উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/ফটোগ্রাফীর চর্চা
একজন চিত্রকর একটা সুন্দর স্থানের ছবি আঁকিতেছিলেন, এক চাষা তাহা দেখিতেছিল। কিছুকাল দেখিয়া চাষা চিত্রকরকে বলিল “এর চাইতে ফটো তুলিয়া লইলেই তো পারিতেন। তাহাতে শীঘ্র শীঘ্র হইত, আর জায়গার চেহারাটাও এর চাইতে খাঁটি হইত।”
গল্পটি একখানি ইংরাজি সংবাদপত্রে পড়িয়াছিলাম, তাহাতে খুব প্রসিদ্ধ একজন চিত্রকরের উল্লেখ ছিল। সুতরাং ঘটনা সত্য হওয়া অসম্ভব নহে। সত্য হউক আর না হউক, ইহা দ্বারা একটি অতি প্রয়োজনীয় কথার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইতেছে। চাষা যাহা বলিয়াছিল, তাহ্য যে তাহার সাদাসিধা হিসাবে ঠিকই বলিয়াছিল, এ কথায় হয় তো কাহারও সন্দেহ হইবে না। অপর দিকে চাষা যাহা এত সহজে বুঝিয়া ফেলিল, তাহ যে চিত্রকরের মাথায় ঢোকে নাই, একথাও বিশ্বাসযোগ্য নহে;এ বিষয়ের মীমাংসা এইরূপ যে, হিসাবের স্থূলত্ব ধারণা হইতে পারে। চাষা সেইস্থানের কেবলমাত্র চেহারাটাই দেখিয়াছিল, কিন্তু চিত্রকর তাহার সৌন্দর্যের চর্চা করিতেছিলেন। কুৎসিতকে বাদ দিয়া সুন্দরকে গ্রহণ করা শিল্পীর কাজ। চাষা এত হিসাবের ধার ধারে না। হয়ত এইরূপ কারণেই চাষা বলিলে আমরা চটিয়া থাকি। চাষার দেখাতে বুদ্ধিবৃত্তি, জ্ঞানলিঙ্গা, সৌন্দর্যস্পৃহা বা কবিত্ত্ব, কোনটারই চর্চা হয় না, তাই ওরূপ দেখার মূল্য এত কম। যাহার দেখার ভিতরে উল্লিখিতরূপ কোন একটা ভাল উদ্দেশ্য আছে, তাহার দেখাই যথার্থ দেখা।
চক্ষে দেখা আর কলে দেখাতে উপায়ের প্রভেদ আছে, কিন্তু কাজ একইরূপ এবং ফলও একই প্রকৃতির। ফটোগ্রাফী বাস্তবিক কলে দেখা। এরূপ দৃষ্টির চর্চা আজকাল ক্রমেই বৃদ্ধি পাইতেছে। দেখার মতন দেখা হইলে ইহা খুবই আশাজনক। কিন্তু অধিকাংশ স্থলে ফটোগ্রাফীর চর্চা যেরূপ নিতান্ত সুখ মিটাইবার জন্য উদ্দেশ্যবিহীন হালকাভাবে হইতে দেখা যায়, তাহ মালমসলা বিক্রেতা ভিন্ন আর কাহারও পক্ষেই শুভলক্ষণ নহে।
ফটোগ্রাফীর চর্চা উচিত রূপ হইলে অনেক উপকারের আশা করা যায়। উদ্দেশ্যবিহীন হইয়া ছবি তোলার প্রয়োজন কোন স্থলেই হয় না। নিতান্ত প্রথম শিক্ষার্থীও এমন জিনিস খুজিয়া বাহির করিতে পারেন যে তাহার কোনরূপ মূল্য আছে। হয়ত তাহা হইতে কিছু শিক্ষা করা যায়, না হয় ব্যবসা বাণিজ্য বা অন্য কোন হিসাবে তাহা কৌতুহলোদ্দীপক, না হয় কোন ঐতিহাসিক অথবা জনশ্রুতিমূলক অথবা অন্য কোন কারণে স্মরণীয় ঘটনার সহিত তাহার সংস্রব আছে। ছবি তুলিবার সময় এ বিষয়ে একটু দৃষ্টি রাখা কঠিন নহে। আর ছবিখানি ভাল হইলে তাহা মুদ্রিত করিয়া সংগ্রহ করা এবং কাচখানি যত্ন করিয়া রাখিয়া দেওয়াতেও তেমন কিছু মুশকিল দেখা যায় না। কিন্তু যদি এই দুটি কাজ নিয়মিতরূপে করিতে পারেন, তবে দেখিয়া আশ্চর্য হইবেন যে কিরূপ মূল্যবান জ্ঞানভাণ্ডার অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ের মধ্যে সঞ্চিত হইতে পারে।
এ সম্বন্ধে “ভাণ্ডার” পত্রিকায় কয়েকটি সুন্দর পরামর্শ মুদ্রিত হইয়াছিল। এ স্থলে এ বিষয়ে আর অধিক বলার প্রয়োজন দেখা যায় না। কেবলমাত্র দুটি আবশ্যকীয় বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাইতেছে। ১) অঙ্কিত বস্তুটি কত বড়, তাহা বুঝিবার কোনরূপ উপায় রাখা বাঞ্ছনীয়। ছবির মধ্যে যদি এমন একটি জিনিস থাকে যাহার আয়তন জানা আছে, তাহা হইলে তাহার সাহায্যে অন্য সকল জিনিসের আয়তন সহজেই উপলব্ধ হয়। ২) ছবি তোলার তারিখটি লিখা থাকিলে অনেক সময় তাহাতে কাজ দেখে।
যে রূপ বিষয়ের কথা বলা হইল, তাহা অপেক্ষা উচ্চতর বিষয়েও ফটোগ্রাফীর কার্যকারিতা আছে। চিত্রবিদ্যায় যেমন কবিত্ব ও সৌন্দর্যচর্চার অবকাশ থাকে,ইহাতেও সেইরূপ। অবশ্য এ বিষয়টি অতিশয় কঠিন;অনেক যত্ন আর পরিশ্রমে ইহাতে কিঞ্চিৎ ফললাভ হইতে পারে। কিন্তু এবিষয়েও আজকাল অনেককে চেষ্টা করিতে দেখা যায়। বর্তমানে এই চেষ্টায় ফল তেমন শ্লাঘার বিষয় না হইলেও ভবিষ্যতে ইহাতে অনেক উপকার হইতে পারে। শ্রাবণের প্রবাসীতে শ্রীমান সুকুমার রায় চৌধুরীর কৃত “প্রবাসীর” ছবি এবং বর্তমান সংখ্যায় অধ্যাপক শ্যামাদাস বন্দোপাধ্যায় কৃত “হর্ষবিষাদ", এই দুটি ছবি দৃষ্টান্তস্বরূপ মুদ্রিত হইল। “প্রবাসীর” ছবিখানি প্রবাসীর আবরণের জন্য বিশেষভাবে তোলা হইয়াছিল। প্রবাসীর পাঠকবর্গের অনেকেরই হয়ত এ বিষয়ে অল্পাধিক চর্চা আছে। তাহাদের কার্যের নমুনা দেখিতে পাইলে প্রবাসী সম্পাদক আনন্দিত হইবেন। উপযুক্ত বোধ হইলে তাহ প্রবাসীতে প্রকাশিত হইতেও পারে।
এই শ্রেণীর ফটোগ্রাফী চর্চায় উপকর আছে.সুতরাং তাহা হওয়া বাঞ্ছনীয়। এরূপ আশা করার সময় এখনও হয় নাই, যে এখন হইতেই আমরা সূক্ষ্ম শিল্পের হিসাবে নির্দোষ চিত্র রচনা করিতে সক্ষম হইব। যে সকল দেশের লোক এ বিষয়ে অগ্রগামী, সে সকল স্থানেও অপেক্ষাকৃত অল্প লোকেই এ বিষয়ে সম্পূর্ণ কৃতকার্য হইয়া থাকেন। পক্ষান্তরে এদেশেও ভেদবার প্রভৃতি দু-একজন ইহাতে বিশেষ প্রশংসা লাভ করিয়াছেন। সুতরাং চেষ্ট হইলে সুফলের আশা করা যায়।