চণ্ডিকা-মঙ্গল/পঞ্চম অধ্যায়

পঞ্চম অধ্যায়।

রাজ সংবাদ।

মুনি বলে শুন রাজা দেবীর চরিত্র।
অবধান কর ভূপ হইয়া পবিত্র॥
শুম্ভ নিশুম্ভ দৈত্য ছিল দুইজন।
ইন্দ্রের সহিতে করিলেক মহারণ॥
মদে মত্ত দুষ্টাসুর অস্ত্রে করি বল।
ত্রৈলক্যের যত কিছু হরিল সকল॥
সূর্য্যের সূর্য্যত্ব নিল ইন্দ্রের ইন্দ্রত্ব।
কুবেরের কর্ম্ম লয় যমের যমত্ব॥
বরুণের বৃত্তি লয় চন্দ্রের চন্দ্রত্ব।
পবন অগ্নির বৃত্তি নিল হয়ে মত্ত॥
দুষ্ট সে অসুর জাতি নাহি জ্ঞান ধর্ম্ম।
হরিলেন দেবতার যার যেই কর্ম্ম॥
রাজ্য ত্যাগি যুদ্ধে পরাজিত দেবগণ।
ব্যাকুলিত হারাইয়ে স্বীয় স্বীয় ধন॥
ভয়ে কম্পবান দেব নাহিক উপায়।
অসুরের ভয়ে স্মরে দেবী মহামায়॥
পড়েছি আপদে দেবী হও সুপ্রকাশ।
কৃপা করি আপদ মা করহ বিনাশ॥

এই যুক্তি করি দেব চলিল সত্বর।
যথা আছে হিমালয়ে পর্ব্বত ঈশ্বর॥
বিবিধ প্রকারে করে দুর্গারে স্তবন।
অসুর আপদ হ’তে করহ রক্ষণ।
নম মাতা মহাদেবী শিবের ঘরনী॥
তুমি দীপ্তি তুমি চন্দ্রমুখী নারায়ণী।
তুমি বিদ্যা তুমি বুদ্ধি তুমি সে কল্যাণী
তুমি মা সর্ব্বানী লক্ষ্মী পতিত পাবনী॥
তুমি দুর্গা নাম ধর দুর্গতি নাশিনী॥
খ্যাতা কৃষ্ণা ধূমাবতী নম কাত্যায়নী॥
শান্ত মূর্ত্তি রৌদ্ররূপা মহেশ গৃহিনী।
তুমি মা প্রতিষ্ঠা দেবী জগত জননী॥
যেই দেবী বিষ্ণুমায়া সর্ব্বঘটে স্থিতি।
নম নম নম তাঁর চরণে প্রণতি॥
যে দেবী চৈতন্যরূপে সর্ব্বঘটে স্থিতি।
নম নম নম তাঁর চরণে প্রণতি॥
ক্ষুধারূপে যেই দেবী সর্ব্বঘটে স্থিতি।
নম নম নম তাঁর চরণে প্রণতি॥
ছাযারূপে যেই দেবী সর্ব্ব ঘটে স্থিতি।
নম নম নম তাঁর চরণে প্রণতি।
শক্তিরূপে যেই দেবী সর্ব্ব ঘটে স্থিতি।
নম নম নম তাঁর চরণে প্রণতি॥
যেই দেবী সর্ব্ব ঘটে তৃষ্ণারূপে স্থিতি।
নম নম নম তাঁর চরণে প্রণতি॥

যেই দেবী সর্ব্ব ঘটে ক্ষান্তিরূপে স্থিতি।
নম নম নম তাঁর চরণে প্রণতি॥
যেই দেবী সর্ব্ব ঘটে লজ্জ্বারূপে স্থিতি।
নম নম নম তাঁর চরণে প্রণতি॥
যেই দেবী সর্ব্ব ঘটে শান্তিরূপে স্থিতি।
নম নম নম তাঁর চরণে প্রণতি।
যেই দেবী সর্ব্ব ঘটে শ্রদ্ধারূপে স্থিতি।
নম নম নম তাঁর চরণে প্রণতি॥
যেই দেবী সর্ব্ব ঘটে কান্তিরূপে স্থিতি।
নম নম নম তাঁর চরণে প্রণতি॥
যেই দেবী সর্ব্ব ঘটে লক্ষ্মীরূপে স্থিতি।
নম নম নম তাঁর চরণে প্রণতি॥
যেই দেবী সর্ব্ব ঘটে বৃত্তিরূপে স্থিতি।
নম নম নম তাঁর চরণে প্রণতি॥
যেই দেবী সর্ব্ব ঘটে তুষ্টিরূপে স্থিতি।
নম নম নম তাঁর চরণে প্রণতি॥
যেই দেবী সর্ব্ব ঘটে স্মৃতিরূপে স্থিতি।
নম নম নম তাঁর চরণে প্রণতি॥
দেই দেবী সর্ব্ব ঘটে দয়ারূপে স্থিতি।
নম নম নম তাঁর চরণে প্রণতি॥
যেই দেবী সর্ব্ব ঘটে মাতারূপে স্থিতি।
নম নম নম তাঁর চরণে প্রণতি॥
যেই দেবী সর্ব্ব ঘটে ভ্রান্তিরূপে স্থিতি
নম নম নম তাঁর চরণে প্রণতি॥

ইন্দ্রিয়েতে অধিষ্ঠান যেই ভগবতী।
নম নম নম তাঁর চরণে প্রণতি॥
নিত্য অখিলের ভূতে যেই দেবী স্থিতি।
নম নম নম তাঁর চরণে প্রণতি॥
চিত্তরূপে যেই দেবী সর্ব্ব ঘটে স্থিতি।
নম নম নম তাঁর চরণে প্রণতি॥
মহিষাসুর বধ কালে ইন্দ্র আদি দেব।
বিবিধ প্রকারে তোমা করিয়াছে স্তব॥
শুভ হেতু সানুকুল হও মা ঈশ্বরী।
শুভদান কর মাতা আপদ সংহারি॥
এই মতে স্তব করে দেবতা সকল।
স্নান হেতু যায় দেবী জাহ্ণবীর জল॥
কহিলেন ভগবতী শুন দেব সব।
কি কারণে তোমা সবে আমা কর স্তব॥
কথোপকথনে, ভগবতী দেহ হ’তে।
উদ্ভব হইল এক দেবী আচম্বিতে॥
ডাকিয়া বলেন দেবী যত দেবগণে।
নিরস্ত হ’য়েছ সবে শুম্ভ দৈত্য রণে॥
নিশুম্ভ করিছে তোমা সবে পরাজয়।
অপমানে স্তব কর আসি হিমালয়॥
যে দেবী বাহির হ’ল পার্ব্বতী হইতে।
কৈষিকী তাঁহার নাম রহিল জগতে॥
নির্গতে কৈষিকী দেবী কাল বর্ণ হ’ল।
কালিকা তাঁহার খ্যাতি জগতে রহিল॥

মনোহর রূপে দশদিক ঝল মল।
রহিল কৈষিকী দেবী যুড়ি হিমাচল॥
চণ্ড মুণ্ড দুই দৈত্য শুভ অনুচর।
যাতায়াত করে তারা দেশ দেশান্তর॥
দেবীকে দেখিয়া চণ্ড মুণ্ড দুই চর।
শীঘ্র জানাইল গিয়া রাজার গোচর॥
এক বামা দেখিলাম সুন্দরী নির্ম্মল।
তাঁর রূপে হিমালয় করে ঝল মল॥
নাহি জানি সেই বামা কাহার রমণী।
ভূবনমোহিনী রূপ শুন নৃপমণি॥
তত্ত্ব লও মহারাজ হয় কার নারী।
অবিলম্বে দেখ গিয়া পরমা সুন্দরী॥
কর যত্ন নারী রত্ন কি কব অধিক।
সে নারীর রূপে দীপ্তি করে দশদিক॥
এমত আশ্চর্য্যরূপ দেখি নাই আমি।
দেখিলে মোহিত হবে যদি দেখ তুমি॥
গজ অশ্ব মণি আদি রত্ন আছে যাহা।
সংসারের যত দ্রব আনিয়াছ তাহা॥
পারিজাত পুষ্প গজরত্ন ঐরাবত।
পুরন্দর হ’তে দ্রব্য আনিয়াছ যত॥
উচ্চৈশ্রবা ঘোটক দিয়েছে পুরন্দরে।
ব্রহ্মার যে বৃত রথ আছে তব ঘরে॥
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতাল যে তব পরাজিত।
তব নাম উল্লেখেতে সবে হয় ভীত॥

কুবের হ’তে আনিয়াছ মহাপদ্ম নিধি।
পদ্মমালা কেশর দিয়েছে জলনিধি॥
বরুণের স্বর্ণছত্র ক’রেছ ধারণ।
তব বল বীর্য্য রাজা ব্যক্ত ত্রিভূবন॥
আনিয়াছ বহুদ্রব্য হ’তে দেবগণ।
দণ্ড আদি মহা অস্ত্র জিনিয়া শমন॥
বরুণের অস্ত্র আছে তোমার মন্দিরে।
তুমি কারে ভয় কর সংসার ভিতরে॥
সমুদ্রেতে যত দ্রব্য হ’য়েছে উৎপত্তি।
তোমার ঘরেতে সব আছয়ে নৃপতি॥
অনলে না হয় দগ্ধ এমত রতন।
চন্দ্রে তোমা দিয়াছেন শুন হে রাজন॥
সংসারের যত ধন করিছ হরণ।
এই নারী রত্ন কেন না কর হণ॥
চণ্ড মুণ্ড কথা শুনি দৈত্যের ঈশ্বর।
ডাকিয়া সুগ্রীব দূত আনিল সত্বর॥
দৈত্যপতি বলে তারে হইয়া চঞ্চল।
যে প্রকায়ে রত হয় কহিবে সকল॥
চলিলেক দূত যেই পর্ব্বতে কামিনী।
কহিলেক সব কথা মধুরসবাণী॥
দূতে বলে শুন দেবী আমার বচন।
ত্রৈলোক্য ঈশ্বর গুপ্ত জানে সর্ব্বজন॥
মম প্রতি হইয়াছে রাজার আদেশ।
প্রকাশ করিয়া কহি শুনহ বিশেষ॥

সর্ব্ব দেবগণ হ’তে শুম্ভ সে প্রধান।
মহারাজ চক্রবর্ত্তী কহি তব স্থান॥
মহা বলবান রাজা ত্রৈলোক্য ঈশ্বর।
সর্ব্ব দেবগণ বশীভূত আর নর॥
যজ্ঞ ভাগ ভিন্ন ভিন্ন ক’রেছে ভক্ষণ।
তাঁর ঘরে ত্রৈলোক্যের আছে যত ধন॥
সমুদ্র মথনে যত জন্মিয়াছে ধন।
গজ রত্ন অশ্ব আনে ইন্দ্রের বাহন॥
স্ত্রীরত্ন বলিয়া তোমা কহে লোক সবে।
আমাদের রাজ্ঞী হ’লে রত্ন ভূষা হবে॥
রাজা কিংবা অনুজ নিশুম্ভ বীরমণি।
এঁকেরে ভজন কর কমল নয়নী॥
যদি তুমি তাঁর ঘরে করহ গমন।
দাস সম দেবগণে করিবে সেবন॥
তাঁহাকে ভজিলে দেবী হবে বহু সুখী।
সত্বর চলহ আমা সঙ্গে চন্দ্রমুখী॥
দূতবাক্য অবগত হইয়া ভবানী।
কোপ ত্যজি ধৈর্য্য ধরি কহে রস বাণী॥
ওহে দূত! যাহা কহ মিথ্যা কিছু নহে।
ত্রিভুবন কর্তা শুম্ভ সর্ব্বলোকে কহে॥
নিশুম্ভ যে মহাবীর জানে জগজ্জন।
আমি শিশুকালে এক করিয়াছি পণ॥
অল্পবুদ্ধি শিশুকালে করিয়াছি পণ।
শ্রবণ করহ দ্রুত কহি বিবরণ॥

যে আমায় যুদ্ধে জিনে করি মহারণ।
যেই জনে মম দর্প করিবে ভঞ্জন॥
মম প্রতিযোগী দূত যেই জন হয়।
সেই বীর মম পতি হইবে নিশ্চয়॥
চলি যাও দূত তুমি কহ শুম্ভ বীরে।
পাণিগ্রহ করে যেন জিনিয়া সমরে॥
দূত বলে শুনিলাম বড় বিপরীত।
তোমার বাক্যেতে দেবী না জন্মে প্রতীত॥
কখন ও দেখি, শুনি নাই ত্রিভূবনে।
যুদ্ধে জয়ী হবে শুম্ভ নিশুম্ভের সনে॥
অন্য অন্য দৈত্য আর দেবে করে রণ।
ভয়েতে কাতর সব রাজার সদন॥
পুরুষ দাড়াতে নারে যাঁহার সাক্ষাতে।
তুমি নারী হ’য়া দাঁড়াইবে কোন মতে॥
যদি নাহি যাও তুমি করিয়া গৌরব।
চুলে ধরি নিয়া যাব করিয়া লাঘব॥
দেবী বলে জানি আমি শুম্ভ বলবান।
সেরূপ নিশুম্ভ হয় বীরের প্রধান॥
পূর্ব্বে আমি এই মত করিয়াছি পণ।
কেমনে করিব আমি এক্ষণে হেলন॥
মম বার্ত্তা ল’য়ে যাও রাজার গোচর।
কার্য্য উপযুক্ত বুঝি করেন সত্বর॥