চণ্ডিকা-মঙ্গল/প্রথম অধ্যায়

চণ্ডিকা-মঙ্গল।

প্রথম অধ্যায়।

মধুকৈটভ বধ।

গণেশাদি দেবগণে করিয়া প্রণতি।
বন্দি পিতা মাতা গুরু যে আছেন ক্ষিতি॥
সাধুর চরণে এই মাগি উপহার।
অশুদ্ধ দেখিলে দোষ ক্ষমিবে আমার॥
অল্পবুদ্ধি হীন জন জ্ঞান অতি হ্রাস।
চণ্ডিকা মঙ্গল চাহি করিতে প্রকাশ॥
সুবর্ণা উদরে জন্ম সূর্য্যের ঔরসে।
বলিয়া অষ্টম মনু যাঁহারে প্রশংসে॥
তাঁহার উৎপত্তি কথা কহিব স্বরূপে।
চণ্ডীর প্রসাদে মনু হইল যেরূপে॥
সূর্য্য বংশে ছিলেন সুরথ নামে রাজা।
নিজ পুত্ত্র সমতুল্য পালিতেন প্রজা॥
কোলার নৃপতিগণ শত্রু হৈল তাঁর।
অতি ঘোরতর যুদ্ধ হইল দোঁহার॥
কোলার নৃপতিগণ জিনিল সমর।
স্বীয় পুরে আসিল সুরথ নৃপবর॥

তাঁর অমাত্যের সনে মিলি রিপুগণ।
রাজ্যে আসি ধনাগার করিল লুণ্ঠন॥
মৃগয়ার ছলে তবে সুরথ রাজন।
বনপথে মনোদুঃখে করিল গমন॥
বিবেকী হইয়া রাজা চলি গেল বন।
উপনীত হৈল রাজা মেধস আশ্রম॥
রাজাকে রাখিল মুনি করিয়া সম্মান।
রহিলেক মহারাজা দেখি রন্য স্থান॥
মায়ামুগ্ধ মহারাজা হৈয়া খেদ চিত্ত।
ধন রাজ্য হারাইয়া খেদ করে নিতা॥
দাস দাসী হয় হস্তী আর পরিজন।
আমা ছাড়ি করে অন্য রাজা উপাসন॥
অনেক দুঃখেতে ধন ক'রেছি সঞ্চয়।
সেই ধন দুষ্টে নিত্য করে অপচয়॥
হেন কালে এক বৈশ্য আসিলেক তথা।
জিজ্ঞাসিল মহারাজ তুমি কেন এথা॥
বৈশ্য বলে নারী, পুভ্র ধনের লোভেতে।
তাড়িয়াছে সবে মিলি, এসেছি বনেতে॥
ধনবান জনক সমাধি মোর নাম।
বিবেকী হইয়া ত্যজিয়াছি নিজ ধান॥
কিন্তু সকলের শোকে হ'য়েছি চিন্তিত।
রাজা বলে মহাশয় একি বিপরীত॥
ধন লোভে যেইজন ঘটা'ল বিচ্ছেদ।
সেই প্রাপিষ্ঠের জন্য কেন কর খেদ॥

বৈশ্য বলে এই কথা সত্য মহাশয়।
নিষ্ঠুরতা কোনরূপে অন্তরে না লয়॥
কর যোড়ে বলে রাজা তপোধন স্থানে।
চিত্ত স্থির নহে মম এই সব শুনে॥
আত্ম জনে বৈশ্যকে ক’রেছে বিড়ম্বন।
তবু মায়া নাহি ছাড়ে কিসের কারণ॥
বৈশ্য আমি দুই জন অত্যন্ত দুঃখিত।
পাপাত্মাকে মায়া হয় একি বিপরীত॥
মুনি বলে এ সংসার মায়ার কারণ।
মায়াতে মোহিত যত পশু পক্ষীগণ॥
ক্ষুধাতে যে প্রাণ যায় তাতে নাই জ্ঞান।
আপনার ভক্ষ্য দ্রব্য খাওয়ায় সন্তান॥
মহামায়া হ’তে মায়া হ’য়েছে উৎপত্তি।
যোগ নিদ্রারূপে মোহ ক’রেছে শ্রীপতি॥
রাজা বলে কহ মুনি কেন তাঁর জন্ম।
তাঁহার স্বভাব কহ কি তাঁহার কর্ম্ম?
মুনি বলে জন্ম মৃত্যু নাহিক তাঁহার।
দেব উপকারে আবির্ভাব বারে বার॥
যোগ নিদ্রাগত যবে শ্রীমধুসূদন।
অনন্ত শয়নে আছে দেব নারায়ণ॥
হরির নাভিতে আছে ব্রহ্মা প্রজাপতি।
বিষ্ণু কর্ণ হ’তে দুই অসুর উৎপত্তি॥
প্রবল মধুকৈটভ অতি দুরাচার।
জন্মিয়া উদ্যত হ’ল ব্রহ্মা মারিবার॥

হরি বিনা অসুরের নাহিক সংহার।
নিদ্রাতে মোহিত জনার্দ্দন অনিবার॥
হরির চক্ষুতে দেবী পাতিল আসন।
তিনি না ত্যজিলে নিদ্রা হয় না ভঞ্জন॥
একাগ্র হৃদয়ে ব্রহ্মা করেন স্তবন।
তুমি সৃষ্টি তুমি স্থিতি সংহার কারণ॥
তুমি স্বহা তুমি স্বধা তুমি সে ঈশ্বরী।
মহামায়া মহামেধা তুমি দেবী গৌরী॥
হ্রস্ব, দীর্ঘ, শ্রদ্ধা তুমি, তুমি সে প্রণব।
তুমি যে সাবিত্রীদেবী তোমা করি স্তব॥
শঙ্খিনী গর্জ্জিনী তুমি শূলিনী চক্রিনী।
লজ্জারূপা সৃষ্টিরূপা জগত জননী॥
ব্রহ্মার স্তবেতে তুষ্ট হইয়া জননী।
নারায়ণ চক্ষু ত্যাগ করে নারায়ণী॥
নিদ্রা ত্যাগে জনার্দ্দন হইলেন স্থির।
অসুরের সনে যুদ্ধে হইল বাহির॥
অব্দ পঞ্চ সহস্র যে বাহুযুদ্ধ করি।
বধিতে না পারে অরি মুকুন্দ মুরারি॥
কহিলেন ভগবান অসুরের প্রতি।
দোহাকার যুদ্ধে আমি তুষ্ট হই অতি॥
বর লও মম-হস্তে হইতে নিধন।
অন্য বর তোমাদের নাহি প্রয়োজন॥
সে মধুকৈটভ বলে এই বর চাহি।
বধ কর যথা বারি পূর্ণ নাহি মহী॥

তবে প্রভু ভগবান শঙ্খ চক্রধারী।
বধিলা ঊরুতে দোহে শিরচ্ছেদ করি॥
ব্রহ্মার স্তবেতে এইরূপে মহাদেবী।
অসুরে বধিয়া রক্ষা করিলা পৃথিবী॥
দেবীর প্রভাব শুন কহি যে সকল।
ভৈরব রক্ষিত রচে চণ্ডিকা মঙ্গল॥