ধূলিরাশি/নিরাশাদেবী
নিরাশা দেবী।
একদিন যবে আমি কল্পনার সনে,
বসিয়াছিলাম এক পর্ব্বত উপরে।
প্রকৃতির শোভা হেরে বিমুগ্ধ নয়নে,
আনমনে বসেছিনু ভুলি জগতেরে॥
একে একে কত তারা ফুটিল গগণে,
রজত কুসুম সম শোভিয়া আকাশ।
ছড়ায়ে কৌমুদীরাশি তারা সখী সনে,
ধীরে ধীরে পূর্ণশশী হইল প্রকাশ॥
সহসা সে রজনীর স্তব্ধতা ভেদিয়া,
মধুর বীণার ধ্বনি পশিল শ্রবণে।
মাঝে মাঝে ধীরে ধীরে যাইছে মিশিয়া,
আবার মধুর স্বর উঠিছে বিমানে॥
চকিত অন্তরে শুনি, উঠিনু তখনি,
নামিলাম ত্বরা করি ত্যজিয়া ভূধর।
নাহি জনরব, ঘোর গভীর রজনী,
অদূরে পর্ব্বত হ’তে ঝরিছে নিঝর॥
ছুটিলাম আমি সেই নির্ঝরের তীরে,
হেরিলাম যাহা, আঁখি না পারে বর্ণিতে।
দাঁড়ায়ে রহিনু রাখি, স্তম্ভিত অন্তরে,
কম্পিত, শীতল হাত কল্পনার হাতে॥
চৌদিকে ফুটিয়া আছে বনপুষ্পচয়,
সম্মুখ প্রদেশে বহে স্বচ্ছ নির্ঝরিণী।
মনোহর দেবীমূর্ত্তি নিশীথ সময়,
বাজায় মধুররে মোহিয়া ধরণী।
এলা’য়ে পড়েছে ঘন অসিত কুন্তল,
অলস ভাবেতে বসি’ বীণা ল’য়ে করে।
বহিতেছে অশ্রুধারা বহিয়া কপোল,
বিধাদের মূর্ত্তি যেন গঠিত প্রস্তরে॥
মলিন-বসনা দেবী, রুক্ষ কৈশ-রাশি,
নয়নের কোলে, আহা! কালিমা পড়েছে।
সরল মু’খানি যেন আকাশের শশী,
বিষাদের কাল মেঘে মলিন করেছে॥
নাহিক যখন তার নিজ দেহপ্রতি,
নাহি কোন(ও) অহঙ্কার, রূপের গৌরব।
বাজাইছে ধীরে ধীরে সুমধুর অতি,
অবাক হইয়া শুনে বৃক্ষ গিরি সব॥
অসিত চিকুর’পরে পড়েছে শিশির,
আঁধার গগণে যেন তারকানিচয়।
কমল-কানন-খানি ভাসে অশ্রুনীরে,
একাকী রয়েছে বসি’ নাহি কোন(ও) ভয়।
চাহিনু তখন আমি কল্পনার পানে,
কহিলাম, “কহ সখি, কে এই রমণী।
কেন বা কঁদিছে হেথা বসিয়া নির্জ্জনে,
বাজাইছে ধীর স্বরে মোছিয়া ধরণী।”
কহিল কল্পনা সখী মৃদুহাস্য করি,
“যাও তাঁর কাছে তুমি, না করিও ভয়।
জিজ্ঞাসা করিও তাঁরে অনুরোধ করি,
কহ, দেবি, কে তুমি এ নিশীথ সময়॥”
চলিলাম ধীরে ধীরে দেবী-সন্নিধানে,
কহিলাম, “কে তুমি গো, অনুরোধ করি।
কহ মোর কেন হেথা এ বিজন বনে,
যাপিছ গভীর নিশা অশ্রুপাত করি॥”
সহসা চমকি দেবী ফিরি মোর প্রতি,
কহিলেন ধীরে ধীরে স্নেহের বচনে।
“অবোধ মানব তুমি নহে স্থিরমতি,
বুঝিবে কি লাগি আমি আছি এ বিজনে?”
“একান্ত বাসনা যদি শুনিতে কাহিনী,
শুন মন দিয়া আমি কহি বিস্তারিয়া।”
কোকিল-কাকলী জিনি কামিনীর বাণী,
পশিল শ্রবণে মম মানস মোহিয়া॥
“এই যে কুসুমচয়,
“করি বন আললাময়,
“ফুটিয়া রয়েছে হের শির নত করি।
“ইহারাই সখী মম,
“ভালবাসি প্রাণ সম,
“ইহাদেরি কাছে আসি প্রতি বিভাবরী॥”
“জান না যে নাম মোর,
“জানে সর্ব্ব চরাচর?
“নিরাশা আমার নাম শুনরে মানব।
“সর্ব্ব গৃহে বাস করি,
“নিশীথে এ বনে ফিরি,
“নিদ্রার কোলেতে যবে অচেতন ভব॥”
“নিদ্রা যবে আসে ধরি,
“তিলেক তিষ্ঠিতে নারি
“পলাইয়া আসি এই তটিনীর তীরে।
“নিরীহ মানবদলে,
“অলীক স্বপনে ভুলে,
“কাটায় খেতে নিশা জুলি নিরাশারে॥”
এত বলি চাহি দেবী,
ক্ষণেক নীরবে ভাবি,
চাহিলেন স্থির নেত্রে কল্পনার পানে।
“যাও যাও ত্বরা করি,
“পোহাইল বিভাবরী,
কহিলেন আরবার “যাও তার সনে॥”
বিনয়-বচনে পুনঃ,
কহিলাম, “দেবি, শুন
“বাজাও বারেক তব মধুর বাজনা।”
হাসিয়া মধুর হাসি,
আলো করি’ দশদিশি,
বাজাইল ঝংকারিয়া সুমধুর বীণা॥
থামিল বীণার স্বর,
বনদেবী তুলিকর,
আশিস্ করিল মোরে ধীরেতে কি বলি।
আর কিছু নাহি মনে,
ঘুমায়ে পড়িনু বনে,
সকল পার্থিব দৃশ্য নিরাশারে ভুলি॥
সহসা যখন আমি খুলিনু নয়ন,
জানিলাম বসে আছি মাথা রাখি’ করে।
পড়েছে মন্তকোপরে অরুণ কিরণ,
একাকী বসিয়া আছি নিরজন ঘরে॥