উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/পুরাণের গল্প/রেবতীর বিবাহ

রেবতীর বিবাহ

 এক রাজা ছিলেন, তাঁহার নাম ছিল রৈবত ককুদ্মী। পশ্চিম সমুদ্রের ধারে, কুশস্থলী নামক নগরে তিনি বাস করিতেন। রৈবতের একটি কন্যা ছিল, তাহার নাম রেবতী। রেবতীর গুণের কথা আর বলিয়া শেষ করা যায় না। মেয়েটি দেখিতে যেমন অপরূপ সুন্দরী, তেমনি সুশীলা আর মিষ্টভাষিণী, আর বুদ্ধিমতীও যতদুর হইতে হয়।

 রেবতী যতই বাড়িয়া উঠিলেন, রাজার মনেও ততই ভাবনা হইল যে, ‘আহা! আমার এই স্নেহের মেয়েটিকে এখন কাহার হাতে সমর্পণ করি?’

 সংসারের যত ভালো ভালো রাজপুত্র একে একে সকলের সংবাদ রাজা লইলেন, কিন্তু কাহাকেও তাঁহার পছন্দ হইলনা। মন্ত্রী, পুরোহিত, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সকলকেই বলিলেন, কেহই তেমন ভালো একটি পাত্রের সন্ধান করিয়া দিতে পারিল না।

 শেষে আর কোনো উপায় না দেখিয়া তিনি ভাবিলেন, ‘ব্রহ্মার কাছে যাই, তিনি অবশ্যই আমার মনের মতন একটি ছেলের কথা বলিতে পারিবেন।’

 এই ভাবিয়া রাজা কন্যাটিকে লইয়া ব্রহ্মার সভায় গিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন হাহা আর হুহু নামে দুইজন গন্ধর্ব সেইখানে বসিয়া ব্রহ্মাকে গান শুনাইতেছিলেন। হাহা আর হুহুর মতো ওস্তাদ আর এই ত্রিভুবনে কখনো দেখা যায় নাই, তাঁহাদের সেই বিচিত্র সংগীত শুনিতে যে কি মিষ্ট লাগিতেছিল, তাহা কি বলিব! সে গান একবার শুনিতে আরম্ভ করিলে আর সকল বিষয়ের কথা ভুলিয়া যাইতে হয়। যতক্ষণ সে গানের শেষ না হয় ততক্ষণ আর উঠিয়া আসিবার জো থাকে না। সে আশ্চর্য গান একবার আরম্ভ হইলে আর শীঘ্র শেষও হইতে চাহে না। সেটা ছিল ত্রেতাযুগের আরম্ভ। গাহিতে গাহিতে সে যুগ শেষ হইয়া গেল, তারপর দ্বাপর আসিল, তাহাও প্রায় শেষ হইতে চলিল, তবে হাহা হুহু গান শেষ করিয়া তম্বুরা নামাইলেন। এতকাল যে চলিয়া গিয়াছে, রাজার কিন্তু সে খেয়ালই নাই। তিনি ভাবিতেছেন, ‘আহা, এমন সুন্দর গান মুহূর্তের মধ্যেই ফুরাইয়া গেল?’

 যাহা হউক, এখন নিজের কাজ সারিয়া লইতে হইবে আর বিলম্ব করা ভালো নহে। এই ভাবিয়া রাজা ব্রহ্মার সিংহাসনের সামনে গিয়া ভক্তিভরে প্রণামের পর জোড়হাতে বলিলেন, “ভগবন্‌! আমার এই কন্যাটির বিবাহ কাহার সঙ্গে দিব, দয়া করিয়া আমাকে বলিয়া দিন। আমি অনেক রাজপুত্রের সন্ধান লইয়াছি, কিন্তু ইহাদের কোনটি যে সকলের চেয়ে ভালো, তাহা স্থির করিতে পারিতেছি না।”

 ব্রহ্মা বলিলেন, “আচ্ছা, তুমি কাহার কাহার কথা ভাবিয়াছ, আমাকে বল দেখি।”

 সে কথায় রাজা অনেকের নাম করিয়া বলিলেন, “ইঁহাদের মধ্যে একটি হইলে আমি সুখী হইতাম।” তাহা শুনিয়া ব্রহ্মা হাসিয়া বলিলেন, “মহারাজ, তুমি যাহাদের নাম করিলে, এখন তো তাহাদের কেহই বাঁচিয়া নাই; তাহারা ছিল ত্রেতা যুগের লোক, আর এখন হইল দ্বাপরের শেষ। এতদিনে তাহাদের ছেলের ছেলে, নাতির নাতি অবধি মরিয়া গিয়াছে, তাহাদের রাজ্য, বংশ, নাম অবধি লোপ পাইয়াছে!”

 তোমরা হয়তো ভাবিতেছ যে, পৃথিবীর আর সব লোক মরিয়া গেল, আর শুধু রাজা আর তাঁহার মেয়েটি বাঁচিয়া রহিয়াছে, এ কেমন কথা হইল?

 কিন্তু সে যে ব্রহ্মার পুরী, সেখানে তো জরা মৃত্যুর অধিকার নাই। কাজেই তাঁহারা দুজন শুধু যে বাঁচিয়া আছেন তাহাই নহে, ঠিক যেমনটি গিয়াছিলেন তেমনি আছেন, একটুও বুড়া হন নাই!

 যাহা হউক, ব্রহ্মার কথায় রাজা নিতান্তই আশ্চর্য হইলেন আব ভয় পাইলেন, আর ব্যস্ত হইলেন তাহার চেয়েও বেশি।

 তিনি বিষম থতমত খাইয়া বলিলেন, “এ্যাঁ, এ্যাঁ! কি সর্বনাশ। তাই তো! প্রভু, এখন উপায়? এখন তবে আমার এই মেয়েটিকে কাহার হাতে দিই? আমার সমকক্ষ রাজা এখন কে কে আছেন?”

 ব্রহ্মা বলিলেন, “মহারাজ! এতদিনে কি আর তোমার সে রাজ্য আছে? তোমার রাজ্যও নাই, প্রজারাও নাই। তোমার সেই সুন্দর কুশস্থলী নগরটি অবধি নাই। তাহার জায়গায় এখন দ্বারকা নামক পুরী হইয়াছে। সেই দ্বারকার রাজা কৃষ্ণ, তাঁহার ভাই বলরাম। সেই বলরামের সঙ্গে গিয়া তোমার এই কন্যার বিবাহ দাও। এ মেয়েটি যেমন লক্ষ্মী, বলরামও তেমনি মহাশয় লোক, সকলরকমেই ইহার উপযুক্ত।”

 কাজেই রাজা তখন আর কি করেন? তিনি ব্রহ্মাকে প্রণাম করিয়া মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে পৃথিবীতে ফিরিয়া আসিলেন। আসিয়া দেখেন বাস্তবিকই তাঁহার রাজ্য, রাজধানী, লোকজন, আত্মীয়স্বজন সব লোপ পাইয়াছে। পৃথিবী আর সে পৃথিবীই নাই। তাঁহাদের সময়ে চৌদ্দ হাত লম্বা এক একটা মানুষ হইত, আর এখনকার লোকগুলি মোটে সাত হাত লম্বা আর তাহাদের চালচলনও যেন কেমন কেমন হইয়া গিয়াছে। যাহা হউক, আর দুঃখ করিয়া কি হইবে? রাজা বলরামকে খুজিয়া বাহির করিয়া, তাঁহার সহিত মেয়ের বিবাহ দিয়া বনবাসী হইলেন।

 এদিকে রেবতীকে পাইয়া বলরামের আর আনন্দের সীমাই নাই। কেবল একটি কথায় তিনি একটু মুশকিলে পড়িয়াছেন, বলরাম হইতেছেন দ্বাপর যুগের লোক, তিনি সাত হাত লম্বা, রেবতী ত্রেতা যুগের মেয়ে, তিনি চৌদ্দ হাত লম্বা, বলরাম প্রাণপণে হাত বাড়াইয়াও তাহার মাথা নাগাল পান না!

 তখন বলরাম করিলেন কি, তাঁহার লাঙ্গলের আগা দিয়া রেবতীকে চাপিয়া অন্যান্য মেয়েদের মতো বেঁটে করিয়া লইলেন। তারপর আর কোনো অসুবিধা রহিল না।