উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/দধীচের কথা
দধীচের কথা
“আমি তোমাদিগকে বৃত্রাসুর বধ করিবার উপায় বলিয়া দিতেছি। দধীচ নামে এক অতি প্রসিদ্ধ এবং মহাশয় মুনি আছেন; তোমরা সকলে গিয়া তাঁহার নিকট বর প্রার্থনা কর। তোমরা চাহিবামাত্র তিনি সস্তুষ্ট হইয়া বর দিতে প্রস্তুত হইবেন। তখন তোমরা বলিবে, “আপনি জগতের উপকারের জন্য আপনার হাড় ক'খানি দিন।” “জগতের উপকারের জন্য সেই মহামুনি তখনই আনন্দের সহিত দেহত্যাগ করিবেন। তারপর তাহার হাড় ক'খানি আনিয়া তাহা দ্বারা বজ্র নামক এক ভয়ঙ্কর অস্ত্র প্রস্তুত করাইতে হইবে। সে অস্ত্রের ছয়টি কোণ, আর তাহার গর্জন অতি ভীষণ। সেই বজ্র দিয়া বৃত্রকে বধ করিতে, ইন্দ্রের কিছুমাত্র কষ্ট হইবে না।”
এই কথা শুনিবামাত্র, দেবতাগণ সরস্বতী নদীর তীরে, দধীচ মুনির আশ্রমে গিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহারা সেই মহাপুরুষকে প্রণাম করিয়া বর প্রার্থনা করিলে, তিনি আহ্লাদের সহিত বলিলেন—
“আমি আপনাদিগকে শুধু হাতে ফিরিতে দিব না। এই আমি দেহত্যাগ করিতেছি।” বলিতে বলিতেই তাঁহার আত্মা দেহ ছাড়িয়া চলিয়া গেল। তারপর দেবতারা তাঁহার হাড় লইয়া বিশ্বকর্মার নিকট চলিয়া আসিলেন।
দেবতারা বলিলেন, “বিশ্বকর্মা, আমরা বজ্র প্রস্তুত করিবার জন্য দধীচ মুনির হাড় আনিয়াছি। তুমি শীঘ্র সেই অস্ত্র গড়িয়া দাও, ইন্দ্র তাহা দ্বারা বৃত্রকে সংহার করিবেন।”
ইহাতে বিশ্বকর্মা অতিশয় আনন্দিত হইয়া, সেই হাড় দিয়া ভয়ঙ্কর বজ্র প্রস্তুত করিয়া দিলেন। বজ্র হাতে করিয়া ইন্দ্রের আনন্দ আর উৎসাহের সীমা রহিল না।
তারপর দানবদিগের সহিত দেবতাদের ভয়ানক যুদ্ধ আরম্ভ হইল। তখন কালেয়গণ সোনার কবচ পরিয়া, প্রচণ্ড তেজের সহিত দেবতাদিগকে আক্রমণ করিবামাত্র, তাঁহাদের রাগ আর সাহস কোথায় চলিয়া গেল-তাঁহারা তাহাদের সামনে টিঁকিয়া থাকিতে সমর্থ হইলেন না! এদিকে দেবতারা এইরূপে পলায়ন করিতেছে, অপরদিকে বৃত্রাসুরটা রাগে ফুলিয়া পর্বতের মতন বড় হইয়া উঠিয়াছে তাহা দেখিয়া ইন্দ্র বেচারা ভয়ে অজ্ঞান হইয়া গেলেন।
এই সময়ে নারায়ণ না থাকিলে আর উপায়ই ছিল না। ইন্দ্রের দুর্দশা দেখিয়া, নারায়ণ নিজের তেজের খানিকটা তাঁহাকে দিলেন। তাহাতে নূতন বল আর সাহস পাইয়া ইন্দ্র মনে করিলেন যে, ‘এবারে আর ভয় পাইব না।’
তখন তিনি বজ্র হাতে খুব তেজের সহিত যুদ্ধ ক্ষেত্রে গিয়া দাঁড়াইবামাত্র বৃত্র একটা অতিশয় উৎকট রকমের ডাক ছাড়িল। তাহা শুনিয়া ইন্দ্র ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে, দুই চক্ষু বুজিয়া, বজ্রটাকে ছুঁড়িয়া মারিয়া, অমনি দে ছুট। বজ্র কোথায় পড়িল সেটুকু পর্যন্ত দেখিবার জন্য অপেক্ষা না করিয়া, তিনি সেখান হইতে পলায়ন পূর্বক একটা পুকুরের ভিতবে ঢুকিয়া কাঁপিতে লাগিলেন।
এদিকে কিন্তু সেই বজ্রের ঘায় তখনই বৃত্র মরিয়া গিয়াছে, আর দেবতাগণ উচ্চৈঃস্বরে ইন্দ্রের বীরত্বের প্রশংসা করিতে করিতে বিশেষ উৎসাহের সহিত দৈত্য মারিতে আরম্ভ করিয়াছেন। দলপতি মরিয়া যাওযাতে অসুরেরা নিতান্ত দুর্বল এবং নিরাশ হইয়া পড়িয়াছিল, কাজেই তাহারা আর দেবতাদের সামনে টিঁকিতে না পারিয়া পলায়ন পূর্বক সমুদ্রের ভিতর গিয়া আশ্রয় লইল। সেইখানে বসিয়া তাহারা পরামর্শ করিল যে, তাহারা সৃষ্টি নষ্ট করিয়া দিবে। কেমন কবিয়া নষ্ট কবিবে, তাহাও তাহারা স্থির করিতে ভুলিল না।
লোকে যে তপস্যা করে সেই তপস্যার জোরেই সংসার টিকিয়া আছে। সুতরাং দানবেরা স্থির করিল যে, যত তপস্বী আর ধার্মিক লোক আছে, সকলকে সংহার করিতে হইবে, এরূপ করিলেই অল্পদিনের ভিতরে জগৎ নষ্ট হইয়া যাইবে!
ইহার পর হইতেই, দানবের দৌরাত্মে পৃথিবী একেবারে ছারখার হইয়া যাইতে লাগিল। দুষ্ট দানবগণ দিনের বেলায় সমুদ্রের ভিতরে লুকাইয়া থাকিত, রাত্রিতে বাহির হইয়া মুনিঋষিদিগকে ধরিয়া খাইত। এইরূপে বশিষ্ঠের আশ্রমে একশত সাতানব্বই জনকে, চ্যবনের আশ্রমে একশত জনকে আর ভরদ্বাজের আশ্রমে বিশজনকে দানবেরা খাইয়া শেষ করিল। অন্যান্য আশ্রমে কত লোক মাবিল, তাহার সংখ্যা নাই। সকাল হইলেই দেখা যাইত, যে, মুনিদিগের হাড় মাংস আর রক্তে চারিদিক ছাইয়া রহিয়াছে।
দানবের ভয়ে লোকেরা সংসার যাত্রা বন্ধ হইয়া গেল। যাহারা পারিল নানাস্থানে পলায়ন করিল। ভীতু লোকেরা অনেকে ভয়েই প্রাণত্যাগ করিল। বীর পুরুষেরা দলে দলে দানবদিগকে খুঁজিয়া বেড়াইতে লাগিলেন, কিন্তু কোথাও তাহাদের সন্ধান পাইলেন না। তখন দেবতাগণ নারায়ণের নিকটে উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “প্রভো, আপনিই আমাদের আশ্রয়-স্থান। এই ভয়ঙ্কর বিপদ হইতে আমাদিগকে উদ্ধার করুন।”