উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/এতদ্দেশীয় ও ইউরোপীয় সংগীত

এতদ্দেশীয় ও ইউরোপীয় সংগীত

 অনেক সময় দেখা যায়, পণ্ডিতেরা যে সকল বিষয় লইয়া গলদঘর্ম হয়েন, সাধারণ লোকে তাহাদের একটা মোটামুটি মীমাংসা সহজেই করিয়া ফেলে। সংগীত সম্বন্ধেও যে কতকটা সেরূপ হয় নাই, তাহা নহে। আমাদের দেশীয় ওস্তাদদিগকে যদি ইউরোপীয় সংগীত সম্বন্ধে মত দিতে বলা যায়, তবে তাহারা অধিকাংশ স্থলেই নানারূপ জানোয়ারের ডাকের দৃষ্টান্ত দিয়া কাজ সারেন। পক্ষান্তরে আমাদের দেশীয় সংগীত সম্বন্ধে সাহেবদের সাধারণ মতও ঐরূপ। আসল বিষয়টা কতকটা “সোনার ঢাল রূপার ঢাল” গোছের—এক এক দল এক এক দিক হইতে দেখেন, আর সেইরূপ বলেন। এ বিবাদে প্রকৃত মীমাংসা করিবার ক্ষমতা লেখকের নাই, আর এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্যও তাহা নহে। এ বিষয়ে উভয় পক্ষের ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত যে সকল মত লেখকের গোচরে আসিয়াছে সাধারণের মনোরঞ্জনার্থ তাহার কিছু কিছু নমুনা দেওয়া যাইতেছে। ইহাতে সাধারণ লোকের পক্ষে একটা সাদাসিধা মীমাংসার সুবিধা হইতেও পারে।

 প্রথম দেশীয় সংগীত আর ইউরোপীয় সংগীতের বিশেষ প্রভেদ কোথায়, তাহা দেখা উচিত। পরস্পরের সহিত নির্দিষ্ট সম্বন্ধ বিশেষ রক্ষা করিয়া যখন মিষ্ট ধবনি সকল একটির পর একটি বিচিত্র নিয়মে বাদিত হয়, তখন তাহ শুনিতে খুব ভাল লাগে। ইহাকেই আমরা রাগ রাগিণী (Melody) বলি;আর এই বিষয়টার আমাদের দেশে খুব চর্চা হইয়াছে। ইহার সম্বন্ধে বিশেষ দ্রষ্টব্য এই যে, ধবনি যতই মধুর হউক না কেন, একাকী সে কার্যকর হইতে পারে না। কোন ধবনিটির পর কোন ধবনিটি হইল, সে দিকে দৃষ্টিপাত করিলে তবে তাহার একটা মূল্য দাঁড়ায়। একটি ধবনির পর আর একটি ধবনি হইলে কিরূপ শুনায় আমরা তাহ বেশ করিয়া দেখিয়াছি। একাধিক ধবনি একসঙ্গে বাজিলে যাহা হয়, যন্ত্রাদির সুর বঁধিবার সময় আমরা তাহার সাহায্য লইয়া থাকি। কিন্তু সেই ব্যাপারটার ভিতরে যে সংগীতের কোন মূল্যবান অংশ প্রস্থর রহিয়াছে আমরা ততটা তলাইয়া দেখি নাই। সাহেবরা এদিকে বিশেষ মনোযোগ দিয়া এই ব্যাপারটাকেই তাহদের সংগীতের প্রধান অঙ্গ করিয়া লইয়াছেন। ইহার নাম হারমনি (harmony)।

 এই মেলোডি আর হারমনি লইয়াই প্রধানতঃ প্রাচ্য ও প্রতীচ্য সংগীতের প্রভেদ। আমাদের মেলোডি আছে, হারমনি নাই। সাহেবদের হারমনিই প্রধান, মেলোডি তাহার অনুগামী।

 আমরা খালি মেলোডিকে “সবে ধন নীলমণি” পাইয়া তাহাকেই ঘসিয়া মাজিয়া সাজাইয়া গুছইয়া সিংহাসনে বসাইয়াছি। সাহেবেরা নাকি মেলোডিকে তেমন একাধিপত্য দেন নাই, কাজেই তাঁহাদের মেলোডি অনেকটা সাদাসিধে গোছের। খালি মেলোডিতে অলঙ্কার অভাবে তেমন বিচিত্রতা হয় না, সুতরাং তাহাতে অলঙ্কারের দরকার। হারমনি থাকিলে তাহাতেই যথেষ্ট বিচিত্রতা হয়, সুতরাং অলঙ্কার অনাবশ্যক।

 আমরা হারমনির রস গ্রহণ করিতে শিখি নাই, সুতরাং সাহেবদের হারমনিকে বাদ দিয়া কেবল তাহদের নিরলঙ্কার মেলোডিকে লইয়া তাহদের সংগীতের বিচার করিতে যাই। ইহাতে ফল এই যে, জিনিসটার প্রকৃত সৌন্দর্যটুকু দেখিতে পাই না, আর আমরা যাহাকে

সুন্দর বলিয়া জানি, তাহা তাহাতে খুঁজিয়া পাই না, সুতরাং সন্তোষ হয় না।

 সাহেবরাও আমাদের সংগীতের অলঙ্কারগুলির রস গ্রহণ করিতে পারেন না, অথচ তাহতে হারমনির অভাবের দরুন একটা মস্ত ত্রুটি দেখেন। সুতরাং তাঁহাদের ভাল লাগে না।

 যাহা বলা হইল, তাহাতে কোন সংগীত উৎকৃষ্ট, কোন সংগীত নিকৃষ্ট, তাহার কোন মীমাংসা হইবে না। তাহাতে কেবল এইটুকুই বুঝা যাইতেছে যে ভাল লাগে না বলিয়াই বাস্তবিক জিনিসটাতে কোন দোষ থাকা প্রমাণ হয় না। বুঝিবার গোলেও ভাল না লাগিতে পারে। অতপর, যাহা বলিতে বসিয়াছি।

 সাহেবেরা প্রাচ্য সংগীতের নিন্দা করিবার সময় তিনটি বিশেষণ বার বার ব্যবহার করেন, —“নাকী”, “বেসুরা”, “একঘেয়ে”।

 আমরাও তাহাদিগকে সহজে ছাড়ি নাই। এক বিশেষজ্ঞ একস্থানে বলিয়াছেন যে হারমনি অসভ্য গথ্ জাতির দ্বারা আবিষ্কৃত হইয়াছিল, সুতরাং ইহার ব্যবহার অসভ্যতার চিহ্ন! মানুষ অসভ্যাবস্থায় অনেক ভাল বিষয়েরই সূত্রপাত করিয়াছিল, সংগীত তাহার মধ্যে একটি। সুতরাং ইহা কি বলিতে হইবে যে গান করাটা অসভ্যতা? এক শ্রেণীর লোক আছেন, তাহাদের ইহাই বিশ্বাস যে “আমাদের যাহা, তাহার মতন আর ন ভুতো ন ভবিষ্যতি”। ইহাতে আর কিছু প্রমাণ না হউক, অনা দেশের সম্বন্ধে আমরা যে কি পরিমাণ কম খবর রাখি, তাহা সুন্দর প্রমাণ হয়।