ঋষি রবীন্দ্রনাথ/১৭
(১৭)
গীতায় আছে, সকলেই কর্ম করে, কারণ কর্ম না করিয়া উপায় নাই, কর্ম করিতে জীব বাধ্য। কিন্তু কর্ম করিলেই কর্মযোগী হয় না, কর্মী আর কর্মযোগী এক নহে। কর্ম করিতে আমরা বাধ্য, তাই কর্ম আমাদের বন্ধন। কিন্তু কর্মযোগীর কর্মবন্ধন বলিয়া কিছু নাই, তাহার কর্ম মুক্তের সহজ কর্ম।
গীতা সিদ্ধ কর্মযোগীর বিশেষ তিনটি লক্ষণের কথা বলিয়াছেন। প্রথম লক্ষণটি হইল এই যে, কর্মযোগীর কর্মের ফলাকাঙ্ক্ষা নাই, অর্থাৎ সে আসক্তিশূন্য
দ্বিতীয় লক্ষণ, কর্মযোগী নিজেকে কর্মের কর্তা মনে করেন না; অর্থাৎ তাঁহার কর্তৃত্বাভিমান নাই। চাকর যেমন কর্ম করিয়াও কর্তা নয়, কর্মযোগীও তাই।
আর তৃতীয় লক্ষণটি হইল এই যে, কর্মযোগীর সকল কর্ম ঈশ্বরে অর্পিত বা নিবেদিত।
এই তিনটির যে কোন একটি লক্ষণ যাহার দেখা যায়, সে কর্ম করিয়াও কর্মী নয়, সে কর্মযোগী এবং তাহার কর্ম আর দশজনের মত কর্ম মাত্র নহে, তাহা কর্মযোগ। আর এই কর্মযোগেই নিখিল সৃষ্টির মহাকর্মের মহানায়কের সঙ্গে সে যোগযুক্ত, সৃষ্টিতে সে ঈশ্বরের কর্মসঙ্গী বা লীলাসঙ্গী। এই কর্মযোগীকেই গীতা বলিয়াছেন—মুক্ত এবং ঈশ্বরপ্রাপ্ত পুরষ।
এখন রবীন্দ্রনাথের কর্ম তথা সাহিত্যসাধনা ও সৃষ্টির ক্ষেত্রে কর্মযোগের বা যোগীর এই লক্ষণটি কত দূর প্রযোজ্য দেখা যাইতেছে। অর্থাৎ, কবি রবীন্দ্রনাথ কর্মী না কর্মযোগী, তাহাই এখন দ্রষ্টব্য।
পঞ্চাশ বৎসরে আসিয়া রবীন্দ্রনাথ নিজের ‘জীবন বৃত্তান্তে’ একস্থানে এই কয়টি কথা লিখিয়াছেন—
“আমার সুদীর্ঘ কালের কবিতা লেখার ধারাটাকে পশ্চাৎ ফিরিয়া যখন দেখি, তখন ইহা স্পষ্ট দেখিতে পাই—এ একটা ব্যাপার, যাহার উপরে আমার কোনই কর্তৃত্ব ছিল না। যখন লিখিতেছিলাম, তখন মনে করিয়াছি আমিই লিখিতেছি বটে, কিন্তু আজ জানি, কথাটা সত্য নহে।”
এখানে স্পষ্ট ইঙ্গিত রহিয়াছে যে, কবিতা তিনিই লিখিয়াছেন, অথচ আসল লেখক তিনি নহেন, অপর একজন, ইহাই রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট দেখিতে পাইয়াছেন। কর্ম করিয়াও গীতার কর্মযোগী নিজে কর্মকর্তা নহে, সেই লক্ষণই কি এখানে অভিব্যক্ত নহে?
কথাটা রবীন্দ্রনাথ আরও স্পষ্ট করিয়াছেন এইভাবে,—
“অন্তত আমার নিজের মধ্যে তাহা উপলব্ধি করিয়াছি। যখন যেটা লিখিতে ছিলাম, আমিই যে তাহা লিখিতেছি এবং একটা কোনো বিশেষভাব অবলম্বন করিয়া লিখিতেছি, এ-সম্বন্ধেও সন্দেহ ঘটে নাই। কিন্তু আজ জানিয়াছি, সে সকল লেখা উপলক্ষ্য মাত্র...... তাহাদের রচয়িতার মধ্যে আর একজন যে রচনাকারী আছেন, ········ফুৎকার বাঁশির এক-একটা ছিদ্রের মধ্যে দিয়া এক-একটা সুর জাগাইয়া তুলিতেছে এবং নিজের কৃতিত্ব উচ্চস্বরে প্রচার করিতেছে, কিন্তু কে সেই বিচ্ছিন্ন সুরগুলিকে রাগিণীতে বাঁধিয়া তুলিতেছে? ফুঁ সুর জাগাইতেছে বটে, কিন্তু ফুঁ তো বাঁশি বাজাইতেছে না। সে বাঁশি যে বাজাইতেছে, তাহার কাছে সমস্ত রাগরাগিণী বর্তমান আছে, তাহার অগোচরে কিছুই নাই॥”
কবি রবীন্দ্রনাথ বাঁশিমাত্র, আসল যিনি কবি তিনিই এই ‘কবি বাঁশিটিকে’ বাজাইয়াছেন এবং সেই বাঁশিতে যে রাগরাগিণীর সৃষ্টি হইয়াছে, তাহাই ‘রবীন্দ্ররচনাবলী’ বলিয়া খ্যাত। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য রচনা তাঁহার হইয়াও তাঁহার নহে, আসল রচনাকারী অপর একজন। কাজেই বাঁশীর মত সেই অচেনার হাতেই তিনি বাজিয়াছেন, কোন কর্তৃত্বই এই রাগ-রাগিণী তথা সাহিত্য সৃষ্টিতে তাঁহার নাই, রবীন্দ্রনাথ বলেন। গীতায় কর্মযোগীর প্রকৃষ্ট নিদর্শন বা লক্ষণই কি এখানে দেখা যায় না? আসল কর্মকর্তা স্বয়ং ঈশ্বর, আর তিনি নিমিত্তমাত্র, এই দৃষ্টিতেই তাঁহার সাহিত্যকর্মকে রবীন্দ্রনাথ জানিয়াছেন এবং তাহাই জানাইতে চাহিয়াছেন।
ইহার পরেই এই কয়টি কথা রবীন্দ্রনাথের মুখ হইতে শুনিতে পাওয়া যায়—
“শুধু কি কবিতা লেখার একজন কর্তা কবিকে অতিক্রম করিয়া তাঁহার লেখনী চালনা করিয়াছেন? তাহা নহে। সেই সঙ্গে ইহাও দেখিয়াছি যে, জীবনটা যে গঠিত হইয়া উঠিতেছে, তাহার সমস্ত সুখদুঃখ, তাহার সমস্ত যোগবিয়োগের বিচ্ছিন্নতাকে কে একজন একটি অখণ্ড তাৎপর্যের মধ্যে গাঁথিয়া তুলিতেছেন॥”
নিজের কাব্যসৃষ্টি সম্বন্ধে বলিতে গিয়া রবীন্দ্রনাথ এখানে যে উক্তিটি করিয়াছেন, তাহার মধ্যে এই প্রমাণও প্রসঙ্গত রহিয়াছে যে, তিনি ব্রহ্মজ্ঞ—যেখানে তিনি বলিয়াছেন ‘সেই সঙ্গে ইহাও দেখিয়াছি ইত্যাদি।’
তাঁহার সাহিত্য-সাধনায় রবীন্দ্রনাথ কি মন্ত্রটি উদ্যাপন করিতে চাহিয়াছেন, এখন তাহা উল্লেখ করা যাইতেছে। সত্তর বৎসর বয়সের পূর্বোক্ত ‘প্রতি ভাষণে’ তিনি বলিয়াছেন—
“ঈশোপনিষদের সেই মন্ত্রটি (ঈশাবাস্যামিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ। তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যসিদ্ধনম্॥—ব্রহ্মাণ্ডে যাহা কিছু অনিত্য বস্তু আছে, এই সমস্তই ঈশ্বরের দ্বারা বাসিত বা আচ্ছাদিত ইত্যাদি) বারবার নতুন নতুন অর্থ নিয়ে আমার মনে আন্দোলিত হয়েছে, বারবার নিজেকে বলেছি—তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ মা গৃধঃ; আনন্দ করো তাই নিয়ে যা তোমার কাছে সহজে এসেছে, যা রয়েছে তোমার চারিদিকে, তারই মধ্যে চিরন্তন, লোভ করো না। কাব্যসাধনায় এই মন্ত্র মহামল্য।”
কাব্য সাধনায় এই মহামন্ত্রের সাধনাই—ব্রহ্মসাধনা।
ঈশোপনিষদের যে মন্ত্রটি রবীন্দ্রনাথ তাঁহার সাহিত্য-সাধনায় লক্ষ্য বা আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করিয়াছেন, তাহা উপনিষদের একটি মহাবাণী। ছান্দেগ্যোউপনিষদের ‘তত্ত্বমসি’—তুমিই ব্রহ্ম, এই মহাবাণীর ন্যায় ‘ঈশাবাস্য সর্বমিদং’ বাণীটিও অন্যতম মহা উপদেশ বলিয়া সাধক ও সিদ্ধসমাজে গৃহীত হইয়া থাকে। উপনিষদের ভাষ্যকারগণও ‘ঈশাবাস্যমিদং সর্বং’—এই জগতের সর্ববস্তুতে তিনি আছেন বা সর্ব কিছু ঈশ্বর দ্বারা আবরণীয় ও আচ্ছাদনীয় এই ব্রহ্মমন্ত্রটিকে বেদের অন্যতম ‘মহাবাণী’ বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন।
এই একটি বাণীর মধ্যেই অতীতের তপোবনের ব্রহ্মতত্ত্ব এবং ব্রহ্মসাধনা যুক্তভাবে সুগুপ্ত রহিয়াছে, সাধকসমাজে এই সত্য স্বীকৃত। ব্রহ্মসাধনার সেই মহা-উপদেশই রবীন্দ্রনাথ তাঁহার সমগ্র সাহিত্য সাধনায় উদ্যাপন করিয়াছেন এবং তাঁহার সাহিত্য সৃষ্টি সেই সাধনারই সাক্ষ্য—ইহাই রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব অভিমত।
কাজেই আমরা প্রারম্ভেই বলিতে সাহস পাইয়াছি যে, ‘রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ’, এই সত্য প্রমাণের জন্য তাঁহার রচনাবলীকে সন্দেহাতীত সাক্ষ্য বা প্রমাণরূপে গ্রহণ করা আদৌ অযৌক্তিক নহে। দার্শনিকগণ রবীন্দ্র রচনায় এক দার্শনিক রবীন্দ্রনাথকে দেখিতে পাইয়াছেন, কিন্তু রবীন্দ্ররচনাবলীতে দার্শনিককে নহে এক দ্রষ্টা ও ঋষিকেই পাওয়া যায়—ইহা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই তাঁহার আপন জীবনবৃত্তান্তে বলিয়া গিয়াছেন, আমরা দেখিয়াছি।
কাজেই আমাদের আলোচ্য প্রশ্নের বিচারে আমরা যদি রবীন্দ্ররচনাবলীর আশ্রয় বা সাহায্য গ্রহণ করি, তবে তাহা যুক্তিযুক্ত ও সঙ্গত কাজই হইবে। তাহা না করিলেই বরং এ আলোচনা অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ থাকিয়া যাইবে।
কিন্তু রবীন্দ্ররচনাবলী এত বিশাল যে, তাহা হইতে আলোচ্য বিষয়ে সাক্ষ্য গ্রহণ করিতে গেলে বিস্তর সময়ের প্রয়োজন এবং কয়েক খণ্ড গ্রন্থেও সে-আলোচনা শেষ করা যাইবে না। কাজেই, রবীন্দ্রনাথের রচনাবলী হইতে কোন সাক্ষ্য প্রমাণাদি বক্ষ্যমান ক্ষেত্রে গৃহীত হইবে না, শুধু ‘গীতাঞ্জলি’ রচনাটিকে বিচারক্ষেত্রে কিছুক্ষণের জন্য উপস্থাপিত করা হইবে।
সমগ্র রবীন্দ্ররচনাবলী হইতে একমাত্র ‘গীতাঞ্জলি’-কে গ্রহণ করার বিশেষ কারণ রহিয়াছে। ‘গীতাঞ্জলি’ নিছক কবিতা বা কাব্য নহে। তাহা হইলেও ‘রবীন্দ্ররচনাবলী’ হিসাবেই এই আসরে ইহার প্রবেশ অধিকার থাকিত, পূর্বেই সে আলোচনা আমরা করিয়াছি।
‘গীতাঞ্জলি’ রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত উপলব্ধিরই কাব্যময় প্রকাশ বা রূপ বলিয়া আমরা মনে করি। ‘গীতাঞ্জলি’ কবি রবীন্দ্রনাথের রচনা নহে, ইহা সাধকের রচনা, যেমন রামপ্রসাদের গান, যেমন কবীর, দাদু প্রমুখদের দোঁহা। ‘গীতাঞ্জলি’ ঋষি কবির ভজন, তাঁহার সাধন-সঙ্গীত, তাঁহার ব্রহ্মোপাসনা।
কাজেই নিছক কাব্য সৃষ্টি ইহাকে বলা ভুল, ইহা রবীন্দ্রনাথের ভগবদ উপলব্ধির সাম-গান। গীতার বক্তার ন্যায় গীতাঞ্জলির কবিও বলিতে পারেন—“গীতাঞ্জলি মে হৃদয়ং সুধী, গীতাঞ্জলি মে সারমুত্তমম।”
যে কারণে গীতাঞ্জলিকে রবীন্দ্ররচনাবলী হইতে স্বতন্ত্র এবং বিশেষ করা হইল, তাহা রবীন্দ্রনাথেরও স্বীকৃত ও অভিপ্রেত। একখানি চিঠিতে গীতাঞ্জলি সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের এই অভিমতের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। চিঠিখানি যখন তিনি লেখেন, তখনও ‘গীতাঞ্জলি’ নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত হয় নাই। চিঠিখানির তারিখ ৬ই মে, ১৯১৩; আর ১৯১৩ সালের ১৩ই নভেম্বর তাঁহার নোবেল পুরস্কার সংবাদ এদেশে আসে।
‘গীতাঞ্জলি’র এই বিশ্ব স্বীকৃতির বহু পূর্বেই রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁহার এই রচনা সম্বন্ধে চিঠিখানিতে লিখিয়াছেন—
“কবিতাগুলি আমি লিখব বলে লিখিনি—এ আমার জীবনের ভিতরের জিনিস—এ আমার সত্যকার আত্মনিবেদন—এর মধ্যে আমার জীবনের সমস্ত সুখ দুঃখ সমস্ত সাধনা বিগলিত হয়ে আপনি আকার ধারণ করেছে।”
গীতাঞ্জলি রবীন্দ্রনাথের আত্মনিবেদন, গীতাঞ্জলি তাঁহার সমস্ত সাধনার মূর্তিমান রূপ—স্বয়ং কবির এই সুস্পষ্ট উক্তির পরে গীতাঞ্জলিকে তাঁহার আধ্যাত্মিক উপলব্ধির বিবরণরূপে গ্রহণ করিতে কোন বাধা থাকিতে পারে না। অর্থাৎ ইহা তাঁহার ব্যক্তিগত উপলব্ধিরূপেই আলোচ্যক্ষেত্রে উপস্থাপিত করিবার যুক্তি এবং অধিকার দুই-ই আমাদের রহিয়াছে।
রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ কিনা এই প্রশ্নের কি উত্তর গীতাঞ্জলি হইতে পাওয়া যায়, তাহাই অতঃপর যথাসম্ভব সংক্ষেপে আলোচনা করা যাইতেছে।