উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/ছোট্ট রামায়ণ/অযোধ্যাকাণ্ড

অযোধ্যাকাণ্ড


বয়স হইল ষাট হাজার বস্ত্র,
চলিতে কাঁপেন রাজা করি থর্-থর।
ভাবিলেন তাই, ‘মোর বল গেছে টুটি,
রামেরে বুঝায়ে কাজ আমি লই ছুটি।’
তখন বলেন রাজা, “শুন সভাজন,
যুবরাজ কর মোর রামেরে এখন।”
শুনিয়া সুখেতে সবে করে কোলাহল,
আনন্দে কৌশল্যা মার চোখে এল জল।
পুরোহিত মহামুনি বশিষ্ঠ তখন,
যতনেতে করিলেন যত আয়োজন।
সুন্দর বসন পরি সাজিল সকলে,
আনন্দে ধুইল মুখ চন্দনের জলে।
মনের সুখেতে তারা করে গণ্ডগোল,
‘ডিম্বি-ডিম্বি’ ‘তাই-তাই’ বাজে ঢাক ঢোল।
কৌশল্যা দেবীর স্নান হয়েছে কখন,
হরিনাম করে মাতা হয়ে এক মন।
কৈকেয়ার ছিল এক আদরের দাসী,
বিষমুখী হতভাগী কুঁজী সর্বনাশী।
মন্থরা নামটি তার, লোকে কয় ‘কুঁজী’,
কার মেয়ে, কোথা ঘর নাহি পাই খুঁজি।
কুঁজী বলে, “হ্যাঁ গা, এত কিসের বাজনা?”
রামের ধাই-মা কয়, “তাও কি জানো না?
যুবরাজ হবে আজি আমাদের রাম,
তাই এত বাদ্য আর এত ধুমধাম!”
এই কথা ধাই তারে কহিল যখন,
হিংসায় কুঁজীর কুঁজ করে টনটন!
কৈকেয়ীর কাছে গিয়া তখনি সে কয়,
“শোনো, শোনো! আজি রাম যুববাজ হয়!”
রাণীর মনে বড় সুখ হল তায়,
খুলিয়া গলার হার দিল মন্থরায়।
দূরে ফেলি সেই হার কহে দুষ্ট কুঁজী,
“ভালো মন্দ কিসে হয়, নাহি জানো বুঝি!
কুটিল কৌশল্যা রাণী রাজার মা হলে,
হেঁট মুখে রবে তুমি তার পদতলে।

রাম রাজা হলে তোর ভরত মারিবে,
তখন তোমার দশা ভাব ফি হইবে।”
শুকাল রাণীর মুখ এ কথা শুনিয়া,
পরান কঁপিল তার ভরতে ভাবিয়া।
বলে, “কুঁজী বল! বল! কি হবে উপায়?
কেমনে বাঁচাব বল। আমার বাছায়?”
কুঁজী বলে, “ভয় নাই, হলে সেই কাজ
দুই বর তোরে যদি দেয় মহারাজ।
ভরত হলে রাজা, রাম গেলে বনে
ভয় না থাকিবে আর, ভাবি দেখ মনে।
যুদ্ধে গিয়ে মহারাজ ভারি ব্যথা পায়,
পরানে বাঁচে সে খালি তোমারই সেবায়।
দুই বর দিবে রাজা বলেছে তখন,
সে বর চাহিয়া কেন লহ না এখন।
ভরতে করহ রাজা রামে বনে দিয়া,
তারপর সুখে থাক খাটেতে বসিয়া।”
রাণী বলে, “ভালো যুক্তি দিলি কুঁজী মোর,
আজি বনে যাবে রাম, ভয় নাই তোর।”
তখন কুঁজীর সাথে করি কানাকানি,
বিপদ ঘটাল যয় সর্বনাশী রাণী।
ভাঙ্গিল হীরার বালা সানে আছাড়িয়া,
ময়লা কাপড় আনি পরিল খুঁজিয়া।
এলাইয়া কালো চুল শুইল ধূলায়—

ভালোই পাতিল ফাঁদ মারিতে রাজার।
আসিয়া দেখেন রাজা একি সর্বনাশ,
মাথায় পড়িল যেন ভাঙিয়া আকাশ।
কতই ডাকেন রাজা, “রাণী, রাণী, রাণী।”
কৈকেয়ী আঁচল শুধু মুখে দেয় টানি।
রাজা কন, “হায়, রাণী নাহি কয় কথা!
হল কি অসুখ ভারি? পাইল কি ব্যথা?
বল রাণী, দুখ দিল কে তোমার মনে,
তলোয়ারে তার মাথা কাট এইক্ষণে।”
বিনয় করিয়া রাজা কত কথা কয়,
কিছুতে রাণীর হায় দয়া নাহি হয়।
তখন বলেন, “কি চাই তোমার?
এখনি পাইবে তাহা, বল একবার।”

শুনিয়া কৈকেয়ী তারে নাকি সুরে কয়,
“সত্য করি বল আগে, দিবে তা নিশ্চয়।”
রাজা কন, “দিব, দিব, দিব তা তোমারে।”
তাহা শুনি দুষ্ট রাণী হাসি কয় তারে,
“মনে কর সেই যুদ্ধ অসুরের সাথে,
বড় খোঁচা মহারাজ খেলে তার হাতে।
করিয়া কতই সেবা বাঁচাই তোমায়
দিতে মোরে দুই বর চাও তুমি তায়।
আজি মোরে সেই বর দেহ মহারাজ,
বিষ খাব, “যদি নাহি কর এই কাজ।”
রাজা কন, “কহ কহ কিবা সেই বর,
দিব তাহা এইক্ষণ, নাহি কোনো ডর।”
শুনিয়া কৈকেয়ী কয়, “আর কিছু নয়
ভরতেরে যুবরাজ কর মহাশয়।
চৌদ্দ বছরের তরে রাম বনে যাবে,
পরিয়া গাছের ছাল ফল মূল খাবে।”
হায় রে নিষ্ঠ‌ুর কথা! হায় দুষ্ট রাণী!
কি ব্যথা রাক্ষসী দিল রাজারে না জানি!
অজ্ঞান হইয়া রাজা পড়িল ধূলায়,
জাগিয়া চাপড়ি বুক করে হায়-হায়।
অস্থির হইয়া রাগে কাঁপে থর্-থর্,
শিশুর মতন কাঁদে হইয়া কাতর।
পাগল হইয়া ধরে কৈকেয়ীব পায়,
আবার অজ্ঞান হয়ে লুটায় ধূলায়।
তবু হায় রাক্ষসীর দয়া নাহি হয়,
লাজ নাই, ভয় নাই, কটু কথা কয়।
এইভাবে গেল রাত কাঁদিয়া-কাঁদিয়া
সকালে আনিল রাণী রামেরে ডাকিয়া।
রাণীরে বলেন, “মাগো, একি হল হায়?
কেন মা এমন দশা হইল পিতার?
কিসের লাগিয়া মুখে কথা নাহি তাঁর?”
রাক্ষসী বলিছে, “বাছা, ওটা কিছু নয়,
লাজেতে তোমার বাপ কথা নাহি কয়।
রাজা বলেছেন, আজ তুমি যাবে বনে,
জানাতে তোমায় তাহা লজ্জা হয় মনে।



পিতার মনের কথা শুনিলে এখন,
লক্ষ্মী ছেলে, বনে যাও ছাড়ি রাজ্যধন!
চৌদ্দ বছরের পর আসিও আবার
ততদিন হবে রাজা ভরত আমার।”
কহিল কঠিন কথা আদর করিয়া
খেতে যেন দিল বিষ মধু মাখাইয়া।
বারণ করিতে তারে না পারেন রাজা,
‘বর দিব’ বলেছেন, হায় তার সাজা!
শ্রীরাম বলেন, “এই যাই আমি বনে,
তার তরে ভয় মাতা করিও না মনে।
রাজা যদি নাহি হই, কিবা তার দুখ।
থাকিলে পিতার কথা বনেতেও সুখ।
রাজা হয়ে সুখে থাক ভরত আমার
পিতারে দেখিও মাগো, কি বলিব আর।”
অযোধ্যার প্রাণ রাম, তিনি যান বনে,
তাঁহাকে ছাড়িয়া লোক বাঁচিবে কেমনে
রুষিয়া লক্ষ্মণ কন, “মারিব বাজায়!
কৈকেয়ী ভরতে মারি রাখিব দাদায়।”
“ভাই রে আমন কথা আনিয়ো না মুখে।
পিতা হন আমাদের দেবতা সমান,
রাখিব তাঁহার কথা দিয়া এই প্রাণ।”
কৌশল্যার দুঃখ আর কি বলিব হায়—
কথায় সে দুঃখ বলে বুঝানো কি যায়?
রামেরে বিদায় দিতে হইল যখন
না জানি কেমন তাঁর করেছিল মন!
রাম কন, “দেখো মাগো পিতারে আমার,
চৌদ্দ বছরের পরে আসিব আবার।”
সীতা কন, “যেথা রাম, সেথা মোর ঘর,
দুজনে সুখেতে রব বনের ভিতর।”
লক্ষ্মণ বলেন, “দাদা, মোরে লও সাথে,
ফল মূল দিব আনি, তুলি নিজ হাতে।”
সুমিত্রা বলেন, “যাও, যাও রে লক্ষ্মণ,
রামেরে দেখিয়ো বাছা পিতার মতন।
সীতা যেন মা তোমার, এই রেখ মনে,
ঘর ভেবে সুখে বাপ থাক গিয়ে বনে।”

বনে যেতে তিনজন করি তাঁরা মন
কাঙালে করিলা দান যত ছিল ধন।
সুমন্ত্র সারথি আনে রথ সাজাইয়া,
কৈকেয়ী গাছের ছাল দিলেন আনিয়া।
তাহা পরি দুই ভাই করিলেন সাজ,
সীতারে পরাতে নাহি দেন মহারাজ।
বেলা হল, বয়ে যায় যাবার সময়,
প্রণাম করিয়া রাম দশরথে কয়,
“বনে যাই, মহারাজ, দেহ পদধূলি,
দুখিনী মায়ের পানে চেয়ে মুখ তুলি।”
তারপরে তিনজনে চড়ে গিয়ে রথে,
পাগল হইয়া লোকে ছুটে যায় পথে।
কঁদিতে কাঁদিতে রাজা নিজে যান ধেয়ে,
ব্রাহ্মা সকলে যান, আর যত মেয়ে।
কাঁদিয়া কৌশল্যা যান; হায় রে দুখিনী—
আলুথালু হয়ে মাতা ধায় পাগলিনী।
কেমনে এ দুখ দেখি পরানেতে সয়?
“চল, চল,” বলি রাম সারথিরে কয়।
ছুটে যায় রথখানি তীরের মতন,
তার সাথে যেতে আর পারে কয়জন?
তবুও ছুটিয়া রাজা কতদুর যায়,
চলিতে না পারি আর বসিল ধুলায়
চাহিয়া রথের পানে কথা নাহি মুখে,
ঝরিয়া চোখের জল বয়ে যায় বুকে।
চলি গেল রথখানা, দেখা নাহি যায়,
অমনি লুটায়ে রাজা পড়িল ধুলায়!
কৈকেয়ী তুলিতে তারে আইল ছুটিয়া,
“দুর-দুর!” বলি রাজা দিল তাড়াইয়া।
তারপর কৌশল্যার হাতখানি ধরে,
ভাসিয়া চোখের জলে গেল তাঁর ঘরে।
সেথায় শুইল রাজা করি হায়-হায়,
ভাবিয়া রামের কথা বুক ফেটে যায়।

জানি রাম কতদুর যান ততক্ষণ,
কেমনে ছাড়িল তাঁরে অযোধ্যার জন?
তীরের মতন তাঁর রথখানি যায়



কপাল চাপড়ি লােক পিছু-পিছু ধায়।
বলে, “এই দুই দেশে কে রহিবে আর?
রাম যেথা যান, মােরা সাথে যাব তাঁর।”
বেলা শেষ হল, তারা তবু নাহি ফিরে,
আঁধার হইল আসি তমসার তীরে।
থামিল তখন রথ, বসিল সকলে,
ঘরে না ফিরিল তার সাথে যাবে বলে।
শেষে রাতে উঠি রাম গেলেন চলিয়া,
 কেহ না জানিল—সবে ছিল ঘুমাইয়া।
প্রভাতে উঠিয়া তারা করে হায়-হায়,
কাঁদিতে— কাঁদিতে শেষে ঘরে ফিরে যায়।
হেথায় চলেছে রথ তিনজনে লয়ে
নদী বন মাঠ কত যায় পার হয়ে।
শৃঙ্গবের পুরে যেই বেলা গেল চলে,
ইহুদী গাছের তলে বসিলা সকলে।
সে দেশে নিষাদ-রাজা, গুহ তার নাম,
বড়ই সরল সে যে, তার মিতা রাম।
‘রাম এল’ শুনে গুহ ছুটে এল সুখে,
“মিতা, মিতা”, করি তাঁরে জড়াইল বুকে।
গুহ বললে, “খাবি মিতা? এনেছি মিঠাই!”
রাম কন, “হায় মিতা, কি করিয়া খাই?”
যেতে মাের হবে যে রে, যেথা ঘাের বন,
ফল মূল খেতে হবে মুনির মতন।”
শুনিয়া কাঁদিল গুহ হাউ-হাউ করে,
বিনিয় করিয়া রামে কহিল সে পরে,
“থাক্ মিতা মাের হেথা, থাক্ মাের শিরে
ঘর তোর, জন তাের, ডর তাের কি রে?
নাচি-নাচি বই জুতা, ফিরি তাের সনে,
রাজা হয়ে থাক্ মিতা, কেন যাবি বনে?”
রাম কন, “তা তাে ভাই হয় না রে হায়,
তায় যে পিতার কথা মিছা হয়ে যায়!”
গঙ্গা জল খেয়ে রাম থাকেন সে রাতে,
জাগিয়া কাঁদিল গুহ লক্ষ্মণের সাথে।
প্রভাতে গুহের কাছে লইয়া বিদায়,
তিনজনে গঙ্গা পার হলেন নৌকায়।
বনের ভিতরে তাঁরা যান তারপরে

সুমন্ত্র কাঁদিল ফিরি অযোধ্যা নগরে।
বাঘ ভালুকের ঘর ঘোরতর বন,
তাহার ভিতর দিয়া যান তিনজন।
দিন গেল, রাত গেল, সন্ধ্যা এল ফিরে,
প্রয়াগে এলেন তাঁরা যমুনার তীরে।
যেথায় আসিয়া গঙ্গা মিলে যমুনায়,
মহামুনি ভরদ্বাজ থাকেন যেথায়।
মুনি বলে, “জানি রাম এলে কি কারণ,
আমার নিকটে বাপ থাক তিনজন।”
শ্রীরাম বলেন, “হেথা লোকজন চলে,
নিরিবিলি কোথা পাই মোরে দিন বলে।”
মুনি বলে, “চিত্রকুট পর্বতের তলে,
ছায়ায় লুকায়ে নদী মন্দাকিনী চলে।
দুই কূলে আছে গাছ ফল ফুলে ঝুঁকি,
হরিণ ময়ুর আসি দেয় সেথা উঁকি।
বনেতে কোকিল গায়, জলে হাঁস খেলে,
সুখেতে থাকিবে রাম সেইখানে গেলে।”
মুনির পায়ের ধূলা লইয়া তখন
যেথা সেই চিত্রকুট যান তিনজন।
সেথায় কুটির বাঁধি লতায়-পাতায়,
মনের সুখেতে তারা রহিলেন তায়।
হেথা রাজা দশরথ পড়ে বিছানায়।
ফেলেন চক্ষের জল করি হায়-হায়।
এমন সময়ে তাঁরে করিয়া প্রণাম,
কাঁদিয়া সুমন্ত্র কয়, “গিয়াছেন রাম।”
সে কথা সহিতে রাজা নারিলেন আর,
সেই রাতে গেল প্রাণ দেহ ঘড়ি তাঁর।
কাঁদিয়া-কাঁদিয়া সবে ছিল অচেতন,
কেহ না জানিল রাজা মরিল কখন।
পাগল হইলা তারা সকালে উঠিয়া,
ভরতের লাগি লোক চলিল ছুটিয়া।
রাজারে ডুবায়ে রাখি তেলের ভিতরে,
পথ চেয়ে রয় তারা ভরতের তরে।

সবে কাঁদে, কৈকেয়ীর মুখে শুধু হাসি,
সে ভাবে, ভরত বড় সুখী হবে আসি!’

ভরত ফিরিয়া ঘরে কহিলেন তায়,
“কি বিপদ হল মাগো, বল তো আমায়।
কোথা পিতা দাদা আর লক্ষ্মণ আমার?
কেন এ সোনার পুরী হেরি ছারখার?”
রাণী বলে, “পিতা তোর নাই রে বাছনি,”
কাঁদিয়া ভরত তায় পড়েন অমনি।
হায়-হায় করি কন কাতর হইয়া,
“না জানি গেলেন পিতা কি কথা কহিয়া।”
রাণী বলে, “তিনি এই বলেন তখন—
হায় রাম! হায় সীতা! হায় রে লক্ষ্মণ!”
ভরত বলেন, “এ কথা কি কথা ভয়ঙ্কর
কি হল তাঁদের মাতা, বলহ সত্বর।”
রাণী বলে, “মরে নাই, রয়েছে বাঁচিয়া,
দিয়াছি রাজায় বলি বনে পাঠাইয়া।
আপদ হইল দূর বাছারে তোমার,
রাজা হয়ে সুখে থাক, ভয় নাই আর।”
এই কথা দুষ্ট রাণী কয় হাসি মুখে,
ছুরি যেন মারে হায় ভরতের বুকে।
রুষিয়া বলেন তিনি, “কি বলিব হায়,
মা না হলে কাটিতাম এখনি তোমায়।
কভু না হইবে, যাহা আছে তোর মনে,
দাদারে আনিতে আমি এই যাই বনে।”
যাহার লাগিয়া রাণী করে হেন কাজ,
খাইয়া তাহার গালি পায় বড় লাজ।
 
কুঁজী ভাবে, পায় জানি কিবা পুরস্কার,
যত ভাবে, তত কুঁজ উঁচু হয় তার।
মুখ ভরা হাসি আর গাল ভরা পান,
মাকড়ির ভারে যেন ছিঁড়ে দুই কান।
চকচকে চীন শাড়ি, চন্দনের ফোঁটা,
হাতে বালা, নাকে নথ, এই মোটা-মোটা।
দুয়ারে দাঁড়ায়ে ছিল সখীদের সাথে,
দারোয়ান ধরে দিল শত্র‌ুঘ্নের হাতে।
শত্র‍‌ুঘ্ন বলেন, “ভালো পাইলাম দেখা—
আজি কিছু সাজা তোর কপালেতে লেখা।”
চুল ধরি পরে যেই দিলেন আছাড়,

ভেড়ার মতন কুঁজী ডাকে চমৎকার।
মরিত সেদিন বেটি আছাড় খাইয়া,
ভাগ্যেতে ভরত আসি দেন ছাড়াইয়া।
ছাড়া পেয়ে তাড়াতাড়ি পলাইল ছুটি,
বাতাসেতে ফড়‍্ফড়্ উড়ে তার ঝুঁটি!
তখন সকলে মিলি, ভরতের সনে,
রামেরে আনিতে সুখে চলিলেন বনে।
বশিষ্ঠ সুমন্ত্র যান, যায় লোকজন,
কৌশল্যা সুমিত্রা আর দাসদাসীগণ।
 কৈকেয়ী চলেন লাজে মাথা হেঁট করি,
লাখে লাখে যায় সেনা খাঁড়া ঢাল ধরি।
গুহের দেশেতে যেই আসিল সকলে,
গুহ বলে, “দেখ, দেখ, ভরতীয়া চলে!
সেটি মোর মিতাটিকে মারিবেক বটে—
লাগা টাঙ্গি ঝট‍্পট্, ঘরে যাক হটে!”
ভরত কি চান গুহ শুনিল যখন,
আনন্দে করিল তার কতই যতন।
পাঁচশত তরী দিয়া করে গঙ্গা পার,
নাচিতে-নাচিতে যায় সাথে-সাথে তাঁর।
ভরদ্বাজ মুনি সনে দেখা হয় পরে,
ভুলিল সবার মন মুনির আদরে।
ঘোল, চিনি, ক্ষীর, সর, দধি, মালপুয়া,
রাবড়ি, পায়স, পিঠা, পূরী, পানতুয়া।
যত চায়, তত পায়, নাহি ধরে পেটে,
গিলিতে না পারে আর, তবু দেখে চেটে।
মুনি বলিলেন, “রাম থাকে চিত্রকূটে,”
অমনি চলিল সবে সেই পথে ছুটে।
আনন্দে চলেছে তারা হইয়া চঞ্চল,
রামের কুটিরে গেল তার কোলাহল।
গাছে উঠে দেখি তায় কহেন লক্ষ্মণ,
“ভরত যাইল দাদা লয়ে লোকজন।
মোদের মারিতে দুষ্ট আসিছে হেথায়,
মাথা কেটে তার সাজা দিব আমি তায়।”
রাম কন, “ভরতের কোনো দোষ নাই,
তাহারে এমন কথা কেন বল ভাই?”
লাজেতে আসেন তায় নামিয়া লক্ষ্মণ,

কুটিরে গেলেন পরে ভাই দুইজন।
ভরত শত্র‍‌ুঘ্ন আহা তখনি আসিয়া,
লুটায়ে ধুলার পরে পড়েন কাঁদিয়া।
গড়াগড়ি দিয়া তাঁরা কাঁদেন দুজন,
কাঁদেন তাঁদের লয়ে শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
পরে বলিলেন রাম, “ভাই রে ভরত,
কি লাগি সহিয়া দুঃখ এলে এত পথ?
কেন রে গাছের ছাল দেখি তোর গায়,
কেন রে আইলে হেথা ছাড়িয়ে পিতায়?”
ভরত কহেন, “হায়, কোথা পিতা আর?
কাঁদিয়া তোমার তরে প্রাণ গেল তাঁর।”
কাঁদেন তখন সবে ‘পিতা' ‘পিতা' বলে,
কঁদিয়া তাদের ঘিরি আসিয়া সকলে।
দুঃখের ভিতরে রাম পান কিছু সুখ,
এমন সময়ে দেখি জননীর মুখ।
কৌশল্যা কৈকেয়ী আর সুমিত্রার পায,
প্রণাম করেন রাম লুটায়ে ধূলায়।
কাঁদিয়া রামের পায় পড়ি তারপরে
ভরত বলেন, “দাদা, চল যাই ঘরে।”
রাম বলিলেন, “ওরে পরানের ভাই,
থাকুক পিতার কথা আমি এই চাই।
তুমি হবে রাজা, আর আমি রব বনে,
পিতার এ কথা ভাই পালিব দুজনে।”
ভরত যতই তাঁরে করেন বিনয়,
শ্রীরাম করে শুধু, “কেমনে তা হয়?”
বশিষ্ঠ বুঝান কত, কাঁদে রাণীগণ,
কিছুতেই না ফিরিল শ্রীরামের মন।
ভরত কাঁদিয়া তাঁরে কহিলেন শেষে,
“যদি কিছুতেই দাদা না যাইবে দেশে,
তোমার খড়ম খুলে দাও দয়া করে,
তারেই করিব রাজা অযোধ্যা নগরে।
পরিয়া গাছের ছাল, ফল মূল খেয়ে
চৌদ্দ বছরের তরে রব পথ চেয়ে।
তারপরে তুমি যদি না আস ফিরিয়া,
নিশ্চয় মরিব দাদা আগুনে পুড়িয়া।”
রাম বলিলেন, “আমি আসিব তখন,

মায়েরে দেখিয়ো ভাই করিয়া যতন।”
এই বলি রাম তাঁরে করেন বিদায়,
ভরত খড়ম লয়ে যান অযোধ্যায়।
পুরীর ভিতরে কিন্তু নাহি যান আর,
নন্দীগ্রামে রহিলেন, নিকটেই তার।
রামের খড়ম রাখি উঁচু সিংহাসনে,
তাহার উপরে ছাতা ধরেন যতনে।
বাতাস করেন তারে চামর লইয়া,
না করেন কোনো কাজ তারে না বলিয়া।
পরেন গাছের ছাল, খান শুধু ফল,
মনের দুঃখেতে তাঁর চোখে ঝরে জল।