উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/ছেলেদের রামায়ণ/সুন্দরকাণ্ড
সুন্দরকাণ্ড
হেন্দ্র পর্বতে উঠিয়া হনুমান একটি ছোট মাঠের উপর দাড়াইল। তার পর জোড়হাতে দেবতাদিগকে প্রণাম করিয়া সে লাফ দিবার জন্য প্রস্তুত হইল। সে সময়ে তাহার শরীর এত বড় হইয়াছিল যে, তাহার ভার মহেন্দ্র পর্বতের সহ্য হইল না। সেই পর্বতের ভিতর হইতে তখন এমনি করিয়া জল বাহির হইয়াছিল যে, ভিজা গামছাকে নিংড়াইলে তাহার চেয়ে বেশি করিয়া জল বাহির হয় না। সেখানকার শেষ উপস্থিত। মুনিরা পর্বত ছাড়িয়া দূরে গিয়া তামাসা দেখিতে লাগিলেন।
তারপর হনুমান দুই হাতে মাটিতে ভর দিয়া, লেজ মোটা করিয়া, শরীর কোঁচকাইয়া, পা গুটাইয়া এমনই ভয়ানক লাফ দিল যে, তাহার কথা মনে কবিলেও যার-পর নাই আশ্চর্য বোধহয়। সেই লাফের চোটে পর্বতের গাছপালা অবধি তাহার পিছু-পিছু ছুটিয়া চলিল; সমুদ্রের জল গিয়া আকাশে উঠিল। তখন হনুমানকে দেখিয়া মনে হইতেছিল, যেন একটা পর্বত আকাশের ভিতর দিয়া ছুটিয়া চলিতেছে। সেজন্য দেবতারা তাহার কতই প্রশংসা করিলেন।
এদিকে সমুদ্র মৈনাক পর্বতকে ডাকিয়া বলিল, ‘মৈনাক, তুমি তুমি শীঘ্র জলের ভিতর হইতে মাথা জাগাইয়া দাও। হনুমানের বোধহয় পরিশ্রম হইয়াছে সে তোমার চুড়ায় বসিয়া বিশ্রাম করিবে।’
মৈনাক পর্বত সমুদ্রের জলের নীচে থাকে। সমুদ্রের কথায় সে তখনই জল হইতে উঠিয়া হনুমানের সম্মুখে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইল। কিন্তু হনুমানের বিশ্রামের কিছুমাত্র দরকার নাই। তাহার উপরে আবার তাহার বড় তাড়াতাড়ি। কাজেই সে মৈনাককে বুকের ধাক্কায় সরাইয়া দিল।
তখন মৈনাক বলিল, ‘হনুমান, তুমি একটু আমার চুড়ায় দাঁড়াইয়া বিশ্রাম কর। আমার চুড়ায় মিষ্ট ফল আছে তুমি তাহা আহার কর। সত্য যুগে যখন সকল পর্বতেরই পাখা ছিল, তখন তাহারা যেখানে ইচ্ছ চলিয়া বেড়াইত আর তাহদের চাপে অনেক জীবজন্তু মারা যাইত। এইজন্য ইন্দ্র বজ্র দিয়া সকল পর্বতেরই পাখা কাটিয়া দেন। কিন্তু তোমার পিতা পবনদেব
দয়া করিয়া আমাকে সমুদ্রের জলে উড়াইয়া ফেলাতে, ইন্দ্র আমার পাখা কাটিতে পারেন নাই। হনুমান, তোমার পিতা আমার এই উপকার করিয়াছিলেন। তুমি কি আমার চূড়ায় একটু বিশ্রাম করিয়া আমাকে সুখী করিবে না?'
হনুমান বলিল, 'মৈনাক, তোমার কথা শুনিয়াই আমার মনে যার-পর নাই সুখ হইয়াছে। কিন্তু ভাই, আমি ব্যস্ত আছি, এখন বসিতে পারিব না; আমাকে মাপ কর।’
এই বলিয়া মৈনাককে ছুঁইয়া হনুমান আবার ছুটিয়া চলিল।
দেবতারা দেখিলেন যে, হনুমান বড়ই ভয়ানক কাজ করিতে চলিয়াছে। এ কাজ সে করিয়া আসিতে পরিবে কি না তাহা পরীক্ষা করিয়া দেখিতে তাঁহাদের বড়ই ইচ্ছা হইল। তাই তাঁহারা নাগদিগের মাতা সুরসাকে ডাকিয়া বলিলেন, 'সুরসা ঠাকরুন, আপনি অনুগ্রহ করিয়া একটিবার হনুর পথটা আগলাইয়া দাঁড়ান তো! দেখি সে কেমন বীর!'
দেবতাদের কথায় সুরসা ভয়ঙ্কর রাক্ষসীর বেশে, হাঁ করিয়া হনুমানের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। হনুমান তাহা দেখিয়া নিজের শরীরটাকে দশ যোজন বড় করিয়া ফেলিল। সে মনে করিয়াছিল যে, এত বড় হইলে আর রাক্ষসী তাকে গিলিতে পরিবে না। কিন্তু রাক্ষসী তখনই তাহার দশ যোজনের জায়গায় বিশ যোজন হাঁ করিয়া বসিল।
কী বিপদ! হনুমান যতই বড় হয়, রাক্ষসী আমনি তাহার চেয়েও বড় হাঁ করে! দশ যোজন, বিশ যোজন, ত্রিশ যোজন, চল্লিশ যোজন, পঞ্চাশ যোজন, ষাট যোজন, সত্তর যোজন, আশী যোজন—হনুমান যতই বড় হইতেছে, রাক্ষসী তাহার চেয়ে বড় হাঁ করিতেছে! হনুমান মনে করিল, 'আর বড় হইয়া কী হইবে? অন্য উপায় দেখা যাক।’
তখন সে হঠাৎ বুড়া আঙুলটির মতন ছোট্ট হইয়া রাক্ষসীর পেটের ভিতর ঢুকিয়া, আবার তখনই বাহির হইয়া আসিল। হনুমান খুবই তাড়াতাড়ি ছোট হইল, রাক্ষসীর মস্ত হাঁ-টাকে গুটাইয়া লইতে বোধহয় তাহার চেয়ে অনেক বিলম্ব হইয়াছিল। কাজেই হনুমানকে গিলা আর তাহার হয় নাই তারপর হয়ত আবার বুড়া আঙুলের মতন ছোট হনুমানটি কোনখান দিয়া ফসকিয়া গিয়াছে, রাক্ষসী তাহা টের পায় নাই। যেমন করিয়াই হউক, নাগের মা ঠাকরুনকে হনুমান বড়ই ফাঁকিটা দিয়াছিল। সুরসাকে ফাকি দিয়া বেশী দূর যাইতে না যাইতে হনুমান একটা রাক্ষসীর হাতে পড়িল। এটার নাম সিংহিকা। হনুমান শূন্যে ছুটিয়া চলিয়াছে, ইহার মধ্যে সিংহিকা তাড়াতাড়ি আসিয়া তাহার ছায়া ধরিয়া বসিল। হনুমান হঠাৎ দেখিল যে, সে আর চলিতে পারিতেছে না, আর সমুদ্রের ভিতর হইতে একটা ভয়ানক রাক্ষসীও উঠিয়া আসিতেছে। সে জানিত যে, এরকম ভয়ঙ্কর রাক্ষস আছে, তাহারা জন্তুর ছায়া ধরিয়া তাহাকে আটকাইয়া ফেলিতে পারে। সুতরাং সে বুঝিতে পারিল যে, এটা সেইরকম রাক্ষসী।
তখন হনুমান তাহার শরীর বড় করতে লাগিল। রাক্ষসীও অমনি ঘোরতর গর্জনের সহিত একেবারে আকাশপাতাল জোড়া ভয়ঙ্কর এক হাঁ করিয়া হনুকে গিলে আর কি! তাহা দেখিয়া হনুমান খুব ছোট হইয়া রাক্ষসীর পেটের ভিতর ঢুকিল। সুতরাং রাক্ষসী যে হনুকে খাইতে চাহিয়াছিল, সে কাজ তাহার হইয়াছিল বলিতে হইবে; তবে দুঃখের বিষয়, হজমটা তেমন ভাল করিয়া হয় নাই। কারণ, হনু তাহার পেটের ভিতর গিয়াই তাহার নাড়িভুঁড়ি সব ছিঁড়িয়া প্রাণ বাহির করিয়া দিল। কাজেই হনুকে হজম করিবার অবসর আর বেচারির রহিল না।
এতক্ষণে হনুমান লঙ্কার খুব কাছে আসিয়াছে; দূর হইতে সমুদ্রের তীরে সুন্দর সুন্দরগাছপালা দেখা যায়। তখন হনুমান ভাবিল, ‘এই প্রকাণ্ড শরীর লইয়া লঙ্কায় গেলে রাক্ষসেরা কি মনে করিবে?' সুতরাং নামিবার পূর্বে সে তাহার শরীরটাকে খুব ছোট করিয়া লইল।
সমুদ্র পার হইয়া হনুমান যেখানে নামিল সেটা পর্বত। এই পর্বতের নাম লম্ব পর্বত, ইহাকে ত্রিকূট পর্বতও বলে। এখান হইতে লঙ্কাপুরী বেশ দেখিতে পাওয়া যায়। নিজে বিশ্বকর্মা লঙ্কা তৈয়ারি করিয়াছিলেন। উহা স্বর্গের মত সুন্দর, আবার তেমনি মজবুত। লম্ব পর্বতের উপরেই শহর, তাহার চারিদিকে সোনার দেওয়াল। বড় বড় সিংহ-দরজা আছে, তাহাও সোনার। শহরের চারিধারে রাক্ষসেরা অস্ত্রশস্ত্র লইয়া পাহারা দিতেছে।
দূর হইতে কিছুকাল লঙ্কার শোভা দেখিয়া তারপর হনুমান ধীরে ধীরে তাহার উত্তর দরজার নিকট গিয়া উপস্থিত হইল। কিন্তু তখনও বেলা ছিল বলিয়া পুরীর ভিতর ঢুকিল না। এত আলোর মধ্যে লঙ্কায় ঢুকিতে গেলে রাক্ষসেরা তাহাকে দেখিতে পাইয়া তাহার কাজই মাটি করিয়া দিবে। তাই বাকি বেলাটুকু সে চুপি-চুপি বাহিরেই কাটাইল। তারপর যখন নগরে ঢুকিতে গেল, তখন বেশ অন্ধকার হইয়াছে। তখন যে সে শহরে ঢুকিল, তাহাও একটি বিড়ালছানার মত ছোট হইয়া।
লঙ্কার বাড়ি-ঘর যেমন বড় বড়, তেমনি সুন্দর। দরজা জানালা সোনার, রোয়াক পান্নার, সিঁড়িগুলি মানিকের। হনুমান এ-সকলের শোভা দেখিতে দেখিতে চলিয়াছে এমন সময় একটা বিকট রাক্ষসী কোথা হইতে আসিয়া তাহার পথ আটকাইয়া বলিল, ‘কে রে তুই বানর? এখানে কি করিতে আসিয়াছিস? সত্য বল্, নহিলে তোকে মারিয়া ফেলিব।’
হনুমান বলিল, ‘বলিতেছি। আগে বল তুমি কে, আর কেনইবা এত রাগ করিতেছ।’ রাক্ষসী বলিল, ‘আমি এই স্থানের দেবতা, আমারই নাম লঙ্কা। এ স্থানের লোকেরা আমারই পূজা করে, আমি এখানে পাহারা দিই। আজ আমার হাতে তোর মরণ দেখিতেছি!’
হনুমান তাহাতে কিছুমাত্র ভয় না পাইয়া বলিল, ‘এই সুন্দর নগরটি একবার দেখিতে আমার বড় ইচ্ছা হইয়াছে!’
রাক্ষসী কহিল, ‘আমাকে হারাইতে না পারিলে তুই নগর দেখিতে পাইবি না।’ হনুমান আবার মিনতি করিয়া বলিল, ‘ঠাকরুন, আমি দেখিয়াই চলিয়া যাইব।’
এ কথায় রাক্ষসী রাগিয়া হনুমানকে এক চড় মারিল। কাজেই তখন হনুমানেরও রাগ হইবে না কেন? তবে রাক্ষসী স্ত্রীলোক বলিয়া, তাহাকে বেশি মারিতে হনুমানের ইচ্ছা হইল না। সে কেবল বাঁ হাতে আস্তে তাহাকে একটি কিল মারিল, তাহাতেই বেচারী মাটিতে পড়িয়া, মুখ সিটকাইয়া একেবারে অজ্ঞান! জ্ঞান হইলে সে বলিল, ‘রক্ষা কর বাবা, আর না। ব্রহ্মা আমাকে বলিয়াছিলেন আমি যখন বানরের কাছে হারিব, তখন রাক্ষসদের বড় বিপদ হইবে। এখন সেই বিপদের সময় উপস্থিত দেখিতেছি। রাক্ষসদিগের আর রক্ষা নাই! এখন তুমি পুরীর ভিতর গিয়া যাহা ইচ্ছা কর।’
তখন হনুমান প্রাচীর ডিঙাইয়া লঙ্কার ভিতর প্রবেশ করিল। সেখানে ঘরে ঘরে তিলতিল করিয়া খুঁজিল, কিন্তু কোথাও সীতার দেখা পাইল না।
সে-সকল ঘরের কোথাও লোকজন গোলমাল করিতেছে, কোথাও পড়াশুনার শব্দ হইতেছে, কোথাও গুপ্তচরেরা অস্ত্রশস্ত্র লইয়া বসিয়া আছে। কোথাও সকলে মিলিয়া আমোদ করিতেছে; তাহাদের বাজনার শব্দ এমনি মিষ্ট যে, তাহাতে আপনা হইতে ঘুম আসিতে চায়। হনুমান এইরূপ কত স্থান দেখিল, কিন্তু কোথাও সীতাকে দেখিতে পাইল না।
এক জায়গায় রাবণের পুষ্পক রথ রহিয়াছে। বিশ্বকর্মা তাহা ব্রহ্মার জন্য মণি-মুক্তা দিয়া প্রস্তুত করিয়াছিলেন। ব্রহ্মা সেই রথ কুবেরকে দেন। কুবেরের নিকট হইতে রাবণ তাহা কাড়িয়া আনে। হনুমান সেই রথের উপর উঠিয়া দেখিল।
রাবণের বাড়িতে সকলে খাওয়া দাওয়া সারিয়া ঘুমাইয়াছে। সেখানে কত আশ্চর্য জিনিসই হনুমানের চোখে পড়িল! সোনার জানালা, মানিকের সিঁড়ি, হাতির দাঁতের মূর্তি, স্ফটিকের থাম—সকল আশ্চর্য! ইহার মধ্যে আবার সকলের চেয়ে আশ্চর্য রাবণের শুইবার স্থানটি স্ফটিকের বেদী, তাহার উপরে নীলকান্ত মণির খাট, তাহাতে সোনালী কাজ-করা হাতির দাঁতের খুঁটি। কলের পুতুলসকল পাখা হাতে লইয়া সেই খাটে বাতাস করিতেছে।
রাণী মন্দোদরীকে দেখিয়া একবার হনুমান মনে করিল, ‘এই বুঝি সীতা। কিন্তু আবার ভাবিল, সীতা এমন সুখে ঘুমাইতেছেন, তাহা কখনই হইতে পারে না। ইনি নিশ্চয়ই অন্য কেহ হইবেন।’
এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে সে রাবণের খাবার ঘরে গেল। কত জন খাইতে খাইতে সেইখানেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। সোনার থালা ঘটিতে, মণির কাজ করা স্ফটিকের বাটিতে কতরকম খাবার জিনিস রহিয়াছে তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না। মাংসের ব্যঞ্জনই বা কতরকমের—হরিণের মাংস, শুয়োরের মাংস, মহিষের মাংস, গণ্ডারের মাংস, ভেড়া, ছাগল, মোরগ আর ময়ূরের মাংস, কিছুরই অভাব নাই। তাহা ছাড়া মাছ তো আছেই। হনুমান সকলই দেখিল।
সেখানে অনেক মেয়ে রহিয়াছেন। কেহ দেবতার কন্যা, কেহ নাগের কন্যা; দেখিতে সকলেই সুন্দর। আবার বিকট চেহারা এবং ভয়ঙ্কর দাঁতওয়ালা রাক্ষসের মেয়েও অনেক আছে। কিন্তু সীতা কোথাও নাই।
হনুমান অনেক করিয়া খুঁজিল। ঘরের পর বাগান, বাগানের পর ঘর, কিছুই সে বাকি রাখিল না। কিন্তু দেখিল, সীতা কোথাও নাই। তখন মনের দুঃখে সে বলিল, ‘হায় হায়! এত করিয়াও সীতাকে দেখিতে পাইলাম না! হয়ত রাবণ তাহাকে মারিয়া ফেলিয়াছে, না হয় তিনি নিজেই মরিয়া গিয়াছেন। আমার এত পরিশ্রম সকলই বৃথা হইল। এখন আমি কোন মুখে ফিরিয়া যাইব? তাহার চেয়ে আমার মরিয়া যাওয়া ভাল!’ তারপর আবার সে মনে করিল, ‘না, মরিব কেন? এখনও ত সকল স্থান দেখা হয় নাই। আরো ভাল করিয়া খুঁজি।’
এই বলিয়া সে আবার প্রাণপণে খুঁজিতে খুঁজিতে একটি অশোক বন দেখিতে পাইল। সেই বনে যাইবামাত্র তাহার মনে হইল, ‘এইখানে বোধহয় সীতাকে দেখিতে পাইব। হয়ত এইদিক দিয়া তিনি আসিবেন।’ এই মনে করিয়া সে একটি শিংশপা অর্থাৎ শিশু গাছের পাতার আড়ালে লুকাইয়া চারিদিক দেখিতে লাগিল।
এমন সময় একটি মেয়ে সেইদিক দিয়া আসিলেন। না খাইয়া তাহার শরীর ভয়ানক রোগা আর ময়লা হইয়া গিয়াছে, কিন্তু তবুও তিনি দেখিতে আশ্চর্যরূপ সুন্দর। রাক্ষসীরা তাঁহাকে ঘিরিয়া আছে আর তিনি ক্রমাগত নিশ্বাস আর চোখের জল ফেলিয়া, কেবল যেন কাহার কথা ভাবিতেছেন। চুল বাঁধেন নাই, একখানি মাত্র হলদে রঙের ময়লা কাপড় পরিয়া আছেন। হনুমান তাঁহাকে দেখিয়াই বুঝিতে পারিল যে ইনিই সীতা। কারণ, তাহারা ঋষ্যমূক পর্বতেথাকিয়া যে মেয়েটিকে দেখিতে পাইয়াছিল, ইনি তাঁহারই মতন দেখিতে।
ততক্ষণে রাত্রি প্রভাত হইয়া গিয়াছে, সুতরাং তখন আর সীতার সহিত কথা বলিবার সুবিধা হইল না। তাই হনুমান আবার রাত্রির জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিল। এদিকে সীতা বসিয়া বসিয়া কেবল কাঁদিতেছেন। ভয়ঙ্কর রাক্ষসীরা তাঁহাকে ঘিরিয়া রহিয়াছে। তাহাদের কোনটা লম্বা, কোনটা কুঁজো, কোনটা কানা। কোনটার কান হাতির কানের মত চ্যাটালো; কাহারও কান আবার ঘোড়ার কানের মত সূচালো। কোনটার গলা হাড়গিলার গলার মতন লম্বা। কোনটার গায় এত লোম যে দেখিলে মনে হয় যেন কম্বল পরিয়াছে। কোনটার মুখ শুয়োরের মুখের মতন, কোনটার মুখ বাঘের মুখের মতন, কোনটার মুখ শেয়ালের মুখের মতন। কোনটার হাতির পায়ের মতন পা। এক-একটার আবার হাতির শুঁড়ের মতন শুঁড়ও আছে। কোনটার জিহ্বা লক-লক করিয়া ঝুলিয়া রহিয়াছে।
চারিধারে এই সকল রাক্ষসী অস্ত্রশস্ত্র লইয়া দাঁড়াইয়া আছে। তাহাদের মাঝখানে সীতা সেই শিংশপা গাছের তলায় বসিয়া কেবলই কাঁদিতেছেন।
তারপর যখন অনেক রাত্রি হইল, তখন রাবণ সেখানে আসিল। সে আসিয়া সীতাকে খুশি করিবার জন্য কতই মিষ্ট কথা কহিল, আবার কত লোভও দেখাইল। কিন্তু সীতা তাহার কোন কথাই শুনিলেন না। তিনি তাহাকে বলিলেন, ‘ওরে দুষ্ট, পাপ করাই বুঝি তোমার কাজ? তুমি যেমন লোক, রাম লক্ষ্মণ আসিয়া তোমাকে তেমনি সাজা দিবেন। যদি তুমি ভাল চাহ, এখনই আমাকে ফিরাইয়া দিয়া রামকে সন্তুষ্ট কর, নতুবা তোমার আর রক্ষা নাই। তুমি তো মরিবেই, তোমার লঙ্কায় আর একটি লোকও বাঁচিয়া থাকিবে না।’
এই কথায় রাবণ ভয়ানক রাগিয়া বলিল, ‘আমি আর দুই মাস দেখিব। তাহার পরে যদি তুমি আমার সঙ্গে ভাল করিয়া কথা না বল, তবে তোমাকে কাটিয়া রাঁধিয়া খাইব!’ সীতা বলিলেন, ‘আমার এমন ক্ষমতা আছে যে আমি তোমাকে এখনই ভস্ম করিতে পারি। কেবল রাম আমাকে অনুমতি দেন নাই বলিয়া চুপ করিয়া আছি। তুমি কুবেরের ভাই, আর নিজে এমন বীর। তুমি কেন রামকে ফাঁকি দিয়া আমাকে লইয়া আসিলে?'
রাবণ দেখিল যে সীতা কিছুতেই তাহার কথায় সন্তুষ্ট হইতেছেন না। তখন সে রাক্ষসীদিগকে আরো বেশি করিয়া সীতাকে বুঝাইতে বলিয়া চলিয়া গেল।
রাবণ গেলে পরে রাক্ষসীরা আসিয়া সীতাকে বকিতে লাগিল। একজন বলিল, ‘তোমার মতন এত বোকা ত দেখি নাই। এমন রাজা রাবণ, তাহাকে তুমি ভালবাসিতে চাহ না!’ আর-একজন বলিল, ‘আমার কথা শোন, তোমার জেদ ছাড়িয়া দাও। তাহা হইলে তুমি সকলের রাণী হইবে।’ বিকটা বলিল, ‘তুই অভাগী রাবণকে কেন ভালবাসিবি না।’ দুর্মুখী বলিল, ‘আমাদের কথা রাখ্, নহিলে তোকে মারিয়া ফেলিব।’
কিন্তু সীতা ইহাদের কোন কথাতেই কান দিলেন না। তাহা দেখিয়া রাক্ষসীরা নিজ-নিজ ঠোঁট চাটিতে চাটিতে কুড়াল লইয়া তাঁহাকে ভয় দেখাইতে লাগিল। নিম্নোদরী বলিল, ‘তোকে খাইব!’ চন্দ্রোদরী বলিল, ‘এটাকে মারিয়া ইহার যকৃত প্লীহা ও বুক সব চিবাইয়া খাইব!’
এইরূপ করিয়া রাক্ষসীরা সীতাকে মারিয়া খাইবার পরামর্শ করিতে লাগিল। তাহা শুনিয়া সীতা বলিলেন, ‘তোমরা আমাকে মারিয়া খাইয়া ফেল। আমার বাঁচিয়া কি কাজ?’ রাক্ষসীরা বলিল, ‘আর দুই মাস থাক্, তারপর তোর মাংস ছিঁড়িয়া খাইব।’এমন সময়ে ত্রিজটা নামে এক বুড়ী রাক্ষসী সেখানে আসিয়া বলিল, ‘তোমরা সীতাকে কষ্ট দিও না। আজ আমি বড় ভয়ানক স্বপ্ন দেখিয়াছি। বোধহয় রাবণ মরিয়া যাইবে আর লঙ্কাও ছারখার হইবে। তোমরা সীতাকে বকিয়াছ, এখন ইহার পায়ে ধরিয়া ক্ষমা চাহ। তাহা হইলে হয়ত তিনি তোমাদিগকে ক্ষমা করিবেন।’
সীতা বলিলেন, ‘ত্রিজটা, তোমার কথা সত্য হইলে আমি তোমাদিগকে ক্ষমা করিব।’ এই কথা বলিয়া তিনি আবার কাঁদিতে লাগিলেন। তারপর সেই শিংশপা গাছের নিকটে আসিয়া, এক হাতে গাছের ডাল ধরিয়া আর এক হাতে মাথার বেণী লইয়া বলিলেন, এই বেণী গলায় বাঁধিয়া মরিব।'
হনুমান শিংশপা গাছে বসিয়া সবই দেখিয়াছে আর মনে মনে ভাবিতেছে কি করিয়া সীতাকে একটু শান্ত করিবে। চারিদিকে রাক্ষসীর দল, সীতার কাছে গেলে তাহারা নিশ্চয়ই দেখিতে পাইবে। কিন্তু যদি শীঘ্র তাঁহার সহিত কথা বলা না হয়, তবে হয়ত তিনি তাহার পূর্বেই মরিয়া যাইবেন! আবার, কথা কহিতে গেলে, যদি রাবণ মনে করিয়া তিনি চিৎকার করিয়া উঠেন, তবে সকল দিকই মাটি হয়। কাজেই এমন করিয়া কথা কহিতে হইবে, যাহাতে তিনি ভয় না পান।
এই ভাবিয়া সে সীতার আর একটু কাছে আসিয়া, আস্তে আস্তে মিষ্ট কথায় বলিতে লাগিল, মহারাজ দশরথের পুত্র রামচন্দ্র বনে আসিয়াছিলেন। সঙ্গে ছিলেন লক্ষ্মণ ঠাকুর আর মা সীতা। দুষ্ট রাবণ রামকে ফাঁকি দিয়া সীতাকে লইয়া আসিল। রাম তাঁহাকে খুঁজিতে খুঁজিতে আসিয়া সুগ্রীবের সহিত বন্ধুতা করিলেন। তারপর সীতার সন্ধান করিবার জন্য সুগ্রীব আমাদিগকে পাঠাইলেন। কত দেশে, কত বনে আমরা সীতা মাকে খুঁজিয়াছি। শেষে সম্পতি পাখির কথায় সাগর পার হইয়া, এখানে আসিয়া বুঝি মায়ের দেখা পাইলাম!’ এই বলিয়া হনুমান চুপ করিল।
হনুমানের কথায় সীতা আশ্চর্য হইয়া চারিদিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিলেন। দেখিলেন, একটি নিতান্ত ছোট বানর গাছের ডালে বসিয়া তাঁহাকে নমস্কার করিতেছে। তাহার গায়ের রঙ অশোক ফুলের মত লাল, চোখ সোনালী, পরনে সাদা কাপড়। ইহা দেখিয়া প্রথমে সীতার বড় ভয় হইল। কিন্তু শেষে অনেক ভাবিয়া তিনি বলিলেন ‘হে দেবতা বৃহস্পতি, হে ব্রহ্মা, হে ইন্দ্র হে অগ্নি, দোহাই আপনাদের! এই বানর যাহা বলিতেছে তাহা সত্য হউক!’
তখন হনুমান গাছ হইতে নামিয়া সীতাকে প্রণাম করিয়া বলিল, ‘আপনি কে মা? কেনই বা এই বনে থাকিয়া এত দুঃখ করিতেছেন? আপনি যদি রামের সীতা হন, তবে আমার কথার উত্তর দিন।’ এই কথা শুনিয়া সীতা বলিলেন, ‘আমি রাজা দশরথের পুত্রবধূ। আমার পিতার নাম জনক, স্বামী রামচন্দ্র। বিমাতার কথায় রাম বনে আসিয়াছিলেন; আমি আর লক্ষ্মণ তাঁহার সঙ্গে আসিয়াছিলাম। সেখান হইতে দুষ্ট রাবণ আমাকে ধরিয়া লঙ্কায় আনিয়াছে। দুই মাস পরে আমাকে মারিয়া ফেলিবে।’
হনুমান সীতার সহিত ভাল করিয়া কথা কহিবার জন্য একটু একটু করিয়া কাছে আসিতে লাগিল। কিন্তু তাহাতে আবার সীতা ভয় পাইয়া বলিলেন, ‘হায় ইহার সহিত কেন কথা বলিলাম? এ হয়ত সেই দুষ্ট রাবণই বানর সাজিয়া আসিয়াছে।’
তাহা শুনিয়া হনুমান জোড়হাতে তাঁহাকে অনেক বুঝাইল। রামের সহিত কেমন করিয়া তাহার পরিচয় হইয়াছে রাবণ সীতাকে লইয়া আসিবার পর রাম কি করিয়া দিন কাটাইতেছেন,তাঁহারাই বা কেমন করিয়া সীতাকে খুঁজিয়াছে, সে সকল কথার কিছুই সে তাঁহাকে বলিতে বাকি,রাখিল না। সকলে্র শেষে, রামের সেই আংটিটি তাঁহার হাতে দিল।
আংটিটি দেখিয়া সীতার মনে আর কোন সন্দেহ রহিল না। তখন আনন্দে তাঁহার সেই সুন্দর মুখখানি উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। তারপর চিন্তিত হইয়া হনুমানকে রামের সংবাদ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। রাম-লক্ষণ কেমন আছেন? তাঁহারা কেন আসিয়া রাবণকে মারিয়া ফেলিতেছেন না? সীতাকে না দেখিয়া রামের শরীর বেশি রোগা হইয়া যায় নাই ত? এইরূপ কত প্রশ্নই তিনি করিলেন। রামের কথা যত জিজ্ঞাসা করেন, ততই তাঁহার আরো জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করে।
হনুমান যার-পর-নাই মিষ্ট কথায় তাঁহার কথার উত্তর দিয়া তারপর বলিল, ‘মা আসুন, আপনাকে পিঠে করিয়া রামের কাছে লইয়া যাই।’
তাহা শুনিয়া সীতা আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এতটুকু বানরটি হইয়া তুমি কি করিয়া আমাকে লইয়া যাইবে?’ হনুমান বলিল, ‘ইচ্ছা করিলেই মা আমি ঢের বড় হতে পারি।’
এই বলিয়া সে দেখিতে দেখিতে পর্বতের মত বড় হইয়া বলিল, ‘মা, আপনার আশীর্বাদে রাবণ আর তাহার লোকজন ঘরবাড়ি সুদ্ধ এই লঙ্কাটাকে আমি মাথায় করিয়া লইয়া যাইতে পারি। আপনার কিছু ভয় নাই। আমার পিঠে উঠিয়া বসুন।’ সীতা বলিলেন, ‘তুমি যে পারিবে তাহা বুঝিয়াছি। কিন্তু সমুদ্রের উপর দিয়া যাইবার সময় আমি নিশ্চয়ই মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া যাইব। কাজেই আমার যাওয়া ঠিক নহে। তুমি শীঘ্র তাঁহাদিগকে এখানে লইয়া আইস।’
হনুমান বলিল, ‘আপনি ঠিক বলিয়াছেন। আচ্ছা, তবে আমাকে এমন একটা কিছু জিনিস দিন যাহা দেখিয়া রামের বিশ্বাস হইবে যে আমি যথার্থই আপনাকে দেখিয়া গিয়াছি।’ একথায় সীতা তাঁহার মাথার মণি খুলিয়া হনুমানের হাতে দিলে হনুমান সেই মণি লইয়া, সীতাকে প্রণাম করিয়া তাঁহার নিকট বিদায় লইল। যাইবার সময় তাঁহাকে অনেক সাহস দিয়া বলিল, ‘মা আপনার কোন চিন্তা নাই, শীঘ্রই আপনার কষ্ট দূর হইবে।’
সীতার নিকট বিদায় লইয়া হনুমান ভাবিতে লাগিল, ‘সীতার সন্ধান ত পাইয়াছি। এখন রক্ষসেরা কেমন যুদ্ধ জানে, তাহার কিছু খবর লইয়া যাইতে পারিলে মন্দ হয় না। আমি যদি এই সুন্দর অশোক বনটিকে নষ্ট করিয়া ফেলি তাহা হইলে রাক্ষসেরা নিশ্চয়ই আমার সহিত যুদ্ধ করিতে আসিবে। তখন আমিও তাহাদের বিদ্যা বুঝিতে পারিব।’
এই বলিয়া হনুমান বিষম হুপ্ হাপ্, দুপ্ দাপ্, মড়্ মড়্ শব্দে অশোক বন ভাঙিতে আরম্ভ করিল। দেখিতে দেখিতে সেই বনের এমন দুর্দশা করিল যে আগুন দিয়া পিটাইলেও তাহার চেয়ে বেশি হয় না। এইরূপে সমস্ত বাগানটিকে ছারখার করিয়া সে একটি সিংহ-দরজার উপরে বসিয়া দেখিতে লাগিল, রাক্ষসেরা এখন কি করে।
এদিকে রাক্ষসেরা বন ভাঙার শব্দে সেখানে আসিয়া দেখিল যে হনুমান তাহার কাজ শেষ করিয়া সিংহ-দরজায় চড়িয়া গর্জন করিতেছে। তখন তাহারা ঊর্ধ্বশ্বাসে গিয়া রাবণকে বলিল, ‘মহারাজ, একটা ভয়ঙ্কর বানর আসিয়া অশোক বন লণ্ডভণ্ড করিয়াছে। বোধহয় সে রামের লোক। সে সীতার সহিত কথা কহিয়াছে আর তিনি যেখানে আছেন সে জায়গাটুকু ভাঙে নাই।’
এ কথা শুনিয়া রাবণ রাগে তাহার কুড়ি চোখ লাল আর কুড়ি পাটি দাঁত কড়্মড়্ করিয়া
তখনই হুকুম দিল, ‘শীঘ্র ওটাকে বধিয়া লইয়া আইস।’ হুকুম পাওয়ামাত্রই বড় বড় রাক্ষসেরা মূষল, মুদগর হাতে মহা তেজের সহিত হনুমানকে বাঁধিয়া আনিতে চলিল। তাহাদিগকে দেখিয়া হনুমান সেই সিংহ-দরজার বিশাল হুড়কাটা হাতে লইয়া বলিল, ‘জয় রামচন্দ্রের জয়।’তারপর আর কয়েক মুহূর্তের বেশি বিলম্ব হইল না। ইহারই মধ্যে সে রাক্ষসগুলির মাথা গুঁড়া করিয়া, আবার সেই সিংহ-দরজায় উঠিয়া ভাল মানুষের মত বসিয়াছে—যেন সে কিছুই জানে না।
খানিক পরে তাহার মনে হইল যে ঐ যে পাহাড়ের মতন বড় বাড়িটা দেখা যাইতেছে সেটাকে ভাঙিতে পারিলে ত বেশ হয়! যেমন কথা তেমনি কাজ। অমনি সেই বাড়িটাকে চুরমার করিয়া হনু আবার সিংহ-দরজায় উঠিয়া বসিয়া আছে।
ততক্ষণে অসংখ্য পাহারাওয়ালা অস্ত্রশস্ত্র লইয়া সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। হনুমানও আর কিছু না পাইয়া, সেই ভাঙা বাড়ির একটা সোনার থাম লইয়াই সে-সকল পাহারাওয়ালাকে পিষিয়া দিল।
এদিকে রাবণ জাম্বুমালীকে যুদ্ধে পাঠাইয়াছেন। কিন্তু তাহার বুক পরিঘের ঘায় ভাঙিতে হনুমানের অধিক সময় লাগিল না। তারপর মন্ত্রীর ছেলেরা যুদ্ধ করিতে আসিয়াছিল। তাহাদিগকেও হনুমান কয়েকটি কিল চড়েই শেষ করিয়া, আবার সেই সিংহ-দরজায় উঠিয়া বসিয়া রহিল।
এইরূপে হনুমান লঙ্কায় যে কি ভয়ানক কাণ্ড বাধাইল তাহা কি বলিব! বড় বড় বীরেরা যুদ্ধ করিতে আসে আর হনু তাহাদিগকে গুঁড়া করিয়া দেয়। ঘোড়া দিয়া ঘোড়া মারে, হাতি দিয়া মারে, রাক্ষস দিয়া রাক্ষস মারে।
দুর্ধর, প্রঘস, বিরূপাক্ষ ভাসকর্ণ আর যুপাক্ষ, ইহাদের এক-একজন অসাধারণ যোদ্ধা। হনুমান দুর্ধরের রথের উপর খালি লাফাইয়া পড়িয়াই রথ আর ঘোড়া-সুদ্ধ তাহাকে থেৎলা করিয়া দিল। তারপর শালগাছ দিয়া বিরূপাক্ষ ও যূপাক্ষকে শেষ করা, পর্বতের চূড়া দিয়া প্রঘস ও ভাসকর্ণকে পেষা আর এটাতে ওটাতে ঠোকাঠুকি করিয়া সঙ্গের রাক্ষসগুলির মাথা ফাটান, এ-সকল ত হনুর পক্ষে কেবল খেলা! সে-কাজ সে চক্ষের পলকে সারিয়া আবার সেই সিংহ-দরজায় উঠিয়া বসিল।
ইহার পর রাবণের পুত্র অক্ষ আট ঘোড়ার রথে চড়িয়া যুদ্ধ করিতে আসিল। সে খুবই যুদ্ধ করিতে পারিত আর প্রথমে অনেক বান মারিয়া হনুমানকে একটু ব্যস্ত করিয়াই তুলিয়াছিল। কিন্তু তাহ অধিক সময়ের জন্য নহে। তাহার পরেই হনুমান এক চড়ে তাহার রথের আটটা ঘোড়াকে আর আট কিল মারিয়া রথখানিকে গুঁড়া করিয়া দিল। তখন অক্ষ রথ হইতে না নামিয়া আর যায় কোথায়? আর হনুও তখন তাহার পা ধরিয়া তাহাকে মাটির উপর এমনি এক আছাড় দিল যে তাহতেই বেচারা একবারে চুরমার! তারপর হনুমান আবার সেই সিংহ-দরজায় উঠিয়া বসিয়া রহিল।
অক্ষের মৃত্যুর কথা শুনিয়া রাবণ তাহার বড় ছেলে ইন্দ্রজিৎকে যুদ্ধে পাঠাইয়া দিলেন। ইন্দ্রজিতের মতন যোদ্ধা লঙ্কায় আর কেহ ছিল না। কিন্তু সে আসিয়াও প্রথমে হনুমানের কিছু করিতে পারে নাই। আর, কি করিয়াই বা পরিবে? বাণ আসিবার আগেই হনুমান সরিয়া বসিয়া থাকে, কাজেই তাহা আর তাহার গায়ে লাগিতে পারে না। তাহা দেখিয়া ইন্দ্রজিৎ রাগের ভরে একেবারে ব্রহ্মাস্ত্র ছাড়িয়া দিল। ব্রহ্মা তাহাকে সেই অস্ত্র দিয়াছিলেন। সে অস্ত্রকে কেহ আটকাইতে পারে না, কাজেই হনুমানও তাহাকে আটকাইতে পারিল না। আবার হনুমানকে ব্রহ্মা বর দিয়াছিলেন যে, কোন অস্ত্রেই তাহার মৃত্যু হইবে না। সুতরাং ব্রহ্মাস্ত্রও তাহাকে মারিতে না পারিয়া, খালি বাঁধিয়া ফেলিল।
ব্রহ্মাস্ত্রে বাঁধা পড়িয়া হনুমান ভাবিল, ‘বেশ হইয়াছে! এখন এরা আমাকে রাবণের কাছে লইয়া যাইবে আর আমিও তাহার সহিত দুটা কথাবার্তা কহিতে পারিব।’
হনুমান বাঁধা পড়িয়াছে দেখিয়া রাক্ষসেরা আনন্দে নাচিতে লাগিল। তাহাদের উৎসাহ দেখে কে! তাহারা মোটা মোটা শনের দড়ি আনিয়া তাহাকে ত শক্ত করিয়া বাঁধিল, তাহাছাড়া তাহাদের যতদূর সাধ্য গালি দিতে আর ভ্যাঙচাইতেও ছড়িল না। হনুমান কিছুই করে না, খালি চ্যাঁচাইতেছে।
এদিকে কিন্তু ব্রহ্মাস্ত্রের বাঁধন খুলিয়া গিয়াছে। কারণ, সে বাঁধন এমনি রকমের যে তাহার উপর আবার দড়ি দিয়া বাঁধিতে গেলে, তাহা আপনি খুলিয়া যায়। যাহা হউক, বাঁধন যে খুলিয়া গিয়াছে, এ কথা হনুমান রাক্ষসদিগকে জানিতে দিল না। ইন্দ্রজিৎ টের পাইল বটে, কিন্তু অন্য রাক্ষসেরা তাহার কিছুই বুঝিল না তাহারা মনে করিল, ‘বাঃ খুব মজবুত করিয়া বাঁধিয়াছি।’ তারপর বিস্তর টানাটানি আর ‘হেঁইয়ো! হেঁইয়ো! করিয়া তাহারা হনুমানকে মারিতে মারিতে বাবণের সভায় লইয়া চলিল।
সেখানে রাক্ষসেরা তাহাকে দেখিয়া কি আশ্চর্যই হইল! কেহ বলিল, ‘আরে, এ বানর কে? এটা এখানে কি করিতে আসিল?’ কেহ বলিল, ‘এটাকে শীঘ্র মারিয়া ফেল!’ কেহ বলিল, ‘পোড়াইয়া ফেল!’ কেহ বলিল, ‘খাইয়া ফেল!’ এই বলিয়া তাহারা হনুমানকে লইয়া টানাটানি করিতে লাগিল।
হনুমান কিছু বলে না। সে কেবল ক্রমাগত রাবণকে আর তাহার সভার ঘরখানি চাহিয়া দেখিতেছে। মণি-মানিকের কাজ করা স্ফটিকের সিংহাসনে রাবণ বসিয়া আছে। তাহার দশ মাথায় দশটি ঝকঝকে সোনার মুকুট। শরীরটি কুচকুচে কালো, তাহাতে রক্তচন্দন মাখানো, তাহার উপর সোনার হার। এক-একটা মুখ যেন এক-একটা জালা! তাহাতে আবার দাঁতগুলি ধারালো, আর ঠোঁটগুলি ঝুলিয়া পড়িয়াছে। হনুমান তাহাকে দেখিয়াই মনে মনে ভাবিল যে এ ব্যক্তি যেমন-তেমন বীর নহে!
এদিকে রাক্ষসেরা হনুমানকে কত কথাই জিজ্ঞাসা করিতেছে—'তুই কোথা হইতে আসিয়াছিস?’ এখানে আসিলি কি করিতে?’ ‘বন ভাঙিলি কেন?’ ‘কে তোকে পাঠাইয়াছে?’ 'ঠিক করিয়া বল্, তাহা হইলে এখনই তোকে ছাড়িয়া দিব, মিথ্যা কহিলে মারিয়া ফেলিব!'
তাহা শুনিয়া হনুমান রাবণকে বলিল, ‘রাজা রাবণ, আমি বানর। তোমাকে দেখিতে লঙ্কায় আসিয়াছিলাম, সহজে তোমার দেখা না পাইয়া বন ভাঙিয়াছি! তাহাতে রাক্ষসেরা আমার সঙ্গে যুদ্ধ করিতে আসিল, কাজেই আমিও তাহাদিগকে মারিয়াছি। আমি রামের দূত, পবনের পুত্র, আমার নাম হনুমান। তোমার ধনজন এত আছে, তোমার কি এমন অন্যায় কাজ করা উচিত? তোমার ভালর জন্যই বলিতেছি, আমার কথা শোন সীতাকে রাখিও না, তাহা হইলে তোমার প্রাণ যাইবে। কি বলিব, রাম আমাকে অনুমতি দেন নাই, নহিলে আমি এখনই তোমার লঙ্কা গুঁড়া করিয়া রাখিয়া যাইতে পারিতাম।’ তখন রাবণ তাহার লাল লাল কুড়িটা চোখ ঘুরাইয়া বলিল, ‘কোথারে জল্লাদসকল, কাট্ ত এটাকে!’ কিন্তু বিভীষণ তাহাকে বারণ করিল।
বিভীষণ রাবণের ছোট ভাই, আর অতিশয় বুদ্ধিমান লোক। সে বলিল, ‘মহারাজ, করেন কি? দূতকে কখনও মারিতে আছে? তাহতে যে ভয়ানক পাপ। দূতকে চাবুক মারা যায়, তাহার মাথা মুড়াইয়া দেওয়া যায়, শরীরের কোন স্থান খোঁড়া করিয়াও মারা যায়, কিন্তু তাহাকে মারা কখনই হইতে পারে না। আর, এটাকে মারিয়া ফেলিলে খবর লইয়া কে যাইবে? তাহা হইলে রাম লক্ষ্মণই বা কি করিয়া এখানে আসিবে, আর রক্ষসেরাই বা কি করিয়া তাহাদিগকে মারিয়া, নিজেদের বাহাদুরি দেখাইবে!’
বিভীষণের কথা শুনিয়া রাবণ বলিল, ‘বিভীষণ, ঠিক বলিয়াছে। ইহাকে মারিয়া কাজ নাই। এই দুষ্টের লেজ পোড়াইয়া দাও, তাহ হইলে দেশে গিয়া আর মুখ দেখাইতে পারিবে না!'
তখন রাক্ষসেরা বোঝা বোঝা নেকড়া আনিয়া হনুমানের লেজে জড়াইতে লাগিল। যত জড়ায় হনুমানের লেজ ততই বড় হয়, আর বেশি নেকড়া লাগে। লঙ্কার নেকড়া ফুরাইয়া যাইবার গতিক আর-কি! নেকড়া জড়ান হইলে, তাহাতে তেল ঢালিয়া আগুন ধরাইয়া দিল।
সেই লেজের আগুন দিয়া হনুমান যে কি কাণ্ড করিবে, তাহা আগে জানিলে কখনই তাহারা এমন করিয়া তাহাতে আগুন ধরাইত না। হনুমান প্রথমেই ত সেই জ্বলন্ত লেজখানি ঘুরাইয়া রাক্ষসদিগকে মারিতে আরম্ভ করিল। যত মারে রাক্ষসেরাও ততই বেশি করিয়া তাহাকে বাঁধে, আর তাহাকে দেখিয়া ছেলে, বুড়ো, আর স্ত্রীলোকেরা হাততালি দিয়া হাসে। এইরূপ করিয়া রাক্ষসেরা লঙ্কার গলি গলি হনুমানকে লইয়া তামাশা দেখাইতে লাগিল। অবশ্য, এ খবর সীতার কাছে পৌঁছিতে অধিক বিলম্ব হইল না। তাহা শুনিয়া সীতা মনে মনে বলিলেন, ‘হে দেবতা অগ্নি, আমি যদি কোন পুণ্য কাজ করিয়া থাকি, তবে তুমি হনুমানকে পোড়াইও না।’
এদিকে হনুমান ভাবিতেছে, ‘কি আশ্চর্য! আমার লেজে এত আগুন, তবু তাহাতে জ্বালা নাই কেন? আগুন যে আমার কাছে হিমের মতন লাগিতেছে। বুঝিয়াছি, আমার পিতা পবন, আর রাম, আর সীতা, ইঁহাদের দয়াতেই এইরূপ হইয়াছে।'
তখন সে মুহূর্তের মধ্যে তাহার শরীরটাকে খুব ছোট করিয়া ফেলিল। তাহাতে বাঁধনের দড়িগুলি আপনা হইতেই খুলিয়া পড়ায়, রাক্ষসেরা আর তাহাকে ধরিয়া রাখিতে পারিল না।
তারপর একটা প্রকাণ্ড দরজার হুড়কা লইয়া রাক্ষসগুলির মাথা ভাঙিতে আর কতক্ষণ লাগে!
বাঁধন ঝাড়িয়া ফেলিয়া হনুমান ভাবিল, ‘এখন কি করি? সমুদ্র ডিঙাইয়া বন ভাঙিয়া, রাক্ষস অনেক মারিয়াছি। এখন এই লেজের আগুন দিয়া এই সকল ঘর দুয়ার পোড়াইতে পারিলেই কাজ শেষ হয়।’
যেই এই কথা মনে করা, আমনি এক লাফে একেবারে ঘরের চালে গিয়া উঠা। তারপর ঘর হইতে ঘরে, সেখান হইতে বাগানে, বাগান হইতে আবার ঘরের ছাদে, এইরূপ করিয়া হনুমান লঙ্কায় আগুন লাগাইয়া ফিরিতে লাগিল। আগে প্রহস্তের বাড়ি, তারপর মহাপার্শ্বের বাড়ি, তারপর বজ্রদংষ্ট্র, ইন্দ্রজিৎ, জাম্বুমালী, মকরাক্ষ, নরান্তক, কুম্ভ, নিকুম্ভ এইরূপ করিয়া একেবারে রাজার বাড়ি পর্যন্ত কিছুই বাকি রহিল না। আগুন যতই জ্বলিয়া উঠিল, বাতাসও
এইরূপ করিয়া হনুমান লঙ্কায় আগুন লাগাইয়া ফিরিতে লাগিল
ততই ছুটিয়া চলিল আর হনুমানও ততই মনের সুখে গর্জন করিতে লাগিল।
সেদিন লঙ্কায় কি সর্বনাশই উপস্থিত হইয়াছিল! যেদিকে চাহিয়া দেখা যায়, সেই দিকেই আগুন দাউদাউ করিয়া জ্বলিতেছে। ধোঁয়ায় আকাশ অন্ধকার, রাক্ষসেরা যে পথ দেখিয়া পলাইবে, তাহারও জোঁ নাই। চারিদিকে কেবল বাতাসের শোঁ-শোঁ, পোড়া কাঠ ফাটার পট-পট, বাড়ি ঘর পোড়ার মড়মড় আর রাক্ষসদিগের হায় হায়। বেচারারা পাগলের মতন ছোটাছুটি করিতেছে আর বলিতেছে, ‘হায় হায় সর্বনাশ হইল।’ ‘ও বাবা গো! এটা কি আসিল!’ ছেলে বুড়ো স্ত্রী পুরুষ কত রাক্ষস যে পুড়িয়া মরিল, তাহার লেখাজোখা নাই।
হনুমান তাহার লেজের আগুন সমুদ্রের জল দিয়া সহজেই নিবাইয়াছিল। কিন্তু লঙ্কার সে সর্বনেশে আগুন কেহই নিবাইতে পারিল না। সেদিন আগুনের তামাশা দেখিয়া হনুমানের মত বড়ই অনন্দ হইয়াছিল।
কিন্তু তাহার আনন্দ অধিকক্ষণ রহিল না। এতক্ষণ সে লঙ্কা পোড়াইতে ব্যস্ত ছিল, তাই সীতার কথা তাহার মনে হয় নাই। তাহার কথা মনে হইবামাত্রই সে ভয়ে আর দুঃখে অস্থির হইয়া ভাবিতে লাগিল, হায় হায়। কি করিলাম সীতাকে-সুদ্ধ বুঝি পোড়াইয়া মারিলাম! এখন আমি রামের কাছে গিয়া কি বলিব যাহা হউক, তখনই আবার তাহার এ কথাও মনে হইল যে সীতা পুড়িয়া মরিবেন ইহা কি সম্ভব? যেন আকাশ হইতে কেহ বলিতেছে, ‘কি আশ্চর্য! লঙ্কা পুড়িযা ছারখার হইল। কিন্তু সীতার কিছুই হয় নাই!’
এ কথা শুনিয়া হনুমানের যে কি আনন্দ হইল তাহা কি বলিব! সে অমনি দুই লাফে গিয়া সীতার নিকট উপস্থিত। তারপর তাঁহাকে অনেক সাহস দিয়া আর তাঁহার পায়ের ধূলা লইয়া, সে সেখান হইতে বিদায় হইল।
লঙ্কার কাছেই অরিষ্ট পর্বত। হনুমান সীতার নিকট বিদায় লইয়া সেই পর্বতে গিয়া উঠিল। তাহার মনে হইল যে সেখান হইতে লাফ দিলে সমুদ্র পার হওয়ার সুবিধা হইবে।
এদিকে হনুমানের সঙ্গের বানরেরা সমুদ্রের ধারে অপেক্ষা করিতেছে। তাহারা কেবল
জাম্ববানের কথায় বানরেরা আনন্দে লাফালাফি করিতে লাগিল। তাহাদের কেহ গাছে চড়ে, কেহ লেজ নাড়ে, কেহ কাপড় উড়ায়, আবার কেহ কেহ মাথা তুলিয়া খালি হনুমানের পথের দিকে চাহিয়া আছে। এমন সময় হনুমান ঝড়ের মতন ছুটিয়া আসিয়া ঢিপ করিয়া সেইখানে পড়িল।
তাহাকে দেখিয়া বানরেরা আর কি তাহাদের আনন্দ সামলাইয়া রাখিতে পারে! তাহারা সকলেই অস্থির হইয়া উঠিল। কি করিয়া তাহাকে আদর আর সম্মান দেখাইবে, তাহাই যেন তাহারা ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছে না। কেহ তাহার বসিবার জন্য গাছের ডাল বিছাইয়া দেয়, কেহ ফল মূল আনিয়া দেয়, কেহ কেহ কিচিমিচি কবে। অনেকে কেবল হাত যোড় করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। হনুমান আগে জাম্ববান অঙ্গদ প্রভৃতি গুরুজনকে প্রণাম করিয়া, তারপর সীতার এবং লঙ্কার খবর সকলকে শুনাইল।
এতদিনে বানরদিগের মনে আবার সুখ আসিয়াছে। তাহাদের কাজ হইয়াছে, এখন সংবাদ লইয়া দেশে ফিরিবার সময় উপস্থিত। ফিরিবার পূর্বে একবার তাহারা মনে করিয়াছিল সীতাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবে;কিন্তু শেষে ভাবিয়া দেখিল যে রামের অনুমতি ভিন্ন তাহ করা উচিত নহে। সুতরাং তাহারা তাড়াতাড়ি কিষ্কিন্ধ্যায় ফিরিয়া চলিল। তিন দিন আগে তাহাদেব মনে যেমন ভয় আর দুঃখ ছিল, এখন তেমনি উৎসাহ আর আনন্দ।
তাহারা যখন কিষ্কিন্ধ্যার কাছে সুগ্রীবের মধুবনে আসিয়া উপস্থিত হইল, তখন তাহদের উৎসাহ আর থামাইয়া রাখিতে পারিল না। অঙ্গদ বলিল, “তোমরা পেট ভরিয়া মধু খাও!” তাহা শুনিয়া বানরেরাও আর তিলমাত্র বিলম্ব করিল না। পেট ভরিয়া মধু আব ফল ত তাহারা খাইলই, তাহার উপর আবার গাছপালা ভাঙিয়া বনের দুর্দশার একশেষ করিল। তাহদের না আছে মৌমাছির ভয়, না আছে পাহারাওয়ালার চিন্তা।
সুগ্রীবের মামা দধিমুখ সেই বনের প্রহরী ছিল। সে তাহাদিগকে কত বারণ করিল, কত ধমকাইল, দুই-একজনকে মারিলও। কিন্তু বানরেরা কি তাহাতে থামে? বরং তাহাবা উলটিয়া দধিমুখেরই নানারকম দুর্দশা করিল। তাহাকে আঁচড়াইয়া কামড়াইয়া, কিলাইয়া, লেজ ধরিয়া টানিয়া বেচারার আর কিছু রাখিল না।
তখন দধিমুখ আর তাহার লোকেরা বানরদের সহিত যুদ্ধ করিতে আসিল। কিন্তু যুদ্ধ করিয়া তাহারা পরিবে কেন? লাভের মধ্যে অঙ্গদের হাতে মার খাইয়া দধিমুখের হাড় ভাঙিবার গতিক হইল।
তখন বেচারা কাদিতে কাদিতে সুগ্রীবের নিকট গিয়া নালিশ করিল। সুগ্রীব তাহার কথা শুনিয়া বলিল, মামা তোমার কথা শুনিয়া বড় সুখী হইলাম। নিশ্চয় উহারা সীতার সন্ধান পাইয়াছে। তাহ না হইলে কি এমন পাগলামি করিতে পারে? মামা, তুমি দুঃখ করিও না; শীঘ্র গিয়া উহাদিগকে পাঠাইয়া দাও।”
দধিমুখও তাহা শুনিয়া ভাবিল, বা! তাইত, উহারা নিশ্চয় সীতার খবর আনিয়াছে।’ তখন কোথায় গেল তাহার বেদনা, কোথায় বা গেল তাহার কান্না। সে সকল দুঃখ ভুলিয়া আমনিহনুমান প্রভৃতিকে আনিতে ছুটয়া চলিয়াছে।
তাহারা আসিলে রাম লক্ষ্মণ আর সুগ্রীব সকল কথাই শুনিতে পাইলেন। হনুমান রামকে সীতার সংবাদ বলিয়া সেই মণি তাঁহার হাতে দিল। রাম মণি হাতে লইয়া, বারবার তাহা দেখিতে লাগিলেন। তারপর তাহা বুকে চাপিয়া ধরিলেন আর তাহার চক্ষু দিয়া ঝর-ঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল।