চণ্ডিকা-মঙ্গল/দ্বিতীয় অধ্যায়

দ্বিতীয় অধ্যায়।

মহিষাসুর-সৈন্যবধ।

মুনি বলে মহিষাসুর শতেক বৎসর।
ঘোরতর যুদ্ধ করে সহ পুরন্দর॥
বলবান দুষ্টাসুর দেব পরাজিয়া।
আপনি হইলা ইন্দ্র দেবতা জিনিয়া॥
ব্রহ্মা সঙ্গী করিয়া যতেক দেবগণ।
চলিলেন যথা আছে শিব জনার্দ্দন॥
ত্রাসযুক্ত দেবগণ ভয়েতে বিকল।
অসুরের বৃত্তান্ত যে কহিল সকল॥
চন্দ্র সূর্য্য ইন্দ্র যম অনিল বরুণ।
অনান্য দেবের বৃত্তি নিয়াছে দারুণ॥
স্বর্গ ত্যজি দেবগণ পৃথিবী বেড়ায়।
বিচরণ করে তথা মনুষ্যের প্রায়॥
সব দেবগণ আসি লইনু শরণ।
তার বধ চেষ্টা কর প্রভু নারায়ণ॥
শুনিয়া এসব, ক্রোধী হ’ল হরিহর।
বাহির হইল তেজ অগ্নি সমসর॥
ইন্দ্র আদি দেবতেজ বাহির হইল।
জ্বলন্ত পর্ব্বত সম প্রজ্বলিত হৈল॥

দেব তেজ তুলনায় নাহিক তাহার।
তেজ হ’তে হৈল এক নারীর আকার।
তেজ হ’তে জন্মিলেক সে নারীর মুখ।
পরমা সুন্দরী কন্যা দেখিতে কৌতুক॥
বিষ্ণুতেজে বাহু হৈল, যম তেজে কেশ।
চন্দ্রতেজে স্তন, ইন্দ্রতেজে মধ্যদেশ॥
ঊরু জঙ্ঘা নিতম্ব বরুণ তেজে হ’ল।
ব্রহ্মতেজে দুই পাদ-পদ্ম যে জন্মিল॥
পদাঙ্গুলি রবিতেজে হইল নির্ম্মাণ।
বসুর তেজেতে হস্ত অঙ্গুলি প্রমাণ॥
কুবের তেজেতে হৈল নাসিকা উদ্ভব।
প্রজাপতি হৈতে হ’ল দন্তের সম্ভব॥
ত্রিনয়ন জন্মিলেক অগ্নির তেজেতে।
সন্ধ্যার তেজেতে ভুরু জন্মিল পশ্চাতে॥
বায়ুতেজে দুই কর্ণ হইল সৃজন।
অন্য দেব হ’তে অবশিষ্টের গঠন॥
সকল দেবের তেজে জন্মে ভগবতী।
দেবী দেখি দেবগণ হরষিত অতি॥
অস্ত্র নাই কি প্রকারে হবে মহারণ।
অস্ত্র দিতে পরামর্শ করে দেবগণ॥
নিজ শূল হ’তে শিব শূল এক নিয়া।
দেবীর দক্ষিণ হস্তে দিল উঠাইয়া॥
চক্র হ’তে অন্য চক্র বাহির যে করি।
দেবীর হস্তেতে দিল মুকুন্দ মুরারি॥

বরুণে দিলেন শঙ্খ, শক্তি বৈশ্বানর।
মারুতে দিলেন তূণ সহ ধনুঃশর॥
বজ্র ঘণ্টা ঐরাবত দিল সুরপতি।
যমে দিল কাল দণ্ড বান অম্বুপতি॥
ব্রহ্মা কমণ্ডুলু প্রজাপতি অক্ষমালা।
সব লোমকুপে রশ্মি দিবাকরে দিলা॥
কালে দিল খড়্গ চর্ম্ম, মালা দিল হর।
ক্ষীরোদ দিলেন হার অজর অম্বর॥
আর চূড়ামণি দিল কর্ণের কুণ্ডল।
অর্দ্ধচন্দ্র নুপুর যে কেয়ূর নির্ম্মল॥
বিশ্বকর্ম্মা দিল অস্ত্র কবচ কুঠার।
অতি শোভাময় পদ্ম দিল জলাধার॥
হিমালয় সিংহে দিল রত্ন নানা জাতি।
সুরাপুর্ণ পান পাত্র দিল জলপতি॥
মহামণি দিল অনন্তাদি নাগগণ।
নাগহার দিল দেবীর গলের ভূষণ॥
অন্য অন্য দেবগণে দিলেন ভূষণ।
সম্মান করিল তাঁরে যত দেবগণ॥
দেবীর রূপেতে হৈল ভূবন প্রকাশ।
অতি উচ্চ শব্দ করে অট্ট অট্ট হাস॥
অতি ঘোরতর শব্দ উঠিল আকাশ।
প্রতি শব্দে হয় যেন সংসার বিনাশ॥
ভয় যুক্ত সর্ব্বলোক সিন্ধু টল মল।
জীব জন্তু সহ মহী যায় রসাতল॥

সবে বলে সিংহ-বাহিনীর হবে জয়।
উচ্চৈঃস্বরে মুনিগণে করে জয় জয়॥
তা দেখি মহিষাসুর করয়ে গর্জ্জন।
সব সেনাগণে যে যোগায় অস্ত্রগণ॥
অসুরে দেখিল দেবী ব্যাপ্ত ত্রিভূবনে।
পদ আছে ভূমিতলে কিরীট গগণে॥
শুনিয়া দেবীর মহা ধনুক টঙ্কার।
পাতালেতে অনন্তাদি হ’ল চমৎকার॥
সহস্র ভুজেতে ব্যাপি আছয়ে সংসার।
ঘোরতর যুদ্ধারম্ভ হইল দোঁহার॥
অতি শীঘ্র হস্তে দেবী বরিষয়ে শর।
অস্ত্র ক্ষেপি অচ্ছাদিল দেব দিবাকর॥
মৈষাসুর সৈন্য হ’তে চিক্ষুরাক্ষ চলে।
চলিল চামর বীর চতুরঙ্গ দলে॥
ছয় অযুত রথ লৈয়া উদয়াক্ষ লড়ে।
কোটীরথ লৈয়া যুঝে মহাহনু বীরে॥
পঞ্চাশ নিযুত সৈন্য লইয়া সঙ্গতি।
যুদ্ধেতে চলিল অসিলোম সেনাপতি॥
ছয় কোটি সৈন্য লৈয়া বাস্কল গমন।
সহস্র সহস্র হস্তী পর্ব্বত প্রমাণ॥
কোটি কোটি রথী সহ কোটি কোটি সেনা।
বিড়ালাক্ষ মহাবীর যুদ্ধে দিল হানা॥
রথী অশ্ব হস্তী সহ অন্য অন্য শূর।
দেবীর সহিতে যুদ্ধ করয়ে প্রচুর॥

কোটি কোটি হস্তী ঘোড়া কোটি কোটি রথী।
মৈষাসুর তার মধ্যে দেখিতে বিকৃতি॥
মুষলমুদ্গর যে তোমর ভিন্দিপাল।
শক্তি শূল খড়্গ গদা যুদ্ধ যে বিশাল॥
অসুরে মারয়ে শক্তি আর মারে পাশ।
দেবী প্রতি খড়্গ মারে করিয়া সাহস॥
তবে দেবী স্বীয় অস্ত্র করি আকর্ষণ।
লীলায় অসুর অস্ত্র করিল ছেদন॥
অতঃপর দেবী শীঘ্র করে শর বৃষ্টি।
তাহাতে অসুর সৈন্য পড়ে কোটি কোটি॥
শরাঘাতে সৈন্য নাশ করেন ঈশ্বরী।
অতিশয় ক্রোধ করি দেবীর কেশরী॥
লম্ফ দিয়া পড়িলেক যথা সৈন্যগণ।
সৈন্য মারে যেন বন দহে হুতাশন॥
যুদ্ধশ্রমে নিশ্বাস ছাড়েন নারায়ণী।
সহস্র সহস্র জন্মে ডাকিনী যোগিনী॥
জন্ম মাত্রে হাতে লয়ে শর ভিন্দিপাল।
নাশ করে দৈত্যগণ যেন যম কাল॥
দেবী শক্তি হানিয়া মারেন দৈত্যগণ।
মাতৃগণে শঙ্খধ্বনি করে ঘনে ঘন॥
যুদ্ধ রঙ্গে কেহ কেহ মৃদঙ্গ বাজায়।
কেহ নাচে কেহ গীত গায় দীর্ঘরায়॥
তবে দেবী শূল শক্তি গদা বৃষ্টি করি।
খড়্গ হস্তে শত শত অসুর সংহারি॥

কেহ কেহ ঘণ্টা শব্দে হয় অচেতন।
পাশ দিয়া কাহাকে করয়ে আকর্ষণ॥
গদাঘাতে বহু সৈন্য হইল নিধন।
কেহ কেহ পলাইল দেখি ঘোর রণ॥
মুষল আঘাতে দৈত্য ছাড়য়ে শরীর।
নদী স্রোত মত তথা বহিছে রুধির॥
দেবী শূলে বক্ষ ভেদি কেহ ভুমে পড়ে।
নিরন্তর যুদ্ধে ভূমি হাহাকার করে॥
মাতৃগণ আমর্দ্দনে দৈত্য ছাড়ে প্রাণ।
ঘোর নাদে কম্পান্বিত হৈল রণস্থান॥
দুই বাহু ছিড়ে কার কার ছিড়ে গলা।
কার শির ছিড়ি কার বক্ষ বিদারিলা॥
সেনাগণ উরু ভাঙ্গি ভূমিতলে পড়ে।
কার বাহুদ্বয় কার এক পদ ছিড়ে॥
কার এক চক্ষু খসে কার ছিড়ে শির।
এইরূপে দৈত্যগণ হইল অস্থির॥
শিরচ্ছেদ হইয়া কবন্ধে করে রণ।
দুই হস্তে লইয়া উত্তম শরাসন॥
খড়্গ শক্তি বাহু অস্ত্র ল’য়ে দুই করে।
শির শূন্য কবন্ধ রণেতে নৃত্য করে॥
দেবীর রণেতে দৈত্য হইল সংহার।
দেবী সৈন্য জয় জয় বলে বারে বার॥
কাটা রথ হস্তী ঘোড়া দানব সকল।
পড়িয়া অগম্য হ’ল মহা রণস্থল॥

শোণিত ধরায় হ’ল মহানদী প্রায়।
কাটা সৈন্য হস্তী ঘোড়া স্রোতে ভাসি যায়॥
মহা সৈন্যগণ ক্ষয় হইল পলকে।
সুকাষ্ঠ পাইয়া যেন দহয়ে পাবকে॥
সিংহনাদ করে সিংহ কোপে কম্পবান।
সিংহের চিৎকারে দৈত্য হারায় পরাণ॥
মাতৃগণ যুদ্ধ করে অসুর সহিত।
যুদ্ধ দেখি দেবগণ হৈল হরষিত॥
স্বর্গে পুষ্পবৃষ্টি করে দেবতা সকল।
অধীন ভৈরব কহে চণ্ডিকা মণ্ডল॥