ছিন্নমুকুল/দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ

দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ

দোষী নির্দ্দোষ

 সেই মূর্চ্ছার পর হইতে সুশীলার জ্বর আরম্ভ হইল। বাল্যকাল হইতে শোক পাইয়া পাইয়া সুশালার শরীরে আর কিছুই ছিল না, তাঁহার শরীর ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছিল, তিনি এক প্রকার চিররুগ্ন হইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। অথচ তিনি মরিলে প্রমোদ ও কনককে দেখিবার কেহই নাই ভাবিয়া এতদিন অতি যত্নে জীবন-রক্ষা করিয়া আসিতেছিলেন মাত্র। কিন্তু শরীরের উপর আর তাঁহার আধিপত্য চলিল না।

 কনকের কষ্টের সীমা নাই। তাহার আহার নিদ্রা প্রায় রহিত হইয়াছে। সারাদিন কনক তাঁহার সেবা করে; তাহার যত্ন দেখিয়া সুশীল আশ্চর্য্য হইয়া ভাবেন কনক চোর, কনক মিথ্যাবাদী, কনকের ঈশ্বরে মন নাই, তবে কনক দেবীর ন্যায় যত্ন শিখিল কোথায়? এরূপ ভালবাসা, এরূপ সেবা ত অমানুষিক গুণ। যখনই কনকের বিষাদময়ী দেবী-প্রতিমার প্রতি তাঁহার দৃষ্টি পড়ে, তিনি মুগ্ধ হইয়া তাহার দিকেই চাহিয়া থাকেন—তাহার সেই আলুলায়িত কুন্তলজালে বেষ্টিত সরলসুন্দর মুখকান্তি দেখিয়া মুগ্ধ হইয়া চাহিয়া থাকেন।

 “কি ভয়ানক! এই দেবী মূর্ত্তির প্রশান্ত অমায়িকতা দেখিলে ইহার ভিতরে যে দোষ থাকিতে পারে, তাহা কে বিশ্বাস কবিবে? ইহাতে যদি দোষ থাকে, তবে বুঝি পৃথিবীতে কিছুই নির্দ্দোষ নাই তবে বুঝি পৃথিবীতে কাহাকেও বিশ্বাস করা যাইতে পারে না।” এই রূপ ভাবিতে ভাবিতে সুশীলর চক্ষু হইতে অশ্রুধারা পড়িয়া বালিস ভিজিয়া যায়। বালিকা কনক যথার্থ কারণ বুঝিতে না পারিয়া পীড়ার কষ্টে অশ্রুজল পড়িতেছে ভাবিয়া ব্যাকুল-চিত্তে কিসে সুশীলার কষ্ট নিবারণ করিবে খুঁজিয়া পায় না।

 এইরূপে দিন যাইতে লাগিল। প্রমোদকে কনক পীড়ার কথা টেলিগ্রামে সংবাদ দিল। প্রমােদ যামিনীনাথের সহিত একত্রে বাড়ী আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

 তাঁহাকে দেখিয়া সুশীলা আহ্লাদিত হইয়া একথা সে কথা কহিয়া কিছু পরে বলিলেন—

 “তুমি এলে ভাল হােল, মরবার আগে তোমাকে কতকগুলি কথা বলব।”

 কনক এ সময় সে গৃহে ছিল না, কোন কার্য্য বশতঃ সে কিছু পূর্ব্বেই অন্য গৃহে গিয়াছিল।

 সুশীলার কথায় প্রমোদ সজল নেত্রে বলিলেন “ও কি কথা, ও কথা বলবেন না।”

 সু। “না, আমি এবার বাঁচব না, আমার দিন ফুরিয়েছে। আমাকে সকলে ডাকছেন, সে দিন রাত্রে দিদিকে যেন দেখলেম, তারপর, তারপর,—”

 বলিতে বলিতে তাঁহার কথা বাধিয়া গেল, সেই রাত্রির ঘটনা মনে করিয়া সুশীলা শিহরিয়া উঠিলেন, যেন সেইরূপ ঘনঘাের মেঘবৃষ্টির মধ্যে সহসা বিদ্যুতালােক হইল, তিনি আবার যেন তাহার মধ্যে সেই মূর্ত্তি দেখিতে পাইলেন। সুশীলা বলিয়া উঠিলেন, “ঐ দেখ আমি প্রত্যক্ষ দেখছি”—বলিতে বলিতে ক্রমে তাঁহার ভয় দূর হইয়া গেল, আনন্দচিহ্ন তাঁহার মুখে বিভাসিত হইল, তিনি আপন মনে অপরিস্ফুট কণ্ঠে বলিতে লাগিলেন “এতদিন পরে আমাকে কি মনে পড়ল? আজ—আজ তুমি আমায় দেখা দিলে? আজ অন্তিম কালে—”

 সুশীলার কথায় প্রমোদ ভীত হইয়া বলিলেন “মা কি বলছেন?”

 সুশীলার চমক ভাঙ্গিল, দেখিলেন, কোথায় সে মূর্ত্তি, বিকারের অসম্বন্ধ প্রলাপে শূন্যে চাহিয়া বকিতেছেন মাত্র। সুশীলা বলিলেন—

 “একি, আমি কি স্বপ্ন দেখছি?” কে জানে এ কেমনতর স্বপ্ন! প্রমোদ একটি কথা তোকে বলবার জন্য ছট্ ফট্ করছি।

 প্র। কি বলুন।

 সু। আমি তো মরতে বসেছি, কনককে দেখিস, ওর স্বভাব আজ কাল বড় বিগড়ে গেছে।

 কনক কিরূপ গুরুতর দোষ করিয়াছে, তাহা খুলিয়া বলিয়া সুশীলা দীর্ঘ নিশ্বাস সহকারে মনের কষ্টে বলিয়া উঠিলেন, “প্রমোদ, কনকের স্বভাব ভাল করতে চেষ্টার যেন ত্রুটি না হয়।”

 সমস্ত শুনিয়া প্রমোদের হৃদয় আকুল হইয়া উঠিল, অনুতাপ ও কৃতজ্ঞতায় তাঁহার হৃদয় পূর্ণ হইল। প্রমোদ দেখিলেন কনক তাঁহার জন্য অনেক কষ্ট অবিচলিতভাবে সহ্য করিতেছে, প্রমোদ তখন সজল নেত্রে মুক্তকণ্ঠে আপনার দোয সুশীলার নিকট ব্যক্ত করিলেন। প্রমোদই সুশীলার যত্নের বই গুলি ছড়াইয়াছিলেন, প্রমোদের জন্যই কনকের টাকার দরকার হইয়াছিল, প্রমোদই সে কথা বিশেষ রূপে গোপন রাখিতে অনুরোধ করায় বালিকা সে কথা কাহাকেও বলে নাই, প্রমোদ এই সকল কথা খুলিয়া বলিলেন। তখন কনককে নির্দ্দোষী জানিয়া সুশীলার আহ্লাদের পরিসীমা রহিল না, তাঁহার বক্ষ হইতে যেন একটা গুরুভার নামিয়া গেল।