চিদ্বিলাস/ন্যায় দর্শন
মহর্ষি গোতমের মতে আত্যন্তিক দুঃখ ধ্বংসই মুক্তি। এই মুক্তি সম্পাদনের উদ্দেশ্যে ন্যায় দর্শন লিখিত হইয়াছে।
মহর্ষি গোতম ঈশ্বর স্বীকার করেন। তিনি বলেন জগতের উপাদান পরমাণু সৎ; কিন্তু তাহা জড় বলিয়া তাহার নিজের কোন স্বতন্ত্র ক্রিয়া নাই; পরমাণু জগতের উপাদান কারণ এবং ঈশ্বর নিমিত্ত কারণ। ঈশ্বরেচ্ছায় পঞ্চভূতের পরমাণু মিলিত হইয়া জগৎরূপে প্রকাশিত হয়, এবং যখন ঈশ্বরেচ্ছায় এই জগৎ নিজকারণ পরমাণুতে ফিরিয়া যায় তখনই প্রলয়। এ সম্বন্ধে অতি সুন্দর উপমা আছে। কুম্ভকার মৃত্তিকা দ্বারা ঘট নির্ম্মাণ করে; কুম্ভকারের অথবা মৃত্তিকার অভাবে ঘট নির্ম্মিত হয় না; এইরূপ যখনই কোন কার্য্য দেখা যায় তখনই তাহার কোন কর্ত্তাও দেখা যায়; অর্থাৎ প্রত্যেক কার্য্যের নিমিত্ত-করণ ও উপাদান-কারণ দেখিতে পাওয়া যায়। গোতম বলেন যখন একটি অতি সামান্য কার্য্যেরও কর্ত্তা দেখিতে পাওয়া যায়, তখন এই জগৎরূপ অতি মহৎ কার্য্যেরও একজন কর্ত্তা আছেন।
পরমাণু নিরবয়ব, অবিভাজ্য, অজ ও নিত্য। ইহার দুইটি সংযোগে দ্ব্যণুক ও তিনটি দ্ব্যণুকের সংযোগে ত্রসরেণু এইরূপে ক্রমে মহাবয়বী পর্য্যন্ত উৎপন্ন হয়। অবয়বী পদার্থ বিভাজ্য অতএব তাহার বিনাশ আছে। পরমাণু ও দ্ব্যণুক প্রত্যক্ষ হয় না, ত্রসরেণু ইন্দ্রিয়ের গোচরীভূত হইয়া থাকে। জগৎ যখন ক্রম বিভাগ দ্বারা পরমাণুরূপে পরিণত হয়, তখনই তাহার বিনাশ, প্রলয় বা তিরোভাব।
মহর্ষি গোতম ষোড়শ পদার্থ স্বীকার করেন, যথা—প্রমাণ, প্রমেয়, সংশয়, প্রয়োজন, দৃষ্টান্ত, সিদ্ধান্ত, অবয়ব, তর্ক, নির্ণয়, বাদ, জল্প, বিতণ্ডা, হেত্বাভাস ছল, জাতি ও নিগ্রহস্থান। ইহাদিগের মধ্যে প্রমেয় পদার্থতত্ত্বের জ্ঞানই মুখ্যভাবে মুক্তির হেতু, এবং অপরাপর তত্ত্বের জ্ঞান পরম্পরা সম্বন্ধে মুক্তির হেতু। প্রমাণাদি পঞ্চদশ পদার্থ তর্কেতেই ব্যবহৃত হয় বলিয়া সে সম্বন্ধে কোন প্রকার বিশেষ উল্লেখ করা হইল না। কেবলমাত্র প্রমেয় পদার্থ কি তাহা বলা হইতেছে।
প্রমেয় দ্বাদশ প্রকার, যথা—আত্মা, শরীর, ইন্দ্রিয়, অর্থ, বুদ্ধি, মন, প্রবৃত্তি, দোষ, প্রেত্যভাব, ফল, দুঃখ ও অপবর্গ। আত্মা দ্রষ্টা ও ভোক্তা। যাহাকে আশ্রয় করিয়া আত্মা ভোগ করেন তাহার নাম শরীর। যদ্দ্বারা আত্মা ভোগ করেন তাহার নাম ইন্দ্রিয়। ভোগ্য বস্তুর নাম অর্থ। ভোগ্যবস্তুর উপলব্ধি বা জ্ঞানের নাম বুদ্ধি। যে বস্তুর সংযোগে ইন্দ্রিয় দ্বারা বিষয়ের উপলব্ধি হয় এবং যাহার বিয়োগে ইন্দ্রিয়দ্বারা বিষয়ের উপলব্ধি হয় না তাহার নাম মন। স্মরণ, অনুমান, সংশয় প্রভৃতি মনের অনেক ধর্ম্ম আছে। প্রবৃত্তি তিন প্রকার,—শারীরিক, বাচিক ও মানসিক। রাগ, দ্বেষ ও মোহ এই তিনটির নাম দোষ; ইহাই প্রবৃত্তির হেতু। পুনঃ পুনঃ জন্ম ও মৃত্যুর নাম প্রেত্যভাব। প্রবৃত্তি হইতে যে সকল সুখ ও দুঃখের অনুভব হয় তাহার নাম ফল। অসৎকর্ম্মের ফলের নাম দুঃখ। সুখের অস্তিত্ব না থাকিলে দুঃখ হয় না, অতএব সুখও একপ্রকারে দুঃখ বলিয়া পরিগণিত হইতেছে। দুঃখের অত্যন্ত বিনাশের নাম অপবর্গ।
মহর্ষি গোতম জ্ঞানকে আত্মার স্বরূপ বলেন না; কারণ ইঁহার মতে জ্ঞান ক্ষণিক; একক্ষণে ইহার উৎপত্তি, দ্বিতীয়ক্ষণে ইহার স্থিতি ও পরক্ষণে ইহার লয় হইয়া থাকে। একটি জ্ঞানের লয় না হইলে আর একটি জ্ঞানের উদয় হইতে পারে না। একই সময়ে দুই বা ততোধিক জ্ঞান একই ভাবে থাকিতে পারে না। যদিও অনেক সময় আমাদিগের মনে হয় যে এককালে আমাদিগের একাধিক জ্ঞান রহিয়াছে, কিন্তু তাহা বাস্তবিক নহে; বস্তুতঃ একাধিক জ্ঞান এত দ্রুত ভাবে মনের মধ্যে ক্রিয়া করে এবং তাহাদিগের উৎপত্তি, স্থিতি ও লয় এত দ্রুতভাবে সংঘটিত হয় যে তাহারা একই সময়ে রহিয়াছে বলিয়া বোধ হয়।[১] অতএব জ্ঞান আত্মা স্বরূপ নহে, পরন্তু ইহা আত্মা হইতে উদ্ভূত হয়।
এক্ষণে জীব কি প্রকারে অপবর্গ বা মুক্তি লাভ করিতে সক্ষম হয় তাহা বলা হইতেছে। গোতম মতে ষোড়শ পদার্থের জ্ঞানই মুক্তির কারণ। দেহাদিতে আত্মবোধই আমাদিগের সমস্ত অনর্থের কারণ। ইহা হইতে দেহাদি অনুকূল বিষয়ে রাগ ও তৎপ্রতিকূল বিষয়ে দ্বেষ হইয়া থাকে। এই রাগ দ্বেষই প্রবৃত্তির কারণ। প্রবৃত্তি ধর্ম্মাধর্ম্মের কারণ। ধর্ম্মাধর্ম্ম সুখ দুঃখের কারণ। জন্ম না থাকিলে ফল ভোগ হয় না, অতএব কর্ম্মফল জন্মের কারণ। মুমুক্ষুব্যক্তি এই তত্ত্বগুলি বিশেষরূপে আলোচনা করিয়া জন্ম মৃত্যুর আদিকারণ দেহাত্মবোধকে একেবারে পরিত্যাগ করিবেন। তাহা হইলেই তাঁহার সমস্ত দুঃখের চিরাবসান হইবে।
- ↑ বায়স্কোপে ক্রমান্বয়ে ছবির পরিবর্ত্তন হয়, কিন্তু যেন একটি ছবি বলিয়া বোধ হয়।