উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/পুরাণের গল্প/শুম্ভ-নিশুম্ভ
শুম্ভ, আর তাহার ভাই নিশুম্ভ, এই দুটা অসুর দেবতাদিগকে বড়ই নাকাল করিয়াছিল। তাহারা তাঁহাদিগকে স্বর্গ হইতে তাড়াইয়া দিয়া আর অস্ত্র-শস্ত্র কাড়িয়া লইয়াই সন্তুষ্ট থাকে নাই, তাঁহাদের ব্যবসায় পর্যন্ত নিজেরা করিতে আরম্ভ করিল। চন্দ্র, সূর্য, কুবের, পবন, অগ্নি কাহারও ব্যবসাই তাঁহাদের হাতে রাখিল না।
বিপাকে পড়িয়া দেবতারা বলিলেন, “আর কাহার কাছে যাইব। মহিষাসুরের হাত হইতে যে দেবী আমাদিগকে বাঁচাইয়াছিলেন; সেই চণ্ডিকা দেবীকেই ডাকি।” এই বলিয়া তাঁহারা হিমালয় পর্বতে গিয়া চণ্ডিকা দেবীর স্তব করিতে লাগিলেন। সেই সময় পার্বতী সেই পথে যাইতেছিলেন, তিনি দেবতাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনারা কাহার স্তব করিতেছেন?” তাহার কথা শেষ হইতে না হইতেই তাঁহার শরীর হইতে চণ্ডিকা দেবী বাহির হইয়া বলিলেন, “দেবতারা আমাকেই ডাকিতেছেন, শুম্ভ-নিশুম্ভ তাঁহাদিগকে তাড়াইয়া দিয়াছে।” এই বলিয়া চণ্ডিকা দেবী যারপরনাই সুন্দর একটি মেয়ে সাজিয়া হিমালয় পর্বতে বসিয়া রহিলেন।
চণ্ড আর মুণ্ড নামে দুটা অসুর সেইখানে কি করিতে আসিয়াছিল, তাহারা সেই মেয়েটিকে দেখিতে পাইয়া শুম্ভকে গিয়া বলিল যে, “মহারাজ, হিমালয় পর্বতে কি আশ্চর্য সুন্দরী একটি মেয়েকে দেখিয়া আসিয়াছি কি বলিব। এমন আর কেহ কখনো দেখে নাই। মহারাজ, সংসারে যত ভালো ভালো জিনিস, সব আপনারা আনিয়াছেন, কিন্তু এই মেয়েটিকে রানী করিতে না পারিলে সবই মাটি।”
এ কথা শুনিয়া শুম্ভ তখনই সুগ্রীব নামে একটা অসুরকে ডাকিয়া বলিল, “সুগ্রীব, শীঘ্র যাও। যেমন করিয়া পার সেই মেয়েটিকে খুশি করিয়া এখানে লইয়া আইস।”
সুগ্রীব হিমালয়ে গিয়া দেবীকে বিশেষ করিয়া বুঝাইতে লাগিল, “আমার প্রভু যে শুম্ভ আর নিশুম্ভ, তাহাদের মতন আর জগৎ-সংসারে কেহই নাই। হে দেবি, ইঁহাদের একজনকে বিবাহ করিলে তোমার আর সুখের সীমা থাকিবে না।”
দেবী বলিলেন, “আহা। তুমি বড় ভালো কথা বলিয়াছ, তোমার যে প্রভু, তাঁহাদের মতন আর কোথাও কেহ নাই। কিন্তু আমার ছেলেমানুষী খেয়াল হইয়াছে, আমাকে যুদ্ধে হারাইতে না পারিলে কেহ আমাকে বিবাহ করিতে পারিবে না। তোমার প্রভুকে গিয়া বল শীঘ্র আসিয়া আমাকে যুদ্ধে হারাইয়া বিবাহ করুন।”
এ কথা শুনিয়া শুম্ভ কি ভয়ানক চটিল, বুঝিতে পার। সে অমনি তাহার সেনাপতি ধুম্রলোচনকে বলিল, “যাও তো ধূম্রলোচন, সেই ঠেঁটা মেয়েটাকে চুলে ধরিয়া নিয়া আইস।” ধূম্রলোচন অনেক লোক লইয়া ভারি ঘটা করিয়া দেবীকে আনিতে গেল। কিন্তু সে তাঁহাকে ধরিয়া আনিবে কি, তিনি কেবল একটিবার ‘হুঁ’ করিয়া তাহার দিকে চাহিবামাত্রই পুড়িয়া ছাই, তাহার সঙ্গে আর যত অসুর আসিয়াছিল, দেবীর সিংহই তাহাদিগকে শেষ করিয়া দিল।
তখন শুম্ভ আরো অনেক সৈন্য, রথ, হাতি, ঘোড়া সঙ্গে দিয়া সেই চণ্ড আর মুণ্ডকে পাঠাইল। তাহারা খাঁড়া ঢাল হাতে হিমালয়ে গিয়া বিষম কাঁইমাই শব্দে যেই দেবীকে ধরিতে যাইবে অমনি দেবী ভ্রূকুটি করিয়া তাহাদের দিকে তাকাইলেন। ভ্রূকুটি করিবামাত্র তাঁহার কপাল হইতে আর একটি দেবতা বাহির হইয়া আসিলেন, তাঁহার নাম চামুণ্ডা। তাঁহার চেহারা বড়ই ভয়ংকর। রঙ কালো, চোখ লাল, শরীরে মাংস নাই, খালি হাড় আর চামড়া। হা ঁকরিলে পাহাড় পর্বত গিলিয়া ফেলিতে পারেন, চ্যাঁচাইলে দেব দানব সকলের মাথা ঘুরিয়া যায়। চামুণ্ডা বাঘের ছাল পরিয়া, মানুষের মাথার মালা গলায় দিয়া গদা খড়্গ পাশ হাতে আসিয়াই অসুরদিগকে ধরিয়া মুড়ি-মুড়কির মতো মুখে পুরিতে লাগিলেন। হাতি, রথ, ঘোড়া, মাহুত, সারথি, অঙ্কুশ, জাঠা, গদা, যাহা হাতে উঠে, মনের সুখে চিবাইয়া খান, বাছিবার দরকার হয় না। অসুরদের যত অস্ত্র আসে, সব গিলিয়া ফেলেন, আর হি, হি, হি, হি করিয়া হাসেন। দেখিতে দেখিতে চামুণ্ডা সকল অসুর খাইয়া শেষ করিলেন। বাকি রহিল কেবল চণ্ড আর মুণ্ড! তাহাদের চুলে ধরিয়া মাথা কাটিতেও মুহূর্তেক মাত্র লাগিল।
ইহার পর শুম্ভ আর নিশুম্ভ নিজেই যুদ্ধ করিতে আসিল। তাহাদের সঙ্গে অতি ভয়ংকর ভয়ংকর অসুর যে কত আসিল, আর হাতি, ঘোড়া, রথ, অস্ত্র যে কতরকম আসিল, তাহার সীমা সংখ্যা নাই। আর যুদ্ধ যাহা হইল, তাহার কথা কি বলিব! দেবীর সঙ্গে চামুণ্ডা আছেন, আর অন্য দেবতারাও নানারকমে তাহাকে সাহায্য করিতেছেন, আর দেবীর সিংহ তো আছেই। সে সময়ে দেবী এমন বিকট হাসি হাসিতেছিলেন, যে অনেক অসুর তাহাতেই মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া যাইতেছিল, আর তখন চামুণ্ডার মতন দেবী নিজেও তাহাদিগকে ধরিয়া মুখে দিতেছিলেন। ইহার পর আর টিকিতে না পারিয়া অসুরেরা ছুটিয়া পলাইতে লাগিল।
অসুরদের মধ্যে একজন ছিল, তাহার নাম রক্তবীজ সে বেটা বড়ই ভয়ংকর;তাহার এক বিন্দু রক্ত মাটিতে পড়িলেই সেখান হইতে একটা বিশাল অসুর দাঁত খিচাইয়া উঠিয়া দাঁড়ায়। সেই রক্তবীজকে লইয়া দেবী প্রথমে একটু মুস্কিলে পড়িলেন। তাহাকে যত কাটেন, ততই রক্ত পড়ে, আর ততই হাজার হাজার অসুর উঠিয়া দাঁড়ায়। অসুরে ত্রিভুবন ছাইয়া গেল, তাহাদের চীৎকারে পাতালের লোক অবধি কালা হইয়া গেল। দেবতারা তো ভাবিলেন, সর্বনাশ বুঝি হয়।
তখন দেবী চামুণ্ডাকে বলিলেন, “এক কাজ কর। অসুরের গায়ে খোঁচা লাগিতে না লাগিতেই তাহার রক্ত চাটিয়া খাইবে। আর সেই রক্ত হইতে অসুর হইতে না হইতেই তাহাকে গিলিয়া ফেলিবে।” চামুণ্ডা বলিলেন, “আচ্ছা”, ইহার পর আর রক্তবীজের বেশি বাড়াবাড়ি করিতে হয় নাই। গিলিয়া খাইলে আর অসুর হইয়াই কি করিবে? কাজেই দেখিতে দেখিতে অসুরের দল কমিয়া গেল, রক্তবীজের গায়ের রক্তও ফুরাইয়া আসিল। এতক্ষণ সে ভয়ানক যুদ্ধ করিতেছিল, কিন্তু রক্ত ফুরাইয়া গেলে আর তাহার কিছু করবার শক্তি রহিল না। দেখিতে দেখিতে দেবী নানা অস্ত্রে তাহাকে মারিয়া ফেলিলেন।
তখন বাকি রহিল কেবল শুম্ভ আর নিশুম্ভ। নিশুম্ভ খানিকক্ষণ খুব যুদ্ধ করিয়া অজ্ঞান হইয়া গেল। তারপর শুম্ভ একাই যুদ্ধ করিতে লাগিল। শুম্ভের আটটা হাত ছিল, গায়ে জোরও ছিল তেমনি; সে যুদ্ধও করিল খুব। কিন্তু শেষে সেও অজ্ঞান হইয়া গেল।
ততক্ষণে নিশুম্ভের আবার জ্ঞান হইয়াছে। নিশুম্ভের দশ হাজার হাত। সেই দশ হাজার হাতে দশ হাজার অস্ত্র লইয়া সে দেবীর সঙ্গে বিষম যুদ্ধ করিতে লাগিল। মরিবার সময়ও সে সহজে মরিল না। দেবী শূল দিয়া তাহার বুক ভেদ করিয়া ফেলিলেন, সেই বুকের ভিতর হইতে আবার ‘দাঁড়া, দাঁড়া,’ বলিয়া একটা বিকট অসুর বাহির হইয়া আসিল। যাহা হউক, সে ভালো করিয়া বাহির হইতে না হইতেই দেবী হাসিতে হাসিতে তাহার মাথা কাটিয়া ফেলাতে, বেচারা যুদ্ধ করিবার অবসর পায় নাই।
শুম্ভ ইহার মধ্যেই আবার উঠিয়া যুদ্ধ আরম্ভ করিয়াছে। ইহাই তাহার শেষ যুদ্ধ। সে অনেকক্ষণ ধরিয়া বিধিমতে দেবীকে মারিবার চেষ্টা করিল। একটি একটি করিয়া তাহার সকল অস্ত্রই দেবী কাটিয়া ফেলিলেন তারপর বাকি রহিল খালি কিল আর চাপড়। একবার দেবীর চাপড় খাইয়া সে চিৎ হইয়া পড়িয়া গিয়াছিল। কিন্তু তখনই আবার উঠিয়া দেবীকে ধরিয়া এক লাফে আকাশে উঠিয়া গেল। তারপর আকাশে থাকিয়াই দুজনের কম যুদ্ধ হইল না। যুদ্ধ করিতে করিতে দেবী তাহাকে বনবন করিয়া ঘুরাইয়া মাটিতে আছড়াইয়া ফেলিলেন; তাহাতেও কি সে মরে? সে তখনই উঠিয়া কিল বাগাইয়া দেবীকে মারিতে চলিয়াছে। তখন দেবী তাঁহার শূল দিয়া তাহার বুকে এমনি ঘা মারিলেন যে তাহার পর তাহাকে উঠিতে হইল না।
তখন যে দেবতারা দেবীর স্তব খুব ভালো করিয়াই করিয়াছিলেন, তাহা আমি না বলিলেও তোমরা বুঝিয়া লইতে পারিবে। দেবী তুষ্ট হইয়া বলিলেন, “তোমরা কি চাও?” দেবতারা বলিলেন, “এমনি করিয়া আমাদের শত্রুদিগকে বধ করিও।”