উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/ছোট্ট রামায়ণ/কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড
কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড
তারপর পম্পা নদী পার হয়ে শেষে,
আসিলেন দুই ভাই বানরের দেশে।
বানর কতই সেথা থাকে ভারী-ভারী,
পর্বত ছুঁড়িয়া মারে লম্বা লেজ নাড়ি।
রাজা তার বড় বীর, বালী নাম ধরে,
সুগ্রীব তাহার ভাই, কাঁপে তার ডরে।
কিষ্কিন্ধ্যায় থাকে বালী লোকজন লয়ে
ঋষ্যমুক নাহি যায় মাতঙ্গের ভয়ে।
সেই মুনি এই শাপ দিয়েছিল তায়,
“মাথা ফেটে যাবে তোর, আসিলে হেথায়।”
সেই ভয়ে ঋষ্যমুকে নাহি যায় বালী
দূর থেকে সুগ্রীবেরে দেয় শুধু গালি।
পর্বত হইতে দেখি শ্রীরাম লক্ষ্মণে,
বড়ই হইল ভয় সুগ্রীবের মনে।
মন্ত্রী হনুমানে ডেকে বলিল তখন,
“কি লাগি আইল হেথা মানুষ দুজন?
নিশ্চয় জানিয়া হনু আইস ত্বরায়।”
গোপ-দাড়ি পরে হনু সাজিল সন্ন্যাসী
রামের নিকটে পরে দেখা দিল আসি।
বড়ই পণ্ডিত হনু, ভারি বুদ্ধিমান,
হাসি-হাসি কথা কয়, মধুর সমান।
রামেরে করিল সুখী মিষ্ট কথা কয়ে,
কাঁধে করে গেল পরে দুজনেরে লয়ে।
সুগ্রীব রামের কাছে জোড়হাতে কয়,
“দয়া করে মোর মিতা হও মহাশয়।
কত দুঃখ দিয়া বালী দিল তাড়াইয়া
রাজা কর মোরে রাম তাহারে মারিয়া।”
শ্রীরাম কহেন তারে, ‘‘আমি তাই চাই,
হইতে তোমার মিতা এনু এই ঠাঁই।
বালীরে মারিয়া রাজা করিব তোমায়,
দয়া করে দাও মিতা খুঁজিয়া সীতায়।”
সুগ্রীব কহিল, “মিতা, নাহি কোনো ভয়
সীতারে খুঁজিয়া মোরা আনিব নিশ্চয়।
সেদিন রাবণ গেল এইখান দিয়া,
দেবতার মতো এক মেয়েকে লইয়া।
কেঁদেছিল সেই কন্যা তোমাদের ডাকি,
সকলে শুনিলু মোরা এইখানে থাকি।
ফেলি গেল অলংকার মোদের দেখিয়া
যতন করিয়া তাহা দিয়াছি রাখিয়া।”
কতই কাঁদেন রাম দেখে অলংকার,
“সীতা, সীতা” বলে বুক ফাটে যেন তাঁর
সুগ্রীব কহিল তাঁরে, “কাঁদিয়ো না মিতা,
নিশ্চয় কহিনু মোরা এনে দিব সীতা।”
তখন রামের বড় সুখ হল মনে,
হাসিয়া কহেন কথা সুগ্রীবের সনে।
সুগ্রীব কহিল, “মিতা, বড় ভয় পাই,
বালীর সমান বীর কোথাও যে নাই।
দুন্দুভি দানবে বালী ফেলে দিল ছুঁড়ে,
যোজন দূরেতে এসে পড়িল সে উড়ে।
ঐ দেখ পড়ে সেই দুন্দুভির হাড়,
দেখ, তায় কত বড় হয়েছে পাহাড়।
হেসে বালী শালগাছ ফোঁড়ে শূল দিয়া,
পর্বতের চুড়া লয়ে খেলে সে লুফিয়া।
দুন্দুভির হাড় তুমি পার কি ছুঁড়িতে?
তীর মারি শালগাছ পার কি ফুঁড়িতে?”
পায়ের আঙুলে রাম সেই হাড় ঠেলে,
দিলেন যোজন দশ দূরে তাহা ফেলে।
গাঁথা গেল সাত শাল তাঁর এক তীরে,
পর্বত পাতাল ফুঁড়ে এল তাহা ফিরে।
তখন সুগ্রীব ধরি শ্রীরামের পায়,
নাচিতে-নাচিতে ধূলা লইল মাথায়।
যত ভয় ছিল তার, গেল দূর হয়ে,
চলিল সে কিষ্কিন্ধ্যায় শ্রীরামেরে লয়ে।
লাফায়ে-লাফায়ে সেথা করে গরজন,
‘‘কোথায় গেলে হে দাদা? এস-না এখন।”
সে ডাক শুনিয়া বালী সহিবে কেমনে?
ঝড়ের মতন ছুটে এল সেই ক্ষণে।
দুজনে বিষম যুদ্ধ হল তারপর,
কিবা তার লাথি কিল আঁচড় কামড়।
ঢিপ্, ঠাস্, ধুপ্, ঘট্, ঘোঁৎ, হুপ্, ধাই,
কত শব্দ হল তায়, শেষ তার নাই।
হোথায় দাঁড়ায়ে রাম তীর হাতে নিয়া,
বালীরে মারিতে চান সেই তীর দিয়া।
কিন্তু তিনি পড়েছেন বড় ভাবনায়,
কে বা বালী, কে বা মিতা, বুঝা নাহি যায়
বাণ না মারেন রাম এই ভয় করে।
কিল গুঁতা খেয়ে মিতা ছুটে এল হটে,
হাঁপায়ে রামেরে আসি কহিল সে চটে,
“এই মোর মিতা তুই! এই তোর কাজ!
তোর লাগি এত কিল খাইলাম আজ।”
শ্রীরাম বলেন, “মিতা করিও না রোষ,
চিনিতে নারিনু তোরে তাই হল দোষ।
গলে বেঁধে এই লতা যাও তুমি ফিরে
মারি কি না মারি দেখ তখন বালীরে!”
সুগ্রীব সে লতাখানি পরিল গলায়,
চেঁচায়ে ডাকিল পরে, ‘‘আয়, দাদা আয়!’’
আবার বিষম যুদ্ধ করিল দুজন,
রামের বাণেতে বালী মরিল তখন।
এমতে বালীরে মারি শ্রীরাম ত্বরায়,
সুগ্রীবেরে করিলেন রাজা কিষ্কিন্ধ্যায়।
অঙ্গদেরে যুবরাজ করিলেন পরে,
সে হয় বালীর পুত্র, ভারি বল ধরে।
তখন ছুটিল যত বানরের দল,
ধুলা উড়াইয়া আর করি কোলাহল।
দেশে-দেশে ফিরি তারা খুঁজিল সীতারে,
পর্বতে নগরে বনে সাগরের পারে।
খুঁজিয়া-খুঁজিয়া পুবে পশ্চিমে উত্তরে,
কোথাও না পেয়ে তাঁরে ফিরে এল ঘরে।
দক্ষিণের লোক ফিরে আসে নি কেবল,
সেথা গেছে হনুমান লয়ে তার দল।
আঙুটি খুলিয়া রাম দিয়াছেন তারে,
পাইলে সীতার দেখা দেখাতে তাঁহারে।
খুঁজেছে নদীর তীরে, পর্বত উপরে,
ঘন বনে, অন্ধকার গুহার ভিতরে।
কোথাও সীতার দেখা না পাইয়া তারা
সাগরের ধারে আসি কেঁদে হল সারা।
বলে, “আর কোন মুখে ফিরে যাব ঘরে?
না খেয়ে মরিব মোরা এইখানে পড়ে।”
তখন কি হল, সবে শুন মন দিয়া,
সেইখানে ছিল পাখি সম্পাতি বসিয়া।
পাখা নাই তার, তাই উড়িতে না পারে,
সেথায় বসিয়া থাকে সাগরের ধারে।
বানর এসেছে এত, দেখিয়া সম্পাতি,
তাদের সকল কথা শোনে কান পাতি।
বানর বসিল সেথা মরিবার তরে,
পাখি বলে, “বেশ হল, খাব পেট ভরে!”
বানর কহিল যবে জটায়ুর কথা,
শুনিয়া বড়ই মনে পাইল সে ব্যথা।
বানর সীতার কথা কহিল যখন,
সম্পাতি কহিল, “তাঁরে নিয়েছে রাবণ।
একশো যোজন এই রয়েছে সাগর,
তারপরে লঙ্কা, সেথা রাবণের ঘর।
সূর্যের তেজেতে পাখা পুড়িল আমার,
সীতার সংবাদ দিলে হবে তা আবার।
নিশাকর মুনি এই কহিল আমারে,
সেই হতে বসে আছি সাগরের ধারে।”
তখন দেখিল চেয়ে যতেক বানর,
সম্পাতির লাল পাখা হইল সুন্দর।
আনন্দে আকাশে উড়ে গেল সে চলিয়া,
কোলাহল করে যত বানর মিলিয়া।
তখন অঙ্গদ কয় সকলেরে ডাকি,
“এখন সাগর শুধু ডিঙ্গাইতে বাকি।
তোমরা তো বড় বীর, তায় ভুল নাই,
সাগর ডিঙ্গাবে কেবা, বল দেখি ভাই?”
বড়ই বিষম যেন লাগে সেই কাজ।
“সাগর ডিঙ্গাতে পারে বীর হনুমান।”
চুপ করে ছিল হনু বসে একধারে
সাগর ডিঙ্গাতে কয় জাম্ববান তারে।
হনু বলে, “চল যাই মহেন্দ্র পর্বতে
সাগর ডিঙ্গাতে লাফ দিব সেথা হতে।”