ত্রিপুরার স্মৃতি/ময়নামতী ও তৎসমীপবর্ত্তী প্রাচীন জনপদ
ময়নামতী ও তৎসমীপবর্ত্তী প্রাচীন জনপদ
পালবংশ সম্ভূত নৃপতিগণ ব্যতীত ত্রিপুরার দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তবর্ত্তী প্রদেশ যে একদা খড়্গবংশীয় মহীগণের শাসনাধীন ছিল এবংবিধ নিদর্শন প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। কথিত আছে—তদনন্তর চন্দ্রদ্বীপের অধিপতি চন্দ্ররাজগণ “মিহিরকুল” বা ত্রিপুর জিলার অন্তর্গত বর্ত্তমান “মেহেরকুল” পরগণায় রাজধানী স্থাপন পূর্ব্বক এতদঞ্চলে রাজত্ব করিয়াছিলেন।
মেহেরকুল পরগণার অন্তর্ভূত কুমিল্লা নগরীর পশ্চিম দিকে ৬ মাইল দূরে অবস্থিত “লালমাই” পর্ব্বতমালার যে অংশ অধুনা “ময়নামতী” নামে খ্যাত, তাহা উল্লিখিত বংশসম্ভূত রাজা মাণিকচন্দ্রের রাজ্ঞী “ময়নামতী“র নামানুসারে প্রসিদ্ধ এইরূপ কিংবদন্তী এতৎ প্রদেশস্থ জনসাধারণ মধ্যে প্রচলিত আছে।
উক্ত ময়নামতী নামক পর্ব্বত শিখরস্থ বিস্তীর্ণ বেদী সদৃশ এক সমতল মৃন্ময় স্তূপের পৃষ্ঠদেশে ত্রিপুরেশগণের একটী সুরময় গ্রীষ্মাবাস নির্ম্মিত আছে। ইহার সান্নিধ্যে “গোপীচাঁদেব সুড়ঙ্গ” নামক একটী বিব বা ভূনিম্নগামী বর্ত্ম ছিল ভলিয়া জ্ঞাত হওয়া যায়। লোকে কহে—মনুষ্য কিংবা অপর কোন প্রাণ দৈববশতঃ তদ্গর্ভে পতিত হইলে তাহাদের জীবননাশ হইতে পারে এই আশঙ্কায় শেষে উক্ত বিবর-মুখ ইষ্টক দ্বারা অবরুদ্ধ করা হুইযাছিল।
উক্ত বিবরের সম্বন্ধে এবংবিধ প্রবাদ প্রচলিত আছে—রাজা মাণিক-চন্দ্রের পুত্র “গোবিন্দ চন্দ্র” বা “গোপীচাঁদ” তদীয় মাতৃ আদেশানুসারে “হরিপা” নামক জনৈক সিদ্ধপুরুষের নিকট যোগশাস্ত্র অধ্যয়ন করিবার পর, ঐ বিবরের দ্বারা ভূগর্ভে প্রবিষ্ট হইয়া যোগসাধন করিয়াছিলেন এই কারণবশতঃ উহা “গোপীচাঁদের সুড়ঙ্গ” নামে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে।
পূর্বোল্লিখিত গ্রীষ্মাবাসের পূর্বদিগ্বর্ত্তী প্রাঙ্গণ খননকালে, ভূনিম্নস্থ একটী ইষ্টক নির্ম্মিত ভবনের কতিপয় দ্বার বিশিষ্ট প্রাচীরের কিয়দংশ উদ্ঘাটিত হইয়াছে। ইহাতে প্রতীয়মান হয় যে, প্রাগুক্ত মৃক্তিকাস্তূপ-গর্ভে গোবিন্দ চন্দ্র কিংবা তৎ পূর্ব্ববর্ত্তী প্রাচীনকালের অপর কোন ব্যক্তি কর্ত্তৃক নির্ম্মিত একটী নিকেতন নিহিত রহিয়াছে। সম্ভবতঃ উহা বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বী কোন চন্দ্ররাজ কর্ত্তৃক নির্ম্মিত বৌদ্ধ বিহারও হইতে পারে, গোবিন্দ চন্দ্র বা গোপীচাঁদ আগমন পূর্ব্বক তাহাতে যোগসাধন করিতেন।
স্তূপটী খনন করিলে তন্মধ্য হইতে পুরাকালের নির্ম্মিত নিকেতন এবং কৌতুহলপ্রদ প্রাচীন দ্রব্যাদি যে আবিষ্কৃত হইতে পারে এই বিষয়ের কোন সন্দেহ নাই। এমন কি—উৎকীর্ণ লিপিবিশিষ্ট প্রস্তরফলক, তাম্রশাসন কিংবা তৎকাল প্রচলিত মুদ্রাদিও প্রাপ্ত হওয়া বিচিত্র নহে—যদ্দ্বারা এতৎপ্রদেশের অন্ধকারময় ইতিহাস জনসমাজে প্রকাশিত হওয়া অতি সম্ভব।
এই স্থান নিবাসী অধিকাংশ লোকই যুগী জাতীয়। জ্ঞাত হওয়া যায় যে, তাহারা বহুকাল অবধি এই স্থানে বাস করিতেছে। ঐ সমস্ত যুগী—বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বী চন্দ্ররাজগণের এতৎপ্রদেশ শাসন কালের নিবাসী হইতে পারে। যুগীরা পূর্ব্বে বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বী ছিল—পরিশেষে ক্রমশঃ তাহারা হিন্দুধর্ম্মে দীক্ষিত হইয়াছে বলিয়া অনুমিত হয়।
যুগীদের মধ্যে হল স্পর্শ করা নিষিদ্ধ বিধায় তাঁহারা ভূমিকৰ্ষণ করে না। বস্ত্র বয়নই তাহাদিগের জীবিকা-নির্ব্বাহের প্রধান উপায়। তজ্জন্য ইহাই তাহাদিগের জাতীয় ব্যবসায়ে পরিণত হইয়াছে।
ময়নামতী নিবাসী যুগীরা নানাবর্ণের যে সমুদয় সুরম্য বস্ত্র বয়ন করে, তৎসমুদয় পূর্ব্ববঙ্গে সর্ব্বত্র প্রসিদ্ধ। এই স্থানে ও কুমিল্লার হাটে উল্লিখিত বস্ত্রনিচয় সচরাচর বহুল পরিমাণে বিক্রয় হইয়া থাকে।
নিশ্চিন্তপুর
ময়নামতীর সন্নিকটস্থ “নিশ্চিন্তপুর” নামক গ্রামের মধ্যবর্ত্তী “লালমাই” পর্ব্বতের ক্রমনিম্ন গাত্রে কতিপয় ইষ্টক-স্তূপ দৃষ্টিগোচর হয়। তৎসমুদয়ের সম্বন্ধে জনশ্রুতি এই—প্রাগুক্ত রাজা মাণিকচন্দ্র ও তদীয় পুত্র গোবিন্দচন্দ্র বা গোপীচাঁদ এতদঞ্চলে রাজত্ব করিবার কালে এই স্থানে রাজধানী স্থাপন পূর্ব্বক যে সকল অট্টালিকাদি নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন, উক্ত ইষ্টক-স্তূপ-রাশি তাহারই বিধ্বস্ত অংশ। পূর্ব্বে এই স্থানে ভগ্ন প্রাচীরদি বর্ত্তমান ছিল বলিয়া জ্ঞাত হওয়া যায়। অধুনা তৎসমুদয় আর নাই। ইষ্টক গ্রহণ ও গুপ্ত-ধন অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে পুরাকালে নির্ম্মিত ভবনাদির ভগ্নাবশেষ পল্লিনিবাসিগণ কিংবা অপরাপর লোকে সচরাচর যে প্রকার সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করিয়া থাকে, অত্রস্থ ভগ্ন প্রাচীরাদিও তদুদ্দেশ্যে বিধ্বস্ত হইয়া থাকিবে। দুঃখের বিষয়—সামান্য লোভের বশবর্ত্তী হইয়া লোকে এবম্প্রকারের প্রাচীন কীর্ত্তিমালা বিলুপ্ত করে। উক্ত ইষ্টক-রাশির উর্দ্ধভাগে নিগমানন্দ স্বামীর আশ্রম নির্ম্মিত হইয়াছে।
এই স্থান হইতে একটী প্রস্তর নির্ম্মিত মূর্ত্তির অধোভাগ উদ্ধৃত হইয়াছে। তন্নিম্নে গরুড়-মূর্ত্তি পর্য্যবেক্ষণ করিয়া ইহা নারায়ণের প্রতিমূর্ত্তি বলিয়া অনুমিত হয়।
বেরল্ল
ময়নামতীর উত্তর পশ্চিম কোণে তিন মেইল দূরে অবস্থিত “বেরল্ল” নামক গ্রামটী “বেরুদেব” নামে খ্যাত রাজপুত্রেব জন্মস্থান—এবং সেই কারণবশতঃ উক্ত জনপদ “বেরল্ল” আখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছে বলিয়া কিংবদন্তী আছে। জ্ঞাত হওয়া যায় যে, তিনি “কুসুমদেব” নামক এতদঞ্চলেব জনৈক অধিপতিব তনয় ছিলেন।
উক্ত কুসুমদেব ও তদীয় পুত্র বেরুদেব ব্যতীত তাঁহাদিগের পূর্ব্ববর্ত্তী কিংবা পরবর্ত্তী তদ্বংশীয় আর কেহ এতদঞ্চলে রাজত্ব করিয়াছিলেন কিনা—তাহারা, কোন কুলোদ্ভব—এবং কোন্ সময়েই বা রাজত্ব কবিযাছিলেন—এই সমস্ত বিষয়ে কোন কথাই অবগত হওয়া যায় না।
কোন কোন ব্যক্তি কর্ত্তৃক এইরূপ কথিত হয় যে, ‘মিহির কুল” বা বর্ত্তমান “মেহের কুল” পরগণা চন্দ্ররাজগনের আয়ত্তে থাকিবার সময় “বেরল্ল” গ্রামটীই করুমন্তপুব নামক এতৎপ্রদেশের সুপ্রসিদ্ধ রাজধানী ছিল। প্রকৃতপক্ষে ইহাই করুমন্তপুর অথবা ইতঃপূর্ব্বে বর্ণিত “ববকামতা”-ই করুমন্তপুব এবং চন্দ্র রাজগণ এতৎ প্রদেশে রাজত্ব করিবার সময়ে করুমন্তপুব সংস্থাপিত—কি পালবংশীয় মহীপগণের সমতট দেশ শাসন কালে করুমন্তপুব প্রতিষ্ঠিত হইযাছিল—এই বিষয়েরই বা কি প্রমাণ আছে—স্বভাবতঃ এবম্প্রকার প্রশ্ন মনে উদিত হয়। যাহাহউক, পূর্ব্বকালেব নানা সময়ে নানাকুলোদ্ভব যে সমুদয় নৃপাল এতৎপ্রদেশে রাজত্ব করিয়াছিলেন বলিয়া কিংবদনটি আছে, তৎসমুদয় মহীপগণের নাম ব্যতীত আর কোনরূপ যথাযথ ইতিবৃত্ত প্রাপ্ত হওযা যায না।
বর্ণিত বেরল্ল নামক গ্রাম হইতে নটেশ্বব মহাদেব, গণেশ, জগদ্ধাত্রী কাল ভৈরব, বুদ্ধ ও জম্ভল প্রভৃতির প্রস্তর নির্ম্মিত প্রতিমূর্ত্তি উদ্ধৃত হইয়াছিল বলিয়া লোক মুখে অবগত হওয়া যায়। ইহাতে এইরূপ অনুমিত হয়—এতদঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম্মের অবসান সময়াবধি হিন্দুধর্ম্মেব পুনরুত্থান কাল পর্য্যন্ত ঐ সকল প্রস্তরমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত হইষাছিল, এবং একদা এই স্থান একটী সমৃদ্ধিশালী জনপদ কিংবা কোন রাজা বিশেষের রাজধানীও থাকিতে পাবে। কালচক্রে অধুনা ইহ সামান্য একটা পল্লীগ্রামে পরিণত হইয়াছে।