চণ্ডিকা-মঙ্গল।

৺রাধাচরণ রক্ষিত (মুন্সেফ) প্রণীত।

চণ্ডিকা-মঙ্গল।

(কাব্য)

মার্কণ্ডেয় পুরাণান্তর্গত চণ্ডীর সরল

পদ্যে মর্ম্মানুবাদ।

“নানান্ দেশের নানান ভাষা
বিনে বাঙ্গালা ভাষা পূরেকি আশা”

৺রাধাচরণ রক্ষিত (মুন্সেফ) প্রণীত।

প্রকাশক শ্রীযাত্রামোহন দাস।



PRINTED BY R M. ROY. Manager Sonaton press,

CHITTAGONG.



প্রকাশকের নিবেদন।

 অশীতি বৎসর পূর্ব্বে চণ্ডিকামঙ্গল কাব্য রচিত হইয়াছে। আজ বঙ্গ ভাষা নানা আভরণ-ভূষিতা, অপূর্ব্ব সৌষ্ঠবশালিনী, বিচিত্র গতিশীলা। তখন ভাষার সে সম্পদ না থাকিলেও উহার একরূপ সরল অনাবিল গতি ছিল যাহা সহজেই প্রাণ স্পর্শ করিত। এই কাব্যে সেই কৃত্তিবাস ও কবিকঙ্কণের যুগের প্রাঞ্জলতা আছে। কিন্তু তাহাই ইহা প্রকাশের একমাত্র কারণ নহে।

 মার্কণ্ডেয় পুরাণান্তর্গত চণ্ডী হিন্দুর একটী মহাগ্রন্থ। ইহা হিন্দুর অধিকাংশ পূজাপার্ব্বণে শান্তি স্বস্ত্যয়নে ঘরে ঘরে পঠিত হইয়া থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় জনসাধারণ এই নিত্য পঠিত শাস্ত্রের মর্ম্ম গ্রহণে অসমর্থ। সংস্কৃত ভাষার কঠিন আবরণ এবং বিষয়ের দুরূহতা উহার অন্যতম কারণ। এমন প্রবাদ আছে যে কোন পুরোহিত “যা দেবী সর্ব্বভূতেষু” পাঠ পুনঃ পুনঃ উচ্চারণ করিলে উহা কর্ত্তার মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং ‘যা দেবী’ বলিবার অপরাধে সেই পুরোহিতকে গৃহস্থের বিরাগ ভাজন হইতে হইয়াছিল। যিনি এই শাস্ত্র গ্রন্থকে বঙ্গীয় হিন্দু সাধারণের সহজ বোধ্য, অভ্যস্ত ভাষায় পরিণত করিয়া হিন্দু সমাজের অশেষ কল্যাণ সাধন করিয়াছেন, তিনি আমাদের কৃতজ্ঞতা ভাজন। তিনি আজ সর্ব্বপ্রকার নিন্দা ও প্রশংসার অতীত। কিন্তু যে পবিত্র উদ্দেশ্যে তিনি চণ্ডীর মর্ম্মানুবাদে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন এই কাব্য প্রকাশে যদি সেই উদ্দেশ্য তিল মাত্র ও সিদ্ধ হয়, যদি এই কাব্য হিন্দু পরিবারে শান্তি স্বস্ত্যয়নে ও পূজাপার্ব্বণে বহুল ভাবে পঠিত হয় তবে তাঁহার স্বর্গত আত্মা বিশেষ পুলকিত হইবেন সন্দেহ নাই। এ স্থলে তাঁহার পরিচয় অপ্রাসঙ্গিক হইবে না।

 শৈল-কিরিটিনী, সাগর-কুন্তলা, সবিতমালিনী—চট্টলভূমি কবি প্রসবিনী। ইহার উত্তুঙ্গ গিরিশৃঙ্গে চন্দ্রশেখর, পূত সলিলা কর্ণফুলী তীরে মেধসাশ্রম হিন্দু ধর্ম্মের গৌরব পূর্ণ নিদর্শন

“কর্ণফুলা নদীতত্র স্নান মাত্রেণ প্রাণিনাং
বিকশৎ কর্ম্মতেজশ্চ বর্দ্ধতে হি দিনে দিনে”।

 এই পার্ব্বতী মাতার অঙ্কে বসিয়া মাধ্যবাচার্য্য জাগরণ চণ্ডী রচনা করিয়াছিলেন। তিনি কবি কঙ্কণের পূর্ব্ববর্ত্তী। এ দেশেই ‘মৃগলব্ধ’ রচিত হইয়াছিল। এ দেশেই আলোয়াল পদ্মাবতী (পদ্মিনী উপাখ্যান) ও সপ্তপয়কর রচনা করেন। ইহা কবিকুল চূড়ামণি নবীনচন্দ্রের জন্মস্থান। এই চট্টগ্রামের অন্তর্গত জোয়ায়া গ্রামে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে প্রসিদ্ধ কায়স্থ বংশে রাধাচরণ রক্ষিত জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পারশ্য ও সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। কিছু দিন সুখ্যাতির সহিত ওকালতী ব্যবসা করিয়া মুন্সেফীর পদ গ্রহণ করেন।

 তিনি জনহিতকর অনুষ্ঠানে বহুল অর্থব্যয় করিয়া জোয়ারা গ্রামকে উন্নত করিয়া তুলিয়াছিলেন। অবসর কালে তিনি ধর্ম্মশাস্ত্রালোচনা ও কবিতা রচনা করিতেন। তাঁহার পুত্র গিরিশচন্দ্র রক্ষিত একজন প্রসিদ্ধ কবিরাজ। তিনি চট্টগ্রামে সর্ব্ব প্রথম আয়ুর্ব্বেদ ঔষধালয় স্থাপন করেন। তাঁহার পৌত্র শ্রীযুক্ত ক্ষেমেশচন্দ্র রক্ষিত মধুরভাষী ও লোকহিতরত। তিনি সৌভাগ্য বান পুরুষ এবং লক্ষ্মীর কৃপা লাভ করিয়া বহু সদনুষ্ঠানে উপার্জ্জিত অর্থের সদ্ব্যবহার করিতেছেন। বিশেষতঃ তিনি বহুল পরিমাণে পিতামহের কবিত্বসম্পদের উত্তরাধিকারী হইয়াছেন।

 চণ্ডিকামঙ্গল রচয়িতা অনেক গুলি কবিতা রচনা করিয়াছিলেন। এখন সে সকল পাওয়া যাইতেছে না। সৌভাগ্যক্রমে চট্টগ্রামের লব্ধপ্রতিষ্ঠ কবিরাজ শ্রীযুক্ত রাজচন্দ্র দাস মহোদয় চণ্ডিকামঙ্গল কাব্য স্বয়ং লিখিয়া রাখিয়াছিলেন। আজ তাহা অবলম্বন করিয়াই এই কার্য্য প্রকাশিত হইল। এ জন্য কবিরাজ মহাশয় আমাদের ধন্যবাদ ভাজন।

 আমি গীতার একটা সংস্করণ প্রকাশ করিয়াছি। মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর অনুবাদ এই ‘চণ্ডিকামঙ্গল’ কাব্য প্রকাশের সহিত আমার নাম যোজিত করিয়া আমি কৃতার্থ বোধ করিতেছি। কারণ। গীতা ও চণ্ডী আমার জীবনের সম্বল, আমার যৌবনের উপদেষ্টা, বার্দ্ধক্যের অবলম্বন, আমার শোকে সান্ত্বনা, কর্ম্মে উৎসাহ, বিপদে সহায়, ক্লান্তির শান্তি, ইহকালের ধর্ম্ম পরকালের আশা, এক কথার আমার জীবনের সর্ব্বস্ব।  ইতি—

শ্রীযাত্রামোহন দাস। 

পরিশিষ্ট।

 আমি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার উপক্রমণিকায় দেখাইবার চেষ্টা করিয়াছি যে হিন্দু শাস্ত্র মাত্রই দ্ব্যর্থবোধক অর্থাৎ জ্ঞানীর পক্ষে অন্তর্লক্ষ্য ও অজ্ঞানীর পক্ষে বহির্লক্ষ্য প্রকাশক। মার্কণ্ডেয় পুরাণান্তর্গত চণ্ডীও রূপকাবৃত মহাশাস্ত্র। ইহা পাঠ করিয়া জ্ঞানী ও অজ্ঞানী উভয়েই ধর্ম্ম অর্থ কামমোক্ষ চতুর্বর্গ লাভ করিতে পারেন। অন্তর্লক্ষ্য গীতাতে যেমন শরীরস্থ প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির যুদ্ধ বুঝায়, সেরূপ চণ্ডীতে দেবতা বা পূণ্যশক্তির সহিত অসুর বা পাপশক্তির মহাসংগ্রাম বুঝাইয়াছে। এই দেবাসুর সংগ্রামে কখন ও বা দেবতা জয়ী কখন বা অসুর জয়ী হইয়া থাকে। যখন দেবতা পরাজিত ও অসুর জয়ী হন তখন জগতে পূণ্যের স্থান পাপ শক্তির অধিকৃত হয়। দেবগণ হীন শক্তি ও পরাজিত হইলে পুণ্য শক্তি রক্ষার জন্ত মহাশক্তির আবির্ভাব হয়। সে মহাশক্তি কি? একবার দেখা থাক।

 সমগ্র জগৎ দুইটী পদার্থের দ্বারা সৃজিত; একটী ব্যোম বা আকাশ, অপরটী প্রাণ। আকাশ সর্ব্বব্যাপী সর্ব্বানুস্যুত সত্ত্বা যাহা হইতে জাগতিক সূক্ষ্ম স্থূল বস্তু উৎপন্ন হইয়াছে। সৃষ্টির আদিতে একমাত্র আকাশই থাকে এবং কল্পান্তে কঠিন তরল ও বাষ্পীয় সকল পদার্থই আকাশে লয় প্রাপ্ত হয়। দ্বিতীয়টী প্রাণ। এই প্রাণই জগৎ উৎপত্তির কারণভূতা অনন্তরূপা সর্ব্বব্যাপিনী মহাশক্তি যথা “অপরেরমিত ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধিমে পুরাং। জীব ভূতাং মহাবাহো ময়েদং ধার্য্যতে জগৎ”॥ গীতা ৭ অ ৫ ম শ্লোক। এই শক্তির প্রভাবেই আকাশ জগৎ রূপে পরিণত হয়। সৃষ্টির পূর্ব্বে প্রাণ অব্যক্তাবস্থায় থাকে এবং কল্পের আদিতে আবার ব্যক্ত হইয়া আকাশের উপর শক্তি রূপে কার্য্য করে এই প্রাণই গতিরূপে প্রকাশ হয় এবং ইহাই চণ্ডীর মহাশক্তি। যাঁহাকে সমস্ত দেবগণ এই বলিয়া স্তব করিয়াছেন যে “দেরি প্রসন্নার্ত্তি হরে প্রসীদ, প্রাণ মাত জগতোঽখিলস্য। প্রসীদ বিশ্বেশ্বরি পাহি বিশ্বং ত্বমীশ্বরী দেবি চরাচরস্য॥ আধার ভূতা জগত ত্বমেকা মহা স্বরূপেন যতঃ স্থিতাসি। অপাং স্বরূপ স্থিতয়া ত্বয়ৈতদাপ্যায্যতে কৃৎস্ন মলঙ্খ্যবীর্য্যে”॥ এই প্রাণরূপী মহাশক্তিকে জানিলে জগতে জানিবার আর কিছু বাকী থাকে না। সান্ত জীবের অনন্তে যাইতে হইলে এই শক্তিই একমাত্র অবলম্বন। অতএব সকল স্থানে ও সকল সময়ে শক্তি পূজারই প্রাবল্য দেখা যায়। ভগবান রামচন্দ্র (জীবাত্মা) সীতা উদ্ধার (আত্মজ্ঞান লাভ) করার আশায় রাবণ (অহঙ্কার) বধের নিমিত্ত শক্তির আরাধনা করিয়াছিলেন; দেবাদিদেব মহাদেব কালীকে বক্ষে ও গঙ্গাতে মস্তকে ধারণ করিয়াছিলেন। নারারণ তুলসীকে শিরোদেশে লাগাইয়া রাখিয়াছেন এবং শ্রীকৃষ্ণ যিনি স্বয়মেব স্বয়ং প্রথম পুরুষ তিনি হ্লাদিনী শক্তি শ্রীরাধাচরণে দাস খৎ লিখিয়া দিয়া এই প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন যে আমি তোমাকে আর কখন ছাড়িব না সকল সময়েই হৃদয়ে ধারণ করিয়া রাখিব।

 সৃষ্টি তত্ত্ব বুঝাইবার জন্য ভগবান মার্কণ্ডেয় মুনি চণ্ডী মাহাত্ম্যের অবতারণা করিয়াছেন। “সর্ব্ব ভূতানি কৌন্তেয় প্রকৃতিং যান্তি মামিকাং। কল্পক্ষরে পুন স্তানি কল্পাদৌ বিসৃজাম্যহং”॥ গীতা ৯ অ ৭ শ্লোক। নিঃসঙ্গ ভগবানের যোগ মায়াই সংসার স্থিতির হেতু; তাই আবার সৃষ্টি ও প্রলয়ের কারণ। কল্পান্তে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড একার্ণব হইলে ভগবান নারায়ণ নিদ্রা জন্য অব্যক্ত প্রকৃতি সহ শায়িত থাকেন অর্থাৎ স্ব স্বরূপে অবস্থান করেন। পুনরায় কল্পারম্ভে তাঁহার সৃষ্টি রাখিবার ইচ্ছা হইলে জগদুৎপত্তির কারনীভূতা সর্ব্বব্যাপিনী অনন্ত শক্তি বা প্রকৃতির বিকাশ হয়। প্রকৃতির প্রথম বিকাশ সাঙ্খ্যমতে মহত্তত্ত্ব এবং মহত্তত্ত্ব হইতে অহঙ্কার উৎপন্ন হয়। যথা “একমূর্ত্তি স্ত্রয়োভাগা ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরাঃ। সবিকারাৎ প্রধানাত্তু মহত্তত্ত্বং প্রজায়তে”॥ এই মহত্তত্ত্বে প্রধান তিনটী রহিল ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর; সতঃ, রজঃ, তমঃ; বা কাল, চৈতন্য, ও সদসৎ শক্তি। সদসৎ বলিতে সূক্ষ্ম ও কারণ ভাবাপন্ন পদার্থ; তাহা হইতে জড়ের ও জড় জগতের উপাদান সকল প্রকাশ হয়। যখনই কাল ও চৈতন্য উহা হইতে বিভিন্ন হয় তখনই উহা নিরোধরূপে অর্থাৎ প্রলয় রূপে আপন সুক্ষ্মভাবে আপনই লয় হয়। এই জন্ম ইহাতে নিরোধাত্মক ও ভূতোৎপাদক গুণ আছে বলিয়া তমঃ অর্থাৎ নিরোধ বা অপ্রকাশ নামক গুণ প্রকাশিত হয়। কাল হইতে মহত্তত্বের যে গুণ থাকে তাহাকে রজো গুণ বা প্রকাশক গুণ কহে। মহত্তত্ত্বে চৈতন্য থাকায় উহা দ্বারা সদসৎ সজীবত্ব লাভ ও বিলুপ্ত ভাব উদ্ভব করণক শক্তি প্রকাশ হয় বলিয়া তাহাকে সত্ত্ব গুণ কছে। ব্রহ্মা রজগুণ ও দান, বিষ্ণু, সত্ব গুণ ও চৈতন্য এবং মহেশ্বর, তম ও সদসৎ শক্তি পরস্পর একার্থ বাচক। সাত্ত্বিক অহঙ্কার হইতে মনের উদ্ভব। মন সূক্ষ্মদেহ ইন্দ্রিয়াদির অনুভাবাত্মক শক্তি। ইন্দ্রির দশটী এবং এই দশটীর অধিষ্ঠাতা সূক্ষ্ম শক্তি বা তেজকে দেবতা বলে। সুতরাং প্রথমে বৈদিক দেবতা দশটী ছিল যথা দিক বায়ু, সূর্য্য প্রচেতা, অশ্বী, বহ্নি, ইন্দ্র, উপেন্দ্র, মিত্র ও প্রজাপতি। পরে তাহাদের গুণ ক্রিয়া ভেদে তেত্রিশ কোটী হইয়াছে। সত্ত্ব গুণের স্থান কণ্ঠের উর্দ্ধে; রজঃ নাভি হইতে কণ্ঠ পর্যন্ত এবং তমঃ নাভির অধোদেশে। মূল প্রকৃতি সত্ত্ব রজঃ তমঃ এই তিন গুণের রঙ্গভূমি। আবার গুণত্রয় সকল সময় সমান থাকে না। পরস্পর পরস্পরকে অভিভূত করিতে চেষ্টা করে। যথা “রজঃ স্তমচাভিভূয় সত্ত্বং ভবতি ভারত। রজঃ সত্ত্বং তমশ্চৈব তমঃ সত্ত্বং রজস্তথা”। গীতা ১৪ অঃ ১০ শ্লোক। যখন কালবশে এই গুণত্রয়ের সাম্যাবস্থা সংঘটিত হয়, তখন তাহাকে প্রলয় বা অব্যক্তাবস্থা বলে। এই সাম্যাবস্থার বিকৃতি ঘটিলে প্রকৃতি ব্যক্তাবস্থা প্রাপ্ত হইরা সৃষ্টির অভিমুখী হয়। সৃষ্টির মুখে প্রকৃতি স্তরে স্তরে সূক্ষ্ম হইতে স্থূলে পরিণত হইয়া জগত্রয় অনুলোম ক্রমে ব্যাকৃত হয়। আর প্রলয় কালে জগত্রয় স্তরে স্তরে স্থূল হইতে সূক্ষ্মে বিলোম ক্রমে অব্যাকৃত হইতে অবশেষে অব্যক্ত মূল প্রকৃতিতে উপশান্ত হয়। প্রকৃতির এই নিয়মানুসারে “প্রলয় কালে জগত্রয় জলময় হইলে ভগবান প্রভু নারায়ণ অনন্ত শয্যায় আশ্রয় পূর্ব্বক যোগ নিদ্রা অবলম্বন করিয়াছিলেন। সেই সময় ভয়ানক মধু কৈটভ নামক অসুরদ্বয় বিষ্ণুর বাম কর্ণ মূল হইতে প্রাদুর্ভূত হইয়া ব্রহ্মাকে নিহত করার নিমিত্ত উদ্যত হইলে স্তুতি সমর্থ প্রজাপতি ব্রহ্মা বিষ্ণুর নাভি সরোজে অবস্থিতি করতঃ ক্রোধোন্মত্ত অসুরদ্বয়কে দেখিয়া এবং ভগবানকে প্রসুপ্ত অবলোকন করতঃ একাগ্রচিত্তে হরির জাগরণার্থ হরিনেত্রকৃতা শ্রয়া সর্ব্বনিয়ন্ত্রী জগৎকর্ত্রী স্থিতিসংহারকারিণী চৈতন্য রূপিনী নিদ্রারূপা ভগবতী যোগ নিদ্রার স্তব করিয়াছিলেন” চণ্ডী মাহাত্ম্যে ১ম ৫৯—৬৪ শ্লোক। চণ্ডীর এই প্রভু নারায়ণই ভগবান বা পুরুষ, যোগনিদ্রা বা মহামায়া মূল প্রকৃতি সাম্যাবস্থায় তাহাতে লীন আছেন। পূর্ব্বে উক্ত হইয়াছে যে মূল প্রকৃতি সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই গুণত্রয়ের রঙ্গভূমি ও পরস্পর পরস্পরকে অভিভূত করিতে চেষ্টা করে। সুতরাং সত্ত্ব ও তমঃ পরাভূত না হইলে রজঃ শক্তির কার্য্য হয় না। সত্ত্বে সুখ, রজে কার্য্য ও তমে প্রসাদাদি অধম গুণ প্রদান করে। সত্ত্ব প্রধান দেবতা বা পূণ্যশক্তি এবং তমো প্রধান দেবতা অসুর বা পাপশক্তি। দেবতা ও অসুরে বা পূণ্য ও পাপে চিরকাল বিদ্ধেষ ভাব। গুণদ্বয় পরস্পর সংঘর্ষণে ব্যাপৃত থাকার সময় ক্রিয়াশীল রজোগুণ বর্দ্ধিত হয়। ভগবানের নাভিপরস্থিত রজো গুণ রূপী ব্রহ্মা সৃষ্টি করিবার জন্য যোগমায়ারূপ প্রকৃতির নিদ্রা হইতে চৈতন্য বা বিকাশ করনার্থ স্তুতি করিয়াছেন অর্থাৎ কার্য্যোন্মুখ হইয়াছেন। সৃষ্টিকাল অর্থাৎ ব্রহ্মার পরমায়ু একশত বৎসর। তৎপর পুনঃ প্রলয়। ব্রহ্মার কার্য্যের ব্যাঘাৎ না হওয়ার জন্য দেবাসুরের যুদ্ধ একশত বৎসর ব্যাপী বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন যথা “দেবাসুরম ভুৎ যুদ্ধং পূর্ণ মব্দ শতং পুরা”। চণ্ডী ২য় অ ১ শ্লোক। এই সময়ের মধ্যে প্রকৃতি সুক্ষ্ম হইতে স্থূলে ক্রমোন্নতি পদ্ধতি ক্রমে স্থূলতর হইতে থাকে। কালবশে ব্রহ্মার আয়ু শেষ হইলে এই বিরোধী গুণত্রয়ের পুনঃ সাম্যাবস্থা সংঘটিত হয় এবং তখনই প্রলয় অর্থাৎ প্রকৃতি স্থূল হইতে পরে বিলোমক্রমে মূল প্রকৃতিতে পর্যবসিত হয়। যথা “একৈ বাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়াকা ময়াপরা। পশ্যেতা দুষ্টমধ্যেব বিশোদ্ভোব দ্বিভূতয়॥ ততঃ সমন্তাস্তা দেব্যা ব্রহ্মাণী প্রমুখা পরম। তস্যা দেব্যন্তনৌ জম্বুরেকৈরা সীতদম্বিকা”॥ চণ্ডী ১০ ম ৫।৬ শ্লোক। পূণ্য পাপের চির শত্রুতা এবং পরস্পর পরস্পরকে অভিভূত করিবার চেষ্টা চিরকাল হইয়া থাকে; পরিশেষে পূণ্য শক্তির জয় অবশ্যম্ভাবী ইহাই চণ্ডী মাহাত্ম্যের উদ্দেশ্য।  ইতি—

শ্রীযাত্রামোহন দাস।