চণ্ডিকা-মঙ্গল/অষ্টম অধ্যায়
অষ্টম অধ্যায়।
রক্তবীজ বধ।
চণ্ডমুণ্ড বধ শুনি দৈত্যের ঈশ্বর।
তর্জ্জন গর্জ্জন করে অতি ভয়ঙ্কর॥
অতি ক্রোধচিত্ত হ’ল শুম্ভ বলবান।
আদেশিল সর্ব্ব সৈন্য হও আগুয়াণ॥
দৈত্যগণ প্রতি আজ্ঞা করে দৈত্যেশ্বর।
সব অস্ত্রধারী যুদ্ধে চলহ সত্বর॥
হস্তী অশ্ব যত ইতি শোর্য্যর সহিত।
সজ্জীভূত হও সবে অতি ত্বরান্বিত॥
পঞ্চাশত কোটি সৈন্য সাজিয়া প্রচুর।
ধূম্রলোচনের বংশ শতেক অসুর॥
কাল আর কালকেয় হও আগুসার।
লও ত্বরা যুদ্ধ সাজ আদেশে আমার॥
ভৈরব-শাসন সৈন্য রাজাজ্ঞা পাইয়া।
সহস্রে সহস্রে ধার যুদ্ধ মুখ হ’য়া॥
সেনাগণ দেখি চণ্ডী অতি ভয়ঙ্কর।
ধনুর টঙ্কারে কাঁপে দিগ দিগন্তর॥
অতি ঘোর নাদ করে সিংহ মহাবল।
সিংহনাদে ঘণ্টা শব্দে অসুর বিকল॥
সিংহনাদে ঘণ্টা শব্দে ধনুর টঙ্কার।
ক্ষিতি টল মল দশ দিক অন্ধকার॥
ভয়ঙ্কর রূপে কালী মারিল হুঙ্কার।
জিহ্বা বাহিরিল আর বদন বিস্তার॥
শুনিয়া দেবীর শব্দ দৈত্য সৈন্যগণ।
ভীত চিত্তে চতুর্দ্দিকে করে পলায়ন॥
চণ্ডী কালিকা আর বাহন কেশরী।
নাশ করে দৈতা সৈন্য নানা অস্ত্র ধরি॥
দেবগণে শ্রেষ্ঠ যাঁরা বীর্য্য বল বন্ত।
ব্রহ্মা শিব ইন্দ্র আদি কার্ত্তিক অনন্ত॥
এই সব দেবগণ দেহ হ’তে শক্তি।
বাহির হইয়া যায় দুষ্পাঠ্য পার্ব্বতী॥
যে দেবের যেইরূপ বাহন ভূষণ।
সেই মতে সেই শক্তি হইল গঠন॥
বাহির হইয়া তবে দেব শক্তিগণ।
অসুর সম্মুখে যায় করিবারে রণ॥
হংস বিমানেতে চড়ি পরমা সুন্দরী।
আসিল ব্রাহ্মণী দেবী কমণ্ডলু ধারী॥
বৃষ পৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া সুন্দরী।
ত্রিশূল ধরিয়া গেল দেবী মহেশ্বরী॥
সাজিল কুমারী দেবী শক্তি হস্তে করি।
কার্ত্তিকের শক্তি সেই অতুল সুন্দরী॥
সাজিল বৈষ্ণবী দেবী বিষ্ণুর গৃহিণী।
গরুড় উপরে শোভা করে নারায়ণী॥
শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম ধরে চারি করে।
দেখিয়া আশ্চর্য্যরূপ দৈত্য ভয়ে মরে॥
দুষ্পাঠ্য দেবী সাজে বরাহ আকার।
শক্তি হস্তে হয় দেবী যুদ্ধে আগুসার॥
নৃসিংহিনী দেবী সাজে করি নানা মায়া।
অর্দ্ধেক মানবাকৃতি অর্দ্ধ সিংহ কায়া॥
ইন্দ্রের ইন্দ্রানী করি হস্তী আরোহণ।
বজ্র হস্তে যায় দেবী করিবারে রণ॥
সহস্র লোচন নামে খ্যাত সুরপতি।
সেই অনুসারে সাজলেক তাঁর শক্তি॥
এই মতে সাজিলেন যত শক্তিগণ।
যুধিবারে যায় যথা আছে দৈত্যগণ॥
শক্তিগণ প্রতি চণ্ডী কহিল তখন।
যুদ্ধ করি দৈত্য সৈন্য করহ নিধন॥
মহা ঘোরতর রূপে চণ্ডিকা হইতে।
শক্তি এক বহির্গত শিবা শতে শতে॥
উগ্র চণ্ডা সেই শক্তি করে নানা মায়া।
ধূম্র বর্ণ জটা তাঁর কাল বর্ণ কায়া।॥
বহির্গত শিবাগণ করে ঘোর নাদ।
দৈত্যগণ বলে বুঝি ঘটিল প্রমাদ॥
দূত প্রতি কহে দেবী যাও শীঘ্র গতি।
যথা আছে আছে শুম্ভ রাজা নিশুম্ভ প্রভৃতি॥
আর আর যেই দৈত্য যুদ্ধে উপস্থিত।
তাদের নিকটেতে কহ ত্বরান্বিত।
ত্রৈলোক্যের ইন্দ্র তব পাবে দেবগণ।
দেবগণে যজ্ঞদুষ্পাঠ্য করিবে ভক্ষণ॥
তোমা সবে দুষ্পাঠ্য রাখ জীবনের আশ।
পাতালেতে দুষ্পাঠ্য করহ নিবাস॥
আাদেশ লঙ্ঘ যদি করি অহঙ্কার।
দুষ্পাঠ্য হবে সবে শিবার আহার॥
যত সৈন্য আসিয়াছে দৈত্যরাজ সঙ্গে।
শিবাগণ ভক্ষিবেক তাহা নানা রঙ্গে॥
দেবীর এসব কথা শুনিয়া অসুর।
কাত্যায়নী প্রতি কোপ করিল প্রচুর॥
দুষ্পাঠ্য শক্তি শর।
বরিষণ কর সবে দেবীর উপর॥
দেবী ছাড়িলেক চক্র নানাবিধ শূল।
কাটিয়া দৈত্যের বাণ করিল নির্ম্মূল॥
শূল হানি বহু সৈন্য করিল বিদার।
খড়্গে কাটি সৈনাগণ করিল সংহার॥
ক্ষেপিল ব্রহ্মার শক্তি কমণ্ডলুর জল
হরিলেক দৈত্য হ’তে যত শক্তি বল॥
ব্রহ্মাণী করিল বহু সৈন্যের সংহার।
চারিদিকে ধায় সৈন্য করি হাহাকার॥
মহেশ্বরী ত্রিশূলেতে দৈত্য পরাভব।
চক্রেতে বৈষ্ণবী দেবী বিনাশে দানব॥
ক্রোধেতে কুমারী দেবী শক্তি ল’য়া হাতে।
দৈত্য সৈন্যগণ দেবী মারে শতে শতে।
বজ্র হস্তে ইন্দ্র শক্তি দৈত্য করে নাশ।
রণ ভূমি শক্তিগণের রূপে ত প্রকাশ।
বক্ষ বিদারিয়া বারে ভূমিতে ফেলায়॥
রক্ত স্রবি হইলেক মহা নদী প্রায়।
বারাহিনী দেবী করে বদন বিস্তার।
ওষ্ঠাঘাতে বহু সৈন্য করয়ে সংহার॥
দন্তাঘাতে দৈত্য সৈন্য করয়ে চর্ব্বণ।
চক্র দ্বারা দৈত্য হয় নিমিষে নিধন॥
নখে বিদারিয়া কারে ভূমিতে ফেলায়।
খাইয়া বহুল সৈন্য উদর ভরায়॥
নার সিংহী নাদ করে হ’লা দিগম্বরা।
অট্ট অট্ট হাসে শিবা দ্যুতি ভয়ঙ্করা॥
অস্ত্রাঘাতে সৈন্যগণ ভূমিতলে পড়ে।
মাতৃগণ সকলেরে উদরেতে পুরে॥
মাতৃগণ সকলেতে অসুর সকল।
পলাইয়া বেগে ধায় হইয়া বিকল॥
দেখিয়া সকল সৈন্য হইয়া অন্তিম।
যুদ্ধ হেতু ক্রোধে ধায় রক্ত বীজ বীর॥
এক বিন্দু রক্ত যদি তার দেহ হ’তে।
স্রবিয়া পড়য়ে তাহা ক্রমে পৃথিবীতে॥
তবে সেই রক্ত হ’তে এক মহা বীর।
উঠি হস্তে গদা ল’য়া যুদ্ধে হয় স্থির॥
শক্তি হস্তে ইন্দ্র শক্তি সহ করে রণ।
রক্তবীজ রণ দেখি কাঁপে দেবগণ॥
তবে ইন্দ্র শক্তি দেবী বজ্র লইয়া হাতে।
করিল আঘাত দেবী রক্তবীজ মাথে॥
বজ্রের আঘাতে তার স্রবরে শোণিত।
আর এক রক্তবীজ উঠে আচম্বিত॥
সমতুল্য বলবান অতি পরাক্রম।
উঠিয়া যুঝেতে বীর করে বহু শ্রম।
এই মতে যত তার রক্ত পড়ে ভূমে।
রক্ত হ’তে রক্তবীজ উঠে ক্রমে ক্রমে॥
জন্ম মাত্রে অবিলম্বে হাতে ল’য়া শর।
মাতৃগণ সহ যুদ্ধ করে ভয়ঙ্কর॥
ইন্দ্রের ইন্দ্রানী শক্তি লয়ে পুনর্ব্বার।
রক্তবীজ শিরচ্ছেদি করিল সংহার॥
তার দেহ হ’তে রক্ত হইল বাহির।
সহস্র সহস্র হ’ল রক্তবীজ বীর॥
চক্র হস্তে বৈষ্ণবী করি মহারণ।
শত শত রক্তবীজ করেন নিধন॥
ইন্দ্র শক্তি দেবী করে গদার আঘাত।
চক্রেতে বৈষ্ণবী করে দৈত্যের নিপাত॥
কিন্তু রক্তবিন্দু স্রবি পড়িয়া ভূমিতে।
সহস্র সহস্র সৈন্য উঠে আচম্বিতে॥
রক্তবীজ সমতুল্য সব হাতে শর।
শক্তৃিগণ সঙ্গে রঙ্গে করয়ে সমর॥
শক্তি হস্তে সুকুমারী দানব সংহারে।
অসি হস্তে নারায়ণী দৈতা নাশ করে॥
শূল হস্তে মহেশ্বরী রক্তবীজ মারে
রক্তবীজ গদা হস্তে মহারণ করয়ে॥
মাতৃগণ ক্রোধ হ’য়া রক্তবীজ প্রতি।
বধিবারে এবে তারা অস্ত্র নানা জাতি॥
অস্ত্রেতে কাটিল অঙ্গ পড়িল শোণিত।
কোটি কোটি রক্তবীজ উঠে আচম্বিত॥
রক্তবীজে ব্যাপিলেক: ভূবন দুষ্পাঠ্য।
দেখিয়া ভয়েতে কাঁপে দেবতা সকল॥
দেবগণ বিষণ্ণ দেখিয়া ভগবতী।
কালী প্রতি কহে দেবী সকরুণ অতি॥
দেবী বলে কর কালী বদন বিস্তার।
দুরাত্মার রক্ত বেগে করহ আহার॥
রক্ত হ’তে যেই বীর হইবে গঠন।
সব মাতৃগণ তারে করেবে ভক্ষণ॥
সবে মিলি তাহাদের রক্ত কর পান।
তবে রক্তবীজ শূন্য হবে রণ স্থান॥
এতেক কহিয়া দেবী শূল ল’য়া করে।
আঘাত মারিয়া রক্তবীজ নাশ করে॥
রক্তবীজ হ’তে যার পড়িল শোণিত।
ভক্ষণ করিল কালী হ’য়া পুলকিত॥
গদাঘাতে রক্তবীজ করিল সংহার।
তার দেহ হ’তে রক্ত স্রবে অনিবার॥
কালিকা করিল পান আর মাতৃগণ।
এই রূপে রক্তবীজ শূন্য হয় রণ॥
অস্ত্রাঘাতে চণ্ডী দেবী যাহাকে সংহারে।
মহাকালী দেবী তার রক্ত পান করে॥
ক্রমে ক্রমে রক্তবীজ হইল নিধন।
পরম হরিষ হ’ল যত দেবগণ॥
সুখেতে করিছে নৃত্য আনন্দ মগন।
শুনি শুম্ভ রাজা ক্রোধে করে আস্ফালন॥
দুষ্ট বলে হরষিত ভূবন মণ্ডল।
রক্ষিত ভৈরবে রচে চণ্ডিকা মঙ্গল॥