উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/অগস্ত্যের সাগরপানের কথা

অগস্ত্যের সাগরপানের কথা

 দেবগণের কথা শুনিয়া নারায়ণ বলিলেন, ইন্দ্রের হাতে বৃত্রাসুরের মৃত্যু হইলে পর কালেয়গণ তোমাদের ভয়ে পলায়ণ করিয়া সমুদ্রের ভিতরে আশ্রয় লইয়াছে। সেইখান হইতে রাত্রিতে বাহির হইয়া, সৃষ্টি সংহার করিবার নিমিত্ত সেই দুষ্টগণ প্রত্যহ এইরূপ নিষ্ঠুর অত্যাচার করে। দিনের বেলায় উহারা সমুদ্রের ভিতরে লুকাইয়া থাকে। যতদিন উহারা এইরূপে সমুদ্রের ভিতরে লুকাইবার স্থান পাইবে, ততদিন উহাদিগকে বধ করিতেও পারিবে না, অত্যাচারও বারণ হইবে না।

 “সুতরাং তোমরা সমুদ্র শুষিবার উপায় দেখ। তাহা ভিন্ন এ বিপদ আর কিছুতেই কাটিবে না। আমি একটিমাত্র লোকের কথা জানি। যাঁহার সাগর শুষিবার ক্ষমতা আছে। তিনি হইতেছেন, মহামুনি অগস্ত্য। এ সংসারে আর কাহারো দ্বারা এ কাজ হইবার সম্ভাবনা নাই।”

 এ কথা শুনিবামাত্র দেবতারা নারায়ণকে ধন্যবাদ দিয়া, অগস্ত্যের আশ্রমে গিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহাদের নিকট সকল কথা শুনিয়া অগস্ত্য যখন সাগরের জল পান করিবার জন্য যাত্রা করিলেন, তখন আর সংসারের লোক কেহই বসিয়া থাকিতে পারিল না। অগস্ত্যের পিছু পিছু দেবতা, গন্ধর্ব, যক্ষ, রাক্ষস, সকলে ছুটিয়া সেই আশ্চর্য ব্যাপারের তামাশা দেখিতে আসিল। সমুদ্রের ধারে আসিয়া অগস্ত্য দেবতাগণকে বলিলেন—

 “আচ্ছা, আমি সমুদ্রের জল পান করিতেছি। আপনারা আপনাদের কাজ শীঘ্র শীঘ্র শেষ করিবেন।”

 এই বলিয়া অগস্ত্য মুনি ক্রোধভরে সাগরের জলপান করিতে লাগিলেন।

 না জানি তখন কি ঘোরতর চোঁ চোঁ শব্দ হইয়াছিল এমন অদ্ভুত কাজ দেবতারাও কখনো চক্ষে দেখেন নাই। তাঁহারা আশ্চর্য ত হইয়াছিলেনই, তাহা ছাড়া, যতক্ষণ সেই চোঁ চোঁ শব্দ চলিয়াছিল, ততক্ষণ সকলে মিলিয়া চিৎকার পূর্বক, ক্রমাগতই অগস্ত্যের স্তব করিয়াছিলেন! এইরূপে সমুদয় জল খাওয়া শেষ হলে, দেখা গেল যে, যত রাজ্যের অসুর সমুদ্রের তলায় কিলবিল করিতেছে।

 তখন আর বাছাগণ যাইবেন কোথায়? দেবতাদিগের অস্ত্রের ঘায়, দেখিতে দেখিতে পাপিষ্ঠদিগের প্রাণ বাহির হইয়া গেল। কয়েকটা মাত্র পাতালে ঢুকিয়া রক্ষা পাইল।

 তারপর দেবতারা, অগস্ত্যকে ধন্যবাদ দিয়া বলিলেন, “মহাশয়, আপনি ছিলেন, তাই আমরা রক্ষা পাইলাম। আপনার এই অদ্ভুত কাজের জন্য, চিরকালই আমরা আপনার সুখ্যাতি করিব। এখন, সাগর শুকনো পড়িয়া থাকিলে, অনেক অসুবিধা হইতে পারে। সুতরাং অনুগ্রহ করিয়া তাহার জলটুকু ফিরাইয়া দিন।”

 মুনি বলিলেন, “যাহা খাইয়াছি, তাই ত হজম হইয়া গিয়াছে তাহা আবার কি করিয়া ফিরাইয়া দিব? সাগরে জল আনিবার আপনারা অন্য উপায় দেখুন।”

 এ কথায় সকলে একটু দুঃখিত হইয়া ঘরে গেলেন। আজকাল সাগরে যখন এত জল দেখা যায়, তখন নিশ্চয় সেই জল আনিবার একটা উপায় হইয়াছিল। কিন্তু তাহার কথা এখন নহে।

 দেবতারা অমর হইলেন, বজ্রের ন্যায় ভয়ঙ্কর অস্ত্র পাইলেন, কিন্তু ইহাতেই যে তাঁহারা অসুরের ভয় হইতে একেবারেই বাঁচিয়া গেলেন, এমন কথা বলা যায় না। কারণ স্পষ্ট দেখা যাইতেছে যে, তাঁহাদের ভালো সেনাপতি ছিল না।

 দেবতাগণ যখন ক্রমাগতই অসুরদিগের নিকট হারিয়া যাইতেন, তখন ইন্দ্রের ঠিক এইরূপ কথা মনে হইত। তিনি অনেক সময় এই কথা ভাবিতেন যে, ‘একজন ভাল সেনাপতির দরকার হইয়াছে।’