উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/পুরাণের গল্প/শব্দবেধী

শব্দবেধী

 জন্তুকে না দেখিয়া, কেবলমাত্র তাহার শব্দ শুনিয়াই যে তাহাকে তীর দিয়া বিঁধিতে পারে, তাহাকে বলে ‘শব্দবেধী’।

 রাজা দশরথ এইরূপ ‘শব্দবেধী’ ছিলেন। যুবা বয়সে অনেক সময় তিনি রাত্রিতে বনে গিয়া এইরূপে কত হাতি, মহিষ, হরিণ শিকার করিতেন। বর্ষার রাত্রে তীর-ধনুক লইয়া চুপিচুপি সরযুর ধারে বসিয়া থাকিতে তাঁহার বড়ই ভালো লাগিত। নদীর ঘাটে নানারূপ জন্তু জল খাইতে আসিত; সেই জলপানের শব্দ একটিবার দশরথের কানে গেলে আর সে জন্তুকে ঘরে ফিরিতে হইত না।

 একবার এইরূপ বর্ষার রাত্রিতে দশরথ সরযুর ধারে তীর-ধনুক লইয়া বসিয়া আছেন। মনে আর কোনো চিন্তা নাই, খালি কান পাতিয়া রহিয়াছেন, কখন কোন জানোয়ারের শব্দ শোনা যাইবে। প্রায় সমস্ত রাত্রি এইভাবে কাটিয়া গিয়াছে, ভোর হইতে আর বেশি বাকি নাই। এমন সময় নদীর ঘাট হইতে ‘গুড়্‌-গুড়্‌-গুড়্‌-গুড়্‌’ করিয়া একটা আওয়াজ আসিল!

 দশরথ চমকিয়া ভাবিলেন, ‘ঐ হাতি।’ আর সেই মুহূর্তেই সেই শব্দের দিকে একটি ভয়ংকর বাণ শন্‌শন্‌ শব্দে ছুটিয়া চলিল।

 দশরথ জানেন না যে সে বাণে কি সর্বনাশ হইবে। সে শব্দ তো হাতির শব্দ নয়, ঋষির পুত্র ভোরের বেলায় কলসী হাতে ঘাট হইতে জল নিতে আসিয়াছেন, সেই কলসীতে জল পোরার ঐ শব্দ।

 অন্ধ পিতামাতা বিছানায় পড়িয়া কষ্ট পাইতেছেন; তাঁহারা একে যারপরনাই বুড়া, তাহাতে আবার নিতান্ত দুর্বল, চলিবার শক্তি নাই। পিপাসায় তাঁহাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত, তাই ছেলেটি ছুটিয়া জল নিতে আসিয়াছেন, এমন সময় কোথা হইতে এই নিদারুণ বাণ আসিয়া তাহার বুকে বিঁধিল। রক্তে দেহ ভাসিয়া গেল, কলসী হাত হইতে পড়িয়া গেল।

 ঋষিপুত্র ধুলায় পড়িয়া ছট্‌ফট্‌ করিতে করিতে বলিলেন, “আহা! আমি তো কাহারও কোনো অনিষ্ট করি না। বনে থাকি, ফলমূল খাই আর বৃদ্ধ অন্ধ পিতামাতার সেবা করি! ওগো! আমি তোমার নিকট কি অপরাধ করিয়াছিলাম যে এমন নিষ্ঠুর সাজা আমাকে দিলে? হায় হায়! আমার পিতামাতাকে দেখিবার যে আর কেহই নাই। আমি মরিলে যে আর তাঁহারা কিছুতেই বাঁচিবেন না!’’

 ঋষিপুত্রের কথা শুনিয়া দশরথেব হাত হইতে ধনুর্বাণ পড়িয়া গেল। তিনি দুঃখে অস্থির হইয়া পাগলের মতো ছুটিয়া আসিয়া দেখিলেন যে সর্বনাশ হইয়া গিয়াছে!

 তখন ঋষিপুত্র অতি কষ্টে তাহাকে বলিলেন, “মহারাজ! আমার কি অপরাধ ছিল? এই এক বাণে আমারও প্রাণ গেল, আমার পিতামাতারও প্রাণ গেল। আহা! মা আর বাবা পিপাসায় কাতর হইয়া পথ চাহিয়া আছেন, আমি গেলে জল খাইতে পাইবেন।”

 দুঃখে দশরথেব বুক ফাটিয়া যাইতেছে, তাঁহার কথা বলিবার শক্তি নাই। তাহা দেখিয়া সেই যাতনার মধ্যেও ঋষিপুত্রের দয়া হইল; তিনি বলিলেন, “মহারাজ! আর এখানে বিলম্ব করিবেন না। এই সরু পথে আমাদের কুটিরে যাওয়া যায়। শীঘ্র গিয়া আমার পিতাকে এই সংবাদ দিন, আর তাঁহার রাগ দূর করুন, নইলে তিনি আপনাকে ভয়ংকর শাপ দিবেন। আর এই বাণ যে আমার বুকে বিঁধিয়া রহিয়াছে, ইহার যন্ত্রণা আমি সহ্য করিতে পারিতেছি না, শীঘ্র এটাকে তুলিয়া দিন।”

 দশরথ ভাবিলেন, “হায়! আমি এখন কি করি? বাণ না তুলিলে ইঁহার যন্ত্রণা যাইবে না, কিন্তু বাণ তুলিলেই ইঁহার মৃত্যু হইবে।”

 তখন ঋষিপুত্র বলিলেন, “আপনার কোনো ভয় নাই। বাণ তুলিবার সময় যদি আমি মরিয়া যাই, তাহাতে আপনার ব্রাহ্মণবধের পাপ হইবে না। আমি ব্রাহ্মণ নহি, আমার পিতা বৈশ্য, মা শূদ্রের মেয়ে।”

 এ কথায় দশরথ ঋষিপুত্রের বুক হইতে বাণ টানিয়া বাহির করিলেন, আর তাহার সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেটির প্রাণ বাহির হইয়া গেল। তখন সেই কলসী ভরিয়া জল লইয়া দশরথ নিতান্ত দুঃখিত মনে ধীরে ধীরে কুটিরের দিকে চলিলেন। সেখানে অন্ধ মুনি আর তাঁহার অন্ধ পত্নী পিপাসায় কাতর হইয়া পুত্রের আশায় বসিয়া আছেন। দশরথেব পায়ের শব্দ শুনিয়া মুনি বলিলেন, “বাবা, এত বিলম্ব কেন হইল? তোমার জন্য তোমার মা বড় ব্যস্ত হইয়াছেন, শীঘ্র ঘরে আইস। তুমি কি রাগ করিয়াছ বাবা? আমাদের যদি কোনো দোষ হইয়া থাকে, তাহা তোমার মনে করা উচিত নয়। তুমি কথা কহিতেছ না কেন?”

 দশরথের চোখ জলে ভরিয়া গেল। তিনি অনেক কষ্টে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “ভগবন, আমি আপনার পুত্র নহি। আমি ক্ষত্রিয়, আমার নাম দশরথ। আজ এই অভাগার বাণে আপনার পুত্রের মৃত্যু হইয়াছে। আমি জন্তু মারিবার জন্য সরযুর ধারে বসিয়াছিলাম। আপনার পুত্রের কলসীতে জল ভরার শব্দ শুনিয়া মনে করিলাম বুঝি হাতির শব্দ। অন্ধকারের ভিতরে সেই শব্দের দিকে বাণ ছুঁড়িলাম, তাহাতেই এই সর্বনাশ হইল। এখন এই পাপীর প্রতি আপনার যাহা ইচ্ছা হয় করুন।”

 এই বলিয়া দশরথ ছল ছল চোখে জোড়হাতে দাঁড়াইয়া রহিলেন।

 মুনি এই দারুণ সংবাদ শুনিয়াও সাধারণ লোকের মতো ব্যস্ত হইলেন না, রাজাকে কোন কঠিন শাপও দিলেন না। তিনি কেবল একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন “মহারাজ। তুমি না জানিয়া এ কাজ করিয়াছ, তাই রক্ষা পাইলে, নাহলে আজ তোমার বংশসুদ্ধ নষ্ট হইত। এখন এক কাজ কর, আমরা আমাদের পুত্রের নিকট যাইতে চাহি, একটিবার আমাদিগকে সেখানে লইয়া চল।”

 রাজা তখনই তাঁহাদের দুজনকে সরযুর ধারে লইয়া আসিলেন। তাঁহাদের চক্ষু নাই, সুতরাং জন্মের মতো একটিবার পুত্রের মুখ দেখিবার উপায় নাই। তাঁহারা কেবল তাঁহার দেহের উপর পড়িয়া বারবার তাঁহাকে আশীর্বাদ করিতে লাগিলেন। তারপর চিতা প্রস্তুত করিয়া সেই দেহ পোড়ান হইল।

 তখন অন্ধ মুনি নিতান্ত দুঃখের সহিত রাজাকে বলিলেন, “মহারাজ। পুত্রের শোকে আমি এখন যে দুঃখ পাইতেছি, এইরূপ পুত্রশোক তোমাকেও পাইতে হইবে।”

 এই বলিয়া তাঁহারা দুজনে সেই চিতায় ঝাঁপ দিয়া পড়িলেন, আর দেখিতে দেখিতে তাঁহাদের শরীর ভস্ম হইয়া গেল।

 ইহার অনেক বৎসর পরে বৃদ্ধ বয়সে, কৈকেয়ীর ছলনায় দশরথ রামকে বনে দেন, আর সেই রামের শোকে তাঁহার মৃত্যু হয়। তখন অন্ধ মুনির সেই কথাগুলি তাহার মনে পড়িয়াছিল—

‘পুত্রব্যসনজং দুঃখং যদেতস্মম সাম্প্রতম্‌
এবং ত্বং পুত্রশোকেন রাজন্‌ কালং করিষ্যসি॥’