উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/পুরাণের গল্প/মহিষাসুর

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

মহিষাসুর

 একটা ভারি ভয়ংকর অসুর ছিল। সে মহিষ সাজিয়া বেড়াইত, তাই সকলে তাকে বলিত মহিষাসুর।

 দেবতারা কিছুতেই মহিষাসুরকে আঁটিতে পারিতেন না। একশত বৎসর ধরিয়া তাঁহারা তাহার সঙ্গে যুদ্ধ করিলেন, তাহাতে সে তাঁহাদিগকে হারাইয়া স্বর্গ হইতে তাড়াইয়া দিয়া নিজে আসিয়া ইন্দ্র হইল।

 দেবতারা তখন আর কি করেন? তাঁহারা ব্রহ্মাকে সঙ্গে করিয়া মহাদেব আর বিষ্ণুর নিকটে গিয়া উপস্থিত হইলেন, বলিলেন, “হে প্রভু, মহিষাসুর তো আমাদের বড়ই দুর্দশা করিয়াছে, আমাদিগকে যুদ্ধে হারাইয়া স্বর্গ হইতে তাড়াইয়া দিয়াছে; এখন আপনারা যদি আমাদিগকে রক্ষা না করেন, তবে আমাদের উপায় কি হইবে?”

 অসুরদের অত্যাচারের কথা শুনিয়া শিব এবং বিষ্ণুর বড়ই রাগ হইল। সেই রাগে তাঁহাদের আর সকল দেবতাদের শরীর হইতে এমন একটা তেজ বাহির হইল যে সে বড়ই আশ্চর্য; মনে হইল যেন একটা আগুনের পর্বত আকাশ পাতাল ছাইয়া সকলের সামনে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। দেখিতে দেখিতে সেই তেজ জমাট বাঁধিয়া একটি দেবীর মতো হইল।

 তাহাকে দেখিয়া দেবতাদিগের আনন্দের আর সীমা রহিল না। তাঁহারা সকলে মিলিয়া কেহ অস্ত্র, কেহ বস্ত্র, কেহ বর্ম, কেহ অলংকার আনিয়া তাঁহাকে দিতে লাগিলেন। হিমালয় বিশাল একটি সিংহ আনিয়া তাঁহার বাহন করিয়া দিলেন।

 দেবীর হাজারখানি হাতে দশদিক ছইয়া গিয়াছে, তাঁহার মুকুট আকাশ ভেদ করিয়া উঠিয়াছে, তাঁহার ভারে পৃথিবী বসিয়া পড়িয়াছে, ধনুর শব্দে আকাশ পাতাল কাঁপিতেছে। তিনি যখন হাজার হাতে হাজার অস্ত্র লইয়া গর্জন করিলেন, তখন বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড কাঁপিয়া উঠিল; অসুরেরা সেই গর্জন শুনিয়া ছুটিয়া আসিল।

 তারপর কি যেমন তেমন যুদ্ধ হইল? মহিষাসুর নিজে যেমন ভয়ংকর তাহার এক একটি সেনাপতিও তেমনি। তাহাদের একটার নাম চিকুর, আর একটার নাম চামর, আরগুলির নাম উদগ্র, মহাহনু, অসিলোমা, বাস্কল, পারিবারিত আর বিড়ালাক্ষ। এইসকল সেনাপতি আর কোটি কোটি অসুর লইয়া মহিষাসুর দেবীর সঙ্গে যুদ্ধ করিতে আসিল। সকলে মিলিয়া অস্ত্র যে কত ছুঁড়িল তাহার সীমা সংখ্যা নাই। কিন্তু সে অস্ত্রে দেবীর কিছুই হইল না। তাঁহার এক এক নিশ্বাসে হাজার হাজার ভূত উপস্থিত হইয়া অসুরের দলকে ঠেঙ্গাইয়া ঠিক করিতে লাগিল। দেবীর সিংহও আঁচড়-কামড় দিয়া তাহাদিগকে কম নাকাল করিল না। আর দেবীর নিজের তো কথাই নাই। তাহার হাজার হাতে হাজার অস্ত্র; সে অস্ত্রে তিনি অসুরদিগকে কাটিয়া, ফুঁড়িয়া, পিষিয়া, পুঁতিয়া শেষ করিতে লাগিলেন। সেনাপতিগুলিও কোনোটা দেবীর অস্ত্রের ঘায়ে, কোনোটা তাঁহার কিলে আর চাপড়ে, কোনোটা বা সিংহের কামড়ে মারা গেল। তখন আর মহিষাসুর চুপ করিয়া থাকিতে পারিল না। সে শিং নাড়িয়া লেজ ঘুরাইয়া, গর্জন করিতে করিতে দেবীর ভূতগুলিকে এমনি তাড়া করিল যে তাহারা পলাইতে পারিলেই বাঁচিত, কিন্তু বাঁচিতে পারিলে তো পলাইবে! দেখিতে দেখিতে সে ভূতের দলকে শেষ করিয়া দেবীর সিংহের পানে ছুটিয়াছে, তাহার লেজের তাড়ায় সাগর লণ্ডভণ্ড, শিং-এর নাড়ায় মেঘ সব খণ্ড খণ্ড হইতেছে, নিশ্বাসের চোটে পাহাড় পর্বত উড়িয়া যাইতেছে। এমন সময় দেবীর পাশ অন্ত্র আসিয়া তাহাকে এমনি বাঁধন বাঁধিল যে আর তাহার নড়িবার শক্তি নাই। কিন্তু, অসুরের মায়া, সে কি সহজ কথা? চোখের পলকে মহিষটা সিংহ হইয়া বাঁধন ছড়াইয়া আসিল! দেবী তখনই সেই সিংহকে কাটিলেন। অমনি দেখা গেল যে আর সিংহ নাই, তাহার জায়গায় খড়্গ হতে একটা মানুষ খেপিয়া আসিতেছে। মানুষ কাটা যাইতে না যাইতেই কোথা হইতে এক হাতি আসিয়া দেবীর সিংহকে শুঁড় দিয়া জড়াইয়া বসিয়াছে। দেবী খড়্গ দিয়া হাতির শুঁড় কাটিলেন, অমনি হাতি আবার মহিষ হইয়া গেল, সেটা আবার শিং দিয়া দেবীকে পর্বত ছুঁড়িয়া মারে। দেবী এক লাফে সেই মহিষের ঘাড়ে চড়িয়া তাহাকে এমনি শূলের ঘা মারিলেন যে তখন অসুর মহাশয়কে সেই মহিষের ভিতর হইতে বাহির হইতেই হইল। কিন্তু তখনো তাহার তেজ কমে নাই, সে আধাআধি বাহির হইয়া যুদ্ধ আরম্ভ করিয়াছে!

 যাহা হউক, যুদ্ধ আর তাহার বেশিক্ষণ করিতে হইল না। কেননা, দেবী সেই মুহূর্তেই খড়্গ দিয়া তাহার মাথা কাটিয়া ফেলিলেন।

 তখন তো দেবতাগণের খুব আনন্দ হইবেই। তাঁহারা দেবীকে প্রণাম করিয়া তাঁহার অনেক স্তবস্তুতি করিলেন।

 দেবী তাহাতে তুষ্ট হইয়া বলিলেন, “তোমরা কি বর চাও?”

 দেবগণ বলিলেন, “আবার কি বর চাহিব? মহিষাসুর মরিয়াছে। তাহাতেই আমাদের ঢের ইয়াছে। এখন শুধু এইটুকু বল যে আমাদের আবার যদি বিপদ হয় তখন ডাকিলে আসিবে।”

 দেবী বলিলেন, “আচ্ছা, আমি আসিব।”

 এই বলিয়া তিনি আকাশে মিলাইয়া গেলেন।

 অসুর যতদিন আছে, ততদিন দেবতাদিগের বিপদ হওয়ার আর ভাবনা কি?

 কাজেই বুঝিতেই পার যে দেবীকে শীঘ্রই আবার তাঁহাদের ডাকে আসিতে হইয়াছিল।