, ‘দাদা, একবার হুকুম দাও তো দেখি কে তোমাকে রাজ্য
না দেয়! না হয় অযোধ্যার সব লোককে মারিব। বাবাকেও মারিব! আমার প্রাণ থাকিতে কাহার সাধ্য দাদাকে ঠকাইয়া ভরতকে রাজ্য দেয়! ‘ আবার তিনি কৌশল্যাকে বলিলেন, মা, আমি কি ভয় করি? তুমি আর দাদা দেখ, আমি কী করিতে পারি। বুড়ো রাজাকে এখনই মারিব!’
ইহা শুনিয়া কৌশল্যা বলিলেন, ‘শোন তো বাবা, লক্ষ্মণ কী বলিতেছে। বাবা, তুমি বনে যাইওনা। তাহা হইলে আমি কখনই বাঁচিব না। মাকে মারিলে তোমার পাপ হইবে।’
কৌশল্যার কষ্ট দেখিয়া রামের বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল। তিনি বলিলেন, মা, কাঁদিও না। বাবার কথা আমি কী করিয়া অমান্য করিব? ভাই লক্ষ্মণ, তুমি আমাকে কত ভালবাস, তাহা কি আমি জানি না? তোমার বড় কষ্ট হইয়াছে তাহা বুঝিতেছি। কিন্তু যাহাতে ধর্ম হয় তাহাই আমাদের করা উচিত। কাজেই বাবা যখন বলিয়াছেন, তখন আমায় বনে যাইতেই হইবে।’
তারপর হাত জোড় করিয়া রাম কৌশল্যাকে বলিলেন, মা, তুমি বাধা দিও না। চৌদ্দ বৎসর দেখিতে দেখিতে ফুরাইয়া যাইবে। তারপর আবার তোমার কাছে আসিব। কৌশল্যা বলিলেন, বাবা, কেবল রাজাই কি তোমার গুরু? আমি কি কেহ নই? আমাকে এত কষ্ট দিয়া তুমি কেমন করিয়া যাইবে?'
রাম বলিলেন, ‘বাবা ধর্ম ঠিক রাখিবার জন্যই আমাকে বনে পাঠাইতেছেন। আমাদের কি উচিত তাঁহার কথা অমান্য করা? মা, আমাকে বনে যাইবার অনুমতি দাও, আর আশীর্বাদ কর, যেন চৌদ্দ বৎসর পরে আবার আসিয়া তোমার পায়ের ধূলা লইতে পারি। তোমার পায়ে ধরি মা, আমাকে বাধা দিও না।’
এইরূপ করিয়া রাম কৌশল্যাকে কত বুঝাইলেন, লক্ষ্মণকেও কত বুঝাইলেন, কিন্তু কৌশল্যা তবুও বলিলেন, ‘বাবা, আমি এ দেশ ছাড়িয়া তোমার সঙ্গেই যাইব!’
রাম বলিলেন, “দেখ মা, কৈকেয়ী ছল করিয়া বাবাকে কী ভয়ানক দুঃখে ফেলিয়াছেন! আমি তো বনে চলিলাম, তারপর তুমিও যদি আমার সঙ্গে যাও, তবে কি বাবা বাঁচিবেন? মা, এমন কথা মনে ভাবিও না। যতদিন বাবা বাঁচিয়া আছেন, ততদিন তাঁহার সেবা কর। চৌদ্দ বৎসর পরে নিশ্চয় আমি আবার আসিব।’
এইরূপে রাম অনেক বুঝাইলে পর কৌশল্যা বলিলেন, ‘বাবা, কিছুতেই শুনিলে না? তুমি বনে যাইবেই? হায়, আমার কপালে বুঝি কেবল দুঃখই লেখা ছিল। তবে এস বাবা! আশীর্বাদ করি, তোমার মঙ্গল হউক। হায়, আমার ভাগ্যে কি এমন দিন হইবে যে, তুমি আসিয়া আবার আমাকে মা বলিয়া ডাকিবে?'
সীতাও বিপদের কথা কিছুই জানিতে পারেন নাই,কিন্তু রামের মুখ দেখিয়াইতিনি বুঝিতে পারিলেন যে একটা বিপদ হইয়াছে। রাম যখন বনে যাইবার কথা বলিলেন, তখন সীতা রাজ্য গেল বলিয়া কোন দুঃখ করিলেন না। তিনি কেবল বললেন, আমি তোমার সঙ্গে যাইব। রাম অনেক নিষেধ করিলেন, বনে যত ক্লেশ যত ভয় আছে, তাহদের কথা বলিয়া অনেক বুঝাইলেন। কিন্তু সীতা তাহ শুনিবেন কেন? তিনি রামের গলা জড়াইয়া ধরিয়া এমন ভয়ানক কাঁদিতে লাগিলেন যে, রাম কিছুতেই তাঁহাকে রাখিয়া যাইতে পারলেন না। কাজেই তখন আর কী করেন। তিনি বলিলেন, তবে চল, আমি যেমন করিয়া থাকিব,তুমিও তেমনি করিয়াথাকিবে। আমাদের যাহা কিছু আছে তাহা ব্রাহ্মণদিগকে, চাকব বাকরকে, আর গরিব দুঃখীকে বিলাইয়া চল আমরা শীঘ্র বনে যাই।’
লক্ষ্মণ রামের আগেই সেখানে আসিয়াছিলেন। রাম সীতার কথাবার্তা শুনিয়া তিনি বলিলেন, ‘দাদা, যদি যাইবেই, তবে আমি ধনুক বাণ লইয়া তোমার আগে আগে যাইব। আমি তোমাকে ছাড়িয়া থাকিতে পারিব না। রাম বলিলেন, সে কী ভাই, তুমি যদি যাও তবে মা কৌশল্যা আর মা সুমিত্রাকে কে দেখিবে?’ লক্ষ্মণ বলিলেন, মা কৌশল্যার জন্য কোন চিন্তা নাই। আর তিনি এত লোককে খাইতে দিতেছেন, তিনি কি মা সুমিত্রাকে দুটি ভাত দিতে পরিবেন না? দাদা, আমাকে সঙ্গে লও। আমি রোজ তোমাদের ফলমূল আনিয়া দিব।’
সুতরাং লক্ষ্মণকে সঙ্গে লইতে হইল। লক্ষ্মণ দেখিতে দেখিতে সকলের নিকট বিদায় লইয়া অস্ত্রশস্ত্র বাঁধয়া প্রস্তুত। তারপর যাহাকে যাহা দিতে হইবে রামের কথামত সকলকে তাহা দিতে লাগিলেন। চাকরেরা যাহা পাইল তাহাতে তাহাদের চিরকাল সুখে কাটিবে। তাহা ছাড়া আবার রাম তাহাদিগকে বলিলেন, যতদিন আমরা ফিরিয়া না আসি, ততদিন আমাদের বাড়িতেই থাক।’
সে দেশে ত্রিজট নামে এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। ঠাকুরটি বুড়া যতদূর হইতে হয়, আবাব গরিব তাহার চেয়েও বেশি। সেই ব্রাহ্মণ রামের দানের কথা শুনিয়া কিছু ভিক্ষাব জন্য আসিয়া উপস্থিত। রাম তাঁহাকে দেখিয়া হাসিয়া কহিলেন, “ঠাকুর, আপনি এই লাঠিটা যত দুর ছুড়িয়া ফেলিতে পরিবেন, তত দূর পর্যন্ত আমার যত গরু আছে সব আপনার।’
সেই বুড়া বামুনেব গায়ে কী জোরটাই ছিল! তখন তিনি কসিয়া কোমর বাধিয়া, ‘হেঁই— হো’ শব্দে লাঠিগাছটাকে একেবারে সরযু পার করিয়া দিলেন। ততদূব অবধি গণিয়া দেখা গেল, এক লক্ষ গরু। রাম ইহাতে যার-পর-নাই সন্তুষ্ট হইয়া সেই লক্ষ গরু তো তাঁহাকে দিলেনই, তাহা ছাড়া আরও অনেক ধন দিলেন।
এইরূপে সমস্ত ধন দান করিয়া রাম লক্ষ্মণ আর সীতা দশরথের সহিত দেখা করিবাব জন্য পথ দিয়া হাঁটিয়া চলিলেন। তাহা দেখিয়া সকলে বলিতে লাগিল, ‘হায় হায়, যে রাম কখনও একা পথ চলেন নাই, যে সীতা কখনও ঘরের বাহির হন নাই, আজ কিনা তাঁহারা এমনভাবে পথ হাঁটিয়া চলিয়াছেন! দশরথকে নিশ্চয়ই ভূতে পাইয়াছে, নহিলে এরূপ হইবে কেন? এ দেশে আমরা আর থাকিব না। চল আমরা রামের সঙ্গে বনে চলিয়া যাই কৈকেয়ী তাঁহার ছেলেকে লইয়া এইখানে পড়িয়া থাকুক!'
রামকে বিদায় দিতে দশরথের কিরূপ কষ্ট হইয়াছিল, তাহা আর আমি লিখিয়া কত জানাইব? কৈকেয়ীর ছল বুঝিতে না পারিয়া তাঁহাকে বর দিয়া বসিয়াছেন, কাজেই এখন আর নিজে কী করিয়া না’ বলেন। কিন্তু রাম তাঁহার কথায় বনে যান, ইহা তাঁহার একেবারেই ইচ্ছা নহে। তাই তিনি রামকে বলিলেন, বাছরে, তুমি আমাকে বধিয়া রাখিয়া নিজে অযোধ্যার রাজা হও। রাম বলিলেন, বাবা, আপনি আরও হাজার বৎসর বাঁচিয়া থাকিয়া সুখে রাজ্য করুন। আমি রাজ্য চাহিনা। আমি বনে গিয়া আপনার প্রতিজ্ঞা রাখিয়া, তারপর আবার আপনার পায়ের ধূলা লইতে আসিব।’
আর একটি দিন রামকে রাখিতে পারিলেও হয়ত দশরথের মনে কতটা আরাম হইত। কিন্তু আর একটি দিনও তাঁহাকে রাখিবার উপায় নাই, কারণ সেইদিনই তাঁহার যাইবার কথা।
শেষে দশরথ সুমন্ত্রকে বলিলেন, রামের সঙ্গে অনেক সৈন্য, অস্ত্রশস্ত্র আর গাড়ি ঘোড়া দাও। শহরের লোকেরা তাঁহার সঙ্গে যাউক। লোকজন, টাকাকড়ি কিছুতেই যেন তাঁহার কষ্ট না হয়।’
ইহা শুনিয়া কৈকেয়ী বলিলেন, ‘মহারাজ, সবই যদি রামের সঙ্গে পাঠাইবেন, তবে আমার ভরতের রাজা হইয়াই বা কী লাভ?
রাম বলিলেন, ‘বাবা, এ সকল কিছুই চাহি না। আমার একখানা খন্তা, একটি পেটরা, আর খানকতক ছেড়া ন্যাকড়া হইলেই চলিবে। এই কথা বলিতে বলিতেই কৈকেয়ী তিন টুকরা ন্যাকড়া লইয়া উপস্থিত। রাম, লক্ষ্মণ ভাল কাপড় ছাড়িয়া ন্যাকড়া পরিলেন। কিন্তু হায়, সীতা তো জানেন না কেমন করিয়া ন্যাকড়া পরিতে হয়! তিনি শুধু তাহা হাতে করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। সুতরাং রামকেই নিজ হাতে সেই ন্যাকড়াখানা তাঁহার রেশমী শাড়ির উপরে জড়াইয়া দিতে হইল। তাহা দেখিয়া কাহার সাধ্য চোখে জল থামাইয়া রাখে।
তখন বশিষ্ঠ সীতাকে ন্যাকড়া পলাইতে বারণ করিয়া কৈকেয়ীকে অনেক বকিলেন। দশরথও বলিলেন, ‘সীতাকে ন্যাকড়া পরাইতে হইবে এমন বর তা আমি কখনও দিই নাই। সীতা সকল রকম ধনরত্ন সঙ্গে লইয়া যাউক। সকলেব শেষে রাম হাত জোড় করিয়া দশরথকে বলিলেন, মহারাজ, আমার দুঃখিনী মাকে দেখিবেন।
এদিকে যাইবার সময উপস্থিত। সুমন্ত্র রথ সাজাইয়া প্রস্তুত। সুতরাং তিনজনে সকলকে প্রণাম কবিয়া বিদায় লইলেন। রাণী সুমিত্রা তখন লক্ষ্মণকে আশীর্বাদ করিয়া কহিলেন, ‘বাবা, তুমি রামের সহিত যাও। সকল সময় তাঁহার কাছে থাকিও। রাম ছাড়া তোমার আর কেহ নাই। রামকে মনে করিও যেন রাজা দশরথ, সীতাকে মনে করিও যেন আমি, আর বনকে মনে করিও যেন অযোধ্যা। যাও বাছা, মনের সুখে চলিয়া যাও।’
তারপর আগে সীতাকে সুন্দর কাপড় পরাইয়া রথে তুলিয়া দেওয়া হইল। পরে রাম লক্ষ্মণ অস্ত্রশস্ত্র, পেটরা, আর সীতার চৌদ্দ বৎসরের মতন কাপড় লইয়া তাঁহার সঙ্গে উঠিয়া বসিলেন। রথ চলিতে দেখিয়া সকলে পাগলের মত হইয়া তাহার সঙ্গে ছুটিল। যখন রথের সঙ্গে আর ছুটিতে পারে না, তখন তাহারা অতি কাতরভাবে সুমন্ত্রকে বলিতে লাগিল, ‘ও সুমন্ত্র, একটু আস্তে যাও! আমরা যে আর পারি না!
রাম অনেক সহ্য করতে পারিতেন, কিন্তু এতটা কী সহা যায়? নিজে দশরথ, এমনকি রাণীরা অবধি ছুটিয়া আসিতেছেন। তাঁহাদের কান্নায় বুঝি পাথরও গলিয়া যায়, মানুষ তো মানুষ। রাম অস্থির হইয়া সুমন্ত্রকে ক্রমাগত বলিতেছেন, জোরে চালাও! কিন্তু সুমন্ত্র জোরে চালাইবেন কি? এদিকে যে রাজা নিজে বলিতেছেন রথ থামাও! মা কৌশল্যা হা রাম! হা সীতা! হা লক্ষ্মণ। বলিয়া এলোচুলে পাগলিনীর মত ছুটয়া আসিতেছেন।
যাহা হউক, সুমন্ত্র যখন দেখিলেন যে রাম আর কিছুতেই সহ্য করিতে পারিতেছেন না, তখন তিনি রথ খুব জোরেই চালাইয়া দিলেন। কাজেই তখন আর রথের সঙ্গে সঙ্গে চলিতে না পারিয়া প্রায় সকলকেই ফিরিতে হইল।
দশরথকেও অনেক কষ্টে ফিরানো হইল। কিন্তু যতক্ষণ রথের ধুলা দেখা যাইতেছিল, ততক্ষণ তাঁহাকে ঘরে আনা গেল না। রথের দিকে চাহিয়া তিনি সেইখানে মাটিতে বসিয়ারহিলেন, আর দাঁড়াইবার শক্তি নাই। রথ চোখের আড়ালে চলিয়া গেল, আর বসিয়াও থাকিতে পারিলেন না।
একটু সুস্থ হইলে পরে দশরথ কৌশল্যার হাতখানি ধরিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে ঘরে চলিলেন—কৈকেয়ীর ঘরে নহে, কৌশল্যার ঘরে। কৈকেয়ী রাজাকে নিতে আসিলেন, কিন্তু রাজা বলিলেন, ‘তুই আমাকে ছুঁইস না।’
কৌশল্যার ঘরে আসিয়া দশরথ সেই যে বিছানায় শুইলেন, তাহাই তাঁহার শেষ শয়ন। কাঁদিতে কাঁদিতে সমস্ত দিন চলিয়া গেল। রাত্রিতে অনেক কষ্টে কৌশল্যাকে বলিলেন, “আমি তোমাকে দেখিতে পাইতেছি না। আমার গায়ে হাত দাও! ‘ কৌশল্যা রাজার কাছে আসিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। তাঁহার দুঃখ দেখিয়া সুমিত্রা বলিলেন, দিদি, এত দুঃখ কেন করিতেছ? রাম কেমন বীর তাহা কি জান না? লক্ষ্মণও তাহার সঙ্গে গিয়াছে, তাহদের কিসের ভয়? আবার তাহারা অযোধ্যায় ফিরিয়া আসিবে!’ সুমিত্রার কথা শুনিয়া কৌশল্যা অনেক শাস্ত হইলেন।
দশরথকে যখন ফিরাইয়া আনা হইল, তখনও অযোধ্যার অনেক লোক রথের সঙ্গে সঙ্গে ছুটিয়াছিল। তাহারা কিছুতেই ফিরিতে চাহিল না। তাহাদের মধ্যে অনেক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ ছিলেন, তাঁহাদের গায়ে জোর নাই, মাথা কাঁপে, তবুও তাঁহারা যাইবেনই। তাঁহাদের কষ্ট দেখিয়া রাম লক্ষ্মণ আর সীতা রথ হইতে নামিয়া তাঁহাদের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটিয়া চলিলেন। ব্রাহ্মণেরা বলিলেন, বাছ রাম, আমরা সঙ্গে যাইব।’
এইরূপে তাঁহারা তমসা নদীর ধারে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ততক্ষণে সন্ধ্যা হইয়াছে। কাজেই সেখানেই রাত্রিতে থাকিবার আয়োজন হইল।
ভোরে উঠিয়া রাম দেখিলেন যে, অযোধ্যার লোকেরা তখনও ঘুমাইতেছে। তখন তিনি চুপি চুপি সুমন্ত্রকে উঠাইয়া বলিলেন, ‘চল, এইবেলা আমরা চলিয়া যাই। সুমন্ত্র রথ সাজাইয়া আনিলেন, কিন্তু রাম লক্ষ্মণ ও সীতা তাহাতে চড়িয়া আর বেশি দূরে গেলেন না। খানিক পরেই তাঁহারা রথ হইতে নামিয়া সুমন্ত্রকে বললেন, তুমি রথখানিকে উত্তর দিক হইতে ঘুরাইয়া আন। শুধু রথ হালকা বলিয়া পথে কিনা তাহার দাগ পড়িবে না, তাই রাম শুধু রথখানিকে ঘুরাইয়া আনিতে দিলেন। তিনি জানিতেন যে ঐ রূপ করিলে আর অযোধ্যার লোকেরা রথের চিহ্ন দেখিয়া তাঁহাদিগকে খুজিয়া বাহির করিতে পরিবে না। তাই তাঁহারা পথ ছাড়িয়া বনের ভিতর দিয়া চলিতে লাগিলেন, আর সুমন্ত্র শুধু রথখানিকে কিছু দূরে ঘুরাইয়া আনিয়া, অন্য এক স্থান হইতে আবার তাঁহাদের তিনজনকে তুলিয়া লইলেন।
এদিকে তমসা নদীর ধারে সেই লোকগুলি জাগিয়া দেখিল যে রাম নাই। তখন তাহার এই বলিয়া কাঁদিয়া অস্থির হইল, ‘হায় হায়, কেন ঘুমাইলাম? আমাদের ভাগ্যে কি এই ছিল? রাম কি শেষে এইরূপ করিয়া আমাদিগকে ফেলিয়া গেলেন?’ কাঁদিতে কাঁদিতে তাহারা রথের চিহ্ন দেখিয়া খানিক দূরে গেল। কিন্তু তাহার পরে রথ কোনদিকে গিয়াছে আর কিছু বুঝিতে পারিল না। কাজেই তখন নিতান্ত দুঃখের সহিত তাহাদিগকে অযোধ্যায় ফিরিয়া আসিতে হইল। সমস্তদিন রথ চালাইয়া, রাম বিকালে শৃঙ্গবের নগরের নিকট গঙ্গার ধারে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানে একটি সুন্দর ইঙ্গুদী গাছ দেখিয় তিনি বলিলেন, ‘এই গাছতলায় আজ আমরা থাকিব।’এই স্থানের রাজার নাম গুহ। তিনি রামের বন্ধু। রাম আসিয়াছেন শুনিবামাত্রই গুহ তাড়াতাড়ি অনেক লোকজন আর ভাল ভাল খাবার জিনিস লইয়া সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। রামের থাকিবার জন্য সুন্দর বিছানা, ঘোড়ার জন্য ঘাস, কিছুই আনিতে তিনি বাকি রাখেন নাই। তাঁহার ইচ্ছা যে, রামকে তাঁহাদের রাজা করিয়া সেইখানেই রাখেন।
রাম আদরের সহিত তাঁহার সঙ্গে কোলাকুলি করিয়া বলিলেন, ভাই, তোমার ভালবাসাতেই আমার যার-পর-নাই সুখ হইয়াছে। কিন্তু তোমার জিনিস আমি কি করিয়া লইব?’—আমায় যে তপস্বীর মতন ফল মূল খাইয়া থাকিতে হইবে। আমাদের কিছুই দরকার নাই, কেবল ঘোড়াগুলিকে দুটি ঘাস দিতে বল। কাজেই গুহ রামকে আর পিড়াপিড়ি করিলেন না। রাম সীতা জল মাত্র খাইয়া গাছতলায় শুইয়া রহিলেন।
রাত্রিতে রাম ঘুমাইলেন, কিন্তু লক্ষ্মণ জাগিয়া পাহারা দিতে লাগিলেন। তাহা দেখিয়া গুহ মনের দুঃখে বলিলেন, ‘রাজপুত্র, আমরাই জাগিয়া বন্ধুকে পাহারা দিব, আপনি ঘুমান।’ লক্ষ্মণ বলিলেন, ‘দাদার এই দুঃখের সময় আমি কেমন করিয়া ঘুমাইব? ইহার পরে বাবা আর বেশী দিন বাঁচিবেন না। তখন মা কৌশল্যা আর সুমিত্রাও নিশ্চয়ই মরিয়া যাইবেন।’ লক্ষ্মণের আর গুহের ঘুম হইল না, সমস্ত রাত্রি তহাদের কাঁদিয়াই কাটিল।
পরদিন সকালে সুমন্ত্রকে বিদায় দিয়া আর গুহের নিকট বিদায় লইয়া রাম লক্ষ্মণ আর সীতা নৌকায় গঙ্গা পার হইলেন। বুড়া সুমন্ত্রের কি আর অযোধ্যায় ফিরিয়া যাইতে পা চলে? রামের সঙ্গে যাইবার জন্য তিনি কতই না মিনতি করিয়াছিলেন। কিন্তু রাম বলিলেন, ‘তুমি যদি অযোধ্যায় ফিরিয়া না যাও, তবে কৈকেয়ী মনে করবেন যে আমি বুঝি বনে যাই নাই। তাহা হইলে বাবাকে তিনি বড়ই কষ্ট দিবেন;তুমি শীঘ্র অযোধ্যায় ফিরিয়া যাও। সুতরাং সুমন্ত্র আর রামের সঙ্গে যাইতে পারলেন না। তিনি একদৃষ্টে রামের দিকে চাহিয়া রহিলেন। যখন আর রামকে দেখিতে পাইলেন না, তখন তাহার চোখ দিয়া ঝর-ঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল।
গঙ্গা পার হইবার পূর্বেই রাম লক্ষ্মণ বটের আঠায় জটা পাকাইয়া তপস্বী সাজিয়াছিলেন। গঙ্গা নদীর পরপারে বৎসদেশ। সেখানে হরিণ মারিয়া খাইয়া, তাহারা বর্ম পরিয়া ধনুর্বাণ হাতে বনের ভিতরে প্রবেশ করিলেন। এক রাত্রি তাহদের সেই বনের ভিতরেই কাটিল। তাহার পরদিন সন্ধ্যার সময় তাহারা প্রয়াগে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানে ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমের নিকট গঙ্গার সহিত যমুনা আসিয়া মিলিয়াছে।
রাম লক্ষ্মণ ভরদ্বাজের আশ্রমে আসিলে পর তিনি তাঁহাদিগকে অনেক আদর যত্ন করিলেন। ভরদ্বাজ রামকে তাহার আশ্রমেই রাখিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু সে স্থানের খুব কাছেই লোকজনের বাড়ি ছিল বলিয়া রামের সেখানে থাকিতে তত ভাল লাগিল না। তিনি ভরদ্বাজকে বলিলেন, দয়া করিয়া আমাদিগকে একটি নির্জন ভাল জায়গা দেখাইয়া দিন।’ ভরদ্বাজ বলিলেন, তবে তুমি এখান হইতে দশ ক্রোশ দূরে চিত্রকূট পর্বতে গিয়া বাস কর। চিত্রকূট খুব সুন্দর আর নির্জন স্থান। সেখানে ফল ফুল,নদী ঝরনা, পাখি, হরিণ অনেক আছে। সে স্থানটি তোমাদের বেশ ভাল লাগিবে।’
তাহার পরদিনই তাহারা ভরদ্বাজকে প্রণাম করিয়া চিত্রকুট যাত্রা করিলেন। পথে যমুনা নদী পার হইতে হয়। নদীর ধারে শুকনা কাঠের অভাব নাই। খসখসের দড়িতে সেই কাঠবাঁধিয়া পার হইবার জন্য ভেলা প্রস্তুত হইল। ভেলার উপর আবার জামের আর বেতের ডাল দিয়া একটা গদি করিতেও বাকি রহিল না—সীতার বসিবার জন্য একটু মোলায়েম জায়গা তো চাই! এই কারিকুরিটি অবশ্য লক্ষ্মণের; সীতার সুবিধা করিতে তিনি সর্বদা ব্যস্ত। এই ভেলায় জিনিসপত্র- সুদ্ধ তাঁহারা নদী পার হইলেন।
তারপর আগে লক্ষ্মণ, মাঝখানে সীতা, পিছনে রাম—এরূপ করিয়া তাহারা পথ চলিতে লাগিলেন। পথের দুই ধারে সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটিয়া আছে সীতা তাহা পূর্বে কখনও দেখেন নাই। তিনি তাহার মিষ্টি কথায় রামকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘এটি কী ফুল? অমনি লক্ষ্মণ তাহা তুলিয়া আনিয়া দেন।
এইরূপে এক দিন পথ চলিয়া তাহারা চিত্রকূট পর্বতের কাছে আসিলেন। সে স্থানটি অতি চমৎকার। তাহার কাছে মন্দাকিনী নামে অতিসুন্দর একটি নদী। সেই নদীর ধারে তাহারা কাঠ আর লতাপাতা দিয়া সুন্দর একখানা ঘর বাঁধিলেন। মণিমাণিক্যের কাজ করা মার্বেল পাথরের বাড়িতে থাকা যাঁহাদের অভ্যাস,এখন তাহদের থাকিবার জায়গা হইল একটি কুঁড়ে। সেই কুঁড়ে ঘরখানিতে তাহাদের বেশ সুখেই দিন কাটিতে লাগিল।
সুমন্ত্র অযোধ্যায় ফিরিয়া আসিলে তাঁহাকে দেখিয়া দশরথের দুঃখ আরও বাড়িয়া গেল। প্রথমে তিনি অজ্ঞান হইয়া গিয়াছিলেন। জ্ঞান হইলে পর জিজ্ঞাসা করিলেন, সুমন্ত্র, তুমি চলিয়া আসার সময় তাহারা কী বলিল? সুমন্ত্র বলিলেন, রাম আপনাদের সকলকে প্রণাম জানাইয়াছেন; আর বলিয়াছেন, “মাকে বলিও তিনি যেন সর্বদা বাবার সেবা কবেন। ভরতকে বলিও, তিনি যেন রাজা হইয়া বাবাকে অমান্য না করেন।” লক্ষ্মণ রাগেব সহিত বলিলেন, “সুমন্ত্র, বাবা যখন দাদাকে বনে পাঠাইয়াছেন, তখন আর তাহার উপরে আমার একটুও ভক্তি নাই।” সীতা কিছুই বলেন নাই, তিনি কেবল হেঁটমুখে চোখের জল ফেলিয়াছেন, আর এক-এক বার রামের মুখের দিকে আর রথের দিকে তাকাইয়াছেন।
ইহার পর রাজা দশরথ ক্রমেই অস্থির হইয়া পডিতে লাগিলেন। তিনি বুঝিতে পারিলেন যে তিনি আর অধিকক্ষণ বঁচিবেন না। যখন তাহার বয়স অল্প ছিল, তখন তিনি একবার অন্ধকার রাত্রিতে হাতি মনে করিয়া একটি অন্ধ মুনির ছেলেকে তীর দিয়া মারিযা ফেলেন। তাহাতে সেই অন্ধ মুনি দুঃখে মরিয়া যান, আর মরিবার পূর্বে দশরথকে এই বলিয়া শাপ দেন, “তোমার এইরূপে পুত্রের শোকে প্রাণ যাইবে।”
মৃত্যুর সময় সেই কথা মনে করিযা দশরথ দুঃখ করিতে লাগিলেন। তারপর ক্রমে তাহার শরীর অবশ হইয়া আসিল। শেষে হা রাম! হা কৌশল্যা! হা সুমিত্রা! হা রে দুষ্ট কৈকেয়ী!” এই বলিতে বলিতে রাত্রি দুই প্রহরের সময় তার প্রাণ বাহির হইয়া গেল। রামকে বনে পাঠাইয়া ছয়দিন মাত্র দশরথ বাঁচিয়া ছিলেন।
রামের জন্য ক্রমাগত কয়েক দিন দুঃখ করিয়া করিয়া সকলে একেবারে অবশ হইয়া পড়িয়াছিলেন;দশরথের মৃত্যুর সময় কেহই টের পান নাই। পরদিন দশরথকে জাগাইতে গিয়া সকলে দেখিলেন যে তিনি মরিয়া গিয়াছেন। তখন আবার কান্না আরম্ভ হইল।
এইরূপে দুঃখের উপর আবার দুঃখ আসিয়া সকলকে যে কিরূপ অস্থির করিয়াছিল, তাহা কী বলিব! এদিকে ভরত শত্রুঘ্নও বাড়ি নাই, তাহারা না আসিলে দশরথকে পোড়ানোও যাইতেছেনা। সুতরাং তাড়াতাড়ি ভরত শত্রুঘ্নকে আনিতে লোক গেল। আর যতদিন তাঁহারানা আসেন ততদিনের জন্য দশরথকে তৈলের কড়ার ভিতরে রাখিয়া সকলে তাঁহাদের পথ চাহিয়া রহিলেন।
ভরত মামার বাড়িতে সুখেই ছিলেন। এ সকল বিপদের কথা তিনি কিছুই জানিতে পারেন নাই। ইহার মধ্যে তিনি একদিন স্বপ্ন দেখিলেন যে, রাজা দশরথ অত্যন্ত ময়লা হইয়া গিয়াছেন, আর একটা পাহাড় হইতে পড়িয়া যাইতেছেন। পাহাড়ের নিচে তৈল ছিল, তিনি সেই তৈলে ডুবিয়া গেলেন। তারপর গাধার গাড়িতে চড়িয়া তিনি দক্ষিণ দিকে যাইতে লাগিলেন।
এইরূপ স্বপ্ন দেখিয়া ভরতের মন বড়ই খারাপ হইয়া গেল। তাই তিনি আর পরদিন বন্ধুগণের সহিত ভাল করিয়া আমোদ করিতে পারিলেন না। এমন সময়ে অযোধ্যা হইতে লোক আসিয়া বলিল, রাজকুমার, আপনি শীঘ্র অযোধ্যায় চলুন। সেখানে এমন কিছু হইয়াছে যে আপনার দেরি হইলে ক্ষতি হইতে পারে।’
এইসকল শুনিয়া ভরত তাড়াতাড়ি অযোধ্যায় চলিয়া আসিলেন। অযোধ্যায় আসিয়া দেখেন যে, তাহার আর আগের মত চেহারা নাই, রাস্তায় লোকজন চলিতেছে না, দোকান পাট বন্ধ, আর সকলেরই মুখ অতিশয় মলিন। দশরথের ঘরে গিয়া দেখিলেন তিনি সেখানে নাই, সুতরাং সেখান হইতে কৈকেয়ীর ঘরে গেলেন।
কৈকেয়ী হাসিভরা মুখে তাহাকে আশীৰ্বাদ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ভাল আছ তো? পথে কোন কষ্ট হয় নাই?’ ভরত বলিলেন, আসিতে একটু পরিশ্রম হইয়াছে। কিন্তু মা, এত তাড়াতাড়ি কেন আমাকে ডাকিয়া আনিলে? বাবা কোথায়? 'কৈকেয়ী বলিলেন, বাছা, তোমার বাবা মরিয়া গিয়াছেন।”
এ কথা শুনিয়া ভরত 'হায় হায়’ করিতে করিতে অজ্ঞান হইয়া গেলেন। তাহার জ্ঞান হইলে পর কৈকেয়ী বলিলেন, বাছা, তোমার বুদ্ধি হইয়াছে, তুমি কেন এত অস্থির হইতেছ?” ভরত বলিলেন, ‘হায়! বাবা আমাদিগকে ছাড়িয়া কোথায় গেলেন। মা, বাবার কী অসুখ হইয়াছিল মরিবার সময় তিনি কী বলিয়া গিয়াছেন?”
কৈকেয়ী বলিলেন, বাছা, মরিবার সময় তোমার বাবা বলিয়ছেন, “হা রাম! হা সীতা! হা লক্ষ্মণ” আর বলিয়াছেন যে, যাহাবা রামকে অযোধ্যায় ফিরিয়া আসিতে দেখিবে তাহারাই সুখী।
এ কথা শুনিয়া ভরত বলিলেন, মা, দাদা তবে এখন কোথায়? কৈকেয়ী বলিলেন, ‘তোমার দাদা সীতা আর লক্ষ্মণকে লইয়া বনে গিয়াছেন। ভরত আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘দাদা কী জন্য বনে গিয়াছেন? তিনি এমন কী অন্যায় কাজ করিয়াছেন যে র্তাহাকে বনে পাঠানো হইল?’
কৈকেয়ী বলিলেন, তিনি কোন অন্যায় কাজ করেন নাই। আমিই রাজাকে বলিয়া তাহাকে বনে পাঠাইয়াছি। রাজা আমাকে দুটি বর দিতে চাহিয়াছিলেন। আমি এই দুই বর লইয়াছি যে, রাম বনে যাইবে, আর তুমি রাজা হইবে। এখন এ সব তোমার হইল, তুমি রাজা হইয়া সুখে থাক।”
ভরতকে সুখী করিবার জন্যই কৈকেয়ী এমন পাপ করিয়াছিলেন। কিন্তু ভরত যে রামকে কতদূর ভালবাসিতেন, তাহা তিনি জানিতেন না। তাহার কাজে সুখী হওয়া দূরে থাকুক, ভরত দুঃখে আর রাগে একেবারে অস্থির হইয়া উঠিলেন। তাহার এতই রাগ হইল যে, কৈকেয়ী
তাঁহার মা না হইলে হয়ত তিনি তাহাকে মারিয়াই ফেলিতেন।
ভরত বলিলেন, ‘দাদা যদি তোমাকে এত মান্য না করিতেন, তাহা হইলে আমি তোমাকে এখনই তাড়াইয়া দিতাম! তুমি রাজার মেয়ে, আর তোমার এই কাজ! যাহা হউক, তুমি যাহা করিয়াছ তাহা আমি কখনই হইতে দিব না। আমি এখনই দাদাকে ফিরাইয়া আনিতে যাইতেছি। তোমার মত দুষ্ট স্ত্রীলোক আর এই পৃথিবীতে নাই! তুমি কেন আগুনে পুড়িয়া, না হয় গলায় দড়ি দিয়া মর না? না হয় বনেই চলিয়া যাও না?’
তারপর ভরত সকলকে ডাকিয়া বলিলেন, “আমি রাজ্য চাহি না। দাদার রাজা আমি কেন লইব? আমি মামার বাড়ি গিয়াছিলাম, ইহার মধ্যে মা এত কাণ্ড করিয়া বসিয়াছেন, আমি ইহার কিছুই জানি না। এই বলিয়া তিনি শত্রুঘ্নকে লইয়া কৌশল্যার সঙ্গে দেখা করিতে চইলেন। কৌশল্যাও ভরতের গলা শুনিতে পাইয়া তাঁহার নিকটেই আসিতেছিলেন। পথে দুইজনের দেখা হইল। ভরতকে দেখিয়া কৌশল্যা বলিলেন, বাবা, এখন তুমি তো রাজ্য পাইয়াছ, তুমি সুখে থাক। আর এই দুঃখিনীকে রামের নিকট পাঠাইয়া দাও। এই কথায় ভরত কৌশল্যার পা জড়াইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে অজ্ঞান হইয়া গেলেন। তখন কৌশল্যাও তাহাকে কোলে লইয়া কাঁদিতে লাগিলেন। তিনি বুঝিতে পারিলেন যে ভরতের কোন দোষ নাই।
দশরথ তখনও সেই কড়ার মধ্যে তৈলের ভিতরে আছেন। তাহাকে পোড়াইতে আর বিলম্ব করা যায় না। সুতরাং পরদিন বশিষ্ঠ অনেক কষ্টে ভরতকে একটু শান্ত করিয়া সেই কাজের চেষ্টা দেখিতে লাগিলেন। ক্রমে দশরথকে পোড়ানো আর তাহার শ্রাদ্ধ দি সকলই হইয়া গেল।
ইহার পর একদিন ভরত আর শত্রুঘ্ন কথাবার্তা বলিতেছেন, এমন সময় কুঁজী ভারি সাজগোজ করিয়া সখীদিগের সহিত সেখানে আসিয়া উপস্থিত। গহনা পরিয়া, চন্দন মাখিয়া, তাহার মুখে হাসি আর ধরে না! বোধ হয় মনে ভাবিয়ছিল যে খুব বড়রকমের একটা কিছু পুরস্কার পাইবে। পুরস্কারটি কী হইল, বলি শুন।
‘এই হতভাগীই সকল অনিষ্টের গোড়া! এখন ইহাকে যাহা করিতে হয় কর।’ শত্রুঘ্নও পাপিষ্ঠাকে মাটিতে আছড়াইয়া ফেলিয়া বেশ ভালমতই তাহাকে পুরস্কার দিতে আরম্ভ করিলেন। সখীরা তো ভয়ে দে ছুট। তখন ভরত বলিলেন, ‘ভাই, ওটাকে মারিয়া ফেলিও না। স্ত্রীলোককে মারিয়াছ শুনিলে দাদা রাগ করবেন। সুতরাং শক্রয় কুঁজীকে ছাড়িয়া দিলেন; কুঁজীও পলাইয়া বঁচিল।
এইরূপ করিয়া দশরথের মৃত্যুর পর তের দিন গেল। তখন একজন রাজা না হইলে কাজই চলিতেছে না। সুতরাং সকলেরই ইচ্ছা এখন ভরত রাজা হন। কিন্তু ভরত বলিলেন, ‘চল, দাদাকে লইয়া আসি। দাদাই রাজা হইবেন, আর আমি চৌদ্দ বৎসর বনে গিয়া থাকিব। তখন সকলে মিলিয়া মহা আনন্দে ভরত শক্রয়ের সঙ্গে রামকে ফিরাইয়া আনিতে চলিল। কৌশল্যা,কৈকেয়ী, সুমিত্রা হইতে আরম্ভ করিয়া, মন্ত্রী, পুরোহিত, চাকরবাকর, সিপাহী, সৈন্য, সকলেই চলিল। অযোধ্যার লোক কেহই পড়িয়া থাকিল না। রথে চড়িয়া, হাতি চড়িয়া, ঘোড়া গাধা উটে চড়িয়া, না হয় হঁটিয়া, যে যেমন করিয়া পারিয়াছে সেইরূপ করিয়াই চলিয়াছে। এক লক্ষ ঘোড়সোয়ার, নয় হাজার হাতি, যাট হাজার রথ, তাহা ছাড়া সিপাহী সাস্ত্রী আর লোকজনযে কত, তাহার ঠিকানা নাই। এমনি করিয়া তাহারা রামকে আনিতে চলিল।
তাহারা যখন গুহের দেশে আসিল, তখন গুহ এত সৈন্য আর লোকজন দেখিয়া প্রথমে একটু ভয় পাইলেন। তাই তিনি তাহার নিজের লোকদিগকে ডাকিয়া বলিলেন, ভরত কি রামের অনিষ্ট করিতে আসিয়াছেন? আমি থাকিতে তিনি তাহা পরিবেন না! চল, আমরা তাহার পথ আটকাই। আর যদি তাহার মনে কোন মন্দ ভাব না থাকে, তবে তার কোন ভয় নাই।’
এই কথা বলিয়া তিনি ভরতের সঙ্গে দেখা করিতে গেলেন। ভরতের কাছে যখন তিনি শুনিতে পাইলেন যে ভরত রামকে ফিরাইয়া আনিতে যাইতেছেন, তখন তাহার মনে খুবই সুখ হইল।
গুহকে দেখিয়া সকলে রাম লক্ষ্মণ আর সীতার সংবাদ শুনিবার জন্য তাঁহাকে ঘিরিয়া ফেলিল। বনে যাইবার সময় গুহের দেশে আসিয়া তাহারা কোথায় ছিলেন, কী খাইয়াছিলেন, কী কথাবার্তা বলিয়াছিলেন, কোন কথাইনা শুনিয়া তাহারা ছড়িল না। রাম সীতা কুশ বিছাইয়া ইঙ্গুদী গাছতলায় ঘুমাইয়াছিলেন, সেই ইঙ্গুদী গাছতলায় সেই কুশ তখনও রহিয়াছে। গুহ সকলকে তাহাও দেখাইলেন।
পরদিন গুহের লোকেরা পাঁচশত নৌকা আনিযা ভরতকে গঙ্গা পার করিয়া দিল। গুহ নিজে ভরতের সঙ্গে চলিলেন। গঙ্গা পার হইয়া ভরদ্বাজের আশ্রমে পৌছিতে তাহাদের অধিক দিন লাগিল না। ভরত রামকে আনিতে যাইতেছেন শুনিয়া ভরদ্বাজ মুনি যে কতদূর সন্তুষ্ট হইলেন, তাহা আর কী বলিব! ভরতকে তিনি বলিলেন, “তোমার লোকজন-সুদ্ধ আমার এখানে নিমন্ত্রণ খাইয়া যাইতে হইবে।’
আর, কী আশ্চর্য নিমন্ত্রণই তিনি তাহাদিগকে খাওয়াইয়াছিলেন! কেহ হয়ত বলিবে যে, মুনি এত টাকাকড়ি কোথায় পাইলেন যে ভরতের লোকদিগকে নিমন্ত্রণ খাওয়াইলেন। কিন্তু কেবল টাকা হইলেই কি সব হইল? তপস্যার দ্বারা ভরদ্বাজ যাহা করিলেন, টাকায় তাহা হয় না। মুনির তপস্যার জোরে তাহার আশ্রমে কোরমা আর পায়সের দিঘি হইল, সরবতের নদী বহিল।
ভরতের লোকেরা যে সে নিমন্ত্রণ খাইয়া অবাক হইবে তাহা আর আশ্চর্য কী? এরূপ নিমন্ত্রণ কি কেহ কোথাও খাইয়াছে? না এত আয়োজন কেহ ইচ্ছা করিলেই করিতে পারে? নিজে দেবতারা আসিয়া ভরদ্বাজের আয়োজন করিয়াছিলেন;আর গন্ধর্বেরা আসিয়া সেখানে গান গাহিয়াছিলেন।
এইরূপে ভরদ্বাজের আশ্রমে নিমন্ত্রণ খাইয়া সকলে চিত্রকূট রওয়ানা হইলেন। ভরদ্বাজ তাহাদিগকে বলিলেন, ‘তোমরা যমুনা নদীর দক্ষিণ ধার দিয়া খানিক দূরে যাও। তারপর বাম দিকে যে দক্ষিণমুখো পথ গিয়াছে সেই পথে গেলে রামের সন্ধান পাইবে।
সেই পথে অনেক দূর চলিয়া, শেষে তাহদের মনে হইল যে হয়ত রাম আর বেশী দূরে নাই। তখন দুই-এক জন লোক বনের ভিতরে ঢুকিয়া দেখিল, এক জায়গায় ধোঁয়া উঠিতেছে। তাহাতে নিশ্চয় বুঝা গেল যে, সেই বনেই রাম আছেন। তখন ভরত সঙ্গের লোকদিগকে সেখানে দাঁড়াইতে বলিয়া নিজেই তাঁহাদিগকে খুঁজতে চলিলেন।
এদিকে ভরতের লোকজন অনেক দূরে থাকিতেই রাম লক্ষ্মণ তাহদের কলরব শুনিতেপান, এবং উহা কিসের কলরব তাহা জানিবার জন্য লক্ষ্মণ একটা শাল গাছে গিয়া উঠেন। সেখান হইতে চারিদিক দেখিয়া তিনি রামকে বলিলেন, ‘দাদা শীঘ্র আগুন নিভাইয়া ফেল, আর বর্ম পরিয়া তীর ধনুক লইয়া প্রস্তুত হও! ভরত আমাদিগকে মারিয়া ফেলিতে আসিয়াছে!
এ কথায় রাম বলিলেন, ‘ভাই, ভরত কি কখনও তোমার অনিষ্ট করিয়াছে? তবে কেন তাহাকে সন্দেহ করিতেছ?”
ইহাতে লক্ষ্মণ লজ্জিত হইয়া বলিলেন, “বোধহয় বাবা তোমাকে দেখিতে আসিয়াছেন। রাম বলিলেন, তাহা হইতে পারে। আমরা বনে থাকিয়া কষ্ট পাইতেছি, তাই বোধহয় বাবা আমাদিগকে লইয়া যাইতে আসিয়াছেন। কিন্তু বাবার সঙ্গে তো সকল সময়েই প্রকাণ্ড শাদা ছাতা থাকে। সে ছাতা কই? তুমি শীঘ্র গাছ হইতে নামিয়া আইস।’
এদিকে ভরত খুজিতে খুজিতে ক্রমে রামের ঘরের কাছে আসিয়া উপস্থিত। লতাপাতার ঘরখানি, তাহার ভিতরে রামের ধনুক দেখা যাইতেছে। আরও কাছে আসিলে দেখিলেন, রাম ঘরের ভিতর চামড়ার আসনে বসিয়া সীতা ও লক্ষ্মণের সহিত কথাবার্তা বলিতেছেন; পরনে গাছের ছাল, মাথায় জটা। তাহা দেখিয়া ভরতের মনে কী কষ্টই হইল! তিনি ছুটিয়া চলিলেন, কিন্তু পৌছিবার আগেই পড়িয়া গেলেন। মুখ দিয়া কেবল ‘দাদা’ এই কথাটি মাত্র বাহির হইয়াছিল, আর কথা সরিল না। ততক্ষণে শত্রুঘ্নও কাঁদিতে কাঁদিতে আসিয়া রামের পায়ে পড়িলেন। তারপর চারি ভাই গলা জড়াইয়া কাঁদিতে লাগিলেন।
তাঁহারা একটু শাস্ত হইলে পর রাম বলিলেন, ভরত, বাবা এখন কোথায়? তুমি তাঁহাকে ছাড়িয়া কেন আসিলে?’ ভরত বলিলেন, ‘দাদা, বাবা তোমার জন্য দুঃখ করিতে করিতে স্বর্গে চলিয়া গিয়াছেন। এখন আমরা তোমাকে লইতে আসিয়াছি। তোমার পায়ে পড়ি দাদা, আমাদের সঙ্গে চল!” এই বলিয়া ভরত রামের পা জড়াইয়া ধরিলেন।
দশরথের মৃত্যুর সংবাদে রাম কাঁদিতে কাঁদিতে ভরতকে বুকে টানিয়া লইয়া বলিলেন, ভাই, বাবা যাহা বলিয়া গিয়াছেন, তাহা আমারও করা উচিত, তোমারও করা উচিত। আমাকে যখন বনে পাঠাইয়াছেন, তখন আমি অযোধ্যায় কী করিয়া যাইব? আর তোমাকে যখন তিনি রাজা হইতে বলিয়া গিয়াছেন, তখন তুমিই বা কী করিয়া সে কথা অমান্য করিবে?'
তারপর দশরথের তপণ করিবার জন্য রাম মন্দাকিনী নদীর ধারে আসিলেন। তপণ শেষ হইলে আবার কান্না আরম্ভ হইল। সেই কান্নার শব্দ শুনিতে পাইয়া ভরতের সঙ্গের লোকেরা আর দূরে বসিয়া থাকিতে পারিল না।
ততক্ষণে বেলা প্রায় শেষ হইয়া গিয়াছিল যাহা কিছু বেলা ছিল, তাহাও সকলের দেখাশুনা, প্রণাম, আশীর্বাদ ইত্যাদিতে কাটিয়া গেল। তারপর রাত্রি কেমন করিয়া কাটিল, তাহার কথা আর বেশী বলিয়া কী ফল? এত দুঃখ যাহদের, তাহারা সে রাত্রি কেমন দুঃখে কাটাইয়াছিল, তাহা তোমরা নিশ্চয় বুঝিতে পারিতেছ।
পরদিন রামকে অযোধ্যায় লইয়া যাইবার জন্য অনেক চেষ্টা হইল। কিন্তু রাম কিছুতেই যাইতে চাহিলেন না। কেবল চেষ্টা করিলে কী হইবে? তাহাকে তো এ কথা বুঝাইয়া দেওয়া চাই যে, বনে যাওয়া উচিত নহে, অযোধ্যায় ফিরিয়া যাওয়াই ভাল:নহিলে তিনি যাইবেন কেন? ভরত অনেক মিনতি করিয়াছিলেন বটে, বশিষ্ঠও নানারূপ মিষ্ট উপদেশ দিয়াছিলেন।
জাবালি নামক আর একজন পুরোহিত তাঁহার সহিত রীতিমত তর্কই জুড়িয়াছিলেন। কিন্তু শেষে সকলকেই তাঁহার নিকট হার মানিতে হইল।
তখন ভরত বলিলেন, ‘দাদা, যদি নিতান্তই না যাইবে, তবে তোমার পায়ের খড়ম দুখানি আমাকে খুলিয়া দাও। এখন হইতে এই খড়মই আমাদের রাজা। আমরা ইহার চাকর। তোমার এই খড়ম লইয়া চৌদ্দ বৎসর তোমার মত গাছের ছাল পরিয়া, ফলমূল খাইয়া, অযোধ্যার বাহিরে তোমার জন্য অপেক্ষা করিব। তাহার পরের বৎসরের প্রথম দিনে যদি তুমি ফিরিয়া না আইস, তবে আগুনে পুড়িয়া মরিব!’
রাম ভরতকে খড়ম দিয়া বলিলেন অবশ্য ফিরিব। ভাই, আমার মাকে দেখিও।’ এই বলিয়া রাম ভরতকে বিদায় দিলেন। তারপর ভরত সেই খড়মকে হাতির উপর চড়াইয়া অযোধ্যায় লইয়া আসিলেন। সেখানে রাণীদিগকে রাখিয়া তিনি মন্ত্রী আর পুরোহিতদিগকে বলিলেন, ‘দাদা যতদিন না আসেন, ততদিন আর অযোধ্যায় থাকিতে পারিব না। চলুন আমরা নন্দীগ্রামে যাই।’
নন্দীগ্রাম অযোধ্যার কাছেই। ভরত সেখানে গিয়া রামের খড়মকে সিংহাসনের উপর রাখিলেন। নিজে গাছের ছাল পরিয়া সেই খড়মের উপর ছাতা ধরিতেন, চামরের বাতাস করিতেন। রাজ্যের কোন কাজ আরম্ভ হইলে আগে খড়মের কাছে না বলিয়া কিছুই করিতেন না।
ভরত চলিয়া আসিলে পর রামের আর চিত্রকূটের কাছে থাকিতে ইচ্ছা হইল না। তাই তিনি সীতা আর লক্ষ্মণকে লইয়া সেখান হইতে অত্রি মুনির আশ্রমে চলিয়া গেলেন।
অত্রি আর তাঁহার স্ত্রী অনসূয়া দেবীর গুণের কথা কী বলিব! এমন ধার্মিক লোক অতি অল্পই দেখা যায়। তাঁহারা যে কত কাল যাবৎ তপস্যা করিতেছেন তাহা কেহ জানে না। অনসূয়া দেবী যার-পর-নাই বুড়া হইয়াছেন; তেমন বুড়া মানুষ রাম দেখেন নাই। সীতাকে অনসূয়া দেবীর এতই ভাল লাগিল যে, তিনি তাঁহাকে বর দিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। সীতা বলিলেন, ‘মা, আপনি যে সন্তুষ্ট হইয়াছেন, ইহাই আমার পরম সৌভাগ্য। ইহার পর আবার বর লইয়া কী হইবে?’
কিন্তু অনসূয়া কি তাহাতে ভোলেন? আর কিছু না হউক, একখানি পোশাক, কতকগুলি অলঙ্কার, একছড়া মালা, আর গায়ে মাখিবার খানিকটা অঙ্গরাগ তিনি সীতাকে না দিয়া ছড়িলেনই না। এইসকল জিনিস যে খুব সুন্দর ছিল, সে বিষয়ে তো কিছু সন্দেহই নাই; তাহা ছাড়া ইহাদের একটি আশ্চর্য গুণ এই ছিল যে, ইহারা কোন কালেও ময়লা হইত না।
এইরূপ আদরযত্নে অত্রি মুনির আশ্রমে এক রাত্রি থাকিয়া পরদিন সীতা ও লক্ষ্মণের সঙ্গে রাম অন্য একটি বনে চলিয়া গেলেন। সে বনের নাম দণ্ডক বন।