উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/ছেলেদের রামায়ণ/কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড

কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড

 ম্পা নদী পার হইলে ঋষ্যমূক পর্বত। সেই ঋষ্যমূক পর্বতের নিকটে বানর দিগের রাজা সুগ্রীব আর কয়েকটি বানর সঙ্গে লইয়া বেড়াইতেছিল। বেড়াইতে বেড়াইতে সে দেখিল যে, দুইজন মানুষ সেই দিকে আসিতেছে।

এই দুইজন অবশ্য রাম ও লক্ষ্মণ ছাড়া আর কেহ নহেন। কিন্তু সুগ্রীবের মনে সর্বদাই বালীর ভয় লাগিয়া ছিল। বালী তাহাকে রাজ্য হইতে তাড়াইয়া দিয়াছে, আবার কখন হয়ত তাহার লোক আসিয়া তাহাকে মারিবে। এইজন্য রাম লক্ষ্মণকে দেখিয়াই সে ভাবিল, বুঝি তাঁহারাও বালীরই লোক। তাই সে সঙ্গের—বানরদিগকে ডাকিয়া বলিল, ‘সর্বনাশ হইয়াছে, এই দুজন নিশ্চয়ই বালীর লোক!’ এই কথা শুনিয়া অন্যান্য বানরদিগের মনেও ভারি ভয় হইল।

কিন্তু উহাদিগের মধ্যে হনুমান বলিয়া একজন ছিল, সে বলিল, ‘কিসের ভয়? বালী তো ঋষ্যমূক পর্বতে আসিতেই পারে না, আর ঐ লোকদুইটির সঙ্গেও তাহাকে দেখিতেছি না।’ তাহা শুনিয়া সুগ্রীব বলিল, ‘ও দুইজনকে দেখিয়া আমার বড়ই ভয় হইতেছে। উহারা বালীর লোক হইতেও পারে। হনুমান, তুমি একবার গিয়া জানিয়া আইস না, উহারা কিরূপ লোক, আর কেন এখানে আসিয়াছে!’

হনুমান তখন দাড়ি গোঁফ পরিয়া একটি ভিখারী সাজিল। তারপর রাম লক্ষ্মণের কাছে গিয়া মিষ্ট কথায় বিনয় করিয়া বলিতে লাগিল, মহাশয়, আপনারা কে? কী জন্যই বা এখানে আসিয়াছেন? আপনাদের দেখিলে যেমন তেমন লোক বলিয়া বোধ হয় না! এমন সুন্দর চেহারা, হাতে চমৎকার অস্ত্র, আর শরীরে বোধ হইতেছে যেন কতই জোর! এই ঋষ্যমূক পর্বতে বানরের রাজা সুগ্রীব থাকেন। তাঁহার ভ্রাতা বালী তাঁহাকে রাজ্য হইতে তাড়াইয়া দেওয়াতে তিনি মনের দুঃখে বনে বনে ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন। সুগ্রীব খুব বীর, আর বড়ই ধার্মিক। তিনি আপনাদের সহিত বন্ধুতা করিতে চাহেন, এবং সেইজন্যই আপনাদের নিকট পাঠাইয়াছেন। আমি তাহার মন্ত্রী, আমার নাম হনুমান। আমি পবনের পুত্র, জাতিতে বানর।’

হনুমানের কথা শুনিয়া রাম লক্ষ্মণকে বলিলেন, ‘আমি সুগ্রীবকে খুঁজতেছি, এমন সময় তাহার মন্ত্রী আসিয়া উপস্থিত হইল। লোকটিকে অতিশয় বিদ্বান, বুদ্ধিমান আর বীর বলিয়া বোধ হইতেছে ইহার কথাগুলি কী মিষ্ট আর কেমন শুদ্ধ! এতক্ষণ কথা কহিল, তবুও একটা পাড়াগেয়ে কথা উহার মুখ দিয়া বাহির হইল না। লক্ষ্মণ, তুমি ইহার সঙ্গে কথাবার্তা বল।’

তখন লক্ষ্মণ বললেন, ‘আমরাও সুগ্রীবকে খুজিতেছি। আমরা অযোধ্যার রাজা দশরথের পুত্র। ইহার নাম রাম, আমার নাম লক্ষ্মণ। আমি ইহার ছোট ভাই সৎমার ছলনায় ইনি আমাকে



লইয়া বনে আসিয়াছেন। ইহার স্ত্রী সীতাদেবীও সঙ্গে আসিয়াছিলেন। কিন্তু কোন দুষ্ট রাক্ষস তাঁহাকে কোথায় লইয়া গিয়াছে, তাহার কিছুই জানি না। শুনিয়াছি তোমাদের রাজা সুগ্রীব খুব বুদ্ধিমান। হয়ত তিনি সেই রাক্ষসকে জানেন। তাই রাম তাঁহার সহিত বন্ধুতা করিতে আসিয়াছেন।’

 হনুমান বলিল, সুগ্রীব অবশ্যই ইহার সহিত বন্ধুতা করিবেন, আর বানরদিগকে লইয়া সীতাকে খুঁজিবার সাহায্য করবেন। বালীর ভয়ে তিনি বনে বনে ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন, সুতরাং আপনাদের আসাতে তাঁহারও উপকার হইতে পারে।’

 তারপর হনুমান রাম লক্ষ্মণকে পিঠে করিয়া সুগ্রীবের নিকট লইয়া গেল। সুগ্রীব রামের পরিচয় পাইয়া বলিল, ‘রাম, তুমি পৃথিবীর মধ্যে সকলের বড় আর আমি বানর। তুমি আমার সহিত বন্ধুতা করিতে আসিয়াছ, আমার কী সৌভাগ্য! ‘

 তখনই হনুমান দুইখানি কাঠ ঘষিয়া আগুন জ্বালিল। সেই আগুনের সম্মুখে সুগ্রীব রামের সহিত কোলাকুলি করিয়া বলিল, “তুমি আমার বন্ধু হইলে। এখন হইতে তোমার যাহা ইচ্ছা, আমরাও তাহাই ইচ্ছা হইবে। যাহাতে তোমার সুখ হয়, তাহাতে আমারও সুখ হইবে, আর যাহতে তোমার দুঃখ হয়, তাহাতে আমারও দুঃখ হইবে। এইরূপে রাম আর সুগ্রীবের বন্ধুতা হইয়া গেল। তারপর তাঁহারা গাছের পাতার বিছানায় বসিয়া নিজ-নিজ সুখ-দুঃখের কথা কহিতে লাগিলেন।

 রাম বলিলেন, ‘বন্ধু, আমি বালীকে মারিয়া তোমার ভয় দূর করিব।” সুগ্রীব বলিল, বন্ধু, তুমি সাহায্য করিলে আমি যে আবার রাজ্য পাইব, তাহতে সন্দেহ কী? তোমার কষ্টও দূর করিয়া দিব। সীতা যেখানেই থাকুন, আমরা তাঁহাকে খুজিয়া বাহির করিবই করিব। কেহই তাঁহাকে লুকাইয়া রাখিতে পরিবে না। সেদিন এইখান দিয়া রাবণ একটি মেয়েকে লইয়া যাইতেছিল। বোধহয় তিনিই সীতা। তিনি তোমার নাম ধরিয়া কাঁদিতেছিলেন। আমাদিগকে দেখিতে পাইয়া গায়ের চাদর আর গহনা ফেলিয়া গেলেন। আমরা তাহা পর্বতের গুহায় লুকাইয়া রাখিয়াছি, দেখিলে হয়ত চিনিতে পরিবে।’

 এই বলিয়া সুগ্রীব সীতার সেই সকল অলঙ্কার আর কাপড় আনিয়া রামকে দেখাইল। সীতার গায়ের চাদর, তাঁহার দুইখানি নূপুর, তাঁহার কেয়ুর আর কুণ্ডল—এ সকল দেখিয়া রাম চিনিতে পারিলেন। তখন তাঁহার দুঃখ যেন আরও বাড়িয়া গেল। সুগ্রীব তাঁহাকে অনেক বুঝাইয়া বলিল, বন্ধু, দুঃখ করিও না। আমরা নিশ্চয়ই সীতাকে আনিয়া দিব।’ এইরূপে দুই বন্ধুতে দুজনার দুঃখ দূর করিবার জন্য প্রতিজ্ঞা করিলেন।

 তারপর সুগ্রীব আর বালীর ঝগড়ার কথা উঠিল। একটা অসুর ছিল, তাহার নাম মায়াবী। সে দুন্দুভি নামক দানবের বড় ছেলে। একবার বালীর সঙ্গে মায়াবীর যুদ্ধ হয়। তখন বালীর তাড়া খাইয়া সে একটা প্রকাণ্ড গর্তের ভিতরে গিয়া ঢোকে। বালীও সুগ্রীবকে সেই গর্তের মুখে রাখিয়া সেই অসুরের সঙ্গে সঙ্গে তাহার ভিতরে ঢুকিল।

 সুগ্রীব এক বৎসর সেই গর্তের মুখের কাছে বসিয়া রহিল কিন্তু বালী ফিরিল না। শেষে গর্তের ভিতর হইতে গরম রক্ত বাহির হইতে লাগিল, অসুরদিগের ভয়ানক গর্জন শোনা গেল। তাহাতে সুগ্রীব মনে করিল, বুঝি বালী মারা গিয়াছে। তখন সে অসুরের ভয়ে গর্তের মুখে এক প্রকাণ্ড পাথর চাপা দিয়া, কাঁদিতে কাঁদিতে কিষ্কিন্ধ্যায় ফিরিয়া আসিল। সেখানকার

লোকেরা বালী মরিয়াছে জানিয়া সুগ্রীবকে রাজা করিল।

 ইহার পর বালী ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, সুগ্রীব রাজা হইয়াছে। তখন সে বলিল, আমি সুগ্রীবকে গর্তের মুখে রাখিয়া অসুর মারিতে গিয়াছিলাম। ইহার মধ্যে হতভাগা আমার রাজ্য লইবার ফন্দি করিয়া আমাকে পাথরচাপা দিয়া আসিয়াছে।’ এই বলিয়া সে সুগ্রীবকে অনেক কষ্ট দিয়া তাড়াইয়া দিল। তাহার কোন কথাই শুনিল না।

 তাহার পর হইতে সুগ্রীব বালীর ভয়ে ঋষ্যমূক পর্বতে আসিয়া বাস করিতেছে। মতঙ্গ মুনির শাপে বালী ঋষ্যমূক পর্বতে আসিতে পারে না। কাজেই সেখানে থাকিলে সুগ্রীবের ভয় অনেকটা কম থাকে।

 রাম বালীকে মারিবেন শুনিয়া সুগ্রীব খুব সন্তুষ্ট হইল। কিন্তু এ কাজ তিনি করিতে পরিবেন কি না, সে বিষয়ে তাহার মনে সন্দেহ ছিল। বালী যেমন তেমন বীর ছিল না। সকালে উঠিয়া সে চার সাগরের জল দিয়া আহ্নিক করিত পর্বতের চূড়া লইয়া গোলা খেলিত।

 দুন্দুভি নামে মহিষের চেহারাওয়ালা একটা অসুর ছিল। সে এমন প্রকাণ্ড ছিল, আর তাহার গায়ে এতই জোর ছিল যে, কেহই তাহার সঙ্গে যুদ্ধ করিতে সাহস পাইত না। দুন্দুভি সমুদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে গেল;সমুদ্র হাতজোড় করিয়া বলিল, আমি পারিব না, হিমালয়ের কাছে যাও। হিমালয়েব কাছে গেলে হিমালয় বলিল, “আমি কি যুদ্ধ জানি? আমি অমনি হার মানিতেছি।’ তখন দুন্দুভি বলিল, তবে আমি কাহার সঙ্গে যুদ্ধ করিব শীঘ্র বল, নহিলে তোমাকে গুতাইয়া গুড়া করিব।’ হিমালয়ে বলিল, কিষ্কিন্ধ্যায় বানরের রাজা বালী থাকেন। তাহার কাছে যাও। তিনি তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করিতে পরিবেন।’

গর্জন শুনিয়া বালী সেখানে আসিলে দুন্দুভি বলিল, “তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করিব। তখন বালী দুই হাতে তাহার দুইটা শিং ছিঁড়িয়া ফেলিল। তারপর তাহার লেজ ধরিয়া তাহাকে মাটিতে খালি আছাড়ের পর আছড়—ঠিক যেমন করিয়া ধোপা কাপড় কাচে। এইরূপে সেটা মরিয়া গেলে পর তার লেজ ধরিয়াই ঘুরাইতে ঘুরাইতে তাহাকে একেবারে চার ক্রোশ দূরে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল। সেই সময় দুন্দুভির রক্ত মতঙ্গ মুনির আশ্রমে গিয়া পড়ে। তাহাতে সেই মুনি বালীকে এই বলিয়া শাপ দেন যে, সে সেখানে গেলেই মাথা ফাটিয়া যাইবে। মাথা ফাটিবার ভয়ে বালী আর সেখানে আসে না। দুন্দুভির হাড়গুলি তখনও ঋষ্যমূক পর্বতে পড়িয়া ছিল। সুগ্রীব রামকে তাহা দেখাইল। বালীর গায়ে কি যেমন-তেমন জোর ছিল! সাতটা বড় বড় শালগাছ একসঙ্গে ধরিয়া বালী তাহাতে এমনি নাড়া দিতে পারিত যে, সেইনাড়াতেই তাহদের সমস্ত পাতা ঝরিয়া পড়িত।

 কাজেই বালীকে সুগ্রীব এত ভয় করিত। আর সেইজন্যই রাম তাহাকে মারিতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে তাহার সন্দেহ হইল। তাহার ভয় দেখিয়া লক্ষ্মণ জিজ্ঞাসা করিলেন, আচ্ছা, কী করিলে তোমার বিশ্বাস হইবে যে দাদা বালীকে মারিতে পারিবেন? সুগ্রীব বলিল, ঐ যে সাতটা তালগাছ দেখিতেছ, বালী তাহার এক একটাকে একেবারে এপিঠ ওপিঠ করিয়া ফুড়িয়া ফেলিতে পারেন। রাম যদি ঐ দুন্দুভির হাড় দুইশত ধনু দূরে ফেলিতে পারেন, আর বাণ মারিয়া একটা তালগাছ ফুটা করিতে পারেন, তবে বুঝিব তিনি বালীকে মারিতে পারবেন।’

 এই কথা শুনিয়া রাম হাসিতে হাসিতে পায়ের বুড়া আঙুল দিয়া দুন্দুভির সেই পাহাড়ের মত হাড়গুলিকে ঠেলিয়া দিলেন, আর সেগুলি একেবারে চল্লিশ ক্রোশ দূরে গিয়া পড়িল। কিন্তু তাহাতেও সুগ্রীবের সন্দেহ গেল না। সে বলিল, ‘এখন কিনা হাড়গুলি শুকাইয়া হাল্কা হইয়া গিয়াছে এখন তো এত দুরে ফেলিতে পরিবেই। বালী আস্ত মহিষটাকে ফেলিয়াছিলেন, সেটা তখন মাংস আর চর্বিতে ইহার চেয়ে কত ভারী ছিল! আচ্ছা, একটা তালগাছ ফুটা কর দেখি!’

 তাহা শুনিয়া রাম একটা বাণ মারিলেন। সে বাণ একেবারে সেই সাতটা তালগাছকে ফুড়িয়া, পাহাড়টাকে সুদ্ধ ফুঁড়িয়া পাতালে ঢুকিয়া গেল। পাতালে গিয়াও কিন্তু সে থামিল না, থামিল আসিয়া রামের তুণে। তখন সুগ্রীব তাড়াতাড়ি রামের পায়ের ধূলা লইতে পারিলে বাঁচে। সে বুঝিতে পারিল যে, ভাল করিয়া রামের এক বাণ খাইলে বালী নিশ্চয় মরিয়া যাইবে।

 তবে আর কিসের ভয়! এখন কিষ্কিন্ধ্যায় গিয়া বালীর সঙ্গে যুদ্ধ বাধাইতে পারিলেই কাজ হইবে। সুতরাং সকলে মিলিয়া কিষ্কিন্ধ্যায় আসিল।

 সেখানে আসিয়া সুগ্রীব কোমরে কাপড় জড়াইয়া, আকাশ ফাটাইয়া চিৎকার করিতে লাগিল, ‘কোথায় গেল দাদা? আইস দেখি, একবার যুদ্ধ করি!’ তাহা শুনিয়া রাগে বালীর রক্ত গরম হইয়া উঠিল। আর কি সে বসিয়া থাকিতে পারে! তখনই দাঁত কড়মড় করিতে করিতে ঝড়ের মতন আসিয়া উপস্থিত। তখন দুইজনে কী ভয়ানক যুদ্ধ হইল, তাহা কী বলিব! কিল আর চড়ের চোটে দুইজনের মুখ দিয়াই রক্ত উঠিতে লাগিল।

 এদিকে রাম বড়ই ভাবনায় পড়িয়াছেন। বালী আর সুগ্রীব দেখিতে একই রকম। তিনি মনে করিয়াছিলেন যে যুদ্ধের সময় বালীকে বাণ মারিবেন। কিন্তু এখন কোনটা যে বালী, তাহা তিনি বুঝিতেই পারিতেছেন না। বাণ মারিলে তাহতে বালী না মরিয়া যদি সুগ্রীব মরিয়া যায়, তবে তো সর্বনাশ!

 কাজেই তখন আর বাণ মারা হইল না। সে-যাত্রা সুগ্রীবকে কেবল অনেকগুলি কিল চড় খাইয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে ঋষ্যমূক পর্বতে পালাইয়া আসিতে হইল। সেখানে আসিয়া যে রামকে বলিল, ‘বন্ধু, এই বুঝি তোমার কাজ! তোমার কথায় আমি বালীর সঙ্গে যুদ্ধ করিতে গিয়া এতগুলি মার খাইলাম, আর তুমি চুপ করিয়া তামাশা দেখিলে!’

 তখন রাম তাহকে বুঝাইয়া দিলেন, ‘বন্ধু, রাগ করিও না। আমি যে কেন বাণ মারি নাই, তাহা শোন। তুমি আর বালী দেখিতে ঠিক একইরকম। কাজেই তোমাদের কোনটি কে, আমি কিছুই বুঝিতে পারি নাই। বালীকে মারিতে গিয়া যদি তোমাকে মারিয়া ফেলিতাম, তাহ হইলে লোকে আমাকে কী বলিত? তুমি আবার যুদ্ধ কবিতে যাও, আর এমন একটা কোন চিহ্ন লইয়া যাও যাহাতে আমি তোমাকে চিনিতে পারি। তাহা হইলে দেখিবে, এক বাণেই আমি বালীকে মারিয়া ফেলিব।’

 এই কথা বলিয়া তিনি লক্ষ্মণকে বলিলেন, ‘লক্ষ্মণ, তুমি ফুল-শুদ্ধ ঐ নাগপুষ্পী লতাটি আনিয়া সুগ্রীবের গলায় বাধিয়া দাও।’ লক্ষ্মণ তাহাই করিলেন।

 এবারে সুগ্রীবের মনে খুবই সাহস। সুতরাং সে আগের চেয়ে অনেক বেশী করিয়া চ্যাঁচাইতে লাগিল। তাহ শুনিয়া বালীও বাহির হইয়া আসিতে আর বিলম্ব করিল না। রাগ দু-জনেরই সমান। দুজনেই বলে, ‘ঘুঁষি মারিয়া তোর মাথা গুঁড়া করিয়া দিব।’ আর যুদ্ধও যেমন-তেমন হইল না। কিল, চড়, লাথি, গুঁতা,আঁচড়, কামড়, কোনটারই ক্রটি নাই। তারপর আবার গাছ পাথর লইয়াও যুদ্ধ হইল। কিন্তু বালীর গায় জোর বেশী থাকাতে, শেষে সুগ্রীব কাবু হইয়া পড়িতে লাগিল।

 এমন সময় রামের বাণ ভয়ানক শব্দে বালীর বুকে আসিয়া বিধিল। বাণের ঘায় বালীকে মাটিতে পড়িতে দেখিয়া রাম লক্ষ্মণ তাহার নিকট ছুটিয়া আসিলেন। তখন বালী রামকে অনেক গালি দিল।

 সে বলিল, “তুমি কেমন লোক চুরি করিয়া কেন আমার উপর বাণ মারিলে? সামনে আসিয়া যুদ্ধ করিতে, তবে দেখিতাম! আমাকে মারিয়া তোমার কী লাভ হইল?’

 রাম বলিলেন, ‘তুমি দুষ্ট লোক, তোমাকে মারতে আমার কোন অন্যায় হয় নাই। আমার বন্ধুর নিকট আমি প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম যে তোমাকে মারিব, কাজেই তোমাকে মারিয়াছি।’

 বালীকে মারিয়া বন্ধুর উপকার করিয়াছেন, কাজেই ইহাতে রামের মনে কষ্ট না হইতে পারে। কিন্তু শেষে যখন বালীর স্ত্রী তারা আর তাহার পুত্র অঙ্গদ সেখানে আসিয়া কাঁদিতে লাগিল, তখন সুগ্রীবও চক্ষের জল রাখিতে পারিল না।

 মরিবার সময় বালীর ভাল বুদ্ধি হইয়াছিল। তখন সে সুগ্রীবকে ডাকিয়া বলিল, ভাই, বুদ্ধির দোষে অন্যায় করিয়াছি, ক্ষমা কর। আমার অঙ্গদকে তোমার নিকট রাখিয়া গেলাম। তাহাকে তুমি তোমার পুত্রের মত দেখিও। এই বলিয়া সে নিজের গলার সোনার হার সুগ্রীবের গলায় পরাইয়া দিল। সেই সোনার হার বালীকে ইন্দ্র দিয়াছিলেন। তাহার গুণ অতি আশ্চর্য।

 বালীর মৃত্যুর পর রাম সুগ্রীবকে কিষ্কিন্ধ্যার রাজা আর অঙ্গদকে যুবরাজ করিলেন। তারপর সীতাকে খুঁজিবার আয়োজন হইতে লাগিল। সুগ্রীব হনুমানকে ডাকিয়া বলিল, ‘হনুমান, শীঘ্র বানরদিগকে সংবাদ দাও, যে সকল বানর খুব শীঘ্র চলিতে পারে, তাহারা দশ দিনের ভিতরে পৃথিবীর সকল বানরকে ডাকিয়া উপস্থিত করুক। মহেন্দ্র পর্বতে, হিমালয়ে, বিন্ধ্যাচলে, কৈলাসে আর মন্দর পর্বতে যে সকল বানর আছে, সমুদ্রের পারে, উদয় পর্বতে আর অস্ত পর্বতে, অঞ্জন পর্বতে, আর পদ্মাচলে কালো কালো হাতির মতন যে সকল বানর আছে পর্বতের গুহার ভিতরে, সুমেরুর পাশে যে সকল বানর আছে আর মহারুণ পর্বতে যে সকল ভয়ঙ্কর বানর আছে, আমাদের দূতেরা তাহদের সকলকেই এখানে ডাকিয়া আনুক।’

 তখনই চারিদিকে দূতসকল ছুটয়া চলিল, আর দেখিতে দেখিতে পৃথিবীর সকল বানর আসিয়া কিষ্কিন্ধ্যায় উপস্থিত হইতে লাগিল।

 অঞ্জন পর্বত হইতে আসিল তিন কোটি বানর,কৈলাস হইতে আসিল এক হাজার কোটি অস্তাচল হইতে দশ কোটি হিমালয়ের বানর ফল খায়, কিন্তু সিংহের মত জোরালো—সেই বানর এক হাজার খর্ব, গর্জন করিতে করিতে আসিয়া উপস্থিত হইল; বিন্ধ্য পর্বতের কালো বানর এক হাজার কোটি আসিল; ক্ষীরোদ সমুদ্রের পারে যে সকল বানর নারিকেল খাইয়া থাকে, তাহারাও আসিল।

 পৃথিবীর বানর আর আসিতে কেহ বাকি নাই। তাহা ছাড়া কিষ্কিন্ধ্যায় কত কোটি বানর আছে, তাহার হিসাব কে করিবে? বানরের পায়ের ধূলায় আকাশ অন্ধকার, সূর্য দেখা যায় না। কিষ্কিন্ধ্যাতে আর স্থান নাই। কত বানর আসিয়াছে আর কত আসিতেছে! তাহদের কেহ লাফায়, কেহ গর্জন করে, কেহ কেহ কুস্তি আরম্ভ করিয়াছে।

 তারপর সুগ্রীব সীতাকে খুঁজিবার জন্য চারিদিকে লোক পাঠাইল। পূর্বে, দক্ষিণে, পশ্চিমে, উত্তরে, কোনখানেই লোক পাঠাইতে বাকি রহিল না। সুগ্রীব তাহাদিগকে বলিল, ‘এক মাসের মধ্যে তোমাদের ফিরিয়া আসা চাইনা আসিলে প্রাণদণ্ড হইবে।”

 এই সকল বানরের মধ্যে হনুমানও ছিল। সুগ্রীব তাহাকে ডাকিয়া বলিল, হনুমান, তুমি জলে, শূন্যে, স্বর্গে সকল স্থানেই যাইতে পার, আর সকল স্থানের খবর জান। তোমার মতন বীর কে আছে? যাহাতে খুব ভাল করিয়া সীতার খোঁজ হয়, তুমি সেইরূপ করবে। হনুমানকে দেখিয়া রামও বুঝিয়াছিলেন যে, সে নিশ্চয়ই সীতার সংবাদ আনিতে পারবে। তাই তিনি তাহার হাতে তাহার নিজের নাম লেখা একটি আংটি দিয়া বলিলেন, ‘এই আংটি দেখিলেই সীতা তোমাকে আমার লোক বলিয়া জানিতে পারবেন। হনুমান জোড় হাতে আংটিটি লইয়া রামকে প্রণাম করিল।

 তারপর বানরেরা সীতার খোঁজ করিবার জন্য গর্জন করিতে করিতে চারিদিকে ছুটিয়া চলিল। কেহ বলে, “আমি রাবণকে মারিয়া সীতাকে আনিব। কেহ বলে, “আরে না! তোমরা থাক, আমিই সব করিব।” কেহ বলে, “আমি পাহাড় গুড়া করিব। কেহ বলে, “আমি এক যোজন লাফাইব। কেহ বলে, “আমি দশ যোজন লাফাইব। কেহ বলে, আমি দশ হাজার যোজন লাফাইব।’

 এইরূপ করিয়া বানরেরা সীতাকে খুঁজতে বাহির হইল। ক্ষুধা হইলে তাহারা ফল খায়; রাত্রিতে গাছেই ঘুমায়। এক মাস পর্যন্ত এমনি করিয়া খুঁজিয়া, তাহারা পৃথিবীর কোন স্থান দেখিতে বাকি রাখিল না। কত দেশে, কত বনে, কত পাহাড়ে যে তাহারা গিয়াছিল, তাহার শেষ নাই।

 সমুদ্রে যে-সকল দ্বীপ আর পাহাড় আছে, সেখানে ভয়ঙ্কর কালো কালো জন্তু থাকে,— তাহদের কান পর্দার মত হইয়া ঠোট অবধি বুলিয়া পড়িয়াছে, তাহদের একটা বৈ পা নাই কিন্তু তবুও তাহারা বাতাসের মত ছোটে— সেইখানে তাহারা সীতাকে খুঁজিয়াছিল।

 যেখানে পিঙ্গলবর্ণ কিরাতেরা থাকে—তাহারা কাঁচা মাছ খায়—সেইখানে তাহারা সীতাকে খুঁজিয়াছিল।

 বাঘমুখো মানুষের দেশে, যব দ্বীপে, স্বর্ণ দ্বীপে, রৌপ্য দ্বীপে তাহারা সীতাকে খুঁজিয়াছিল। ভয়ঙ্কর ইক্ষু সমুদ্রের ধারে বিকটাকার রাক্ষসেরা থাকে, তাহারা জন্তুর ছায়া ধরিয়া টানিয়া তাহাকে খায়। সেইখানে তাহারা সীতাকে খুঁজিয়াছিল।

 তারপর লাল সমুদ্র। সেখানে রাক্ষসেরা পাহাড়ের চুড়া ধরিয়া বাদুড়ের মত ঝুলিতে থাকে। সূর্যের তেজে তাহদের মাথা গরম হইয়া গেলে তাহারা সমুদ্রের জলে পড়িয়া যায়;সেখান হইতে ঠাণ্ড হইয়া আবার পাহাড়ে উঠিয়া ঝুলিতে থাকে। সেই লাল সমুদ্রে তাহারা সীতাকে খুঁজিয়াছিল।

 তারপর ক্ষীরোদ সমুদ্র। তারপর জলোদ সমুদ্র। সেখানে অতি বিশাল একটা ঘোড়ার মুখ হইতে ক্রমাগত আগুন বাহির হইতেছে আর তাহ দেখিয়া সমুদ্রের জন্তসকল ভয়ে চিৎকার করিতেছে। সেই জলোদ সমুদ্রে তাহারা সীতাকে খুঁজিয়াছিল।

 যেখানে সূর্য উদয় হয়, সেই সোনার পর্বতে তাহারা সীতাকে খুঁজিয়াছিল। তাহার পরে কেবলই অন্ধকার; সেখানে কেহই যাইতে পারে না।



বৃষভ পর্বত দেখিতে র্যাড়ের মতন, তাহাতে গন্ধর্বেরা থাকে। সেখানে নানারকম চন্দন গাছ আছে, কিন্তু তাহার কথা কাহাকেও জিজ্ঞাসা করিলে বড়ই বিপদ হয়। সেখানেও তাহারা সীতাকে খুঁজিয়াছিল।

 চন্দনগিরি নামক পর্বতে একরকম পক্ষী থাকে, তাহার নাম সিংহ পক্ষী। তাহারা হাতি আর তিমিমাছ ধরিয়া খায়। সেই পক্ষীর বাসায় তাহারা সীতাকে খুঁজিয়াছিল।

 সুমেরু পর্বত পার হইলে অস্তাচল;সেখানে সূর্য অস্ত যান। ততদূর পর্যন্ত তাহারা সীতাকে খুঁজিতে গিয়াছিল। তাহার পর কেবল অন্ধকার; সেখানে কেহই যাইতে পারে না।

 উত্তরকুরু দেশের নদীতে সোনার পদ্ম ফোটে, আর তাহার তীরে মুক্ত ছড়ানো থাকে। সেই দেশে তাহারা সীতাকে খুঁজিয়াছিল।

 তাহার পরে উত্তর সমুদ্র। তাহার মাঝখানে সোমগিরি নামক সোনার পর্বত আছে। সূর্য না উঠিলেও, সোমগিরির আলোকেই পরিষ্কার দেখিতে পাওয়া যায়। সোমগিরি বড় ভয়ানক পর্বত সেখানে বানরেরা যাইতে পারে নাই।

 এইরূপ করিয়া তাহারা সীতাকে খুঁজিয়া বেড়াইল, কিন্তু কোথাও তাঁহার সন্ধান পাইল না। এক মাস পরে আর সকলেই কিষ্কিন্ধ্যায় ফিরিয়া আসিল; কেবল হনুমান আর তাহার সঙ্গে যাহারা গিয়াছিল, তাহারা এখনও ফিরে নাই।

 হনুমান, অঙ্গদ, তার, আর জাম্ববান, অনেক বানর লইয়া দক্ষিণ দিকে গিয়াছিল। তাহারা অনেক খুঁজিয়াও সীতাকে দেখিতে পাইল না। প্রথমে ভয়ানক একটা বনের ভিতর ঘুরিয়া ঘুরিয়া তাহারা কাহিল। তারপর সেখান হইতে যে জায়গায় আসিল, তাহ আরও ভয়ঙ্কর। সে পোড়া দেশে গাছপালা নাই, জীবজন্তু জন্মাইতে পায় না, নদীসকল শুকাইয়া গিয়াছে, এক ফোঁটা জল পর্যন্ত পাইবার জো নাই। কবে কণ্ডু বলিয়া এক মুনি ছিলেন, এই হতভাগ্য দেশে তাহার পুত্রের মৃত্যু হয়। সেই পুত্রের শোকে কণ্ডু মুনি দেশটাকে শাপ দিয়া তাহার এই দশা করিয়া গিয়াছেন। যাহা হউক, সেখানেও তাহারা সীতার কোন সন্ধান পাইল না।

 সেখান হইতে তাহারা আর একটা বনে গিয়া ঢুকিবামাত্রই একটা বিকটাকার অসুর তাহাদিগকে তাড়িয়া মারিতে আসিল। অঙ্গদ মনে করিল, বুঝি এটাই রাবণ। এই মনে করিয়া সে তাহাকে এক চড় মারিল যে, সে চড় খাইয়া আর তাহার উঠিয়া যাইতে হইল না। এক চড়েই অসুরের বাছা মাটিতে পড়িয়া ছটফট করিয়া অস্থির।

 কিন্তু এত খুঁজিয়াও সীতার সন্ধান পাওয়া গেল না। এদিকে ক্ষুধা তৃষ্ণায় তাহদের প্রাণ যায়, আর চলিবার শক্তি নাই। এমন সময়ে তাহারা একটা প্রকাণ্ড গর্তের কাছে আসিয়া উপস্থিত হইল। সে গর্তের নাম ঋক্ষ বিল। তাহার ভিতর হইতে হাঁস, সারস প্রভৃতি পক্ষী উড়িয়া বাহির হইতেছিল। সে সকল পক্ষীর শরীরে জল দেখিয়া তাহারা মনে করিল যে, নিশ্চয়ই এই গর্তের ভিতরে জল আছে।

 এই মনে করিয়া তাহারা সেই গর্তের ভিতর ঢুকিল। গর্তের মুখের কাছে খানিক দূর পর্যন্ত ভয়ানক অন্ধকার, কিন্তু সেই অন্ধকারের পরেই একটি অতি সুন্দর এবং আশ্চর্য স্থান। সেখানকার সকলই সোনার। গাছপালাও সোনার, জলের মাছও সোনার, পদ্মফুলও সোনার। কেবল পদ্মের কাছে যে মৌমাছি উড়িতেছে তাহ মানিকের।

 সেই স্থানে ঘুরিতে ঘুরিতে তাহারা একটি তপস্বিনী দেখিতে পাইল। তাহার শরীরে এত

তেজ যে, দেখিলে মনে হয় যেন আগুন জ্বলিতেছে। তাহারা তপস্বিনীকে প্রণাম করিয়া জোড়হাতে বলিল, মা, আমরা ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হইয়া এখানে আসিয়াছি। এ আশ্চর্য দেশ কাহার, আর এ সকল জিনিস কী করিয়া সোনার হইল, তাহা জানিতে আমাদের বড়ই ইচ্ছা হইতেছে।”

 তপস্বিনী বলিলেন, “বাছা, এ স্থান ময় নামক দানবের তৈয়ারি। তোমরা এখানে কেন আসিয়াছ? ইহা যে অতি ভয়ঙ্কর স্থান।’ এই বলিয়া তিনি নানারকম মিষ্ট ফল আর ঠাণ্ডা জল আনিয়া বানরদিগকে খাইতে দিলেন। বানরেরা তাহা খাইয়া তাহাকে অনেক ধন্যবাদ দিল।

 এদিকে আর-এক নূতন বিপদ উপস্থিত। সেই গর্তের ভিতরে ঘুরিয়া ঘুরিয়া তাহদের এক মাস চলিয়া গেল, তবুও তাহারা বাহিরে আসিবার পথ পায় না। তাহা দেখিয়া সেই তপস্বিনী তাহাদিগকে বলিলেন, বাছাসকল, এ গর্তের ভিতর একবার আসিলে কেহই জীবন্ত বাহিরে যাইতে পারে না। যাহা হউক, তোমাদের কোনও ভয় নাই। তোমরা খানিক চোখ বুজিয়া থাক আমি তোমাদিগকে বাহিরে লইয়া যাইতেছি। এই কথা শুনিয়া বানরেরা সেখানে চোখ বুজিয়া রহিল;তারপর চাহিয়া দেখিল যে, তাহারা বাহিরে বিন্ধ্য পর্বতের কাছে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। নিকটে সমুদ্র, তাহার গর্জন শোনা যাইতেছে।

 গর্তের বাহিরে আসিয়া কিন্তু তাহদের একটুও আনন্দ হইল না;বরং নানা চিন্তায় তাহদের মন অস্থির হইয়া উঠিল। তাহদের তখন বার-বার এই কথা মনে হইতে লাগিল, ‘এখন দেশে গিয়া কী বলিব? এক মাস তো চলিয়া গেল;কিন্তু হায়, সীতার কোন সংবাদই পাওয়া গেল না! এখন কোন মুখে দেশে ফিরিব? সুগ্রীব আগেই বলিয়াছেন যে এক মাসের ভিতর না ফিরিলে তিনি মারিয়া ফেলিবেন। কাজেই আর কিসের ভরসায় বা দেশে ফিরিব? তাহার চেয়ে এইখানে না খাইয়া মরা অনেক ভাল।’

 সুতরাং তাহারা স্থির করিল যে, তাহারা আর দেশে না গিয়া সেইখানেই না খাইয়া মরিবে। এইরূপে মরিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া তাহারা খাওয়া দাওয়া ছাড়িয়া দিয়া দক্ষিণ মুখে সমুদ্রের ধারে বসিয়া রহিল;তখন তাহদের কান্না ছাড়া আর কোন কাজ রহিল না। তাই তাহারা রামের কথা, সীতার কথা, জটায়ু পাখির কথা আর নিজেদের দুঃখের কথা বলিয়া কেবলই কাঁদিতে লাগিল।

 সেই বিন্ধ্য পর্বতের উপরে জটায়ুর দাদা সম্পাতি পাখি থাকিত। সে বানরদিগকে দেখিয়া বলিল, অনেক দিন পরে আমার জন্য এতগুলি খাবার জিনিস উপস্থিত হইয়াছে। আমার বড়ই ভাগ্য! এই সকল বানরের এক-একটা মরিবে আর আমি খাইব।’

 এইথা শুনিয়া অঙ্গদ হনুমানকে বলিল, ‘ঐ দেখ যম নিজেই পাখি সাজিয়া আমাদিগকে লইতে আসিয়াছে। আমাদের প্রাণ গেল, তবুও রামের কাজ হইল না! জটায়ু যুদ্ধ করিয়া সীতার জন্য প্রাণ দিয়াছিল, জটায়ুই সুখী!'

 জটায়ুর নাম শুনিয়া সম্পাতি কাদিতে কাঁদিতে বলিল, হায়! কে তোমরা আমার প্রাণের ভাই জটায়ুর মৃত্যুর কথা বলিতেছ? জটায়ু কেমন করিয়া মরিল? আমার পাখা পুড়িয়া গিয়াছে আমি উড়িতে পারি না। তোমরা আমাকে ধরিয়া নামাও।

 সম্পাতির কথায় প্রথমে বানরদের বড় ভয় হইল, পাছে পাখিটাকে পাহাড় হইতে নামাইলে সে তাহাদিগকে ঠোকরাইয়া খাইতে আরম্ভ করে। কিন্তু শেষে তাহারা ভাবিল, আমরা যখন

 মরিতে বসিয়াছি, তখন ঐ পাখিটা আমাদিগকে খাইলে আমরা যাহা চাই তাহাই তো হইবে, আর বেশী কী।’ তখন অঙ্গদ সম্পাতিকে পাহাড় হইতে নামাইয়া আনিল। তারপর নিজেদের পরিচয় দিয়া রামের বনবাসের কথা, রাবণের সীতাকে লইয়া যাইবার কথা, জটায়ুর মৃত্যুর কথা, সীতাকে খুঁজিবার কথা, এক-এক করিয়া সকলই তাহাকে বলিল।

 অঙ্গদের কথা শুনিয়া সম্পাতি বলিল, “তোমরা যে জটায়ুর কথা বলিতেছ, সে আমার ভাই। তাহাকে যে মারিয়াছে, তাহার শাস্তি দিই এমন শক্তি আমার আর নাই। ছেলেবেলায় আমরা দুই ভাই মিলিয়া ইন্দ্রকে জয় করিয়াছিলাম। ফিরিবার সময় সূর্যের নিকট দিয়া আসিতে গিয়া তাহার তেজে জটায়ু অজ্ঞান হয়ে গেল। তাহাকে ঢাকিতে গিয়া আমিও পাখা পুড়িয়া এখানে পড়িলাম। সেই অবধি আমি এখানে পড়িয়া আছি জটায়ুর কী হইয়াছে আমি জানি না।”

 ইহা শুনিয়া অঙ্গদ বলিল, রাবন কোথায় থাকে তুমি জান কি? সম্পাতি বলিল, একদিন রাবণকে আমি একটি মেয়েকে লইয়া যাইতে দেখিয়াছি। সেই মেয়েটি ‘হা রাম! হা লক্ষ্মণ!” বলিয়া কাদিতেছিলেন। বোধহয় তিনিই সীতা। সামনের এই সমুদ্র একশত যোজন চওড়া; তারপর লঙ্কাদ্বীপ, সেই লঙ্কায় রাবণের বাড়ি। তোমরা এই সমুদ্র পার হইয়া লঙ্কায় যাও। আমি নিশ্চয় বুঝিতেছি তোমরা সেখান হইতে ভালোয় ভালোয় ফিরিয়া আসিতে পারিবে। বাবণ সীতাকে লইয়া যাইবার সময় আমাব পুত্র সুপাশ্ব তাহার পথ আটকাইয়াছিল, কিন্তু রাবণ মিনতি করাতে ছাড়িয়া দিল। আমার পাখা নাই, আমি আর কী করিতে পারি? আমি কেবল মুখের কথা বলিয়াই রামের উপকার করিব। তোমরা আর বিলম্ব করিও না। যাহা করিলে রামের কাজ হইতে পারে তাহা কর।’

 এই কথা বলিয়া সম্পাতি আবার বলিল, সীতাকে যে রাবণ লইয়া যাইবে, এ কথা নিশাকর নামে এক মুনি আমাকে অনেক দিন আগেই বলিয়াছিলেন। আট হাজার বৎসর আগে এখানে নিশাকর মুনির আশ্রম ছিল;ছেলেবেলায় আমি আর জটায়ু তাঁহাকে প্রণাম করিতে যাইতাম। তিনিও আমাদিগকে বড়ই স্নেহ করিতেন। আমার যখন পাখ পুড়িয়া গেল, তখন তিনি বলিলেন, ‘তুমি দুঃখ করিও না; তোমার আবার পাখা হইবে। তুমি এখান হইতে কোথাও যাইও না। আমি তপস্যা করিয়া জানিয়াছি যে, রাজা দশরথের পুত্র রামের স্ত্রী সীতাকে রাবণ চুরি করিয়া লইয়া যাইবে। সেই সীতাকে খুঁজিবার জন্য রামের দূতেরা এখানে আসিলে, তুমি তাহাদিগকে তাঁহার সন্ধান বলিয়া দিও। তাহা হইলেই তোমার আবার পাখা হইবে।” সেই অবধি আমি তোমাদিগের জন্য অপেক্ষা করিয়া এইখানে বসিয়া আছি। আমার অনেক দুঃখ, কিন্তু রামের এই কাজটি করিবার জন্য আমি সকল দুঃখ ভুলিয়া আছি। সুপার্শ্ব সীতার সাহায্য করে নাই বলিয়া আমি তাহাকে বকিয়াছিলাম।’

 কী আশ্চর্য! এই কথা বলিতে বলিতে সম্পতির সুন্দর লাল রঙের পাখা হইল। তখন সে বানরদিগকে ডাকিয়া বলিল, “দেখ! মুনির বরে আমার আবার পাখা হইয়াছে, আর গায়ে যেন সেই আমার প্রথম বয়সের মতন জোর বোধ হইতেছে! তোমরা চেষ্টা কর, নিশ্চয়ই সীতাব সন্ধান পাইবে। এই বলিয়া সম্পাতি আনন্দে নীল আকাশে উড়িয়া চলিয়া গেল। তাহা দেখিয়া বানরদিগের মনে যে আনন্দ ও আশা হইল, তাহা আর কী বলিব! তখন তাহারা নিশ্চয় বুঝিতে পারিল যে, সীতার খবর পাওয়া যাইবে।

 কিন্তু কী করিয়া সীতার খবর পাওয়া যাইবে? একশত যোজন সমুদ্র ডিঙাইতে পারিলে তবে তো লঙ্কা! আর সেই লঙ্কায় গেলে তবে তো সীতার সন্ধান হয়। বানরেরা সমুদ্রের ধারে আসিয়া অবাক হইয়া বসিয়া রহিল। এত বড় সমুদ্র পার হইয়া সীতার সংবাদ আনা বড়ই কঠিন দেখা যাইতেছে। এ কাজ কে করিবে?

 তখন অঙ্গদ বলিল, ‘তোমরা তো সকলেই খুব বীর। বল দেখি ভাই কে কত দূর লাফাইতে পার?'

 অঙ্গদের কথা শুনিয়া তার বলিল, ‘আমি দশ যোজন লাফাইতে পারি।’ গবজাক্ষ বলিল, ‘আমি কুড়ি যোজন পারি।’ শরভ বলিল, ‘আমি ত্রিশ যোজন পারি।’ ঋষভ বলিল, ‘আমি চল্লিশ যোজন পারি।’ গন্ধ মাদন বলিল, ‘আমি পঞ্চাশ যোজন পারি।’ মৈন্দ বলিল, ‘আমি ষাট যোজন পারি।’ দ্বিবিদ বলিল, ‘সত্তর যোজন পারি।’ সুষেণ বলিল, ‘আশি যোজন পারি।’ জাম্ববান বলিল, ‘নববই যোজন পারি।’ সকলের কথা শুনিয়া অঙ্গদ বলিল, ‘আমি একশত যোজন সমুদ্র ডিঙাইতে পারি; কিন্তু ফিরিয়া আসিতে পারিব কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ হইতেছে।’

 তখন জাম্ববান বলিল, ‘রাজপুত্র তুমি ইচ্ছা করিলে এক হাজার যোজন পার হইতে পার, কিন্তু নিজে তাহা করিতে যাইবে কেন? তুমি হুকুম দিবে, আমরা কাজ করিব। যে এ কাজের যোগ্য লোক, আমি তাহাকে ঠিক করিয়া দিতেছি।’

 এই বলিয়া সে হনুমানকে বলিল, ‘বাপু হনুমান, তুমি যে এত বড় বীর হইয়া এমন চুপ করিয়া এক পাশে বসিয়া আছ, তাহার কারণ কী? তুমি তো যেমন-তেমন লোক নহ!’

 বাস্তবিকই হনুমান যেমন-তেমন লোক ছিল না। যখন হনুমানের জন্ম হয়, তখন সূর্য উঠিতেছিল। লাল সূর্য দেখিয়া সে মনে করিল, বুঝি তাহা কোনরূপ ফল। তাই সে লাফাইয়া তাহা ধরিতে গেল। সূর্যের তেজে তাহার কিছুই হয় নাই, কিন্তু ইন্দ্র তাহাকে দেখিয়া বজ্র ছুঁড়িয়া মারিলেন। বজ্র খাইয়াও সে মরিল না, কেবল পর্বতের উপরে পড়িয়া তাহার বাঁ পাশের হনু অর্থাৎ দাড়ি ভাঙিয়া গেল। সেইজন্য তাহার নাম হইল হনুমান।

 হনুমান পবন দেবতার পুত্র। ইন্দ্র হনুমানকে বজ্র মারাতে পবন রাগ করিয়া সমস্ত বাতাস বন্ধ করিয়া দিলেন। তাহাতে সংসারে লোক নিশ্বাস ফেলিতে না পারিয়া অস্থির হইয়া উঠিল। তখন দেবতারা দেখিলেন বড় বিপদ! কাজেই তাঁহারা পবনকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য হনুমানকে বর দিলেন। ব্রহ্মা বলিলেন, ‘কোন অস্ত্রে হনুমানের মৃত্যু হইবে না।’ ইন্দ্র বলিলেন, ‘তাহার নিজের ইচ্ছা ভিন্ন কিছুতেই তাহার মৃত্যু হইবে না।’

 বড় হইয়া হনুমান অসাধারণ বীর হইয়াছে। সে যেখানে ইচ্ছা সেইখানেই যাইতে পারে, কিছুতেই তাহাকে আটকায় না। সেই হনুমানকে ডাকিয়া এখন জাম্ববান বলিল, ‘বাছা, তুমি এ কাজটি করিলে আমাদের প্রাণ বাঁচে।’

 তখন হনুমান বলিল, ‘ঐ যে মহেন্দ্র পর্বত দেখা যাইতেছে, উহা খুব উঁচু আর মজবুত। ঐ স্থান হইতে লাফাইবার সুবিধা হইবে।’ এই কথা বলিয়া সে মহেন্দ্র পর্বতে গিয়া উঠিল।

 মহেন্দ্র পর্বত দেখিতে খুব সুন্দর, আর বড়ও কম নহে। তাহাতে বড় বড় বন আছে, ঝরঝর শব্দে কত ঝরনা বহিতেছে, পাখিরা গাছে বসিয়া মনের সুখে গান গাহিতেছে। আর বাঘ, সিংহ, হাতি প্রভৃতি জানোয়ারেরা দলে দলে বনের ভিতর চরিয়া বেড়াইতেছে। হনুমানের