উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/ছেলেদের রামায়ণ/আদিকাণ্ড

আদিকাণ্ড

 নেক দিন আগে আমাদের এই ভারতবর্ষে দশরথ নামে এক রাজা ছিলেন। সরযূ নদীর ধারে, অযোধ্যা নগরে তিনি রাজত্ব করিতেন।

সেকালের অযোধ্যা নগর আটচল্লিশ ক্রোশ লম্বা, আর বার ক্রোশ চওড়া ছিল। তাহার চারিদিকে প্রকাণ্ড দেওয়ালের উপরে লোহার কাঁটা দেওয়া ভয়ঙ্কর অস্ত্রসকল সাজানো থাকিত। সে অস্ত্রের নাম শতঘ্নী, কেন না তা ছুঁড়িয়া মারিলে একেবারে এক শত লোক মারা পড়ে।

তখনকার অযোধ্যা দেখিতে খুব সুন্দরও ছিল। ছায়ায় ঢাকা পরিষ্কৃত পথ, ফুলে ভবা সুন্দর বাগান, আর দামী পাথরের সাততলা আটতলা জমকালো বাড়িতে নগরটি ঝলমল করিত।

এই সুন্দর অযোধ্যা নগরে শাদা পাথরের বিশাল রাজপুরীতে শাদা ছাতার নীচে বসিয়া মহারাজ দশরথ তাঁহার রাজ্যের কাজ দেখিতেন। ধৃষ্টি, বিজয়, অকোপ, জয়ন্ত, সুমন্ত্র, সুবাষ্ট্র, ধর্মপাল আর বাষ্ট্রবর্ধন নামে তাঁহার আটজন মন্ত্রী এমন বিদ্বান বুদ্ধিমান আব ধার্মিক ছিলেন যে, তাঁহারা দেশে একটিও অন্যায় কাজ হইতে দিতেন না। সে দেশে চোর ডাকাত ছিল না। ভাল ছাড়া মন্দ কাজ কেহ করিত না। ভাল খাইয়া, ভাল পরিয়া, ভাল বাড়িতে থাকিয়া সকলেরই সুখে দিন কাটিত। রাজা দশরথ তাহাদিগকে এত স্নেহ কবিতেন যে আর কোন রাজা তেমন করিতে পারিতেন না। দশরথকেও তাহারা তেমনি করিয়া ভালবাসিত।

হায়! এমন রাজা দশরথ, তাঁহার একটিও ছেলে ছিল না। ছেলে নাই বলিয়া তিনি ভারি দুঃখ করিতেন। একদিন তিনি মন্ত্রীদিগকে বলিলেন, ‘দেখ, আমি যজ্ঞ কবিব। হয়ত তাহাতে খুশি হইয়া দেবতারা আমাকে পুত্র দিবেন।’

এ কথা শুনিয়া সকলে বলিল, ‘মহারাজ, আপনি ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে নিয়া আসুন। তিনি যজ্ঞ করিলে নিশ্চয়ই আপনার পুত্র হইবে।’ এই মুনির হরিণের মত শিং ছিল, তাই লোকে তাঁহাকে ঋষ্যশৃঙ্গ বলিত। এমন ভাল মুনি কমই দেখা গেছে।

মন্ত্রীদিগের কথা শুনিয়া দশরথ বলিলেন, ‘বড় ভাল কথা। ঋষ্যশৃঙ্গ যে আমার জামাই হন, কারণ তিনি আমার বন্ধু লোমপাদ রাজার মেয়ে শান্তাকে বিবাহ করিয়াছেন। আমি নিজেই তাঁহাকে আনিতে যাইব।’

লোমপাদ রাজার বাড়ি অঙ্গদেশে। দশরথ সেই অঙ্গদেশে গিয়া ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে লইয়া আসিলেন। তারপর যজ্ঞ আরম্ভ হইল।

 আগে হইল অশ্বমেধ যজ্ঞ। ঘোড়ার মাংস দিয়া এই যজ্ঞ করিতে হয়। প্রথমে একটা ঘোড়া ছাড়িয়া দেওয়া হইল। ঘোড়ার সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র লইয়া অনেক লোকজনও চলিল, যাহাতে কেহ তাহাকে আটকাইতে না পারে। তাহারা ক্রমাগত এক বৎসর ঘোড়াটাকে নানা দেশ ঘুরাইয়া শেষে তাহাকে অযোধ্যায় ফিরাইয়া আনিল।

 তত দিনে শত-শত কারিকর, ছুতোর, রাজমিস্ত্রি, মুটে, মজুর মিলিয়া সরযূর উত্তর ধারে যজ্ঞের জন্য চমৎকার জায়গা তৈয়ার করিয়াছে। সেখানে কত মুনি, কত ব্রাহ্মণ, কত রাজা আর অন্য লোকজন কত আসিয়াছে, তাহার লেখাজোখা নাই। মিথিলার রাজা জনক, অঙ্গ দেশের রাজা লোমপাদ, মগধের রাজা, পূর্বদেশের রাজা, সিন্ধুদেশের রাজা, সৌবীরের রাজা, সৌরাষ্ট্রের রাজা, আর কত বলিব! পৃথিবীর যত রাজার সঙ্গে দশরথের বন্ধুতা ছিল, সকলেই উপস্থিত।

 ঘোড়া ফিরিয়া আসিলেই অশ্বমেধ যজ্ঞ আরম্ভ হইল। যজ্ঞের কয়দিন সকলে কী আনন্দ করিয়া যে নিমন্ত্রণ খাইল, তাহা কী বলিব! যত চাহিয়াছে ততই খাইতে পাইয়াছে। ব্রাহ্মণেরা ভোজনে সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, 'মহারাজের জয় হউক।' ছেলেদের পেট ভরিয়া গেল, তবুও তাহারা বলিল, 'আরও খাইব।'

 অশ্বমেধ যজ্ঞ শেষ করিয়া ঋষ্যশৃঙ্গ বলিলেন, 'এরপর পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করিলে মহারাজের ছেলে হইবে।'

 তখনই পুত্রেষ্টি যজ্ঞ আরম্ভ হইল। সেই যজ্ঞের আগুনের ভিতর হইতে একজন পুরুষ বাহির হইয়া আসিলেন। তিনি দেখিতে অতি ভয়ঙ্কর। তাঁহার শরীর পাহাড়ের মত উঁচু, রঙ কালো, চোখ লাল, দাড়ি গোঁফ সিংহের কেশরের মত, পরনে লাল কাপড়। তাঁহার হাতে রূপার ঢাকা দেওয়া সোনার থালা, তাহাতে চমৎকার পায়স। সেই ভয়ঙ্কর পুরুষ দশরথকে বলিলেন, মহারাজ, ব্রহ্মা নিজে এই পায়স রাঁধিয়া পাঠাইয়াছেন। ইহা রাণীদিগকে খাইতে দাও, নিশ্চয় তোমার পুত্র হইবে।’ এই বলিয়া তিনি কোথায় যে মিলাইয়া গেলেন, কেহ দেখিতে পাইল না।

 দশরথের কী আনন্দ! এই পায়স রাণীদিগকে খাইতে দিলেই তাঁহার পুত্র হইবে। প্রধানা রাণী তিন জন - বড় কৌশল্যা, মেজ কৈকেয়ী, ছোট সুমিত্রা। দশরথ কী করিয়া তিন জনকে পায়স বাঁটিয়া দিলেন, বলিতেছি। প্রথমেই সেই পায়সের অর্ধেকটা লইয়া খানিক সুমিত্রার জন্য আর বাকি কৌশল্যার জন্য রাখিলেন, তারপর অন্য অর্ধেকেরও খানিকটা সুমিত্রার জন্য আর বাকিটা কৈকেয়ীর জন্য রাখা হইল। বেশ সহজ হিসাব।

 তিন রাণীতে মিলিয়া মনের সুখে সেই পায়স খাইলেন। তাহার কিছুদিন পরেই তাঁহাদের দেবতার মত চারিটি ছেলে হইল— কৌশল্যার একটি, কৈকেয়ীর একটি, আর সুমিত্রার দুইটি।

 দশরথের পুত্র হইয়াছে শুনিয়া যে সকলেই আনন্দিত হইল, তাহাতে আর সন্দেহ কী? ব্রাহ্মণ আর গরিব দুঃখীদের তো খুবই আনন্দ হইবার কথা, কারণ তাহারা অনেক টাকা-কড়ি পাইল।

 ছেলে চারিটি এগারো দিনের হইলে পুরোহিত বশিষ্ঠ মুনি তাঁহাদের নাম রাখিলেন। সকলের বড় ছেলেটি কৌশল্যার, তাঁহার নাম হইল রাম। তাহার পরেরটি কৈকেয়ীর, তাঁহার নাম হইল ভরত। আর দুটি সুমিত্রার, তাঁহাদের নাম হইল লক্ষ্মণ আর শক্রঘ্ন।

 ছেলে চারিটি যেমন সুন্দর, তেমনি বুদ্ধিমান, আর তেমনি তাঁহাদের মিষ্ট স্বভাব। ভাল ছেলের যতরকম গুণ থাকিতে হয় তাহার কিছুই তাঁহাদের কম ছিল না। অল্পদিনের ভিতরেই তাহারা যার-পর নাই বিদ্বান আর বীর হইয়া উঠিলেন। লেখায়, পড়ায়, যুদ্ধে, শিকারে কোন কাজেই তাঁহাদের মতন আর কেহ ছিল না।

 ভাইকে কেমন করিয়া ভালবাসিতে হয়, তাহা রাম, লক্ষ্মণ, ভরত আর শত্রুঘকে দেখিলে বুঝিতে পারিতে। তাহার মধ্যে আবার রামকে লক্ষ্মণ আর ভরতকে শত্রুঘ্ন আরও বেশি করিয়া ভালবাসিতেন। ইহাদিগকে দেখিলে সকলেই সুখী হইত। রাজা দশরথ যে কতখানি আনন্দিত হইতেন, তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না।

 একদিন রাজা দশরথ পুরোহিত আর মন্ত্রীদিগকে লইয়া ছেলেদের বিবাহের পরামর্শ করিতেছে, এমন সময় বিশ্বামিত্র মুনি তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিলেন। মুনিদের ভিতরে বিশ্বামিত্রের মান বড়ই বেশি। তাঁহার মত তপস্যা খুব কম লোকেই করিয়াছে; তেমন ক্ষমতাও খুব কম লোকেরই আছে। তাহাতে আবার লোকটি বিলক্ষণ একটু রাগী। এরূপ লোককে যেমন করিয়া আদর যত্ন করিতে হয়, দশরথ তাহার কিছুই বাকি রাখিলেন না। তারপর তিনি বলিলেন, 'মুনিঠাকুর, আপনি যে আসিয়াছেন, ইহা আমার বড়ই সৌভাগ্য; আর ইহাতে আমি খুবই সুখী হইলাম। এখন আপনি কী চাহেন বলুন, আমি তাহাই দিতেছি।'

 দশরথ ভাবিয়াছিলেন, মুনি টাকা-কড়ি চাহিবেন। কিন্তু মুনি যাহা চাহিলেন, তাহাতে তাঁহার প্রাণ শুকাইয়া গেল। বিশ্বামিত্র বলিলেন, 'মহারাজ, আমি যেজন্য আসিয়াছি তাহা শুন। আমি একটা যজ্ঞ করিয়াছিলাম, ইহার মধ্যে মারীচ আর সুবাহু নামে দুই রাক্ষস আসিয়া তাহাতে মাংস ঢালিয়া সব নষ্ট করিয়া দিয়াছে। শুনিয়াছি রাবণ নামে একটা ভয়ানক দুষ্ট রাক্ষস আছে, ইরা তাহারই লোক। তুমি যদি দশ দিনের জন্য তোমার রামকে আমার সঙ্গে দাও, তবে সে রাক্ষসদুটাকে মারিয়া দিতে পারে। রাম ছাড়া আর কেহই এ কাজ করিতে পারিবে না। রাম এখন বড় হইয়াছে আর বীরও যেমন-তেমন হয় নাই। রাক্ষসের সাধ্য কী যে তাহার সঙ্গে যুদ্ধ করে। তোমার কোন ভয় নাই। রামকে দিয়া আমার এ কাজটি করাইয়া দাও, ইহাতে ভাল হইবে।

 মুনির কথা শুনিয়াই তো দশরথ কাঁপিতে কাঁপিতে অজ্ঞান হইয়া গেলেন। খানিক পরে একটু সুস্থ হইয়া তিনি বলিলেন, 'মুনিঠাকুর আপনার পায়ে পড়ি, আমি রামকে দিতে পারিব না। আমার রাম কি এ-সকল ভয়ানক রাক্ষসের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে পারিবে? না-হয় আমি নিজেই অনেক লোকজন লইয়া আপনার যজ্ঞে পাহারা দিব। রামকে ছাড়িয়া দিন।' ইহাতে বিশ্বামিত্র এমনই রাগিয়া গেলেন যে, তাঁহার রাগ দেখিয়া দেবতারা পর্যন্ত অস্থির।

 যে সর্বনেশে মুনি, ইঁহার আরও বেশি রাগ হইলে কি আর রক্ষা ছিল। কাজেই তখন বশিষ্ঠ মুনি রাজাকে অনেক বুঝাইয়া বলিলেন, 'মহারাজ, শীঘ্র রামকে আনিয়া দিন, ইহাতে রামের ভাল হইবে। বিশ্বমিত্র যেমন তেমন মুনি নহেন, ইঁহার সঙ্গে যাইতে রামের কোনও ভয় নাই। তাহার ভালর জন্যই বিশ্বামিত্র তাহাকে লইতে আসিয়াছেন।’ বশিষ্ঠের কথা শুনিয়া দশরথের আর ভয় রহিল না। তিনি তখনই রাম আর লক্ষ্মণকে আনিয়া দিলেন।

 যুদ্ধের পোশাক পরিয়া, তীর ধনুক খড়্গ লইয়া, বিশ্বামিত্রের পিছু-পিছু দুই ভাইকে যাইতে বড়ই সুন্দর দেখাইতেছিল। রাজা আর রাণীরা তাঁহাদের মাথায় চুমা খাইয়া তাঁহাদিগকে ছেলেদের রামায়ণ brጫ আশীৰ্বাদ করিলেন; আর সকলেই বলিল, “তোমাদের ভাল হউক!’ খানিক দূরে গিয়া বিশ্বামিত্র রামকে বলিলেন, বাছ রাম, ঐ সরযুর জলে মুখ ধুইয়া আইস। আমি তোমাকে বলা’ আর "অতি-বলা’ নামক মন্ত্র দিব। এ মন্ত্র জানিলে তোমার পরিশ্রম বা অসুখ হইবে না, কেহ তোমার কোন ক্ষতি করিতে পরিবে না, আর যুদ্ধে সকলেই তোমার কাছে হারিয়া যাইবে।” রাম নদীতে মুখ ধুইয়া মুনির নিকট মন্ত্ৰ লইলেন। তখন তাহার মনে হইল, যেন তাহার শরীরের তেজ অনেক বাড়িয়া গিয়াছে। রাত্রি হইলে তিন জনে সরযুর ধারে ঘাসের উপর ঘুমাইয়া রহিলেন। সকালবেলা উঠিয়া আবার পথ চলিতে লাগিলেন। সেদিনকার রাত্রি কাটিল অঙ্গদেশে মুনিদের আশ্রমে। এইখানে আসিয়া সরযূ নদী গঙ্গাব সহিত মিলিয়াছে। مفه مس - مست. یا به سند حده পরদিন মুনিরা একখানি সুন্দর নৌকা আনিয়া র্তাহাদিগকে গঙ্গা পার করিয়া দিলেন। বাম-লক্ষ্মণেব উপবে পাথব ছুড়িয়া মাবিতে লাগিল ওপারে ভয়ানক বন। সেই বনে তাড়কা নামে একটা রাক্ষসী থাকে। তাহার গায়ে হাজার হাতির জোর। আগে এখানে সুন্দর দেশ ছিল , তাহাতে কতই লোকজন বাস করিত। এই তাড়কা আর তাহার পুত্র মারীচ সেই সকল লোকজনকে খাইযা দেশটি একেবারে নষ্ট করিয়া ফেলিয়াছে। এখন সেখানে ভয়ানক বন, সে বনে মানুষ গেলেই তাড়কা তাহাকে ধরিয়া খায়। বিশ্বামিত্র রামকে বলিলেন, বাছা, রাক্ষসীটাকে মারিতে হইবে।” রাম বলিলেন, “আচ্ছা।’ এই বলিয়া তিনি ধনুকের গুণ ধরিয়া খুব জোরে টঙ্কার দিলেন। ধনুকের গুণ জোরে টানিয়া হঠাৎ ছাড়িয়া দিলে টং করিয়া একটা শব্দ হয়, তাহাকেই বলে টঙ্কার’। রাম ধনুকে এমনি টঙ্কার দিলেন যে, তাহা শুনিয়া বনের জন্তুরা মনে করিল বুঝি সর্বনাশ উপস্থিত। সে শব্দে তাড়কাও প্রথমে চমকিয়া গিয়াছিল। কিন্তু তাহার পরেই সে হাত তুলিয়া, হা করিয়া, ঘোরতর গর্জন করিতে করিতে আসিয়া উপস্থিত। তখন ধূলায় চারিদিক অন্ধকার করিয়া সে রাম-লক্ষ্মণের উপরে পাথর ছুড়িয়া মারিতে লাগিল। কিন্তু রামের বাণের কাছে সে পাথর কিছুই নয়। তিনি পাথর তো আটকাইলেনই, তাহার উপর আবার রাক্ষসীর লম্বা হাতদুটোও কাটিয় ফলিলেন। তবুও কিন্তু সে ছুটিয়া আসিতে ছাড়ে না। তাহ দেখিয়া লক্ষ্মণ তাহার নাক আরকান কাটিয়া দিলেন। তখন সে হঠাৎ কোথায় যে মিলাইয়া গেল, কিছুই বুঝা গেল না। হাত নাই তবুও বড় বড় পাথর ছুড়িয়া মারে, কিন্তু কোথায় আছে দেখা যাইতেছে না। তখন রাম কেবল তাহার শব্দ শুনিয়াই সেই শব্দের দিকে তীর ছুড়িতে লাগিলেন। এমন ভয়ানক তীর ছুড়িতে লাগিলেন যে রাক্ষসী তাহার জীবনে আর কখনও এত তীর খায় নাই। লুকাইয়া থাকিবার জো কী! তীরের জ্বালায় অস্থির হইয়া শেষটা তাহাকে দেখা দিতেই হইল। আর রামও অমনি এক বাণে একেবারে তাহার বুক ফুটা করিয়া দিলেন। তখন ভয়ানক চিৎকার করিয়া তাড়কা মরিয়া গেল।

 দেবতারা আকাশ হইতে রামের যুদ্ধ দেখিয়া বড়ই সন্তুষ্ট হইলেন। আর বিশ্বামিত্রের তো কথাই নাই। তিনি রামকে কি বলিয়া আশীর্বাদ করিবেন আর কী দিয়া সুখী করিবেন, তাহাই ঠিক করিতে পারিতেছেন না। সে রাত্রি তাঁহাদের সেই বনেই কাটিল। সকালে উঠিয়া বিশ্বামিত্র রামকে বলিলেন, 'বাছা, আমি তোমার উপর বড়ই সন্তুষ্ট হইয়াছি, তাই তোমাকে কতকগুলি আশ্চর্য অস্ত্র দিব। এ-সকল অস্ত্র থাকিলে কেহই তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করিতে পারিবে না।'

 এই বলিয়া বিশ্বামিত্র পূর্বমুখে বসিয়া মনে মনে অস্ত্রদিগকে ডাকিতে লাগিলেন, আর অমনি নানারূপ আশ্চর্য এবং ভয়ঙ্কর অস্ত্র সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল।

 ধর্মচক্র, কালচক্র, বিষ্ণুচক্র, ইন্দ্রচক্র, ব্রহ্মশির, ঐষিক, ব্রহ্মাস্ত্র, ধর্মপাশ, কালপাশ, বরুণপাশ, শুষ্ক অশনি, আর্দ্র অশনি, পৈনাক, নারায়ণ, শিখর, বায়ব্য, হয়শির, ক্রৌঞ্চ,কঙ্কাল, মুষল, কপাল, কিঙ্কিণী, নন্দন, মোহন, প্রস্বাপন, প্রশমন, বর্ষণ, শোষণ, সস্তাপন, বিলাপন, মাদন, মানব, তামস, সৌমন, সংবর্ত—আর কত নাম করিব। এ-সকল ছাড়া, আরও অনেকগুলি অস্ত্র, শক্তি, খড়গ, গদা, শূল, বজ্র ইত্যাদি বিশ্বামিত্রের ডাকে সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল।

 তাহারা জোড়হাত করিয়া রামকে বলিল, 'রাম, আমরা এখন তোমার হইয়াছি; তুমি যাহাই বলিবে তাহাই করিব।’ রাম একে-একে তাহাদের সকলের গায়ে হাত দিয়া বলিলেন, 'এখন যাও আমি যখন ডাকিব তখন আসিবে।' অস্ত্রেরা 'আচ্ছা তাহাই হইবে' বলিয়া যেখান হইতে আসিয়াছিল সেইখানে চলিয়া গেল।

 ইহার পর তাঁহারা একটা খুব সুন্দর স্থানে আসিলেন। সে স্থানটি দেখিয়া রাম বলিলেন, 'কী সুন্দর জায়গা। গুরুদেব, এখানে কে থাকেন?’ বিশ্বামিত্র বলিলেন, 'এই স্থানের নাম সিদ্ধাশ্রম। এখানে আগে কশ্যপ মুনি থাকিতেন। তিনি তাঁহার স্ত্রী অদিতি দেবীর সহিত এক হাজার বৎসর এইখানে থাকিয়া তপস্যা করিয়াছিলেন। তাঁহাদের তপস্যায় সন্তুষ্ট হইয়া বিষ্ণু নিজে তাঁহাদের পুত্র হইয়া জম্মেন। সেই ছেলের নাম বামন; তিনি অনেক আশ্চর্য কাজ করিয়াছিলেন। এখন আমি এই স্থানে থাকিয়া তপস্যা করি। এইখানে দুষ্ট রাক্ষসেরা আমাদের যজ্ঞ নষ্ট করিতে আসে। সেই দুষ্টদিগকে তুমি মারিবে।'

 এই কথা বলিতে না বলিতেই তাঁহারা আশ্রমে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তারপর ঠিক হইল যে, পরদিন যজ্ঞ আরম্ভ হইবে।

 যজ্ঞের দিন ভোরে উঠিয়া রাম লক্ষ্মণ বিশ্বামিত্রকে বলিলেন, 'মুনিঠাকুর, রাক্ষসেরা কখন আসিবে ঠিক করিয়া বলিয়া দিন।' বিশ্বামিত্র তখন চক্ষু বুজিয়া চুপ করিয়া বসিয়া ছিলেন, রাম লক্ষ্মণের কথায় কোন উত্তর দিলেন না। অন্য মুনিরা বলিলেন, 'রাজপুত্র, উনি মৌনে বসিয়া আছেন। উঁহাকে ছয় রাত্রি ঐরূপ চুপ করিয়া থাকিতে হইবে, কথা বলিতে পারিবেন না। এই ছয় রাত্রি তোমরা খুব সাবধান হইয়া তপোকন পাহারা দাও।' রাম লক্ষ্মণ তখনই অস্ত্রশস্ত্র লইয়া পাহারা দিতে আরম্ভ করিলেন। দিন নাই, রাত নাই, চোখে ঘুম নাই, খালি কখন রাক্ষস আসে সেইদিকেই তাঁহাদের মন।

 এইরূপে পাঁচ দিন চলিয়া গেল। ছয় দিনের দিন তাঁহারা আরও বেশি করিয়া পাহারা দিতে লাগিলেন। এমন সময় দপ্ করিয়া যজ্ঞের বেদী জ্বলিয়া উঠিল। তাহার সঙ্গে সঙ্গে আকাশে ভয়ানক শব্দ, আর যজ্ঞের জায়গায় রক্ত-বৃষ্টি। তখন রাম উপরের দিকে চাহিয়া দেখিলেন যে, মারীচ আর সুবাহুর সঙ্গে বড় বড় বিকটাকার রাক্ষসেরা দল বাঁধিয়া যজ্ঞ নষ্ট করিতে আসিয়াছে।

 তাহা দেখিয়া রাম মারীচের বুকে মানবাস্ত্র নামক বাণ ছুঁড়িয়া মারিলেন। বাণের চোটে সে বেচারা অজ্ঞান হইয়া ঘুরিতে ঘুরিতে একেবারে একশত যোজন দূরে সমুদ্রে গিয়া পড়িল। তারপর রাম আগ্নেয়াস্ত্র ছুঁড়িলে তাহার ঘা খাইয়া সুবাহু সেইখানেই পড়িয়া মরিল। বাকি রাক্ষসগুলিকে মারিতে খালি বায়ব্য অস্ত্র ছাড়া আর কিছুর দরকার লাগে নাই। তখন মুনিগণের যে কি আনন্দ হইল, তাহা কি বলিব!

 অনেক পরিশ্রমের পর সে রাত্রিতে লতা-পাতার বিছানায় রাম লক্ষ্মণ বড়ই সুখে ঘুমাইলেন। পরদিন সকালে মুনিরা বলিলেন, চল বাবা, মিথিলায় যাই। সেখানকার রাজা জনক যজ্ঞ করিকেন, তাহা দেখিতে হইবে। আর সেখানে একখানা ভয়ঙ্কর ধনুক আছে, তাহাতে এত জোর যে, দেবতা, গন্ধর্ব, রাক্ষস, মানুষ কেহই তাহাতে গুণ দিতে পারে নাই; সেই ধনুকখানাও দেখিতে হইবে। এই বলিয়া মুনিরা মিথিলায় যাইবার জন্য জিনিসপত্র বাঁধিয়া লইলেন। জিনিস নিতান্ত কম ছিল না, একশতখানা গাড়ি তাহাতেই বোঝাই হইয়া গেল।

 সবুজ শস্যের ক্ষেতের মধ্য দিয়া তাঁহাদের চলিবার পথ। সে পথে যাইতে রাম লক্ষ্মণের বড়ই ভাল লাগিতেছিল। সেদিনকার রাত্রিতে তাঁহারা শোণ নদের ধারে আসিয়া রহিলেন। তাহার পরের রাত্রি গঙ্গার ধারে, তাহার পরের রাত্রি বিশালা নগরে কাটিল। চারি দিনের দিন সকালবেলায় তাঁহারা দূর হইতে মিথিলার সুন্দর রাজপুরী দেখিতে পাইলেন। ঐ স্থানের নিকটেই একটি অতি সুন্দর আর খুব পুরাতন আশ্রম ছিল। তাহা দেখিয়া রাম বিশ্বামিত্রকে জিজ্ঞাসা করিলেন, গুরুদেব, এটি কাহার তপোবন? এখানে বেন লোকজন নাই?

 বিশ্বামিত্র বলিলেন, 'বাছা, এটি গৌতম মুনির আশ্রম। গৌতমের স্ত্রী অহল্যা একবার একটা নিতান্ত অপরাধের কাজ করাতে গৌতম তাঁহাকে এই বলিয়া শাপ দিয়াছিলেন, “তুই এইখানে ছাইয়ের উপর পড়িয়া থাক্‌। তোকে কেহ দেখিতে পাইবে না। বাতাস ভিন্ন তুই আর কিছু খাইতে পাইবি না। এইরূপে তোর অনেক বৎসর কাটিবে। তারপর যখন দশরথের পুত্র রাম এইখানে আসিবেন, তখন তাঁহার পূজা করিস। তাহা হইলে আবার তুই ভাল হইবি, আর আমিও ফিরিয়া আসিব।” এই বলিয়া গৌতম কৈলাস পর্বতে চলিয়া গেলেন। রাম, তুমি একবার এই আশ্রমের ভিতরে আইস। তাহা হইলে অহল্যা আবার ভাল হইতে পারেন।'

 গৌতমের আশ্রমে গিয়া তাঁহারা অহল্যা দেবীকে দেখিতে পাইলেন। এত দিন ধরিয়া তিনি কেবলই তপস্যা করিয়াছেন। তাহাতে তাঁহার শরীরের এমন আশ্চর্য তেজ হইয়াছে যে দেবতারাও তাঁহার দিকে তাকাইতে পারেন না। এতদিন গৌতমের শাপে কেহই তাঁহাকে দেখিতে পায় নাই। এখন রাম আসিয়াছেন বলিয়া সকলেই তাঁহাকে দেখিল। অহল্যাকে দেখিয়া রাম লক্ষ্মণ তাঁহার পায়ের ধূলা মাথায় করিয়া লইলেন। অহল্যাও গৌতমের কথা মনে করিয়া রামকে পূজা করিলেন। এদিকে গৌতম মুনি হিমালয়ে থাকিয়া তপস্যার দ্বারা সকল কথাই জানিতে পারিয়াছেন। সুতরাং তিনিও তখন সেই আশ্রমে আসিয়া উপস্থিত। এইরূপে অহল্যার দুঃখের শেষ হইল। তারপর গৌতম আর অহল্যা দুজনে মিলিয়া মনের সুখে ঈশ্বরের আরাধনা করিতে লাগিলেন।

 গৌতমের আশ্রম হইতে মিথিলা বেশি দূরে নয়। সেখানে গিয়া সকলে দেখিলেন যে, জনক রাজা অতি চমৎকার যজ্ঞের আয়োজন করিয়াছেন। কত মুনি, কত লোকজন, কত গাড়ি ঘোড়া সেখানে আসিয়াছে, তাহা গণিয়া উঠা ভার। বিশ্বামিত্র তাঁহাদের থাকিবার জন্য সেই ভিড়ের এক কোণে একটি নিরিবিলি জায়গা খুঁজিয়া লইলেন। ততক্ষণে রাজা জনকও খবর পাইয়া বিশ্বামিত্রকে আদর করিবার জন্য সেখানে আসিয়াছেন; সঙ্গে তাঁহার পুরোহিত শতানন্দ মুনি।

 বিশ্বামিত্রকে নানারূপ সম্মানে তুষ্ট করিয়া রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন, 'মুনিঠাকুর, আপনার সঙ্গের এই ছেলেদুটি কী সুন্দর’ আহা, যেন দুটি দেবতার ছেলে! এ দুটি কোন্ রাজার পুত্র? আর কি জন্য এত কষ্ট করিয়া এখানে আসিয়াছেন?’ বিশ্বামিত্র বলিলেন, 'মহারাজ, ইঁহারা অযোধ্যার রাজা দশরথের পুত্র। সিদ্ধাশ্রমে রাক্ষসদিগকে মারিয়া, তারপর গৌতমের আশ্রমে অহল্যার কষ্ট দূর করিয়া এখানে আসিয়াছেন। এখন ইঁহাদের সেই শিবের ধনুক দেখিবার ইচ্ছা।'

 জনকের পুরোহিত শতানন্দ মুনি গৌতমের বড় ছেলে। তিনি যখন শুনিলেন যে তাঁহার মাতা আবার ভাল হইয়াছে, তখন তাঁহার মনে কী সুখই হইল! তিনি রামকে কতই স্নেহ দেখাইলেন আর বিশ্বামিত্রের কত প্রশংসা করিলেন, তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না। তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, বিশ্বামিত্রই রামকে আনিয়া তাঁহার মায়ের দুঃখ দূর করিয়াছেন।

 পরদিন সকালবেলায় বিশ্বামিত্র জনককে বলিলেন, äমহারাজ, সেই ধনুকখানি রাম লক্ষ্মণ একবার দেখিতে চাহেন'।

 জনক বলিলেন, ‘ধনুকের কথা বলি শুনুন। এই ধনুক আগে ছিল শিবেব। শিব একবার দেবতাদের উপর চটিয়া গিয়া এই ধনুক হাতে তাঁহাদিগকে তাড়া করিয়াছিলেন, কিন্তু দেবতারা অনেক মিনতি করাতে খুশি হইয়া ধনুকখানা তাঁহাদিগকেই দিলেন। দেবতারা আবার রাজা দেবরাতের নিকট তাহা রাখেন। এই দেবরাত আমার পূর্বপুরুষ।

 'ইহার পর একদিন আমি লাঙ্গল দিয়া যজ্ঞের স্থান চষিতেছিলাম। এমন সময় আমার লাঙলের মুখের কাছে পৃথিবী হইতে একটি পরমা সুন্দরী কন্যা উঠিল। সেই মেয়েটি এতদিন আমার ঘরে থাকিয়া এখন বড় হইয়াছে। লাঙলের মুখে উঠিয়াছিল বলিয়া আমি তাহার নাম রাখিয়াছি সীতা। আমার প্রতিজ্ঞা এই যে, এই শিবের ধনুকে যে গুণ দিতে পারিবে তাহাকেই এই মেয়ে দিব।

 'তারপর কত রাজা আসিয়াছে, কিন্তু তাহারা ধনুকে গুণ দিবে কি, তাহা তুলিতেই পারে। তখন তাহারা ভয়ানক চটিয়া গিয়া আমার সহিত যুদ্ধ করিতে আসিল। আমি অনেক কষ্টে, দেবতাদের সাহায্য লইয়া শেষে শত্রুদিগকে তাড়াই। এখন সেই ধনুক আমি রাম লক্ষ্মণকে দেখাইব। রাম যদি তাহাতে গুণ দিতে পারেন, তবে তিনি সীতাকে পাইবেন।'

 তখন জনকের হুকুমে ধনুকখানা বাড়ির ভিতর হইতে বাহিরে আনা হইল। আট চাকার গাড়ির উপরে, লোহার সিন্ধুকের মধ্যে ধনুকখানি রহিয়াছে। তাহা টানিয়া আনিতে পাঁচ হাজার জোয়ান কাহিল! রাম সেই ধনুক দেখিয়া কহিলেন, “এটাতে গুণ দিতে হইবে নাকি?' বিশ্বামিত্র আর জনক বলিলেন, 'হ্যাঁ'।

 এত বড় ধনুক তুলিতে রামের একটু কষ্ট হইলেও তাঁহার নিন্দার কথা ছিল না। কিন্তু কষ্ট হওয়া দুরে থাকুক, বরং সে কাজটা তাঁহার খুব সহজই বোধ হইল। যেই ধনুক তোলা, অমনি তাহাতে গুণ চড়ানো। তারপর গুণ ধরিয়া এক টান দিতেই, ধনুক ভাঙিয়া একেবারে দুইখান! এমনি সহজে রাম সেই ধনুক ভাঙিলেন।

 কিন্তু রাম তাহা সহজে ভাঙিলেন বলিয়া তো ধনুকখানি সহজ ধনুক ছিল না! আর সে ধনুক ভাঙার ব্যাপারখানাও যেমন তেমন ব্যাপার হইয়াছিল বলিয়া মনে হয় না; কারণ, তাহার শব্দে বিশ্বামিত্র, জনক আর রাম লক্ষ্মণ ছাড়া সকল লোক চিৎপাত হইয়া পড়িয়া অজ্ঞান হইয়া গিয়াছিল। তখন জনক বলিলেন, 'রামের গায়ে আশ্চর্য জোর! এমন আর কাহারও নাই। আমি ইহার সঙ্গেই সীতার বিবাহ দিব।'

 তখনই পত্র লইয়া দূতেরা দশরথকে আনিতে অযোধ্যায় চলিল। দশরথও তাহাদের মুখে সকল কথা শুনিয়া আর বিলম্ব করিলেন না। পরদিনই বশিষ্ঠ আর অন্য-অন্য পুরোহিত ব্রাহ্মণ প্রভৃতিকে সঙ্গে লইয়া তিনি মিথিলা যাত্রা করিলেন। ধন-রত্ন, গাড়ি-ঘোড়া, সৈন্য-সামন্ত, কত সঙ্গে লইলেন তাহার লেখাজোখা নাই। মিথিলায় পৌঁছিতে তাঁহাদের চারি দিন লাগিল।

 রাজায় রাজায় দেখা হইলে একটা খুবই ধূমধাম হইয়া থাকে। সে আর কত বর্ণনা করিব? কিন্তু আসল কাজের কথাটা, রামের বিবাহের কথা। সে-বিষয়ের পরামর্শ কিরূপ হইয়াছিল, বলিতেছি।

 জনক রাজার আর একটি মেয়ে ছিল, তাহার নাম ঊর্মিলা। তাহা ছাড়া, জনকের ভাই রাজা কুশধ্বজের দুটি মেয়ে ছিল, তাহাদের নাম মাণ্ডবী আর শ্রুতকীর্তি। রাম, লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘু এই চারিটি ভাইয়ের সঙ্গে সীতা, ঊর্মিলা, মাণ্ডবী আর শ্রুতকীর্তি এই চারিটি বোনের বিবাহ হইলে বেশ ভাল হয়, না? সুতরাং স্থির হইল যে, রামের সহিত সীতার, লক্ষ্মণের সহিত ঊর্মিলার, ভরতের সহিত মাণ্ডবীর, আর শত্রুঘ্নের সহিত শ্রুতকীর্তির বিবাহ হইবে।

 সুন্দর সময়ে অগ্নিসাক্ষী করিয়া মহা ধুমধামে শুভকার্য শেষ হইল; সেদিন মিথিলায় কী আনন্দই হইয়াছিল! যেদিকে তাকাও কেবলই আলো, আর নিশান, আর ধূপ-ধুনা, আর মুনিঠাকুর, আর শঙ্খ-ঘণ্টা, আর ঢাক-ঢোল;আর হাতি ঘোড়া, আর মিঠাই সন্দেশ, আর ভিখারী বৈষ্ণব, আর হাসি তামাশা, ছুটাছুটি, ভোজন, ভোজন, কোলাহল, কোলাহল, কোলাহল।

 পরদিন সকালে বিশ্বামিত্র হিমালয়ে চলিয়া গেলেন। দশরথও অযোধ্যায় যাইবার আয়োজন করিতে লাগিলেন। জনক প্রত্যেক মেয়েকে কী দিয়াছিলেন শুনিবে? প্রত্যেক মেয়েকে তিনি এক-এক লক্ষ গরু দিয়াছিলেন। আর হাতি, ঘোড়া, সিপাহি, সোনা, রূপা, মণি, মুক্তা, রেশমী কাপড়, কম্বল ইত্যাদি কত যে দিয়াছিলেন, আমি তাহার হিসাব দিতে পারিব না। ইহার উপর আবার এক-এক শত করিয়া সখী, এক-এক শত দাসী, আর এক-এক শত চাকর। এইরূপে আদর যত্ন করিয়া জনক সকলকে বিদায় করিলেন। দশরথও মনের সুখে অযোধ্যায় চলিলেন।

 এমন সময় দেখ কী সর্বনাশ উপস্থিত! পাখিরা চ্যাঁচাইতেছে, জন্তুরা ছুটিয়া পালাইতেছে, পৃথিবী কাঁপিতেছে, ঝড় বহিতেছে, গাছ ভাঙিয়া পড়িতেছে, সূর্য ঢাকিয়া গিয়াছে, চারিদিক অন্ধকার। সকলে ভয়ে অস্থির, না জানি এর পর কী বিপদ হইবে।

 বিপদ যে কি, তাহা জানিতেও বিলম্ব হইল না; কারণ তখনই পরশুরাম আসিয়া উপস্থিত হইলেন। যে মানুষ পথ দিয়া চলিবার সময় এমন কাণ্ড হয়, তিনি যে কেমন ভয়ঙ্কর লোক তাহা বুঝিতেই পার। তাঁহার শরীরটা যেন একটা পাহাড়, চোখদুটো যেন আগুনের গোলা! হাতে একখানি ধনুক আছে, তাহা সেই জনক রাজার ধনুকের চেয়ে নিতান্ত কম নহে। আর একখানা কুড়াল যে আছে, তাহার কথা কি বলিব! কুড়াল কাঁধে ফিরেন বলিয়া তাঁহার 'পরশু' অর্থাৎ ‘কুড়ুলে’ রাম নাম হইয়াছে (পরশু অর্থে কুড়াল)। এই কুড়াল দিয়া তিনি, একবার নয়, দুবার নয়, ক্রমাগত একুশবার ক্ষত্রিয়দিগকে কাটিয়া খণ্ড-খণ্ড করিয়াছেন। তাহাদের অপরাধ এই যে, কার্তবীর্যার্জুন নামক তাহাদের একজন তাঁহার বাপ জমদগ্নি মুনিকে মারিয়া ফেলে।

 এতদিনে তাঁহার রাগটা একটু কমিয়া গিয়াছে। এখন আর ক্ষত্রিয় দেখিলেই তাহাকে ধরিয়া মারেন না। কিন্তু রামের উপর তিনি বড়ই চটিয়া গিয়াছেন। তিনি আসিয়া রামকে সম্মুখে দেখিতে পাইয়াই বলিলেন 'তুমি নাকি বড় বীর হইয়াছ? শিবের ধনুক ভাঙিয়াছ? বটে! আচ্ছা, আমি এই আর-একখানি ধনুক আনিয়াছি। এখানিতে একবার তীর চড়াইয়া টান দেখি! যদি পার, তবে তোমার সহিত যুদ্ধ করিব।'

 ইহা শুনিয়া দশরথের বড় ভয় হইল। তিনি মনে করিলেন, না জানি এই সর্বনেশে মানুষ রামের কী ভয়ানক অনিষ্টই করিবেন! তাই তিনি রামকে ছাড়িয়া দিবার জন্য পরশুরামকে অনেক মিনতি করিলেন। কিন্তু পরশুরাম কি তাহা শোনেন। তিনি রামকে বলিলেন, ‘বিশ্বকর্মা দু-খানি বড় ধনুক প্রস্তুত করিয়াছিলেন; তাহার একখানি তুমি ভাঙিয়াছ, আর একখানি এই আমার হাতে আছে। এখানি সেখানার চেয়ে কম নয়। এখন বলিতেছি, আমার এই ধনুকখানিতে তীর চড়াও, দেখি তুমি কেমন ক্ষত্রিয়!'

 ক্ষত্রিয়কে 'দেখি তুমি কেমন ক্ষত্রিয়’ বলিলে বড়ই অপমানের কথা হয়। সে তাহা কিছুতেই সহিয়া থাকিতে পারে না। কাজেই তখন রাম বলিলেন, 'আচ্ছা তবে দেখুন।’ এই বলিয়া তিনি ধনুকখানি লইয়া তাহাতে গুণ দিলেন। তারপর একটি বাণ তাহাতে চড়াইয়া বলিলেন, মুনিঠাকুর, আপনি ব্রাহ্মণ, আমার গুরুলোক; তাই এই বাণ আমি আপনার উপর ছুঁড়িতে ইচ্ছা করি না; কেন না, তাহা হইলে আপনি মরিয়া যাইবেন। তবে আপনি তপস্যা করিয়া যে সকল জায়গা পাইয়াছে, আমি ইচ্ছা করিলে তাহা নষ্ট করিয়া দিতে পারি, না হয় আপনার আকাশে চলাফেরার পথ বন্ধ করিয়া দিতে পারি। এখন বলুন ইহার কোন্‌টা করিব?

 এতক্ষণে পরশুরামের সে রাগ নাই। তিনি খুবই জব্দ হইয়া গিয়াছেন। তাই তিনি নরম হইয়া বলিলেন, 'রাম, আমার তপস্যায় পাওয়া স্থানগুলিই না হয় নষ্ট করিয়া দাও, কিন্তু আমার পথ আটকাইও না। তোমার ভাল হউক। আমি বুঝিতে পারিয়াছি তুমি যে-সে লোক নহ।' সুতরাং রাম তীর ছুঁড়িয়া পরশুরামের তপস্যায় পাওয়া জায়গাগুলি নষ্ট করিয়া দিলেন; তাঁহার পথ আটকাইলেন না। তখন পরশুরাম সেখান হইতে চলিয়া গেলেন, আর আর সকলে অযোধ্যায় চলিয়া আসিল।

 তারপর রাণীরা কত আদর করিয়া বউ ঘরে লইলেন সে আর বেশী করিয়া কি বলিব? সে সময় পূজা অর্চনা, গান বাজনা, আমোদ আহ্লাদ অবশ্যই হইয়াছিল। রাণীরা বউদিগকে আশীর্বাদ করিয়া বসন ভূষণ কত কী দিয়াছিলেন, সে খবর কে রাখে!

 আমি কেবল ইহাই জানি যে, ইহার কিছুদিন পরে ভরত আর শত্রুঘ্ন মামার বাড়ি বেড়াইতে গেলেন।