কুমার সম্ভব/পঞ্চম সর্গ
পঞ্চম সর্গ।
সেই রূপে পার্ব্বতীর সমক্ষে মহাদেব মদনকে ভস্ম করা অবধি পার্ব্বতীর আশা ভঙ্গ হইয়াছিল, তিনি মনে মনে আপন সৌন্দর্য্যের নিন্দা করিতে লাগিলেন, কারণ প্রেমাস্পদ ব্যক্তির নিকট প্রীতি-ভাজন না হইলে সৌন্দর্য্য থাকা না থাকা দুই সমান॥ ১॥
তাঁহার ইচ্ছা হইল যে আপনার সৌন্দর্য্যের সাফল্যবিধানের জন্য তপস্যাতে প্রবৃত্ত হইবেন। আর তাহা না করিলেই বা, যে প্রেমে শরীরের অর্দ্ধাঙ্গ হইলেন, তাদৃশ প্রেম এবং যে স্বামীর স্ত্রী হইলে বিধবা হইতে হয় না, তেমন স্বামী, এই দুই বস্তু তিনি কি রূপে লাভ করিতেন॥ ২॥
যখন মেনকা শুনিলেন যে পার্ব্বতীর মন শিবের প্রতি এত দূর আসক্ত হইয়াছে যে, তপস্যা করিতে উদ্যত হইয়াছেন, তখন তিনি কন্যাকে বক্ষস্থলে অলিঙ্গন করিয়া তপস্যার কঠোর ক্লেশ তিনি স্বীকার না করেন এই উদ্দেশে কহিলেন॥ ৩॥
বৎসে, আমাদের গৃহে অনেক মনোমত দেবতা আছেন, তাঁহাদিগের আরাধনা কর; তোমার শরীরে কি তপস্যা সম্ভবে? সুকুমার শিরীষপুষ্প ভ্রমরের চরণপাত সহ্য করিতে কথঞ্চিৎ পরে, কিন্তু তাহার উপর পক্ষী বসিলে কি উহার তাহা সহ্য হয়॥ ৪॥
এই সকল উপদেশবাক্য মেনকা বলিলেন, কিন্তু পার্ব্বতীর যে রূপ স্থির প্রতিজ্ঞা, তাহাতে তপস্যার উদ্যম তিনি পরিত্যাগ করিলেন না। যেমন জলের নিম্ন দিকে গতি কেহ অন্যথা করিতে পারে না, তেমনি কাহার সাধ্য যে অভিলষিত বিষয়ের দৃঢ় প্রতিসংকল্প-বিশিষ্ট মনকে বিচলিত করিতে সক্ষম হয়॥ ৫॥
একদিন উন্নতাশয়া পার্ব্বতী অতি বিশ্বাসী এক জন সখী দ্বারা পিতার নিকট এই বলিয়া পাঠাইলেন যে, আমার মনের অভিলাষ আপনার অবিদিত নাই, অতএব যত দিন না কৃতকার্য্য হই, তত দিন তপস্যা করিবার জন্য আমাকে বনে যাইয়া বাস করিতে অনুমতি দিন॥ ৬॥
তাঁহার পিতাও তেমনি উন্নতাশয়, উপযুক্ত পাত্রে কন্যার এরূপ অনুরাগ দর্শনে তিনি সন্তুষ্ট হইয় অনুমতি দিলেন। তদনুসারে পার্ব্বতী, যথায় কেবল ময়ূর এবং তাদৃশ অহিংস্র জন্তুগণ বিচরণ করিত, এতাদৃশ এক শিখরে, গিয়া বাস করিলেন, উত্তর কালে এই শিখর জন সমাজে তাঁহার তপোবন বলিয়া বিখ্যাত হইয়াছিল॥ ৭॥
তাঁহার প্রতিজ্ঞা কোন মতে বিচলিত হইবার নহে; যে হার বক্ষস্থলে আন্দোলিত হইয়া তথাকার চন্দন লোপ করিয়া দিত, সেই হার পরিত্যাগ পূর্ব্বক প্রাতঃকালীন সূর্য্যাতপের তুল্য শ্বেতরক্ত-বর্ণ-শালী বল্কল পরিধান করিলেন; তাঁহার উন্নত স্তন দ্বয়ের উপরি সংলগ্ন হইয়া সেই বল্কল স্থানে স্থানে ছিন্ন-প্রায় হইয়া উঠিল॥ ৮॥
পরম সুন্দর কেশকলাপের দ্বারা তাঁহার মুখের যে প্রকার শোভা হইত, জটা বন্ধন করিলেও সেই মুখ সেই রূপ কমনীয়ই রহিল। ভ্রমরের মালার সংযোগেই যে পদ্মের শোভা হয়, তাহা নহে; শৈবাল সংযোগেও উহার শোভার হ্রাস হয় না॥ ৯॥
মুঞ্জ নামক তৃণ দ্বারা বিরচিত গুণত্রয়-সংঘটিত যে মেখলা তিনি তপস্যার অঙ্গ স্বরূপ ধারণ করিলেন, তাহা ইহার পূর্ব্বে আর কখন ধারিত হয় নাই বলিয়া ক্ষণে ক্ষণে তাঁহার রোমাঞ্চ হইতে লাগিল এবং নিতম্বদেশ রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল॥ ১০॥
এখন অধরে অলক্তক রসের লেপন ছিল না, সুতরাং অধরে হস্ত যাইত না; পূর্ব্বে কন্দুক ক্রীড়া করিতেন, কন্দুক ঊর্দ্ধে উঠিয়া পুনর্ব্বার বক্ষস্থলে পতিত হইয়া তথাকার কুঙ্কুমাদি অঙ্গরাগ দ্বারা রক্তবর্ণ হইয়া উঠিত, এখন সেই কন্দুকের সহিতও হস্তের সম্পর্ক রহিল না। এখন কুশাঙ্কুর ছেদন করাতে হস্তের অঙ্গুলি ক্ষত বিক্ষত হইয়া উঠিল এবং জপমালার সহিতই উহার বিশেষ বন্ধুত্ব ঘটিয়া উঠিল॥ ১১॥
অতি চমৎকার শয্যার উপর গাত্র পরিবর্ত্তন কালে কেশ হইতে যদি পুষ্প পতিত হইত, তাহাতেও তাঁহার ক্লেশ হইত। এরূপ সুকুমারী হইয়াও তিনি এখন বাহু-লতার উপর মস্তক সংস্থাপন পূর্ব্বক অনাবৃত ভূমিতলে শয়ন করিতে লাগিলেন॥ ১২॥
তাঁহার যে সমস্ত রমণীয় অঙ্গচেষ্টা ছিল, সে গুলি এখন বায়ুভরে আন্দোলিত তনু-কলেবরা লতাতে এবং তাঁহার চঞ্চল দৃষ্টিপাত হরিণীতে দৃষ্ট হইতে লাগিল; ইহাতে, জ্ঞান হয় যে তিনি তপস্যায় প্রবৃত্ত হইয়া ঐ দুজনের নিকট পূর্ব্বোক্ত দুটী বস্তু তপস্যার অবসানে পুনর্ব্বার গ্রহণ করিবেন বলিয়া গচ্ছিত রাখিয়ছিলেন॥ ১৩॥
যেরূপ স্তনজুগ্ধে জননী সন্তান প্রতিপালন করেন, তদ্রূপ পার্ব্বতী আলস্য পরিত্যাগ পূর্ব্বক কলস-বিগলিত বারিধারা দ্বারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কতগুলি বৃক্ষকে লালন পালন করিতে লাগিলেন, ইহারা তাঁহার এত দূর প্রীতিভাজন হইয়াছিল যে ভবিষ্যতে কার্ত্তিক জন্মগ্রহণ করিয়াও জ্যেষ্ঠ সহোদরতুল্য সেই বৃক্ষদিগের প্রতি পার্ব্বতীর স্নেহের হ্রাস জন্মাইতে পরিবেন না॥ ১৪॥
অঞ্জলি অঞ্জলি বন্য ধান্য নিত্য নিত্য ভক্ষণ করিতে দেওয়াতে হরিণেরা তাঁহার প্রতি এতদূর বিশ্বস্ত হইয়া উঠিল, যে কখন কখন কুতূহলিনী হইয়া হরিণের চক্ষের সহিত সখীগণের চক্ষের পরিমাণ করিলেও তাহারা স্থির হইয়া থাকিত॥ ১৫॥
নিত্য নিত্য স্নান করেন, অগ্নিহোত্রের অনুষ্ঠান করেন, বল্কলের উত্তরীয় ধারণ করেন, এবং বিহিত অধ্যয়নাদি করিয়া থাকেন, তাঁহার এইরূপ অশেষ প্রকার সদাচারের কথা শুনিয়া দেখা করিবার নিমিত্ত ঋষিরা আসিতে লাগিলেন, কারণ যাঁহারা ধর্ম্মানুষ্ঠান দ্বারা মহৎ হইয়াছেন, তাঁহাদিগের বয়সের বিষয় লোকে অনুসন্ধান করে না॥ ১৬॥
সেই তপোবনটী ক্রমে এমনি স্থান হইয়া উঠিল যে, তথায় যাইলে লোকে পবিত্র হইত; যে হেতু পরস্পর শত্রু ভাবাপন্ন প্রাণিগণ পূর্ব্বের শক্রতা পরিত্যাগ করিল; বৃক্ষেরা অভিলষিত পুষ্পফলের দ্বারা অতিথির সৎকার করিত; এবং অভিনব পর্ণশালার মধ্যে হোমের বহ্নি সর্ব্বদা প্রজ্বলিত রাখা হইত॥ ১৭॥
পার্ব্বতী প্রথমে যে নিয়মে তপস্যা আরম্ভ করিয়াছিলেন, যখন দেখিলেন যে সেরূপ তপস্যাদ্বারা ইষ্টসিদ্ধি হইবার সম্ভাবনা নাই, তখন তিনি আপন শরীরের সুকুমারতা অগ্রাহ্য করিয়া আরো ঘোরতর তপস্যা আরম্ভ করিলেন॥ ১৮॥
যিনি কন্দুকক্রীড়া দ্বারাও পূর্ব্বে ক্লান্তিবোধ করিতেন, তিনি এখন অবলীলাক্রমে কঠোর তপস্যায় প্রবৃত্ত হইলেন, ইহাতে বোধ হয় তাঁহার শরীর সুবর্ণ আর পদ্ম এই দুই বস্তু দ্বারা নির্ম্মিত হইবেক, কারণ পদ্মের গুণে স্বভাবত কোমলও বটে আর সুবর্ণের গুণে দেহ সারবানও ছিল বটে॥ ১৯॥
সেই সুগঠন-কটিদেশবতী চারুহাসিনী গ্রীষ্মকালে আপনার চারি পার্শ্বে চারি অগ্নি প্রজ্বলিত করিয়া স্বয়ং তন্মধ্যবর্ত্তিনী থাকিতেন এবং চক্ষু দগ্ধ হইয়া যায়, সূর্য্যের যে এতাদৃশ প্রভা, তাহা পর্য্যন্ত গ্রাহ্য না করিয়া এক দৃষ্টে সূর্য্যের প্রতি চাহিয়া থাকিতেন॥ ২০॥
এইরূপে সূর্য্যতাপে সর্ব্বতোভাবে সন্তাপিত হইয়া তাঁহার মুখ পদ্মের ন্যায় পরম সুন্দর শোভা ধারণ করিত। কেবল সুদীর্ঘ অপাঙ্গদেশে নীলবর্ণ রেখা ক্রমে ক্রমে প্রকাশ হইল॥ ২১॥
যেমন বৃক্ষের প্রাণধারণ, সেইরূপ তাঁহার প্রাণধারণ হইত কেবল, বিনা যাচ্ঞায় উপস্থিত হয় যে বৃষ্টি-বারি, তদ্দ্বারা, এবং অমৃতময় তারাপতি চন্দ্রের কিরণের দ্বারা। বৃক্ষদিগেরো ঐ দুই বস্তু জীবিকা নির্ব্বাহের উপায় স্বরূপ॥ ২২॥
আকাশচারী বহ্নি যে সূর্য্য, এবং কাষ্ঠদ্বারা প্রজ্জ্বালিত যে পার্থিব বহ্নি, এই দুই প্রকার বহ্নির সন্তাপে যখন তাঁহার শরীর অত্যন্ত সন্তাপিত হইল, তখন গ্রীষ্মের অবসান হইল, নবীন বারি তাঁহাকে অভিষেক করিল, এবং চতুঃপার্শ্বস্থ ভূমিতলের সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার গাত্র হইতে উষ্মা নির্গত হইতে লাগিল॥ ২৩॥
সেই প্রথম বৃষ্টির জলবিন্দু গুলি তাঁহার নিতান্ত ঘন নেত্রলোমের উপর ক্ষণকাল অবস্থিতি করিল, পরে অধরে প্রহার পূর্ব্বক উন্নত স্তনের উপর নিপতিত হইয়া চূর্ণ চূর্ণ হইয়া গেল। তদনন্তর ত্রিবলী অতিক্রমের সময় উহাতে ব্যাঘাত প্রাপ্ত হইয়া অনেক বিলম্বে গভীর নাভিমধ্যে প্রবিষ্ট হইল॥ ২৪॥
সেই বর্ষাকালের রাত্রিতে তিনি অনাবৃত স্থানে শিলাতলে শয়ন করিয়া থাকিতেন, তখন ঝঞ্ঝা-সম্বলিত বৃষ্টি ক্রমাগত পতিত হইতেছে, এ অবস্থায় রাত্রির অধিষ্ঠাত্রী দেবতারা যেন ভবিষ্যতে তাঁহার তপস্যার কঠোরতার সাক্ষ্য দিবার জন্য বিদ্যুতের চক্ষু মেলিয়া দেখিতে লাগিলেন॥ ২৫॥
পৌষমাসের রাত্রিতে যখন বায়ু চতুর্দ্দিকে শিশির বর্ষণ করিতে থাকে, সেই সময়ে তিনি জলমধ্যে অবস্থিতি করিতেন, আর চক্রবাক চক্রবাকী তাঁহার সমক্ষে বিরহদুঃখ অনুভব করত পরস্পরের উদ্দেশে রোদন করিতেছে ইহা দেখিয়া তাঁহার অন্তঃকরণে কারুণ্য-রসের সঞ্চার হইত॥ ২৬॥
তৎকালে তাঁহার সর্বাঙ্গশরীর জলে নিমগ্ন থাকিত, কেবল মুখখানি ভাসিত, উহার সৌরভ পদ্মের ন্যায়, এবং শীতপ্রযুক্ত অধর পদ্ম-দলের ন্যায় কাঁপিতে থাকিত, সুতরাং যদিও শীত সমাগমে সরোবরের তাবৎ পদ্ম নষ্ট হইয়াছিল, তথাপি তাঁহার তথাবিধ সেই মুখ যেন পদ্মের ন্যায় জ্ঞান হইত॥ ২৭॥
বৃক্ষ হইতে স্বয়ং যে শুষ্ক পত্র পতিত হয়, তাহা ভক্ষণ করিয়া থাকাই কঠোর তপস্যার পরা কাষ্ঠা; তিনি কিন্তু তাহা পর্যন্ত পরিত্যাগ করিয়াছিলেন এই নিমিত্ত পৌরাণিকেরা তাঁহার অপর্ণা এই এক নাম দিয়াছে॥ ২৮॥
তাঁহার শরীর ত মৃণালের ন্যায় কোমল, তথাপি সেই শরীরে তিনি পূর্ব্বোক্ত প্রকার যে সকল কঠোর তপস্যার অনুষ্ঠান করিতে লাগিলেন, অন্যান্য ঋষিগণ আপনাদিগের কষ্টসহ কঠিন শরীর দ্বারাও সে প্রকার কঠোর তপস্যা করিতে পারক হয়েন নাই॥ ২৯॥
অনন্তর এক দিন এক ব্রহ্মচারী তাহার আশ্রমে আসিয়া উপস্থিত, তাঁহার গাত্রে মৃগচর্ম্ম, হস্তে পলাশের যষ্টি, কথায় বার্ত্তায় অতীব চতুর ও সপ্রতিভ, মূর্ত্তি যেন ব্রহ্মণ্যদেবের তেজে জাজ্জ্বল্যমান, মস্তকে জটা; তাঁহার অবয়ব দর্শনে বোধ হয় যেন ব্রহ্মচর্য্য আশ্রম মূর্ত্তিমান্ হইয়া আসিয়াছেন॥ ৩০॥
অতিথি-সৎকারে পার্ব্বতীর আস্থা ত ছিলই, কিন্তু ইহার প্রতি সবিশেষ সমাদর প্রদর্শন পূর্ব্বক তিনি আতিথ্য করিলেন। বাস্তুবিকও, যাঁহারা সর্ব্বত্র সমদর্শী হইবেন বলিয়া মনে মনে প্রতিজ্ঞ করিয়াছেন, তাঁহাদিগেরো কোন কোন ব্যক্তির প্রতি সবিশেষ গৌরব হইয়া থাকে॥ ৩১॥
ব্রহ্মচারি পার্ব্বতীর নিকট যথাযোগ্য অতিথি-সৎকার গ্রহণ করিলেন, এবং ক্ষণকাল, যেন বিশ্রাম করিতেছেন এই ভঙ্গিতে স্থির হইয়া রহিলেন। পরে সরল দৃষ্টি পার্ব্বতীর প্রতি নিক্ষেপ করিতে করিতে শিষ্ট-জনোচিত রীতির অনুসরণ পূর্ব্বক এই সকল কথা বলিতে আরম্ভ করিলেন॥ ৩২॥
কেমন, তোমার ধর্ম্মানুষ্ঠানের উপযোগী কুশ-কাষ্ঠ এস্থানে অনায়াসে পাওয়া যায় ত? এস্থানের জলে তোমার স্নানাদি সুন্দর রূপ নির্ব্বাহ হয় ত? কেমন, যেরূপ পার, তাহার অতিরিক্ত তপস্যা করিয়া শরীরকে ক্লেশ দাওনা ত? যেহেতু শরীরই ধর্ম্মানুষ্ঠানের সর্ব্বপ্রধান উপায়॥ ৩৩॥
এই যে লতাগুলি, যাহাদিগের মূলে তুমি জলসেক করাতে উহাদিগের পল্লব উৎপন্ন হইয়াছে, কেমন সে পল্লব নিরন্তর অবিচ্ছিন্ন ভাবে উৎপন্ন হইয়া থাকে ত? তোমার অধরে অনেক দিন অলক্তক রস লেপন কর নাই, উহা পাটলবর্ণ হইয়া গিয়াছে, ঐ পল্লব গুলিও স্বভাবত তদ্রূপই পাটল॥ ৩৪॥
এই যে হরিণেরা, যাহাদিগের চঞ্চল চক্ষু অবলোকন করিলে মনে হয় যেন তোমার নয়ন মাধুরীর অভিনয় করিতেছে, উহারা যখন বিশ্বাস বশতঃ তোমার হস্তস্থিত কুশ আসিয়া ভক্ষণ করে, কেমন তখন উহাদিগের প্রতি তুমি বিরক্ত হও না ত?॥ ৩৫॥
রূপ থাকিলে লোকে পাপী হয় না এই যে এক কথা আছে, তোমাকে দেখিলে কিন্তু তাহা সত্যই বোধ হয়। তাহাই ত দেখিতেছি যে তোমার আকৃতি যেমন চমৎকার, তোমার ধর্ম্মানুষ্ঠানও তেমনি আশ্চর্য্য, যে মুনিরা পর্য্যন্ত তাহা হইতে শিক্ষা পাইতে পারেন॥ ৩৬॥
স্বর্গের গঙ্গায় সপ্তর্ষিগণ পূজা অর্চ্চা করিয়া পূজার সামগ্রী নিক্ষেপ করিয়া গঙ্গাজলের শোভা বৃদ্ধি করিয়া থাকেন। সেই পরম পাবন গঙ্গাজল মস্তকে পতিত হইয়া পর্ব্বতরাজের যেরূপ পবিত্রতা উৎপন্ন করিয়াছে, আমি বোধ করি তোমার নির্ম্মল চরিত্রের দ্বারা পর্ব্বতরাজ ততোধিক পবিত্র হইয়া গিয়াছেন॥ ৩৭॥
তোমার ন্যায় বুদ্ধিমতী নারী মন হইতে অর্থ ও কামের অনুসন্ধান এক কালে দূরীভূত করিয়া কেবল যে ধর্ম্মেরই অনুসরণ করিতেছে, ইহা দেখিয়া আজি আমার নিশ্চিত প্রতীতি হইল যে ধর্ম্মই ত্রিবর্গের মধ্যে শ্রেষ্ঠ॥ ৩৮॥
এরূপ বিশেষ সমাদর যখন তুমি আপনি আমাকে করিয়াছ, তখন আমাকে আর তোমার পর ভাবা উচিত হয় না—কারণ হে অবনত-কলেবরে, পণ্ডিতেরা বলেন যে সাত্টী কথা একত্রে হইলেই সাধু লোকের বন্ধুত্ব জন্মিয়া যায়॥ ৩৯॥
অতএব হে তাপসি, তুমি ত বিস্তর সহ্য কর, আর আমি জাতিতে ব্রাহ্মণ, স্বভাবত চপল ইহা তুমি ত জানই—এ নিমিত্ত কিঞ্চিৎ প্রশ্ন করিতে ইচ্ছা করি যদি গোপনীয় না হয়, আশা করি যে তুমি প্রকাশ করিয়া বলিবে॥ ৪০॥
স্বয়ং ব্রহ্মা প্রজাপতির বংশে তোমার জন্ম, তোমার রূপ লাবণ্য এমনি আশ্চর্য্য যে জ্ঞান হয় যেন ত্রিভুবনের সৌন্দর্য্য তোমার শরীরেই আছে, বিভব সম্পত্তির যে সুখ, তাহাও তোমায় চেষ্টা করিয়া পাইতে হয় না, বয়সও নবীন অতএব কি বাসনা করিয়া তুমি তপস্যা করিতেছ বল দেখি॥ ৪১॥
বটে, যে সকল নারীর মনে তেজ থাকে, কোন অসহ্য অপ্রিয় ঘটনা হইলে তাঁহাদিগের এরূপ প্রবৃত্তি হইয়া থাকে। কিন্তু হে ক্ষীণোদরশালিনি! যখন মনে মনে বিশেষ অনুধাবন করিয়া দেখি, তখন তোমার পক্ষে সে অপ্রিয় ঘটনা সম্ভব বোধ হয় না॥ ৪২॥
তোমার যে মূর্ত্তি, তাহাতে শোক কখন তোমাকে স্পর্শ করিবে বোধ হয় না। আর জনকের গৃহে কোন রূপ অপমান প্রাপ্ত হইয়ছ, ইহাই বা কিরূপে সম্ভব? অন্য কোন ব্যক্তিও যে তোমার অপমান করিবে, ইহাও সম্ভব বোধ হয় না, কারণ ফণি-ফণস্থিত মণি-শলাকা অপহরণ করিতে হস্ত অগ্রসর করে এমন সাধ্য করে আছে?॥ ৪৩॥
কেন বল দেখি এই নবীন বয়সে অলঙ্কার পরিত্যাগ পূর্ব্বক তুমি বৃদ্ধাবস্থার উপযুক্ত বল্কল ধারণ করিয়াছ? বল দেখি সন্ধ্যা বেলা, যখন চন্দ্র তারা উজ্জ্বল কান্তি ধারণ করিতেছে, তখন যদি সূর্য্যোদয় হয়, তাহা হইলে কি অসংগত ব্যাপার হয়॥ ৪৪॥
তবে কি তুমি স্বর্গ কামনায় তপস্যা করিতেছ, তাহা হইলে নিরর্থক এ ক্লেশ, কারণ তোমার পিতার যে সকল স্থান, তাহাই যে দেবভূমি স্বর্গ। তবে কি উপযুক্ত স্বামী পাইবার জন্য?—তাহা হইলে তপস্যা কেন? রত্নকেই সকলে অন্বেষণ করে, রত্ন কখন কাহারো অন্বেষণ করে না॥ ৪৫॥
‘স্বামী’ এই নাম শ্রবণ মাত্র তোমার দীর্ঘ উষ্ণ নিশ্বাস পড়িল, তাহাতে বুঝিলাম যে স্বামীর জন্যেই তোমার তপস্যা; কিন্তু আমার মনের সংশয় ত দূর হইতেছে না। তুমি প্রার্থনা করিতে পার, এমন পুরুষই ত্রিজগতে নাই, তাহাতে আবার তুমি প্রার্থনা করিয়াও পাইতেছ না, এমন কে আছে বুঝিতে পারিতেছি না॥ ৪৬॥
কি আশ্চর্য্য! তোমার প্রিয়পাত্র সেই যুবা কি নিষ্ঠুরই হইবেক! এত দিন ধরিয়া তোমার কপোল দেশের সহিত কর্ণ পদ্মের সমাগম নাই, এখন তথায় ধান্য-মঞ্জরীর ন্যায় পিঙ্গল বর্ণ জটাগুলি শিথিলভাবে লম্বমান রহিয়াছে, এরূপ অবস্থা ঘটিলেও সে কি রূপে নিশ্চিন্ত আছে?॥ ৪৭॥
তপস্যা করিয়া যার পর নাই কৃশ হইয়াছ, যেখানে পূর্ব্বে অলঙ্কার পরিতে, সে সকল স্থান রৌদ্রে দগ্ধ হইয়াছে, দিবা ভাগের চন্দ্র কলার ন্যায় তোমার শরীর বিবর্ণ হইয়াছে, ইহা দেখিয়া কোন্ সহৃদয় ব্যক্তির মনে দুঃখ না হয়?॥ ৪৮॥
তোমার এই যে কুটিল লোম-রাজি-বিভূষিত ও রমণীয়দৃষ্টিপাতকারী চক্ষু, ইহার সম্মুখে আপনার মুখ আনিয়া ধরিয়া দিতেছে না, অতএব বুঝিলাম যে তোমার প্রিয়পাত্র ‘আমি বড় রূপবান্’ এই অহঙ্কারেই প্রতারিত হইতেছেন॥ ৪৯॥
হে পার্ব্বতি। আর কত কাল তপস্যার ক্লেশ ভোগ করিবে? এই ব্রহ্মচর্য্য আশ্রমে আমিও কিঞ্চিৎ তপস্যার সঞ্চয় করিয়াছি। না হয়, তাহার কিয়দংশ লইয়া আপন অভীষ্ট সিদ্ধ কর—কেবল তোমার প্রিয়পাত্র কে এইটী আমি জানিতে ইচ্ছা করি॥ ৫০॥
ব্রহ্মচারী এই রূপে মনের কথা আকর্ষণ পূর্ব্বক পূর্বোক্ত কথাগুলি রলিলে পর পার্ব্বতী লজ্জা বশতঃ আপন প্রিয়পাত্রের নামোল্লেখ করিতে পারিলেন না। পরে কজ্জ্বলবিরহিত নয়ন নিত্য-সহচরী সখীর প্রতি নিক্ষেপ করিয়া তাঁহাকে কহিতে ইঙ্গিত করিলেন॥ ৫১॥
পার্ব্বতীর সখী ব্রহ্মচারীকে কহিলেন, হে সাধো! আপনার জানিতে ইচ্ছা হইয়াছে, অতএব শুনুন যে কাহার অভিলাষে অভিলাষিণী হইয়া, যেমন পদ্মকে ছত্রের কার্য্যে নিযুক্ত করা, সেই রূপ আপনার সুকোমল শরীরকে তপস্যার অনুষ্ঠানে ইনি নিযুক্ত করিয়াছেন॥ ৫২॥
ইঁহার অভিলাষ অতি উচ্চ—ইন্দ্র আদি অতুল ঐশ্বর্য্যশালী চারি দিক্পালকেও পতিত্বে বরণ করিতে ইঁহার ইচ্ছা নাই। যিনি কন্দর্পকে শাসন করিয়া অবধি সৌন্দর্য্য গুণে বশীভূত হইবার নহেন, সেই মহাদেবকে পতি পাইবেন, এ প্রকার ইঁহার অভিলাষ॥ ৫৩॥
কামদেব স্বয়ং ভস্ম হইলেন, কিন্তু তাঁহার যে বাণ মহাদেবের দুর্দ্ধর্ষ হুঙ্কার-বাক্যে পরাঙ্মুখ হইয়া মহাদেবকে স্পর্শ করিতে পারে নাই, সেই বাণ আসিয়া গাঢ় রূপে ইঁহার বক্ষস্থলে আঘাত করিল॥ ৫৪॥
সেই অবধি ইনি মদন সন্তাপে জর্জর হইলেন, ললাটে চন্দন লেপন করিয়া কেশ গুলি ধূসর হইয়া গেল, তখন পিতার ভবনে ঘনীভূত তুষার-শিলায় শয়ন করিয়াও ইঁহার আর সন্তাপ শান্তি হইল না॥ ৫৫॥
কিন্নর জাতীয় রাজ কন্যারা ইঁহার সঙ্গে একত্র হইয়া বনমধ্যে সংগীত চর্চ্চা করিতেন; যখন সেই উপলক্ষে শিবের চরিত্র-কীর্ত্তন-সংক্রান্ত গান আরম্ভ হইত, তখন চক্ষে জল আসিয়া ইঁহার কণ্ঠ রোধ হইত, কথা অস্পষ্ট হইয়া ঘাইত, সখীরা দেখিয়া রোদন করিতেন॥ ৫৬॥
আর রাত্রির তিন ভাগের এক ভাগ অবশিষ্ট থাকিতে কত দিন দেখিয়াছি ইনি ক্ষণকালের জন্য দুই চক্ষু মুদ্রিত করিয়া হঠাৎ জাগরিত হইতেন, তখন কেহ কোথাও নাই, অথচ যেন কাহাকেও বলিতেছেন “হে নীলকণ্ঠ! কোথায় চলিলে,” যেন কাহারো গলদেশে বাহু-বন্ধন অপর্ণ করিবার জন্য দুই বাহু প্রসারিত করিতেছেন॥ ৫৭॥
আর বালিকার ন্যায় কখন বা আপনি শিবের প্রতিমূর্ত্তি চিত্রিত করিয়া সেই প্রতিমূর্ত্তিকে এই বলিয়া তিরস্কার করিতেন যে “পণ্ডিতেরা তোমাকে সকলের অন্তর্যামী কহে, কিন্তু আমি যে তোমার প্রতি অনুরাগিণী, ইহা আজিও তুমি কেন জানিতে পারিতেছ না”॥ ৫৮॥
পরে যখন বুঝিলেন যে সেই জগৎপাতা শিবকে পতি পাইতে হইলে তপস্যা ব্যতীত উপায়ান্তর নাই, তখন পিতার অনুমতি লইয়া এবং আমাদিগকে সঙ্গে লইয়া ইনি তপস্যা করিবার জন্য তপোবনে আসিয়াছেন॥ ৫৯॥
এই যে বৃক্ষগণ, যাহাদিগকে সখীই রোপণ করিয়াছেন এবং যাহারা ইঁহার তপস্যা আদ্যন্ত প্রত্যক্ষ করিয়াছে, ইহারাও ফলবান্ হইল। কিন্তু মহাদেবকে পাইবার নিমিত্ত ইঁহার যে অভিলাষ, তাহার অঙ্কুরও আজি উদয় হয় না॥ ৬০॥
যেমন ইন্দ্রই বৃষ্টি ও অনাবৃষ্টির বিধাতা, তিনি অনুগ্রহ না করিলে ভূমি শুষ্ক হইয়া ক্ষতবিক্ষত হইয়া যায়, তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করিলে ভূমির সে ভাব নষ্ট হয়, তদ্রূপ শিবই ইঁহার কষ্টের হেতু, তিনি যে কবে অনুগ্রহ করিবেন জানি না, তিনি ইঁহার অভিলাষের পাত্র হইয়া দুর্লভ হইয়াছেন, কিন্তু তাঁহাকে পাইবার নিমিত্ত তপস্যা করিয়া করিয়া ইনি এরূপ কৃশ হইয়াছেন যে দেখিলে সখীদের চক্ষে জল আসে॥ ৬১॥
পার্ব্বতীর মনের কথা তাঁহার সখী জানিতেন, অতএব যখন তিনি এই রূপে কোন কথা গোপন না করিয়া সেই প্রিয়দর্শন ব্রহ্মচারীকে আদ্যোপান্ত ব্যক্ত করিয়া কহিলেন, তখন তাঁহার মুখে কিছুমাত্র আনন্দের লক্ষণ লক্ষিত হইল না, তিনি কেবল পার্ব্বতীকে এই মাত্র জিজ্ঞাসা করিলেন যে, ‘কেমন, তোমার সখী যাহা বলিলেন, তাহা কি সত্য অথবা পরিহাস মাত্র?’॥ ৬২॥
তখন পার্ব্বতী হস্তের অঙ্গুলি গুলি মুদ্রিত করিয়া স্ফটিকময়ী জপমালা হস্তের অগ্রভাগে সংস্থাপন পূর্ব্বক অনেক বিলম্বে মুখে কথা আনয়ন পূর্ব্বক অতি কষ্টে কহিলেন॥ ৬৩॥
হে পণ্ডিতবর! আপনি যাহা শুনিলেন, তাহা যথার্থ! সত্যই এ অভাজন উচ্চপদ আকাঙ্ক্ষা করে। হায় আমার কি দুরাশা যে এই সামান্য তপস্যা দ্বারা সে উচ্চপদ পাইব ইহা মনে করিয়াছি। তবে মনের বাসনা ধাবিত না হয় এমন বস্তু কিছুই নাই॥ ৬৪॥
তখন ব্রহ্মচারী কহিলেন, শিবকে আমি জানি, তাঁহার লাভের জন্য তুমি আবার চেষ্টা করিতেছ। তিনি যে রূপ কদাচারী পুরুষ, আমি কিন্তু এ বিষয়ে তোমার সাহায্য করিতে পারিলাম না॥ ৬৫॥
এমন অসার বস্তুতে তোমার এরূপ আগ্রহ কেন হইতেছে? যখন তোমার এই হস্তে বিবাহের সূত্র পরাইয়া দিবে, তখন বিবেচনা করিয়া দেখ দেখি, সর্পে বেষ্টিত শিবপাণি ইহাকে ধারণ করিতে গেলে ইহার কি দুর্দ্দশা ঘটিবেক॥ ৬৬॥
তুমি আপনিই বুঝিয়া দেখ, কলহংস চিহ্নে চিহ্নিত যে বধূর পট্টবস্ত্র এবং বিন্দু বিন্দু রুধির-বর্ষণকারী যে হস্তিচর্ম্ম, এ উভয়ের কখন কি মিলন হওয়া সংগত হয়?॥ ৬৭॥
তোমার এই দুই চরণ চিরকাল পুষ্প সমাচ্ছাদিত গৃহ মধ্যে ন্যাস করিয়া আসিয়াছ, তোমার সেই চরণ অলক্তক রসে রঞ্জিত হইয়া কেশ সমাচ্ছাদিত শ্মশান ভূমিতে নিক্ষেপ করিবে ইহা কি তোমার শক্রতেও ইচ্ছা করে॥ ৬৮॥
ইহা অপেক্ষা অসংগত আর কি আছে যে শিবের আলিঙ্গন তোমাকে গ্রহণ করিতে হইবেক। হরিচন্দন-লেপ-সংযুক্ত তোমার বক্ষস্থলে কি না চিতাভষ্মের ধুলি সংলগ্ন হইবে॥ ৬৯॥
আর এক বিড়ম্বনা তোমার যে অতি শীঘ্রই ঘটিবেক, তাহা তুমি ভাবিয়া দেখিতেছ না? বিবাহের পর তোমার উচিত যে হস্তি-রাজের পৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া যাওয়া—যখন তুমি বৃদ্ধ বৃষের পৃষ্ঠে আরোহণ করিবে, তখন ভদ্র লোক মাত্রেরি মুখে নিশ্চয় হাসি আসিবে॥ ৭০॥
কি দুঃখের বিষয়! শিবকে পাইবার জন্য আগ্রহ যুক্ত হইয়া এক্ষণে দুটী বস্তু শোচনীয় হইয়া গেল; সেই লাবণ্যময়ী চন্দ্রকলা ত অগ্রেই গিয়াছে আর ত্রিভুবনের লোকের লোচনানন্দভূতা তুমিও এখন সেই দশা প্রাপ্ত হইলে॥ ৭১॥
হে হরিণ-শিশু-লোচনে! লোকে যে যে গুণে ভূষিত বরের কামনা করিয়া থাকে, তাহার একটীও গুণ কি শিবের আছে। দেখ শরীরে তিন চক্ষু, জন্মের পরিচয় কেহই জানে না, আর ধনবান্ যে কিরূপ, তাহা তাঁহার বসন নাই ইহাতেই বুঝা গিয়াছে॥ ৭২॥
অতএব এই দুরভিসন্ধি হইতে মনকে নিবৃত্ত কর। তোমার মত সুলক্ষণা অবলার পাণিগ্রহণ তাদৃশ ব্যক্তি কর্ত্তৃক হওয়া নিতান্ত অযোগ্য। যজ্ঞে পশু বন্ধনের যূপের প্রতি যে পূজা করা গিয়া থাকে, শ্মশানস্থিত বধ্য-শূলকে সেই পূজা কেহ দিবেক, ইহা ভদ্র লোকে কখন প্রত্যাশা করেন না॥ ৭৩॥
ব্রহ্মচারী এই রূপে তাঁহার অনভিমত কথা সমস্ত যখন বলিতেছিলেন, তখন পার্ব্বতীর অধর কম্পিত হইয়া তাঁহার ক্রোধোদয়ের সূচনা করিয়া দিল, ভ্রূলতা কোপে সংকোচ প্রাপ্ত হইল, দুই চক্ষুর প্রান্তভাগ রক্ত বর্ণ হইয়া উঠিল এবং তিনি বক্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন॥ ৭৪॥
তখন তাঁহাকে কহিলেন, মহাদেব যে কি বস্তু, তাহা তুমি কখনই অবগত নহ, সেই নিমিত্তই আমাকে এতাদৃশ কথা বলিতেছিলে। মূঢ় লোকে মহাপুরুষদিগের অসাধারণ আচরণ অবলোকন পূর্ব্বক উহার কারণ নিরূপণ করিতে না পারিয়া নিন্দা করিয়া থাকে॥ ৭৫॥
তুমি কহিয়াছ, শিব কদাচারী, শ্মশানে থাকেন, চিতাভস্ম মাখেন। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, মাঙ্গল্য আচরণ তিনি কেন করিতে যাইবেন? যাহার চেষ্টা যে, বিপদ হইতে উদ্ধার হইবে, অথবা যাহার বাঞ্ছা যে ঐশ্বর্য্য লাভ করিবে, সেই মাঙ্গল্য আচরণের অনুসন্ধান করে। কিন্তু শিব জগতের পরিত্রাতা, তাঁহার কোন কামনা নাই, তিনি কেন অসার আশা দ্বারা চিত্ত-বৃত্তিকে কলুষিত করিবার নিমিত্ত মাঙ্গল্য আচরণের অনুষ্ঠান করিতে যাইবেন॥ ৭৬॥
মহাদেবের তত্ত্ব কেই বা অবগত আছে? তাঁহার কিছু নাই, অথচ তাঁহা হইতেই সকল সম্পত্তি উৎপত্তি হয়; তিনি শ্মশানে বাস করেন, অথচ ত্রিভুবনের অধিপতি; তাঁহার আকৃতি ভয়ঙ্কর, অথচ তাঁহার নাম শিব॥ ৭৭॥
ব্রহ্মাণ্ডই তাঁহার মূর্ত্তি, অতএব তাঁহার শরীর যে কি প্রকার, ইহা অবধারণ কে করিবে? কখন অলঙ্কারে উজ্জ্বল, কখন সর্পই তাঁহার ভূষণ; কখন পরিধান হস্তিচর্ম্ম, কখন বা পট্টবস্ত্র; কখন মনুষ্যের ললাটাস্থি মস্তকে ভূষণ স্বরূপ ধারণ করেন, কখন বা চন্দ্রই তাঁহার শিরোভূষণ হয়॥ ৭৮॥
চিতাভস্ম তাঁহার শরীরের সংস্পর্শ পাইয়া নিশ্চয়ই অতিপবিত্র পদার্থ হইয় উঠে; নতুবা যখন শিব নৃত্যকালে হস্ত পদাদি সঞ্চালন করিলে সেই ভস্ম ভূমিতলে পতিত হয়, তখন দেবতারা উহা মস্তকে লেপন করিবেন কেন॥ ৭৯॥
তিনি নির্ধন, কিন্তু যখন তিনি বৃষে আরোহণ করিয়া গমন করেন, তখন মদমত্ত-ঐরাবতারূঢ় ইন্দ্র তাঁহার চরণে প্রণিপাত করিয়া চরণাঙ্গুলি গুলি মস্তকস্থিত প্রফুল্ল মন্দার মালার পরাগে রক্ত বর্ণ করিয়া দেন॥ ৮০॥
তুমি ত অধঃপাতে গিয়াছ, শিবকে নিন্দা করাই তোমার অভিপ্রায়, তথাপি শিবের একটী প্রশংসা তোমার মুখ হইতেও নির্গত হইয়াছে। যিনি ব্রহ্মারও উৎপত্তির মূল, তাঁহার জন্মের নিরূপণ কি রূপে সম্ভবে?॥ ৮১॥
আর বাগ্যুদ্ধে প্রয়োজন করে না। তুমি শিবের বিষয় যেরূপ জান, তিনি সর্ব্বতোভাবে সেই রূপই না হয় হইলেন। আমার মন তাঁহার উপর একাগ্র হইয়া রহিয়াছে। প্রণয়ের প্রবৃত্তি হইলে দোষ গুণ বিচার থাকে না॥ ৮২॥
সখি বারণ কর; এই ব্রাহ্মণের অধর আবার কম্পিত হইতেছে, আবার কিছু বলিবে। মহতের নিন্দা যে করে, শুদ্ধ সে নহে, কিন্তু যে শুনে, সে পর্য্যন্ত পাপে লিপ্ত হয়॥ ৮৩॥
অথবা এই স্থান হইতে আমার চলিয়া যাওয়াই কর্ত্তব্য, এই কথা বলিয়া পার্ব্বতী গাত্রোত্থান করিলেন, ত্বরা প্রযুক্ত তাঁহার বক্ষস্থলের বল্কল সরিয়া গেল। তৎক্ষণাৎ মহাদেব নিজ মূর্ত্তি পরিগ্রহ পূর্ব্বক কিঞ্চিৎ হাস্য করিয়া তাঁহাকে ধারণ করিলেন॥ ৮৪॥
তাঁহাকে দেখিয়া পার্ব্বতী কাঁপিতে লাগিলেন, তাঁহার ক্ষীণ শরীর ঘর্ম্মাক্ত হইয়া উঠিল; যাইবার জন্য চরণ উত্তোলন করিয়াছিলেন, সে চরণ ঊর্দ্ধেই রহিল, অতএব যেমন পথি মধ্যে কোন পর্ব্বতের সহিত দেখা হইলে নদীর জল অস্থির হয়, অগ্রসরও হয় না, পশ্চাৎ দিকেও যায় না, তদ্রূপ পার্ব্বতী গেলেন কি রহিলেন, ইহা বলা অসাধ্য॥ ৮৫॥
হে অবনত-কলেবরে! আজি অবধি আমি তোমার দাস, তুমি তপস্যা স্বরূপ মূল্য দ্বারা আমাকে ক্রয় করিয়াছ, শিব এই কথা বলিবামাত্র পার্ব্বতীর তপস্যা-জন্য সমস্ত ক্লেশ তৎক্ষণাৎ দূর হইল; কারণ যাহা পাইবার জন্য ক্লেশ করা যায়, তাহা পাইলে শরীর পুনর্ব্বার নবীন হইয়া উঠে॥ ৮৬॥