উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/ছোট্ট রামায়ণ/অরণ্যকাণ্ড

অরণ্যাকাণ্ড

তার পরে সীতা আর লক্ষ্মণেরে নিয়া
দণ্ডক বনেতে রাম গেলেন চলিয়া।
দণ্ডক বনেতে যেতে লাগে বড় ডর,
হাতি সিংহ বাঘ সেথা ফেরে ভয়ংকর।
বিরাধ বলিয়া থাকে রাক্ষস সেথায়,
বিঁধে ব্রহ্মার বরে অস্ত্র তার গায়।
খিঁচাইয়া রাখে দাঁত পথ-ঘাট জুড়ি।
কড়‍্মড়ি হাতি খায়—এই বড় ভুঁড়ি!
রামেদের দেখে বেটা আইল ধাইয়া,
তাড়াতাড়ি দিল ছুট সীতারে লইয়া।
শ্রীরাম কাঁদেন তায় করি হায়-হায়,
লক্ষ্মণ বলেন রুষি, “মারহ বেটায়।”
শুনিয়া বিরাধ কয়, “ঝাট‍্ পালা ঘরে!
হেথেরটি মোর গায়ে বিন্ধিবে না করে!”
সাত বাণ যদি রাম মারিলেন তারে,
খেঁকায়ে আইল বেটা রাখিয়া সীতারে।
ঝেড়ে ফেলে বাণ সব, ধায় শ‍ূল নিয়া,
রাম দেন সেই শূল বাণেতে কাটিয়া।
তাহে দুষ্ট দিল ছুট দুভাইকে লয়ে,
কতই তখন সীতা কাঁদিলেন ভয়ে।
ভাঙিলা দুভাই তবে রাক্ষসের হাত


অমনি চেঁচায়ে বেটা হল চিৎপাত।
কিন্তু সে আপদ যে রে কিছুতে না মরে,
পাথরে না পিষা যায়, খড়‍্গে নাহি ধরে।
পুঁতিলেন তাই তারে মিলি দুই ভাই,
চলিলেন তারপর ছাড়ি সেই ঠাঁই।
মুনিদের ঘরে-ঘরে ফিরি তারপর,
সুখেতে কাটিয়া গেল দশটি বৎসর।
পরে আসিলেন তাঁরা পঞ্চবটি বনে,
সেথায় হইল দেখা জটায়ুর সনে।
অতি বড় পাখি সে যে, সম্পাতির ভাই,
রামেরে বলিল, “বাবা থাক এই ঠাঁই।
তোমার পিতার বন্ধু আমি যে রে ধন,
সীতারে দেখিব আমি করিয়া যতন।”
ভারি চমৎকার সেই পঞ্চবটী বন,
নানা রঙে ফুল ফল, দেখে ভরে মন।
দুলিয়া সুন্দর পাখি খেলে ডাল ধরি,
কুলকুল করি বয় নদী গোদাবরী।
সেই পঞ্চবটী বনে, সুন্দর কুটিরে,
সুখেতে থাকেন তাঁরা গোদাবরী তীরে।
হেনেকালে কি হইল শুনহ সকলে—
রাক্ষুসী আইল সেথা সূর্পনখা বলে।
লঙ্কায় রাবণ থাকে, দশ মাথা যার,
এই বুড়ি হতভাগী বোন হয় তার!
হাঁ করে সীতারে বুড়ি কয় গিয়ে ধেয়ে,
“মুহি গিন্নী হব এই বুড়িডারে খেয়ে!”
খাইত সীতারে বুড়ি নিশ্চয় তখন,
ভাগ্যে তাব নাক কান কাটেন লক্ষ্মণ।
ব্যথায় অভাগী তায় মরে মাথা কুটি,
“বাঁপ্পরে! মাঁইরে!” বলি ঐ যায় ছুটি!
গেল বুড়ি খর আর দুষণের ঠাঁই।
সেই দুটা হয় তার মাসতুত ভাই।
লোকজন লয়ে তারা থাকে জনস্থানে,
কাটা নাক নিয়া বুড়ি গেল সেইখানে।
পরে যা হইল সে যে বড় ভয়ংকর
রাক্ষসের ডাকে বন কাঁপে থর‍্থর্।
দেখিতে-দেখিতে তারা, খাঁড়া ঢাল নিয়া,

ছোট্ট রামায়ণ
৭৪৭

হাজারে-হাজারে সেথা আইল ছুটিয়া৷
শ্বাস ফেলি ঘোঁৎ-ঘোঁৎ ভেঙচায় রাগে,
দাঁত কড়মড়ি শুনি বড় ডর লাগে!
লাঠি গদা, শেল শূল, কুড়াল কাটারি,
রোষেতে ছুঁড়িয়া তারা মারে ভারী-ভারী
রামের বাণেতে সব হল খান-খান,
দুই দণ্ডে গেল যত রাক্ষসের প্রাণ৷
একটা রহিল শুধু, অকম্পন বলে,
চেঁচায়ে লঙ্কায় সেটা ছুটে গেল চলে৷
রাবণের কয় কাঁপি, “হেই মোহারাজ!
আরে তোর খরটি তো মরিলেক আজ!
দুসনিয়া ফুসনিয়া যেতো মাল ছিলো,
সবেক মানুসা বেটা বামা কাটি দিলো!”
পরেতে আসিয়া সেই নাককাটি বুড়ি
হাই-মাই করি সেথা কাঁদে মাথা খুঁড়ি৷


লাফায়ে তখন উঠিল রাবণ
বাগেতে আগুন হয়ে,
সারথিরে কয়, “আয় তো রে মোর
গাধাটানা রথ লয়ে!”
সেই রথে চড়ি চলিল রাবণ
যেথায় মারীচ থাকে,
বলে, “চল যাই রামের নিকটে
সাজা দিব আজ তাকে৷”
শুনিয়া মারীচ বলে, “হায় বাপ :
মুই তো না সেথা যাব!
বেটা বড় ভূত, লাগাবেক তীর,
লাট্টু পাক মোরা খাব!”
রাবণ কহিল, “নাহি যাস যদি
এখনি কাটিব তোরে;”
মারীচ কহি।, “যাব, যাব, মুই!
কি করিবি লিয়ে মোরে?”
রাজা কয়, “তুমি সোনার হরিণ
সাজিয়া সেথায় যাবে,
সীতার নিকটে নাচিয়া নাচিয়া
লতা-পাতা খুঁটে খাবে৷

৭৪৮
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

রামেরে তখন দিবে সে পাঠায়ে
তোমারে ধরিয়া নিতে,
দূরে নিয়া তারে চেঁচাইবে তুমি
হা লক্ষ্মণ, হায় সীতে!
তাহা শুনি আর নারিবে লক্ষ্মণ
বসিয়া থাকিতে ঘরে,
আমিও তখন সীতারে লইয়া
ছুট দিব রথে করে।”
সাব্জি লয়ে সীতা তুলিছেন ফুল,
মারীচ তখন এল,
হরিণ সাজিয়া তাঁহার ।নকটে
নাচিতে-নাচিতে গেল।
তাবে দেখি সীতা আনেন অমনি
শ্রীরাম লক্ষ্মণে ডাকি,
লক্ষ্মণ বলেন, “বুঝেছি, এসব
মাবীচ বেটার ফাঁকি।”
হেলা করে সীতা নাহি দেন কান
লক্ষ্মণের সে কথায়,
মিনতি করিয়া পাঠান বামেবে
হরিণ ধরিতে হায
সে পোড়া হবিণ বামেরে লইযা
কত দূব গেল চলে,
বাণ খেয়ে শেষে ডাকিল কাতবে,
“হায় রে লক্ষ্মণ!” বলে।
শুনি তা অমনি লক্ষ্মণেরে সীতা
কাঁদিয়া কহেন ভয়ে,
“হায়, বুঝি তারে খাইল রাক্ষস
যাহ ধনু-শর লয়ে!”
লক্ষ্মণ বলেন, “মারীচের ফাঁকি
নহে গো এ কিছু আর,
রাম বড় বীর, মারিবে তাঁহায়,
এত জোর আছে কার?
একলা হেথায় রাখিয়া তোমায়
যাইব কেমন করে?
কোনো ভয় নাই আসিবেন রাম
এখনি ফিরিয়া ঘরে।”

রুষিয়া তখন কহিলেন সীতা,
“বুঝিনি সকলই হায়,
ওরে দুষ্ট, তুমি এই চাও, যাতে
রাক্ষসে তাঁহারে খায়৷”
কঠিন কথায় ব্যথা পেয়ে হায়
গেলেন লক্ষ্মণ চলি,
অমনি সেথায় আইল রাবণ,
“হর হর বোম!” বলি৷
যোগীর মতন সেজেছে রাবণ
চেনা নাহি যায় তারে,
টিকি দোলাইয়া হাসিয়া-হাসিয়া
আসিল কুটির দ্বারে৷
যোগী ভাবি সীতা বসিতে আসন
দিলেন যতন করে,
ঘরে ছিল ভাত, আনিয়া আদরে
খাইতে দিলেন পরে৷
কহিছে রাবণ, “কার মেয়ে তুমি?
কেমনে আইলে বনে?”
সীতা কন, “আমি জনকের মেয়ে
এসেছি পতির সনে৷”
শুনি দুষ্ট কয়, “ভিখারীর সাথে
বয়েছ কিসের তরে?
বনের ভিতবে বাঘ থাকে ভারি
খাইবে তোমারে ধরে৷
মোর সাথে চল, আমি সেই রাজা,
রাবণ যাহারে কয়,
খাটেতে বসিয়া পাইবে সকল
যা তোমার মনে লয়৷”
সীতা কন তারে, “বটে রে অভাগা
এত বড় মুখ তোর!
আজি তোর দাঁত ভাঙিবেন রাম
দাঁড়া দেখি দুষ্ট চোর৷”
কুড়ি চোখ তায় ঘুরায় রাবণ
রাগেতে পাগল হয়ে,
বিশ পাটি দাঁত করি কড়্মড়্
চলে রে সীতায় লয়ে৷

রথখানি তার আইল অমনি
লাফায়ে উঠিল তায়,
দূরে দুই ভাই জানি কোন ঠাঁই
দেখিল না হায়-হায়!
গাছের উপরে বসিয়া তখন
ঘুমায় জটায়ু পাখি,
চমকি শুনিল ঐ যেন সীতা
কাঁদেন তাহারে ডাকি!
অমনি জটায়ু যমের মতন
ধরিল রাবণে গিয়া,
আধমরা করে ছাড়িল বেটারে
আঁচড় ঠোকর দিয়া।
ভাঙি রথখানি মারি তার ঘোড়া
ছিঁড়ি সারথির মাথা,
কাড়িল ধনুক ঝেড়ে ফেলে বাণ
পিষিল চামর ছাতা।
দেবতার বর পেয়েছে রাবণ,
সে যে মরিবার নয়,
দশ মাথা তার ছিঁড়ে কতবার
আবার নতুন হয়।
বুড়া পাখি হায় কত পারে আর?
বল তার গেল টুটি,
হাত-পা তাহার কাটিয়া রাবণ
সীতা লয়ে যায় ছুটি।


ঘরে ফিরে দুই ভাই না পান সীতায়
কাতরে কাঁদেন রাম করি হায়-হায়।
খুঁজিলেন বনে-বনে গুহায়-গুহায়,
গোদাবরী তীরে আর যত ঝরনায়।
কোথাও না পান তাঁরা দেখিতে সীতারে,
কেহ নাই, তাঁর কথা জিজ্ঞাসেন যারে।
পরে আইলেন তাঁরা জটায়ু যেথায়,
রয়েছে অবশ হয়ে পড়ে যাতনায়।
রোষেতে বলেন রাম দেখিয়া তাহারে,
“এই দুষ্ট খাইয়াছে আমার সীতারে!
রাক্ষস পাখির মতো রয়েছে সাজিয়া—

ঘুমায় কেমন দেখ, সীতারে খাইয়া।”
এই বলি তারে রাম যান মারিবারে
কষ্টেতে তখন পাখি কহিল তাঁহারে—
“মেরে তো আমায় বাপ গিয়েছে রাবণ,
তারপরে তুমি আর মেরো না রে ধন।
পলায়ে গিয়েছে দুষ্ট লয়ে সীতা মায়,
প্রাণ গেল, না পারিনু রাখিবারে তাঁয়।”
জটায়ুরে বুকে লয়ে দুভাই তখন,
কাঁদেন কাতর হয়ে, শিশুর মতন।
কিন্তু হায়, সেই ক্ষণে প্রাণ গেল তার
কিছুই কহিতে পাখি পারিল না আর।
সেথা হতে তারপর সীতারে খুঁজিয়া,
চলিলেন দুই ভাই ঘন বন দিয়া।
কবন্ধ রাক্ষস ছিল তাহার ভিতর,
কি আর কহিব সে যে কত ভয়ংকর।
মাথা নাই, গলা নাই, আছে শুধু ভুঁড়ি,
হাঁ করে রয়েছে তাই সারা বন জুড়ি।
থামের মতন তার বড়-বড় দাঁত,
যোজন জুড়িয়া দুই সর্বনেশে হাত।
একখানা চোখ দিয়া চায় কট্‌মট্‌,
হাতি মোষ যাই দেখে, ধরে চট্‌পট্‌!
শ্রীরাম লক্ষ্মণ যান সেই বন দিয়া,
খপ্‌ করে নিল বেটা তাঁদেরে ধরিয়া।
তখন বলেন তাঁরা, “খায় বুঝি গিলে,
এই বেলা কাটি হাত দুই ভাই মিলে।”
এই বলি দুই ভাই তলোয়ার দিয়া,
তাড়াতাড়ি হাত তার ফেলেন কাটিয়া।
গড়াগড়ি দিয়া কিবা চেঁচাইল তায়,
কহিল সে, “কে তোমরা? বল তা আমায়।”
শুনিয়া তাঁদের নাম বিনয়ে সে কয়,
“ভাগ্যেতে আমার হেথা এলে মহাশয়
এখন পোড়াও মোরে যদি দয়া করে
ঘুচিবে আমার দুঃখ, যাব নিজ ঘরে।”
আগুন জ্বালিয়া ভারি দুজনে তখন
কবন্ধে পোড়ান তায় শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
অমনি দেখেন তাঁরা, কিবা চমৎকার,

পরম সুন্দর দেহ হইল তাহার।
আগুন হইতে উঠি তখন সে কয়,
“সুগ্রীবের কাছে তুমি যাও মহাশয়।
ঋষ্যমূক পরবতে, পম্পা নদী-তীরে,
থাকে সে লইয়া সাথে বড়-বড় বীরে।
ত্বরায় তাহারে বন্ধু কর মহাশয়,
করিয়া সীতার খোঁজ দিবে সে নিশ্চয়।”
তাহা শুনি দুই ভাই যান সেথা হতে,
যেথায় সুগ্রীব থাকে সেই পরবতে।